জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের সংবাদ সম্মেলন
চিনিকলের পর পাটকলসহ সকল বন্ধ কলকারখানা খুলে দেওয়ার দাবি

“জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে মাড়াই স্থগিত করে দেওয়া চিনিকলসমূহ পুনরায় চালু করার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আজকের এই সংবাদ সম্মেলন।
ঘোর করোনাকালে ২০২০ সালের ২ জুলাই স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চাশ হাজার শ্রমিক ও লাখ লাখ পাটচাষির জীবন-জীবিকার কথা বিবেচনায় না নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ছাব্বিশটি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছিল। করোনাকালে একই কায়দায় ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বর আখচাষি ও চিনিকল শ্রমিকদের কথা বিবেচনা না করে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পনেরোটি চিনিকলের মধ্যে কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর (গাইবান্ধা), শ্যামপুর (রংপুর), সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর), পঞ্চগড়–এই ছয়টি চিনিকল লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের নির্দেশনায় এই ছয়টি চিনিকলে ২০২০-২১ অর্থবছরে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পনেরোটি চিনিকল রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ব্রিটিশ আমলে, নয়টি পাকিস্তান আমলে এবং তিনটি বাংলাদেশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়। পনেরোটি চিনিকলের মালিকানায় রয়েছে ১৯ হাজার ৯৬ একর জমি। এই পনেরোটি চিনিকলে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অনুমোদিত জনবল সংখ্যা ১৬ হাজার ২৩৫ জন থাকলেও বর্তমানে কর্মরত ৯ হাজার ১৬ জন। এর মধ্যে কর্মকর্তা ৭১৪ জন, কর্মচারী ৪ হাজার ৪০১ জন এবং শ্রমিক ৩ হাজার ৯০১ জন। বন্ধ করা ছয়টি চিনিকলে স্থায়ী কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ২ হাজার ৮৮৪ জন। দেশের বাজারে বৎসরে চিনির চাহিদা ২০ লাখ টন। রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলোয় ২ লাখ ১০ হাজার ৪৪০ টন উৎপাদন ক্ষমতার বিপরীতে ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে মাত্র ৮২ হাজার ১৪০ টন চিনি উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ মাড়াই মৌসুমে উৎপাদিত হয়েছে ৪৮ হাজার ১৩৪ টন এবং ২০২১-২২ মাড়াই মৌসুমে ২৪ হাজার ৫০৯ টন, ২০২২-২৩ মাড়াই মৌসুমে ২১ হাজার ৩১৪ টন ও ২০২৩-২৪ মাড়াই মৌসুমে ৩০ হাজার ৮১৮ টন চিনি উৎপাদিত হয়েছে।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
৩৬ দিনের লড়াই শেষে ৫ আগস্ট সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার আত্মদান ও ২০ হাজারের বেশি আন্দোলনকারীর আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাবিরোধী গণ-অভ্যুত্থান বিজয়ী হয়েছে। জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ ২০ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিল্প উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি পেশ করে। স্মারকলিপির অনুলিপি সচিব অর্থ ও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়। স্মারকলিপির পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প উপদেষ্টা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের একাধিক বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান। দ্বিতীয় বৈঠকে মাড়াই স্থগিত করা চিনিকলসমূহ পুনরায় চালু করার জন্য এবং চিনিকল লাভজনকভাবে চালানোর নিমিত্তে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা প্রণয়নের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই ৩০ সেপ্টেম্বর এগারোর সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের বর্তমান চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক ও শ্রমিক নেতা আবদুল্লাহ ক্বাফী রতনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়। টাস্কফোর্সের অন্য বেসরকারি সদস্যরা হলেন: অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, শ্রমিক নেতা মানস নন্দী, রংপুরের শ্যামপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, প্রখ্যাত কৃষক নেতা, আখচাষি আলতাফ হোসেন। পরবর্তী সময়ে প্রকৌশলী আবুল খায়ের আব্দুল ওহাব, আদিবাসী নেতা ডা. ফিলিমন বাস্কে, শ্রমিক নেতা কাইয়ূম হোসেন, শ্রমিক নেতা কামরুজ্জামান ফিরোজকে টাস্কফোর্সে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়: ১) মাড়াই স্থগিত করা চিনিকলসমূহ পুনরায় চালু করার জন্য সুপারিশ প্রণয়ন, ২) সুপারিশ করা চিনিকলসমূহ লাভজনকভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রণয়ন, ৩) চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য পদক্ষেপের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন এবং ৪) সরকারের কাছ থেকে চিনিকলের প্রাপ্য ট্রেডগ্যাপের অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা ও সুদসহ পুঞ্জীভূত ঋণ মওকুফের উপায় খুঁজে বের করা।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
টাস্কফোর্স সদস্যরা পাঁচটি সভায় মিলিত হন। বন্ধ ৬টি চিনিকলের পরিস্থিতি গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার পর টাস্কফোর্স ৬টি চিনিকল পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়ার প্রস্তাব করে। প্রথম পর্যায়ে শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ চিনিকল, দ্বিতীয় পর্যায়ে পঞ্চগড়, পাবনা চিনিকল ও তৃতীয় পর্যায়ে কুষ্টিয়া, গাইবান্ধার রংপুর চিনিকল খুলে দেওয়ার প্রস্তাব করে প্রতিবেদন শিল্প মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। পরে মাননীয় উপদেষ্টা প্রতিবেদনের সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং প্রধান উপদেষ্টার সম্মতি সাপেক্ষে ২০২০ সালের ১ ডিসেম্বরের স্থগিতাদেশ ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রত্যাহার করা হয় এবং তিনটি পর্যায়ে বন্ধ চিনিকলসমূহ খুলে দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। সরকারি আদেশে বন্ধ হওয়া ৬টি চিনিকল খোলার সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক। এটি চিনি শ্রমিক, আখচাষি ও জাতীয় পর্যায়ে বন্ধ কারখানা খুলে দেওয়ার জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনের এক ঐতিহাসিক বিজয়।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
চিনিকলসমূহে লোকসানের দায় কার?
সরকারের হিসাবে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৯৭০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে চিনিকলগুলো। সেই লোকসানের দায় শ্রমিক-কৃষকদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে কারখানা বন্ধের যুক্তি তৈরি করেছিল তৎকালীন সরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ার কারণগুলো হচ্ছে: আখের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় একরপ্রতি আখের ফলন অনেক কম, পুরাতন প্রযুক্তি ও মেশিনের কারণে আখ থেকে চিনি আহরণ হার (রিকভারি রেট) অন্যান্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় প্রায় অর্ধেক, পণ্যের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে উদ্যোগহীনতা, চিনি বিপণনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক হতে না পারা, আখ কেনা থেকে শুরু করে চিনি উৎপাদন ও বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতায় বেড়ে ওঠা পাহাড়সম ব্যাংকঋণ ও তার সুদ, অপ্রয়োজনীয় জনবলের বেতন-ভাতা প্রভৃতি।
নিশ্চিত করে বলা যায়, উপরের কারণগুলোর জন্য কৃষক-শ্রমিকদের দায়ী করার সুযোগ নেই। এর জন্য দায়ী সরকার ও প্রশাসনের ভুলনীতি ও দুর্নীতি। বাৎসরিক চাহিদা ২০ লাখ টন ধরলে বর্তমান বাজারদরে বাংলাদেশে চিনির বাজার হচ্ছে ৩২ হাজার কোটি টাকার। বর্তমানে পাঁচ-ছয়টি বেসরকারি গ্রুপ রিফাইনারি কারখানা প্রতিষ্ঠা করে বিদেশ থেকে অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে পরিশোধন করে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে বাজারজাত করছে। এরা আখিচাষিদের কাছ থেকে এক কেজি আখও কিনবে না। ফলে আখচাষ শেষ হয়ে যাবে। পাঁচ লাখ আখচাষি নিঃস্ব হবে। বাংলাদেশের চিনিখাত হয়ে পড়বে বিদেশনির্ভর। আর তা নিয়ন্ত্রণ করবে মুষ্টিমেয় চিনি-সিন্ডিকেট। বাংলাদেশের আপামর ভোক্তারা চিরতরে অসহায় হয়ে পড়বেন।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
বিরাষ্ট্রীয়করণ বা বেসরকারিকরণই ছিল শেখ হাসিনা সরকারের প্রধান লক্ষ্য।
বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ নির্দেশিত নয়া উদরবাদী পথ ধরেছিল শেখ হাসিনার সরকার। নয়া উদারবাদী নীতির কারণে বিরাষ্ট্রীয়করণ ছিল তৎকালীন সরকারের প্রধান লক্ষ্য। তথাকথিত মুক্তবাজার নীতির কারণে সরকার নিজের মালিকানায় থাকা প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দিচ্ছিল। সরকার তাদের করপোরেট বন্ধুদের হাতে তুলে দিয়েছিল জনগণের সম্পত্তি। গত তিপ্পান্ন বছর ধরে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, দুর্নীতির কারণে নিঃস্বপ্রায় প্রতিষ্ঠানের সম্পদগুলো তুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যক্তিমালিকদের হাতে, যা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব মুক্তিসংগ্রামে জাতির কাছে দেওয়া অঙ্গীকারের বরখেলাপ। জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। সরকারের লক্ষ্য যেহেতু বিদ্যমান চিনিকলগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণ করা, সেহেতু চিনিকলগুলোকে চলতি মূলধনের জোগান, কৃষককে সময়মতো আখের মূল্য পরিশোধ করা, চিনিসমৃদ্ধ আখের জাত উদ্ভাবন ও সংগ্রহ করা, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মিলে আখপ্রাপ্তি ও ৮-১০ শতাংশ রিকভারিতে চিনি উৎপাদন নিশ্চিত করা, কারখানাগুলোর আধুনিকায়ন, পণ্যের বহুমুখীকরণ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও জনবল নিয়োগ, মাথাভারি প্রশাসনকে যৌক্তিকীকরণ ইত্যাদি না করে প্রথম দফায় চিনিকলগুলো বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেগুলো ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দেওয়ার জন্য। এভাবেই পরিসমাপ্তি ঘটানো হতো রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি শিল্পের।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের নতুন পথ দেখিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী লড়াই সমাজের সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় শিল্প ও শ্রমখাতে বৈষম্যবিরোধী লড়াই নতুন উদ্দীপনা পেয়েছে। জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ একইসাথে শিল্প মন্ত্রণালয় ও পাট মন্ত্রণালয়ে যথাক্রমে বন্ধ চিনি ও পাটকল খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। সরকার কর্তৃক চিনিকল খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে লড়াইয়ে বিজয় শুরু হয়েছে। বন্ধ পাটকলসহ অন্যান্য বন্ধ কারখানা উপযুক্ত আধুনিকীকরণের মাধ্যমে খুলে দেওয়ার লড়াই জারি থাকবে। আমরা আজকের এই সংবাদ সম্মেলন থেকে অবিলম্বে বন্ধ পাটকলসমূহ খুলে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।
প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
শাসকশ্রেণির সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর নয়া উদারবাদী নীতির লক্ষ্যই হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেওয়া। ক্ষমতাসীনদের এ নীতি সরাসরি শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের ওপর আক্রমণ। এ আক্রমণ কেবল শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলন দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। এ লড়াই জাতীয় সম্পদ রক্ষার লড়াই। জনগণের সম্পদ জনগণের মালিকানায় রাখার লড়াই। কতিপয় লুটেরা ধনিক ও তাদের অনুগ্রহভোগী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াই। সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের গণবিরোধী নীতিকে রুখতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলাটা এখন সময়ের দাবি।”
জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদ
জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা
২২ ডিসেম্বর ২০২৪