মুক্তিযুদ্ধে দেশের ভেতরের বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে দেশের ভেতরের বাহিনী

আহমাদ ইশতিয়াক

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছিলো এক বা একাধিক আঞ্চলিক বাহিনী। গবেষকদের মতে এদের সংখ্যা প্রায় ৩০টি। ভারতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের  নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত ও বিভিন্ন সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি দেশের ভেতরে আঞ্চলিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিটি যুদ্ধে অংশ নিয়ে প্রদর্শন করেছিলেন অসাধারণ সাহস ও বীরত্ব। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা যথাযথ স্বীকৃতি পান নি। এদের মধ্যে ১০টি আঞ্চলিক বাহিনীর ওপর বছরজুড়ে অনুসন্ধান করা হয় এবং তা ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ডেইলি স্টার পত্রিকায় ১০ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখানে একসঙ্গে এগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশিত হলো। অন্যান্য আঞ্চলিক বাহিনী নিয়েও আমরা লেখা প্রকাশ করতে চাই।    

আত্রাই পাড়ের ওহিদুর বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে রাজশাহীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিলো এক দুর্ধর্ষ  প্রতিরোধ বাহিনী। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক নেতা ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে উঠা বাহিনীটি পরবর্তীতে ‘ওহিদুর বাহিনী’ নামে পরিচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে প্রাথমিকভাবে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হলেও একপর্যায়ে ওহিদুর বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজারেরও অধিক। মুক্তিযুদ্ধে ওহিদুর বাহিনীর বীরত্বগাঁথা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে পৃথক দুটি গ্রন্থ।  ওহিদুর রহমানের লেখা ‘মুক্তি সংগ্রামে আত্রাই’ গ্রন্থে এই বাহিনী সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। অন্য গ্রন্থটি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মিজানুর রহমান মিজান।

ওহিদুর বাহিনীর বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদনের কাজে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরজমিনে নওগাঁ, রাজশাহী ও নাটোরের একাধিক উপজেলায় যান এই প্রতিবেদক। এসময় ওহিদুর রহমান সহ বাহিনীর পঞ্চাশ জনেরও বেশী মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয়। জানা যায়  বর্তমানে নওগাঁ জেলার সদর থেকে রাণীনগর, আত্রাই হয়ে পূর্বে নাটোরের সদর, নলডাঙ্গা, সিঙড়া ও বগুড়ার নন্দীগ্রাম পর্যন্ত এবং পশ্চিমে রাজশাহীর বাগমারা, পুঠিয়া উপজেলা পর্যন্ত ৪টি জেলার ১৪টি থানা জুড়ে ছিল ওহিদুর বাহিনীর বিস্তৃতি।

যেহেতু ওহিদুর রহমান পূর্বে কৃষক আন্দোলন ও কৃষক সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাই তাঁর অনেক কর্মী-সমর্থক ছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ নওগাঁয় এসে পৌঁছালে ২৬ মার্চ নওগাঁর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।  এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে গঠিত হয় আত্রাই থানা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ।

প্রথমেই শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজ।  ১০ এপ্রিল আত্রাইয়ের তেঁতুলিয়া গ্রামের গান্ধী আশ্রমে অনুষ্ঠিত কর্মীসভায় অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে আত্রাই থানা দখলের সিদ্ধান্ত হয়। প্রাথমিকভাবে ওহিদুর বাহিনীতে কৃষক ও নেতাকর্মীরা যোগ দিলেও একপর্যায়ে  ছুটিতে থাকা ও পালিয়ে আসা বাঙালি সেনা, পুলিশ, ইপিআর সদস্য সহ  ছাত্র-যুবক-শ্রমিক সহ সর্বস্তরের মানুষ ওহিদুর বাহিনীতে যোগ দেন। ফলে বাহিনীর বিস্তৃতিও ছড়িয়ে পড়ে বিশাল অঞ্চল জুড়ে।

ওহিদুর বাহিনীর বিস্তৃত এই যুদ্ধাঞ্চল জুড়ে প্রবাহিত হয়েছে আত্রাই, ছোট যমুনা, ফক্কিনী, খাজুরা ও নাগর সহ ৬টি নদী ও চলন বিল সহ ১৩টি বিল।  নদীমাতৃক হওয়ায় ওহিদুর বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হতো জলপথে। বাহিনীতে ৫২টি বড় পানসি নৌকা ছিল, লোকে বলতো ‘ওহিদুরের বায়ান্ন ডিঙ্গি’। এছাড়া বাহিনীর অস্ত্রাগার, চিকিৎসা, রসদ সরবরাহ এবং গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য ছিল পৃথক নৌকার ব্যবস্থা। 

স্থায়ী কোন হেডকোয়ার্টার ছিলোনা, কয়েকটি অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার ছিল। বিল হালতির মধ্যে থাকা খোলাবাড়িয়া গ্রাম ছিল তেমনই  একটি ঘাঁটি। এছাড়া ঝিকরা, মিরাট, হাঁসাইগাড়িতেও অস্থায়ী ঘাঁটি ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ৫০টিরও বেশী সফল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। একের পর এক সফল অপারেশনে ওহিদুর বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ফুরিয়ে এসেছিলো। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য একের পর এক থানা আক্রমণ চালানো শুরু করেন ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে  রাজশাহীর বাগমারা থানা দখল ছিল ওহিদুর বাহিনীর তেমনই একটি অপারেশন।  বাগমারা থানার মতো আত্রাই থানাতেও দ্বিতীয় দফায় আক্রমণ চালিয়েছিলেন ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ৯ ডিসেম্বর নওগাঁর রানীনগর থানায় আক্রমণ করে  ৪০ জন রাজাকারকে আত্মসমর্পণ করিয়ে ৫০টিও বেশী রাইফেল নিজেদের দখলে নেন ওহিদুর বাহিনী। এছাড়া নওগাঁ, রাজশাহী ও নাটোরের বিভিন্ন  রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর অস্ত্র ও  গোলাবারুদ উদ্ধার করেছিলেন তাঁরা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অপারেশনগুলো ছিল বেগুনবাড়ি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, বাঁইগাছা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, সোনাডাঙ্গা রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, মৈনম রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, তাহেরপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, সড়ককুতিয়া রাজাকার ক্যাম্প প্রভৃতি।

ওহিদুর বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল ৬ সেপ্টেম্বর আত্রাইয়ের সাহাগোলা ব্রিজ ধ্বংস। এই যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এছাড়া ছিল তারানগর-বাউল্লার যুদ্ধ, বামনীগ্রামে অ্যামবুশ,  বার্নিতলার যুদ্ধ, তাহেরপুর- ভবানীগঞ্জ ও ব্রহ্মপুর হাটে অপারেশন,  নলদিঘির যুদ্ধ, নলডাঙ্গা ব্রিজ অপারেশন, ভবানীগঞ্জের খন্ড যুদ্ধ প্রভৃতি। ১৯ সেপ্টেম্বর আত্রাইয়ের বান্দাইখাড়া গ্রামে গণহত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণ শেষে ফেরার পথে তারানগর বাউল্লায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি নৌকার বহরে অতর্কিত আক্রমণ চালায় ওহিদুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময়  গুলিবিদ্ধ ও নদীতে ডুবে ১৫০ জনেরও বেশী পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

১৪ ডিসেম্বর ভোরে ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে বাহিনীর ৭০০-৮০০ মুক্তিযোদ্ধা আত্রাই থানা দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন ওহিদুর রহমান।                    

ভৈরব তীরের রফিক বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাট শহরের ভৈরব-দড়টানা নদীর অপর পাড়ে চিরুলিয়ার বিষ্ণুপুরে গড়ে উঠেছিলো আঞ্চলিক গেরিলা বাহিনী। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাবেক নেতা রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির অনুসারীদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনীটি পরবর্তীতে পরিচিতি পেয়েছিল ‘রফিক বাহিনী’ নামে।  

শাহাদত হোসেন বাচ্চুর  ‘চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের মুক্তিযুদ্ধ’ লেখায় পাওয়া যায়  এই বাহিনীর সৃষ্টি ও বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধদিনের বীরত্ব। এছাড়া  স্বরোচিষ সরকার রচিত ‘একাত্তরের বাগেরহাট মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস’ গ্রন্থে রয়েছে এই বাহিনীর বেশ কয়েকটি যুদ্ধের বর্ণনা। রফিক বাহিনীর উপর বিস্তারিত প্রতিবেদনটি তৈরির কাজে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরেজমিনে বাগেরহাটের সদর, চিতলমারী, ফকিরহাট উপজেলা ও খুলনার রূপসা উপজেলা সফর করেন এই প্রতিবেদক। এসময়ে রফিক বাহিনীর অন্তত ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। 

একাত্তরের ৯ মার্চ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ‘বাগেরহাট  মহকুমা সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। এ কমিটির তত্ত্বাবধানে মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সমান্তরালে এপ্রিলের শেষের দিকে  ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ভাসানী গ্রুপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের অনুসারীদের উদ্যোগেও  একটি ক্যাম্প গড়ে ওঠে। এই ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন বাগেরহাটের ভাসানী ন্যাপের শেখ আজমল আলী গোরাই, পরিচালনায় ছিলেন রফিকুল ইসলাম খোকন। 

২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যার সংবাদ পাওয়ার পর বাগেরহাট শহর ছেড়ে দলটির সব সদস্যই বিষ্ণুপুরে অবস্থান নেন।  প্রাথমিক পর্যায়ে মাত্র ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে গঠিত হলেও একপর্যায়ে রফিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৫০০’র  বেশী। প্রাথমিকভাবে অস্ত্র জোগাড়ের পর বিভিন্ন থানা আক্রমণ, রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণের মাধ্যমে অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধেও বেশ কিছু অস্ত্র আসে।    

রফিক বাহিনীর সদর দপ্তর বিষ্ণুপুরের খালিশপুর গ্রামে। এছাড়া সন্তোষপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চিতলমারী ইউনিয়নের সুড়িগাতী গ্রামে রফিক বাহিনীর আরও দুটি ঘাঁটি ছিল। রফিক বাহিনীর একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাগেরহাটের ১৫০ কিলোমিটার এলাকা শত্রুমুক্ত রাখতে পেরেছিলেন রফিক বাহিনীর সদস্যরা। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে ২৫টিরও বেশী সফল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার হতাহত হয়েছিলো।

২৪ জুলাই রূপসা থেকে বাগেরহাটগামী  রাজাকারদের বহনকারী একটি বিশেষ ট্রেনে আক্রমণ চালিয়েছিলেন রফিক বাহিনী। এই অপারেশনে পঞ্চাশেরও অধিক রাজাকার হতাহত হয়। অপারেশনের শেষে রফিক বাহিনী প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিজেদের দখলে নেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে রফিক বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল মাধবকাঠির যুদ্ধ। ১ আগস্ট পাকিস্তানি সেনারা বিষ্ণুপুর গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার দুই সহোদরকে হত্যা করে সমস্ত গ্রামে অগ্নিসংযোগ করে। রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘৬ তারিখে মিলিটারি ও রাজাকারেরা মাধবকাঠি মাদ্রাসায় অবস্থান নিলে পরদিন রাত ১২টায় আমরা দেড়শো মুক্তিযোদ্ধা মাদ্রাসার চারপাশ ঘেরাও করে আক্রমণ শুরু করি।  ৮ তারিখ দুপুর পর্যন্ত ওদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলে। একপর্যায়ে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটে লঞ্চে করে নদী দিয়ে পালিয়ে যায়।’  এই যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সেনা ও ১৬ জন রাজাকার নিহত হয়।

২৪ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মানস ঘোষের কাছ থেকে অস্ত্রের প্রস্তাব পেয়ে ভারত সীমান্তের দিকে রওয়ানা হন রফিকুল ইসলাম। যদিও পথিমধ্যে পাকিস্তানিদের আক্রমণের মুখে পড়ে আহত হন তিনি। ঐদিনই দেবী বাজারের কাছে রফিক বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতে চিরুলিয়া বিষ্ণুপুরের ক্যাম্পগুলো ধ্বংসের লক্ষ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে ৯ সেপ্টেম্বর যাত্রাপুর ইউনিয়নের পানিঘাট এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী। যা রফিক বাহিনীর কাছে ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। রফিক বাহিনীর সদস্য আবদুল মজিদ শেখ বলেন, ‘আমরা প্রতি বাঙ্কারে দুজন করে ছিলাম। মিলিটারি যখন লঞ্চ নিয়ে গুলি করতে করতে আমাদের সামনে এগোতে লাগলো তখন আমরা গুলি শুরু করলে লঞ্চের সারেং মারা যায়। তলা ফুটো হয়ে লঞ্চ চারদিকে ঘুরতে লাগলো। গুলিতে মিলিটারির পাশাপাশি বহু রাজাকারও মারা যায়।’  এমতাবস্থায় সড়কপথে পাকিস্তানি সেনারা অগ্রসর হলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয়। কারফিউ জারি করে ১৬ জন পাকিস্তানি সেনার লাশ উদ্ধার করে পাকিস্তানি বাহিনী। ১৩ সেপ্টেম্বর দোপাড়া ব্রিজের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আরেকটি দুর্ধর্ষ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন রফিক বাহিনী। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থায়ী এই যুদ্ধে ৩ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়। অন্যদিকে রফিক বাহিনীর বিজয় পাল শহীদ হন।

৩০ অক্টোবর বাগেরহাট সদরের গোটাপাড়া ইউনিয়নের বাবুরহাট বাজারে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে রফিক বাহিনীর যুদ্ধে এক ক্যাপ্টেন সহ চারজন পাকিস্তানি সেনা ও তিনজন রাজাকার নিহত হয়। ৯ নভেম্বর বাবুরহাটের আরেকটি যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫ সেনা ও বহু রাজাকার নিহত হয়।

শ্রীপুর বাহিনী বা আকবর বাহিনী

মাগুরার শ্রীপুরের একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকবর হোসেন মিয়ার নেতৃত্বে মাগুরার শ্রীপুরে গড়ে উঠেছিলো একটি আঞ্চলিক বাহিনী।  কাগজে কলমে বাহিনীটি ‘শ্রীপুর বাহিনী’ হিসেবে পরিচিতি পেলেও লোকমুখে তা আকবর বাহিনী হিসেবেই পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে মাত্র ছয়টি রাইফেল নিয়ে শুরু করা শ্রীপুর  বাহিনীতে একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছিলো ৮০০’রও বেশী। এই বাহিনীর কার্যক্রম ও বীরত্বগাঁথা নিয়ে আকবর হোসেন ‘মুক্তিযুদ্ধে আমি ও আমার বাহিনী’ নামে  একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। সেই গ্রন্থ সূত্রে জানা যায়,  ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন আকবর হোসেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে মাত্র ৩ বছর পরেই ১৯৫৪ সালে  চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি। ১৯৬৫ সালে  শ্রীপুরের শ্রীকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। 

মার্চের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে  নিজের অনুসারী ও স্থানীয় ছাত্র জনতাকে সংগঠিত করতে শুরু করেন আকবর হোসেন।  ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা শুরুর পর মাগুরায় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়, এর অন্যতম সদস্য ছিলেন আকবর হোসেন। মাগুরার নোমানী ময়দানের পার্শ্ববর্তী আনসার ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের ক্যাম্প খোলা হয়। ক্যাম্পে আগত ছাত্র- তরুণদের বেশীরভাগই ছিল শ্রীপুর কলেজের শিক্ষার্থী।

 ২৮ মার্চ আকবর হোসেনের নেতৃত্বে শ্রীপুরেও সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।  এপ্রিলের শেষের দিকে পাকিস্তানী বাহিনীর মাগুরায় আগমনের আগমুহূর্তে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মাগুরা আনসার ক্যাম্প থেকে ৬টি রাইফেল,  ওয়্যারলেস ও বেশ কিছু গোলাবারুদ নিয়ে শ্রীপুরে চলে আসেন।  এসময়ে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে শ্রীপুর বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের দুই ধরনের শত্রুর মুখোমুখি হতে হয়েছিলো। পাকিস্তানি বাহিনী ছাড়াও ছিল স্থানীয় ডাকাত ও পাকিস্তানপন্থী বিহারীরা। মুক্তিযুদ্ধের আগে  মাগুরা ও ফরিদপুর অঞ্চলে ডাকাত দলের তৎপরতা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার সুযোগে ডাকাতেরা  লুটপাট, হত্যা, এমনকি ধর্ষণের মতো কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

এমতাবস্থায় আকবর হোসেন সহ বাহিনীর নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ডাকাত নিধনের জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে শ্রীপুর  বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০ জনে। এসময় বাহিনীর অস্ত্র বলতে ছিল ২৪টি রাইফেল ও হাজারখানেক গুলি।

শ্রীপুর বাহিনীর সম্মিলিত প্রথম অপারেশন ছিল ৫ জুন, রাজবাড়ীর রামদিয়ায় একদল মুক্তিযোদ্ধা ডাকাত সর্দার  চাঁদ খাঁর বাড়িতে অভিযান চালান। চাঁদ খাঁর জমা করা সমস্ত লুটের সামগ্রী সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। চাঁদ খাঁ ও একের পর এক ডাকাত নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে  আশেপাশের অঞ্চলগুলোতেও শ্রীপুর বাহিনীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এসময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা, ইপিআর, আনসার সদস্য সহ বহু ছাত্র, যুবক, তরুণ  শ্রীপুর বাহিনীতে যোগ দেয়।  মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয়  টুপিপাড়া গ্রামে খোলা হয়  প্রশিক্ষণ ক্যাম্প।

 থানার নামে বাহিনীর নামকরণ করা হলেও এই বাহিনীর অবস্থান কেবল শ্রীপুর বা মাগুরার থানাগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলোনা। পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহের শৈলকুপা, হরিণাকুণ্ডু, রাজবাড়ির পাংশা, বালিয়াকান্দি,   ফরিদপুরের মধুখালী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল শ্রীপুর বাহিনীর অবস্থান। শ্রীপুর বাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযান ছিল  ঝিনাইদহের শৈলকুপা থানা দখল।  ৯ আগস্ট দিবাগত রাতে আকবর হোসেনের নেতৃত্বে  মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বড় দল শৈলকুপা থানায় আক্রমণ চালায়। এসময় থানায় থাকা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ও  পুলিশ রাজাকার সহ অন্তত ৩০ জন আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা থানা থেকে ৫৭টি রাইফেল ও ৪ হাজার গুলি উদ্ধার করেন।  শৈলকূপা থানা দখলের মাধ্যমে শৈলকূপার অনেকটা অংশ মুক্ত হয়ে যায়। একইসঙ্গে থানায় শ্রীপুর বাহিনীর অবস্থান সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। শৈলকুপা থানা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ৩০টিরও বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে ছিল- আলফাপুরের যুদ্ধ,  নাকোলের যুদ্ধ, কাজলীর যুদ্ধ, চারবার শ্রীপুর থানা অপারেশন, বালিয়াকান্দি থানা আক্রমণ,  ইছাখাদা ও বিনোদপুর রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ, মাগুরা আনসার ক্যাম্প আক্রমণ প্রভৃতি। 

২১ আগস্ট শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা থানা দখল করে ৩৪টি রাইফেল, দেড় হাজার গুলি উদ্ধার করেন এবং একইসঙ্গে পুলিশের সাবেক এসআই আকরাম হোসেন নামের এক মুক্তিযোদ্ধাকে থানার ওসি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর দুদিন পরেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘শ্রীপুর থানা মুক্ত’ ঘোষণা দেয়া হয়। 

মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনী সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও সফল যুদ্ধগুলোর একটি ছিল ঝিনাইদহের শৈলকুপার আলফাপুরের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ৫৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ১০ অক্টোবর ৫০০’র বেশী পাকিস্তানি সেনা শ্রীপুর বাহিনীর টুপিপাড়া ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়।  পূর্ব সংবাদের ভিত্তিতে মুক্তিযোদ্ধারা আগেই ক্যাম্পে ছেড়ে চলে যান। পাকিস্তানি সেনারা খামারপাড়া বাজারে ঢুকে লুটপাট চালায়। নদীর অপর পার থেকে শ্রীপুর বাহিনীর কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা  পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে গুলি করলে ৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

১১ অক্টোবর দুপুরে পাকিস্তানি সেনারা কাজলি ঘাট দিয়ে নদী পার হতে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্রাশফায়ারে ৩ পাকিস্তানী সেনা নিহত হয়। এরপরের দুদিনে  লাঙ্গলবাঁধের উল্টো দিক থেকে আগত পাকিস্তানি সেনাদের অভিযানে আবাইপুর ও গয়েশপুরে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।  ১৩ অক্টোবর চতুড়িয়া গ্রামে শ্রীপুর বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ২৪ নভেম্বর একদল মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের মাগুরা থেকে শ্রীপুর গামী একটি বহরে  আক্রমণ চালায়। এসময় এক কর্নেল সহ ৮ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। 

অক্টোবর  মাসে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে  শ্রীপুর বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক বাহিনী ও আকবর হোসেনকে বাহিনী প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি সনদ প্রদান করেন ৮ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর।

টাঙ্গাইলের বাতেন বাহিনী

মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক বাহিনীর কথা বললে সর্বপ্রথম উঠে আসবে টাঙ্গাইলের ‘কাদেরিয়া বাহিনী’র কথা। এই বাহিনীর  বীরত্বের ইতিহাস প্রায় সবারই জানা। ঠিক একই সময়ে টাঙ্গাইলে গড়ে উঠেছিল আরও একটি দুর্ধর্ষ আঞ্চলিক বাহিনী। টাঙ্গাইলের সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন ভিপি খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে গঠিত সাড়ে ৩ হাজার মুক্তিযোদ্ধার বাহিনীটি পরবর্তীতে পরিচিতি পেয়েছিল ‘বাতেন বাহিনী’ নামে। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কনোড়া গ্রামকে কেন্দ্র করে বাহিনীটি প্রথমে গঠিত হলেও পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা এমনকি গাজীপুরের জেলাতেও এই বাহিনী বিস্তৃতি ছিলো।

বাতেন বাহিনীর উপর বিস্তারিত জানার জন্য এই প্রতিবেদক টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের বেশ কয়েকটি উপজেলা সফর করেন। এসময় বাতেন বাহিনীর প্রায় ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মুক্তিযুদ্ধে বাতেন বাহিনীর বীরত্বগাঁথা নিয়ে বাহিনীর বেসামরিক প্রধান মীর শামছুল আলম শাহজাদা  ‘মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ – ১৯৭১ বাতেন বাহিনী’ গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সেই গ্রন্থ সূত্রে ও  বাহিনীর একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,  ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরুর পর ২ এপ্রিল শামছুল আলম শাহজাদার নেতৃত্বে কোনড়া গ্রামে প্রাথমিকভাবে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়।  ৩ এপ্রিল নিজ গ্রাম কোনড়ায় এসে কোনড়া ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামের ছাত্র, তরুণ, যুবকদের যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে শুরু করেন  খন্দকার আবদুল বাতেন।

৩ এপ্রিল সংঘটিত সাটিয়াচরা যুদ্ধে পালিয়ে আসা দুজন ইপিআর সেনার কাছ থেকে পাওয়া ২টি রাইফেল ও ৪৫ রাউন্ড গুলিই ছিল বাতেন বাহিনীর প্রথম অস্ত্রের সম্বল।  এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আতোয়ার রহমান খন্দকার বাতেনকে আরও বেশ কয়েকটি রাইফেলের সন্ধান দিলে তারুটিয়া গ্রামের একটি ডোবা থেকে ৮টি রাইফেল উদ্ধার করেন মুক্তিযোদ্ধারা। উদ্ধারকৃত এসব অস্ত্র দিয়ে পাকাপাকিভাবে শুরু হয় বাতেন বাহিনীর সশস্ত্র প্রশিক্ষণ। 

২০ এপ্রিল সিদ্দিক হোসেনের নেতৃত্বে স্থানীয়ভাবে সংগঠিত একটি দল অস্ত্র সহ বাতেন বাহিনীতে যোগ দিলে বাহিনীর সক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে যায়।  এপ্রিলের শেষের দিকে ফজলুল হক মল্লিকের নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আরেকটি দল অস্ত্র, গোলাবারুদ সহ বাতেন বাহিনীতে যোগ দেয়।  এসময়ে দক্ষিণ টাঙ্গাইলের লাউহাটি বাজারে স্থাপন করা হয়েছিলো বাহিনীর রিক্রুটিং সেন্টারও। এ পর্যায়ে সর্বস্তরের মানুষ বাহিনীতে যোগ দেয়। একইসঙ্গে যোগ দেন পালিয়ে আসা ও ছুটিতে থাকা বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার সদস্যরাও। 

বাতেন বাহিনীতে ৪১টি কম্পানি, ১২৩টি প্লাটুন ও ৩৭০টি সেকশন ছিল। মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল  সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশী। ৫০টিরও বেশী যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসব যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও হাজারের বেশী  পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছিলো।

মুক্তিযুদ্ধে বাতেন বাহিনীর প্রথম সফল অপারেশন ছিল  মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ। থানায় বেশকিছু পাকিস্তানি সেনা, মিলিশিয়া, পুলিশ অবস্থানের খবর পেয়ে বাতেন ও বারীর নেতৃত্বে দুটি গ্রুপ থানা আক্রমণে অংশ নেয়।  ৪ মে রাতে থানা দখলের পর প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা।

সিঙ্গাইর থানা দখলের একদিন পরে ৫ মে ল্যান্স নায়েক মোখলেসুর রহমানের নেতৃত্বে বাতেন বাহিনীর আরেকটি দল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানা আক্রমণ চালিয়ে থানা দখল করে। অপারেশনের সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গোলাগুলির একপর্যায়ে কয়েকজন পুলিশ নিহত হয়। পরবর্তীতে থানা থেকে  বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করেন বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। 

১৭ মে দিবাগত রাতে মানিকগঞ্জের দৌলতপুর থানায় আক্রমণ চালান বাতেন বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা। এসময় থানায় অবস্থানকারী মিলিশিয়া ও পুলিশরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় দুইপক্ষের মধ্যে ৩ ঘণ্টা প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে অনেক লাশ ও প্রচুর গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। দৌলতপুর থানা দখলের পর ১৮ মে থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বাহিনী প্রধান খন্দকার আবদুল বাতেন। 

মে মাসের শেষের দিকে ঘিওর হাটের দিন ছাগল ও তরকারী বিক্রেতার ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধারা বিনা বাধায় ঘিওর থানা দখল করেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের মাঝে ছিল ধল্লা ব্রিজের অবস্থান। গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনী ব্রিজটিকে রক্ষার জন্য ২০ জন রাজাকার মোতায়েন করে। সেখানে অবস্থানকারী রাজাকারেরা প্রতিনিয়তই ব্রিজ দিয়ে যাতায়াতকারী সাধারণ মানুষের জিনিসপত্র লুট করে নির্যাতন করতো।  বিষয়টি জানার পর মে মাসের শেষ সপ্তাহে খন্দকার আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ব্রিজটিতে  অবস্থানকারী ২০ রাজাকারকে বেঁধে ফেলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিনিয়ে নেন। (চলবে)

 

আহমাদ ইশতিয়াক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সাংবাদিক। ইমেইল: ahmadistiak1952@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •