উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির বাড়তি বোঝা

সংবাদ পর্যালোচনা

উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভ্যাট বৃদ্ধির বাড়তি বোঝা

কল্লোল মোস্তফা

দেশে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ নেই, বাজেট উপস্থাপনের সময়ও আসেনি। তা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার আইএমএফের শর্ত মেনে অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য ভোক্তা অধিকার সংগঠন, নাগরিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ীসহ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই ৯ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশ দুটি হলো: মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫ এবং দি এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫।

এরপর সমালোচনার মুখে ২২ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চারটি আদেশ জারি করে ১০টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করে। এ তালিকায় রয়েছে মোবাইল ফোন সেবা, রেস্তোরাঁ, ওষুধ, পোশাক, মিষ্টি, নন-এসি হোটেল, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি। অবশ্য এর পরও ৯০টিরও বেশি পণ্যে বর্ধিত ভ্যাট ও শুল্ক রয়ে গেছে। যেসব পণ্যে আগের তুলনায় বেশি ভ্যাট ও শুল্ক কার্যকর রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো, সব ধরনের টিস্যু, শিশুখাদ্য–বিস্কুট, এলপি গ্যাস, ব্র্যান্ডের পোশাক, পানির বোতল, টিফিন বক্স, হাওয়াই চপ্পল, প্লাস্টিকের পাদুকা, মিস্টি, ফল, ড্রিঙ্কস, ফলের রস, টমেটোর সস, চশমার ফ্রেম ইত্যাদি।

টেবিল: কয়েকটি পণ্যের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির হার ও পরিমাণ

পণ্য

আগের কর হার (শতাংশ)

বর্তমান কর হার (শতাংশ)

আগের কর (টাকা)

বর্তমান কর (টাকা)

বিস্কুট (৬০ টাকার টোস্ট)

১৫

৪.২

এলপি গ্যাস (১২ কেজি)

৭.৫

৯৫

১০২

টিস্যু (মাঝারি প্যাকেট)

৭.৫

১৫

৩-৪

৭-৮

ব্র্যান্ডের পোশাক (১০০০ টাকার)

৭.৫

১০

৭৫

১০০

পানির বোতল, টিফিন বক্স (২০০ টাকা)

১৫

৩০

হাওয়াই চপ্পল, প্লাস্টিকের পাদুকা (১৫০ টাকা)

১৫

২২.৫০

মিস্টি ১ কেজি (৩৫০ টাকা)

৭.৫

১০

২৬.২৫

৩৫

আপেল, মাল্টা ও কমলা (১ কেজি)

২০

৩০

১০১

১১৬

সিনেমার টিকিট (৩০০ টাকা)

১০

১৫

৩০

৪৫

শুধু তাই নয়, বিদ্যমান নিয়মে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টার্নওভার বা বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে তার জন্য ৪ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য ছিল। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকা অর্থাৎ দৈনিক বিক্রি গড়ে ১৩ হাজার ৬৯৮ টাকা পার হলেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় চলে আসবে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট বেড়ে যাবে, যা মূল্যস্ফীতির ওপর আরও বেশি চাপ তৈরি করবে।

বিদ্যমান নিয়মে কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের টার্নওভার বা বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত হলে তার জন্য ৪ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য ছিল। তবে সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে কোনো প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকা অর্থাৎ দৈনিক বিক্রি গড়ে ১৩ হাজার ৬৯৮ টাকা পার হলেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় চলে আসবে।

সরকার ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিল এমন এক সময়ে যখন টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কষ্টে আছে সীমিত আয়ের মানুষ। ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে দেশের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দাবি করেছেন, ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। ২ জানুয়ারি তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা সেই ছাড়টা দেখবেন।’ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশেই, এমনকি নেপাল-ভুটানেও, বাংলাদেশের মতো এত কম কর (ট্যাক্স) নেই।

অর্থ উপদেষ্টার এ ধরনের বক্তব্য বিগত সরকারের মন্ত্রীদের দায়িত্বহীন কথাবার্তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আজ থেকে তিন বছর আগে ২০২২-এর জানুয়ারিতে উচ্চমূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সারা বিশ্বেই আছে। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নেই। গত ১৫ বছর মূল্যস্ফীতির হার গড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশে আরও বেশি মূল্যস্ফীতি ছিল। কাজেই আমি বলব, বাংলাদেশ একটি অসাধারণ দেশ। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি নেই।’

অর্থ উপদেষ্টার মতো এনবিআরও দাবি করেছে যেসব পণ্য ও সেবার শুল্ক–কর বাড়ানো হয়েছে, সেখানে নিত্যপণ্য নেই। এতে সর্বসাধারণের ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে না ও মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।

বাস্তবতা হলো বিস্কুট, এলপি গ্যাস, টিস্যু, ব্র্যান্ডের পোশাক, পানির বোতল, টিফিন বক্স, হাওয়াই চপ্পল, প্লাস্টিকের পাদুকা, মিস্টি, ফল ইত্যাদি সবই জীবনযাত্রার অংশ। এসব পণ্য ও সেবার ওপর শুল্ক-কর বৃদ্ধি সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ বাড়াবে। অর্থ উপদেষ্টা ও এনবিআরের বক্তব্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ বৃদ্ধি ও মূল্য স্থিতিশীল রাখতে চাল, আলু, পেঁয়াজ, চিনি, ডিম, খেজুর, ভোজ্যতেল ইত্যাদি নিত্যপণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হলো এই শুল্ক হ্রাসের ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমেনি। শুল্ক ছাড়ের সুবিধা কতটা সাধারণ মানুষ পেয়েছে, আর কতটা ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢুকেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা নভেম্বরে বেড়ে হয় ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এই মূল্যস্ফীতির হার গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।১০ এ রকম একটা অবস্থায় শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে দুর্দশা আরও বাড়বে।

সরকারের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে, অক্টোবরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা নভেম্বরে বেড়ে হয় ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বাংলাদেশে এই মূল্যস্ফীতির হার গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুসারে, ৪৫০ কোটি ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির আওতায় চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরেই কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), টাকার অঙ্কে যা ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই শর্ত পূরণ করার জন্যই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে।১১ সন্দেহ নেই বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, গোটা দুনিয়ার মধ্যেই অন্যতম কম। ওইসিডির তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে যা ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২৪ দশমিক ৭২ শতাংশ এবং উন্নত দেশে ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ থাকে।১২

ফলে বাংলাদেশকে কর আহরণ বাড়াতে হবে অবশ্যই। তবে কর আহরণ বৃদ্ধির জন্য ভ্যাট বৃদ্ধি করাই একমাত্র পথ নয়, ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বদলে প্রত্যক্ষ আয়কর বৃদ্ধি করাই জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের বদলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে পরোক্ষ কর আদায়ের ওপর বেশি নির্ভর করা হলে তা ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি করে। অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ তার এক লেখায় (‘বাজেট এবং প্রতারণার ধারাবাহিকতা’) করব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদ আহরণ ও ব্যয় করার ঘটনাকে বৃষ্টি প্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, এক জায়গা থেকে পানি শুকিয়ে জলীয় বাষ্প হয়ে বৃষ্টি যদি আরেক জায়গায় হয়, তাহলে একটি জায়গা লাভবান হয়, ফুলে-ফলে ভরে ওঠে; কিন্তু অন্য জায়গা ক্রমাগত শুকিয়ে কাঠ হতে থাকে। করের মাধ্যমে সম্পদ স্থানান্তরের এই প্রক্রিয়া প্রধানত দুভাবে হতে পারে: আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত। সম্পদ এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তর যতটা সহজে বোঝা যায়, এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে সম্পদ স্থানান্তর ততটা বোধগম্য হয় না। যখন সরকারের আয়ের বেশিরভাগটা প্রত্যক্ষ করের বদলে পরোক্ষ কর, অর্থাৎ আমদানি শুল্ক, ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক, সারচার্জ ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বজনের কাছ থেকে আদায় করা হয়, তখন এই শ্রেণিভিত্তিক সম্পদ স্থানান্তরের ঘটনাটি ঘটে।১৩

বাংলাদেশে বিগত সরকারের আমলে ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ আয় করের তুলনায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুল্ক ও ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর বেশি আদায় করা হয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। যেসব কারণে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন, তার অন্যতম কারণ ছিল এই অর্থনৈতিক বৈষম্য। যেখানে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে মোট রাজস্বের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৫০ শতাংশের বেশি প্রত্যক্ষ কর থেকে সংগ্রহ করা হয়,১৪ সেখানে বাংলাদেশে কর আয়ের ৬৪ শতাংশই আদায় করা হয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্ক ও ভ্যাট ইত্যাদি পরোক্ষ করের মাধ্যমে।১৫

সিপিডির এক গবেষণা অনুসারে, দেশে করযোগ্য আয় করেও ৬৮ শতাংশ মানুষ আয়কর দেন না। জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে ২ লাখ ১৩ হাজার কোম্পানি রেজিস্টার্ড হলেও রিটার্ন দাখিল করে মাত্র ৪৫ হাজার কোম্পানি। বিভিন্ন খাতে কর ফাঁকি ও কর এড়িয়ে যাওয়ার কারণে বছরে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি থেকে ২ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আয় কম হয়।১৬ অন্তর্বর্তী সরকার এই বিপুল পরিমাণ কর ফাঁকি বন্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বোঝা বাড়িয়েছে।

অথচ কর ফাঁকি শনাক্ত করবার নানা রকম উপায় রয়েছে যার মধ্যে প্রযুক্তিগত সমাধানও অন্তর্ভুক্ত। এ বিষয়ে বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে তৈরি একটি প্রস্তাব অনুসারে, আয়কর রিটার্ন ও ভ্যাটের ডেটার সঙ্গে জমি ও ফ্ল্যাটের মালিকানা, ইলেকট্রিসিটি ও গ্যাস বিল, শেয়ার মার্কেটের স্টক ও বন্ডের মালিকানা ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্যের তুলনা করে কর ও ভ্যাট ফাঁকি উন্মোচন করা সম্ভব। এ জন্য আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স ও মেশিন লার্নিংভিত্তিক ডেটা এনালিটিকস কাজে লাগাতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবে বিভিন্ন ধরনের ডেটা ব্যবহার করে কর ফাঁকি উন্মোচন করা হয়।১৭

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঢাকার ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ ফ্ল্যাটের হিসাব আয়কর রিটার্নে দেখানো হয় না। ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কোনো ধরনের কর ও ভ্যাট দেয় না। এই ফাঁকি দূর করার জন্য দোকানগুলোতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন করা দরকার, কিন্তু গত সরকারের আমলে দুর্নীতির মাধ্যমে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে এই কাজ দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৫ শতাংশ দোকানে ইএফডি স্থাপন করা হয়েছে।১৮

কিন্তু বুয়েটের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কাজ করার জন্য তিন মাস আগে এনবিআরকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও এ বিষয়ে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। ধারণা করা যায়, কর ফাঁকি রোধে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে এনবিআর কর্মকর্তাদের দুর্নীতির রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে, তাই হয়তো এনবিআরের দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেই। অথচ এখন রাজস্ব বাড়ানোর জন্য ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলো।

দেখা যাচ্ছে, বিগত সরকারের মতো বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও ধনী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে জোর দেওয়ার বদলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আরও বেশি করে পরোক্ষ কর আদায়ের পথে হাঁটছে। তারা কর ফাঁকি রোধ ও বিদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে জোর দেওয়ার বদলে অগণতান্ত্রিক কায়দায় আইএমএফের কথা মেনে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা আদায়ের সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে পরোক্ষ কর বৃদ্ধির মতো বৈষম্য বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপ গ্রহণ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।

তারা কর ফাঁকি রোধ ও বিদেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধারে জোর দেওয়ার বদলে অগণতান্ত্রিক কায়দায় আইএমএফের কথা মেনে ভ্যাট বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের পকেট থেকে টাকা আদায়ের সহজ রাস্তা বেছে নিয়েছে।

বিগত সরকারের আমলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর মতো বৈষম্য বৃদ্ধিকারী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত হয়নি। কাজেই সরকারকে ভ্যাটের মাধ্যমে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ‘সহজ রাস্তা’ থেকে সরে আসতে হবে। শুধু ১০টি পণ্য নয়, সকল বর্ধিত ভ্যাট ও সম্পূর্ক শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে। ভ্যাট ও শুল্কের মতো পরোক্ষ করের বদলে ধনিক গোষ্ঠীর আয় ও সম্পদ থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায় বাড়াতে হবে।

কল্লোল মোস্তফা: লেখক, গবেষক। ই-মেইল: kallol_mustafa@yahoo.com

তথ্যসূত্র:

১। ‘শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ল’, প্রথম আলো, জানুয়ারি ১০, ২০২৫

২। ‘১০ পণ্য ও সেবায় ভ্যাট কমল’, সমকাল, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫

৩। ‘রেস্তোরাঁ, মুঠোফোন সেবায় বর্ধিত শুল্ক–কর কমল,’ প্রথম আলো, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫

৪। ‘ওষুধ রেস্তোরাঁ মোবাইলে কথা বলায় আগের ভ্যাট ফিরিয়ে আদেশ জারি,’ বণিক বার্তা, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫; ‘শুল্ক–কর বাড়ায় পকেট থেকে যাবে ১২ হাজার কোটি টাকা,’ প্রথম আলো, জানুয়ারি ১২, ২০২৫; ‘শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ল,’ প্রথম আলো, জানুয়ারি ৯, ২০২৫

৫। ‘ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক বিক্রি ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে দিতে হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট,’ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড অনলাইন, জানুয়ারি ১, ২০২৫

৬। ‘কর বাড়লেও জিনিসপত্রের দামে প্রভাব পড়বে না: অর্থ উপদেষ্টা,’ প্রথম আলো অনলাইন, জানুয়ারি ২ ২০২৫

৭। ‘দেশে মূল্যস্ফীতি নেই: অর্থমন্ত্রী,’ দেশ রূপান্তর, জানুয়ারি ২, ২০২২

৮। ‘ভ্যাট বাড়ালেও নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না,’ সমকাল, জানুয়ারি ৪, ২০২৫

৯। ‘২০০০ কোটি টাকা ছাড়ের সুফল পাচ্ছে না জনগণ,’ যুগান্তর, নভেম্বর ১৮, ২০২৪

১০। ‘মূল্যস্ফীতি না কমলেও অনেক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা অস্বাভাবিক বেড়েছে,’ বণিক বার্তা, জানুয়ারি ২, ২০২৫

১১। ‘নতুন বছরে মোবাইল ও ওষুধসহ বাড়তে পারে যেসব খরচ,’ যুগান্তর, জানুয়ারি ২, ২০২৫

১২। ‘Revenue Statistics in Asia and the Pacific 2024 ─ Bangladesh,’ OECD, accessed Jan 23, 2025, https://www.oecd.org/content/dam/oecd/en/topics/policy-sub-issues/global-tax-revenues/revenue-statistics-asia-and-pacific-bangladesh.pdf

১৩। আনু মুহাম্মদ, ‘বাজেট এবং প্রতারণার ধারাবাহিকতা,’ বাংলাদেশের অর্থনীতির চালচিত্র (ঢাকা: শ্রাবণ প্রকাশন, ২০০০)

১৪। Manya Rathore, ‘Share of direct and indirect tax in total central tax in India FY 2018-2023,’ statista.com, Dec 21, 2022

১৫। Bangladesh Ministry of Finance, ‘Statement I: Broad Details of Revenue Receipts,’ in Budget 2023-24 (Dhaka: Bangladesh Ministry of Finance, 2023)

১৬। ‘বছরে ৩ লাখ কোটি টাকার কর ফাঁকি,’ দেশ রূপান্তর, এপ্রিল ৪, ২০২৩; CPD, Study on Corporate Tax Transparency Issues and Concerns in Bangladesh(Dhaka: CPD, 2023)

১৭। ‘প্রপোজাল ফর প্রিপারেশন অব আইটি মাস্টারপ্ল্যান ফর এনবিআর,’ ডিপার্টমেন্ট অব সিএসই, বুয়েট, ২০২৪

১৮। পূর্বোক্ত

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •