বিবৃতি
পাঠ্যপুস্তকে ও সংবিধানে আদিবাসীদের স্বীকৃতির দাবি এবং আদিবাসীদের ওপরে হামলা-
আক্রমণের নিন্দা ও প্রতিবাদ

‘আদিবাসী’ শব্দ ছিল বলে গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোয় সন্ত্রাসী আক্রমণ হয়েছে। আবার এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থী জনতা মিছিল করলে তাদের ওপর পুলিশী হামলা হয়েছে। এগুলোর বিরুদ্ধে গত কিছুদিন সমাজের বিভিন্ন অংশ বিবৃতি দিয়েছেন, সভা সমাবেশ করেছেন। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। এখানে এ বিষয়ে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক বিবৃতি প্রকাশিত হলো।
আমরা, দেশের সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনাবলীতে উদ্বিগ্ন নিম্নস্বাক্ষরকারী নাগরিকরা, একটি উগ্র জাতিবাদী ভুঁইফোঁড় সংগঠনের দাবির প্রেক্ষিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক থেকে “আদিবাসী” শব্দসম্বলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলা, বিক্ষোভরত আদিবাসী ছেলেমেয়ের ওপরে সংগঠনটির সন্ত্রাসীদের ন্যক্কারজনক আক্রমণ, এবং এর প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা’র শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপরে পুলিশ বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ওপর ভর করে জেঁকে বসা আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ ছিল পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের। ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন ঘটেছে কিন্তু ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার এখনো অবসান ঘটেনি। অভ্যুত্থানের পরে উগ্র জাতিবাদী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে নব উদ্যমে পাহাড়ে আগ্রাসন চালাতে দেখা যাচ্ছে। গতবছর ১৯ ও ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় সেটেলার বাঙালির আক্রমণে ও সেনাবাহিনীর গুলিতে ৪ জন আদিবাসী মর্মান্তিক হত্যার শিকার হন, আদিবাসীদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও বৌদ্ধ বিহারে অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়। গত ২৪-২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে বান্দরবানের লামা উপজেলার ত্রিপুরা পাড়ার আদিবাসীরা পাশের পাড়ায় বড়দিনের উৎসবে গেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয় পাড়ার ১৭টি ঘর। রাষ্ট্রীয় মদদে আমাদের দেশের আদিবাসীদের ওপরে তীব্র আক্রমণ-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে।
তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ঢাকায় আমরা ‘স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি’ নামে একটি ভুঁইফোঁড় উগ্র জাতিবাদী সংগঠনের আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি, যারা নবম ও দশম শ্রেণীর বাংলা ব্যাকরণ এবং রচনা পাঠ্যপুস্তকের পেছনের প্রচ্ছদ থেকে “আদিবাসী” শব্দসম্বলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার দাবি জানায়, এবং প্রায় সাথে সাথেই এনসিটিবি সেই গ্রাফিতিটি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। একইসাথে এনসিটিবি চেয়ারম্যান গণমাধ্যমে জানান, “… এছাড়া বইয়ের কোথাও আদিবাসী শব্দ নেই।” বাস্তবিকই ২০২৫ শিক্ষাবছরের পাঠ্যপুস্তকের কোথাও “আদিবাসী” শব্দ নেই, সেখানে রয়েছে “নৃ-গোষ্ঠী”, “ভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী”, “বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী” কিংবা “অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠী”, যা আগের শিক্ষাবছরে ছিল “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী”। আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ভয়ানকভাবেই আদিবাসীদের অপরায়ন ও বিমানবিকীকরণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তৃতীয় শ্রেণির শিশুদের পাঠ্য “বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়” বইয়ে রয়েছে, “আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। বাংলাদেশের মানুষ বাংলায় কথা বলে …। এছাড়াও অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষাও রয়েছে।” পাঠ্যপুস্তকের এই অপরায়ন ও বৈষম্যের মূলে রয়েছে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও ১৭ বার সংশোধিত জাতিবাদী সংবিধান, যেখানে আদিবাসীদের জাতিসত্ত্বার কোন স্বীকৃতি নেই, যেখানে আদিবাসীদের পরিচিত করা হয়েছে “উপজাতি”, “ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী, সম্প্রদায়” হিসেবে। স্টুডেন্টস ফর সভারেন্টি নামক উগ্র জাতিবাদী সংগঠনটি ফ্যাসিবাদী এই সংবিধানকেই ঢাল বানিয়েছে। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের শ্লোগান “তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি” বলেই তারা আদিবাসীদের ওপরে আক্রমণ চালিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল যে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী সমাজ গঠন, তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই চালানো হচ্ছে এই আক্রমণ। এই আক্রমণ কেবল উগ্র জাতিবাদী-ফ্যাসিবাদী সংগঠনটির এবং পতিত ও নব্য ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তির নয়, বরং প্রবলভাবে রাষ্ট্রশক্তিও এই আক্রমণে শরিক। তারই প্রমাণ মেলে ১৫ জানুয়ারিতে আদিবাসীদের ওপরে হামলার সময় পুলিশ বাহিনীর নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকায় এবং ১৬ জানুয়ারিতে এর প্রতিবাদে ‘সংক্ষুব্ধ ছাত্র জনতা’র শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপরে পুলিশ বাহিনীর বেধড়ক লাঠিচার্জ, জলকামান, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে।
আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, “উপজাতি” বা “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী”র মত অবমাননাকর শব্দ সংবিধান ও পাঠ্যপুস্তক থেকে সরানোই যথেষ্ট নয়। “আদিবাসী” শব্দটি কেবল “ভিন্ন” বা “অন্যান্য” নৃগোষ্ঠী দিয়ে প্রতিস্থাপনযোগ্য শব্দ নয়। আদিবাসী (indigenous) শব্দের অর্থ কোন জাতি কত আগে থেকে একটা দেশে বাস করছে তা নয়, বরং কোনো একটি ভৌগোলিক অঞ্চলে (যেমন পার্বত্য অঞ্চলে, কিংবা সমতলের বিভিন্ন বন-জঙ্গল, চর বা দ্বীপাঞ্চলে) যারা প্রাক-ঔপনিবেশিক আমল থেকে যুগ যুগ ধরে কেবল বাসই করছে না, সে অঞ্চলের প্রকৃতির সাথে শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ, যাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে, যাদের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক, সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থাও টিকে আছে ও যারা নিজেদের এই স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখতে চায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যকারী জাতিগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন যেকোনো জনগোষ্ঠী যারা নিজেদেরকে “আদিবাসী” হিসেবে পরিচত করতে চায়, তারাই “আদিবাসী”। “আদিবাসী”র এই সংজ্ঞানুসারে বাংলাদেশের আধিপত্যকারী বা প্রধান (dominant) বাঙালি জাতিকে “আদিবাসী” বলার কোন উপায় বা কারণ নেই। আমাদের আদিবাসী জাতিসমূহকে “আদিবাসী” হিসেবে স্বীকৃতি দিলে পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোন আশংকাও নেই। কেননা, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই আদিবাসীরা নিজস্ব ভূমি তথা তাদের নিজস্ব জীবন, সম্পদ ও সংস্কৃতি রক্ষার অধিকার চাইছেন। এটি তাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। ফলে, আদিবাসীদের স্বীকৃতির বিরুদ্ধে ও তাদের অধিকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আধিপত্যবাদী ও জাতিবাদী রাজনীতি বাংলাদেশের জন্যে আত্মবিধ্বংসী, যা দেশের বহুবর্ণিল ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করার মাধ্যমে শক্তিলাভ করে। সাম্প্রতিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছবি, গ্রাফিতি, প্রতিবাদী ভাষ্য ইত্যাদি থেকে “আদিবাসী” শব্দটিকে মুছে দেওয়া সেই রাজনীতির অংশমাত্র। এই রাজনীতি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই মানতে চায় না, এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে একটি একক জাতি, একক জনগোষ্ঠী এবং একক সংস্কৃতির মালিকানায় রাখার আগ্রাসী আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্ব করে। এই রাজনীতিই বস্তুত ফ্যাসিবাদ তৈরি করে, আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাঝে ফ্যাসিবাদকে জিইয়ে রাখে। আমরা মনে করি, এহেন জাতিবাদী-ফ্যাসিবাদী রাজনীতির কবর রচনা করেই কেবলমাত্র জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক একটি বহুত্ববাদী সমাজ গঠন করা সম্ভব।
আমরা এই বিবৃতির মাধ্যমে নিম্নলিখিত দাবিসমূহ উত্থাপন করছিঃ
১। পাঠ্যপুস্তক থেকে “আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি বাদ দেয়ার প্রতিবাদে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সামনে আদিবাসীদের সমাবেশের ওপরে ন্যক্কারজনক হামলার সাথে জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সংক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার মিছিলের ওপরে হামলাকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও নির্দেশপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। পাঠ্যপুস্তক থেকে “আদিবাসী” শব্দ সম্বলিত গ্রাফিতি সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে এবং এনসিটিবি’র নতজানু চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক থেকে আদিবাসীদের অপরায়ন ও বিমানবিকীকরণের যাবতীয় প্রকাশভঙ্গি দূর করতে হবে এবং আদিবাসীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আদিবাসীদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। আদিবাসীদের যথাযথ সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। সংবিধানে নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশী পরিচয় থাকলেই চলবে না, জাতি হিসেবে বাংলাদেশের সকল জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানে “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” এর বদলে “আদিবাসী” পরিচয় প্রদান করতে হবে এবং সকল ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও শিল্পকলাসমূহের পরিপোষণ ও উন্নয়নের পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের অঙ্গীকার সম্বলিত বিধান রাখতে হবে।
৪। জাতিসংঘের “ডিক্লারেশন অন দ্য রাইটস অফ ইন্ডিজেনাস পিপলস” (২০০৭) সনদে পরিপূর্ণভাবে অনুস্বাক্ষর করতে হবে। আদিবাসীদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫। পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী ও অলিখিত সেনাশাসন অপসারণ করতে হবে।
গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক
১৯ জানুয়ারি, ২০২৫