মাগুরায় গণঅভ্যুত্থান: একজন সংগঠকের ডায়েরী

মাগুরায় গণঅভ্যুত্থান: একজন সংগঠকের ডায়েরী

নাফিসা নাওয়ার নিঝুম

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের মতোই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের বয়ানকে দলীয়করণ/খন্ডীকরণ করার ডামডোলে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের অসংখ্য শিক্ষার্থী ও জনতার অবদানের কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে। এই লেখায় মাগুড়া শহরে কীভাবে একদল কম বয়সী শিক্ষার্থী নিজেদের তাগিদ থেকে প্রতিবাদ শুরু করার পর পুরো শহর ধীরে ধীরে নেমে এল রাস্তায় তারই বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। লিখেছেন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী, যিনি মাগুরায় সংগঠকদের একজন। লেখক ও তার বন্ধুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাগুরায় প্রথম বিক্ষোভের ডাক দেন কোন ‘কেন্দ্রীয়’ ডাকের অপেক্ষা না করেই। তাদের নাড়া দিয়েছিল কী কী বিষয়? কীভাবে তাদের লড়তে হয়েছিল পরিবারসহ? কী ধরনের ট্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল? সেইসব গল্পই এখানে রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের পরের উপলব্ধিও।

মাগুরা চারটা উপজেলার ছোট একটা জেলা। মূল শহর আধাঘণ্টা হাঁটলে ঘুরে ফেলা যায়। এখানে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। মেডিকেল কলেজ থাকলেও অবকাঠামো আর জায়গার অভাবে শহরে শিক্ষার্থীদের মূল কেন্দ্র সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। আমি এই কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ি। দীর্ঘদিন মাগুরাতে কোনো প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম তো দূর কমিটিই নেই। বড় বড় এলাকায় হওয়া আন্দোলনের আঁচ আমাদের এই মফস্বলে কখনো তেমন লাগতে দেখিনি। আওয়ামী বিরোধী সবরকম শক্তিই এখানে এত নিষ্ক্রিয় ছিল যে, অন্যান্য সব এলাকার মানুষ যখন তুমুল লড়াই করছে, তখনও আমরা ভেবে মরছি রাস্তায় দাঁড়ানোর মতো লোকবল গুছিয়ে উঠতে পারবো কিনা। এরকম একটা অবস্থা থেকে শুরু করে জুলাই শেষ অবধি আমাদের কাঁধে চারজন সহযোদ্ধার লাশের ভার। আমরা ভাবতেও পারিনি, এই ছোট শহর এত বদলে যাবে। আমাদের সাথে বের হয়ে কয়েকজন আর কখনো বাড়ি ফিরবে না‌।

তখনও আমরা ভেবে মরছি রাস্তায় দাঁড়ানোর মতো লোকবল গুছিয়ে উঠতে পারবো কিনা। এরকম একটা অবস্থা থেকে শুরু করে জুলাই শেষ অবধি আমাদের কাঁধে চারজন সহযোদ্ধার লাশের ভার। আমরা ভাবতেও পারিনি, এই ছোট শহর এত বদলে যাবে। আমাদের সাথে বের হয়ে কয়েকজন আর কখনো বাড়ি ফিরবে না‌।

১৫ জুলাই

সারাদিন ফেসবুকে ঢুকিনি। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছে কয়েকদিন ধরে, জানতাম। মৌন সমর্থন ছিল। খুব বেশি খোঁজ-খবর রাখার সুযোগ পাইনি। ভারতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া আমার খালামণির তখন বাঁচা-মরা অবস্থা। বাড়ির সবার মনোযোগ ওদিকে। দুপুর কাটলো তীব্র মন খারাপ নিয়ে। বিকেলে একটু শান্ত হতে পাড়ার ভেতর হাঁটছি। একটা চায়ের দোকানের টিভিতে প্রথম খবরে দেখলাম-ঢাকায় ছাত্রলীগ আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর খুব বাজেভাবে হামলা চালিয়েছে, আহতরা মেডিকেলে গেলে সেখানেও হামলা করেছে।

বাড়ি ফিরে ফেসবুকে ঢুকে একেবারে থ হয়ে গেলাম। একটা মেয়ের ছবি ঘুরছিল, পুরো মুখ রক্তে লাল হয়ে আছে। কোনোভাবেই নিতে পারছিলাম না। পরিচিত অনেক ‘শ্রদ্ধেয়’ লোক আবার এই হামলার সাফাই গাইছিলেন। শিক্ষার্থীরা নাকি নিজেদের ‘রাজাকার’ বলেছে! মেজাজ এত খারাপ হয়ে গেল, পুরো স্লোগানটা বোঝানোর ইচ্ছেও করলো না। ফেসবুকে একটা-দুইটা পোস্ট করে প্রতিবাদ জানিয়েও লজ্জা করছিল। যে ছেলে-মেয়েগুলো আজ রাস্তায় মার খেলো, ওরা তো আমার অধিকারের জন্যেও লড়লো। তাহলে আমি কেন ওদের জন্য রাস্তায় নামবো না?

এখানে তখনো কোনো সমন্বয়ক তৈরি হয় নি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্মটা কী পরিকল্পনা করছে তাও জানি না। ছাত্র ইউনিয়নের ইমন ভাইকে কল দিলাম ঢাকার খবর নিতে। তিনি জানালেন অবস্থা খুব সিরিয়াস। তখনো হামলা চলছে। সাজেশন দিলেন কারো অপেক্ষা না করে নিজেরাই ব্যাচে ব্যাচে যোগাযোগ করে বের হয়ে যেতে। আগা-মাথা খুব বেশি না ভেবে অল্প কয়েকজনের সাথে আলাপ করলাম। জায়গা হিসেবে চৌরঙ্গী মোড় ঠিক করে রাত প্রায় একটার দিকে পোস্ট করে ফেললাম – ‘আমরা, মাগুরার সাধারণ ছাত্ররা কাল (১৭ই জুলাই) রাস্তায় থাকছি। যারা নির্বিচারে ছাত্র মারে, হাসপাতালে হামলা চালায়, মাঝরাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরের মতো আক্রমণ করে, আমরা তাদের বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছি।’ মাগুরাতে আমরাই ঐ প্রথম ছাত্র সমাবেশের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ফেলি। রাতে কোনোভাবেই ঘুম আসে না চিন্তায়। বাসার একটা ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে জলরঙ গুলে পোস্টার‌ লিখতে থাকি।

মাগুরাতে আমরাই ঐ প্রথম ছাত্র সমাবেশের প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে ফেলি। রাতে কোনোভাবেই ঘুম আসে না চিন্তায়। বাসার একটা ক্যালেন্ডার ছিঁড়ে জলরঙ গুলে পোস্টার‌ লিখতে থাকি।

মাগুরায় গণঅভ্যুত্থানের শুরু হয়েছিল এই পোস্টার দিয়ে। এই অনলাইন পোস্টার দিয়েই প্রথম রাস্তায় নামার ডাক দেয়া হয় মাগুরায়। পরে কর্মসূচির তারিখ ১ দিন পেছানো হয়। স্থানও পালটে ভায়নার মোড় করা হয়। লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

১৬ জুলাই

এই দিনটার মতো অদ্ভূত সময় জীবনে আর কখনো পার করিনি। একদিকে ছাত্রলীগের হুমকি-ধামকি শুরু হলো। বাড়ির লোক জেনে ফেলে আটকে রাখার চেষ্টা করলো। আরেকদিকে দেখলাম আমাদের থেকেও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা মিছিলের জন্য বন্ধুদের ডাকছে। ভয় আর সাহস একসাথে মিশলে এত অদ্ভূত অনুভূতি হয়, জানতাম না। ঘরের লোকের ভয় পাওয়া মুখ দেখে কষ্ট হচ্ছিল। আবার পথে মার খাওয়া মানুষগুলোকেও  ভুলতে পারছিলাম না। প্রথমদিকে আমি, আমার বন্ধু মেঘলা আর এই বছর রাবিতে ভর্তি হওয়া মাহাথির ভাই নিজেদের পরিচিত মহলে যোগাযোগ করতে থাকি। ক্লাস এইট থেকে শুরু করে অনার্সের ভাই-আপুরা সাড়া দিতে থাকেন।

আমাদের একটা ৫০-৬০ জনের গ্রুপ তৈরি হয়ে যায় দ্রুত। ঠিক এভাবেই অন্য অনেকে নিজেদের স্কুল-কলেজে, ব্যাচে, এমনকি পাড়ায় যোগাযোগ করে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি করে ফেলেছিল। আমরা সারাদিন চেষ্টা করতে থাকি এমন সবগুলো গ্রুপকে একজোট করে ফেলার। কেউ কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করে, আবার আমরাও কারো কারো সাথে যোগাযোগ করি। একক কোনো মানুষ বা সংগঠন মাগুরাতে নেতৃত্ব দেয় নি। তেমন অবস্থাও ছিল না। রাজনৈতিক দলগুলো নিশ্চয়ই নিজেরা পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু তখনো তারা সরাসরি কোনো সাংগঠনিক কর্মসূচী দিতে পারে নি। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে দলীয় পরিচয়ে না এসে শিক্ষার্থী হিসেবে তারা আমাদের সাথে যুক্ত হয়ে যায়।

দুপুরে জানতে পারি আমাদের গ্রুপে ছাত্রলীগের কোনো চর ছিল। একে একে আমাদের বাড়িতে কল আসতে থাকে। মা-বাবাদের ভয় দেখানো হয় যেন তাদের ছেলে-মেয়েরা এইসব ‘ঝামেলায়’ না আসে। কলেজ ছাত্রলীগের সেক্রেটারি আমার প্রেমিককে কল দিয়ে হুমকি-ধামকি দেয়। আমার আগে ও বিপদে পড়বে, টের পাচ্ছিলাম। মাহাথির ভাই এইসব ক্যাচালে ঝিনাইদহ চলে যায়। অসহায় লাগতে শুরু করে। বিকেলে পড়তে যাই, কারো মন বসে না, এইসব আলাপই চলে। বাড়ি ফেরার আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মোশাররফ আংকেল দেখা করে যেতে বলেন। প্রথমে শোনেন আমরা কী ভাবছি, কীভাবে আগাতে চাইছি। এরপর কয়েকটা প্রশ্ন করেন।

– যদি পুলিশ দাবড় দেয়, কী করবি?

– দৌঁড় দেবো।

– যদি কারো হাত-পা ভাঙে?

– সদরে নিয়ে গেলে হবে। ঐটা কাছে।

– তোদের সাথে তো আরো ছোটরা যাবে। ওদের কিছু হলে ওদের পরিবারকে ফেস করতে পারবি?

এই সময় থমকে যাই একটু। আসলেই তো। ক্লাস এইটের প্রান্ত, টেনের ইরিন, মাত্র এসএসসি দেওয়া তনয়ারা যাবে। ওদের ক্ষতি হলে আমরা কী জবাব দেবো? আংকেল উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলেন, ‘নিরুৎসাহিত করছি না। শুধু এই সম্ভাবনাগুলো ভাবিস। মানসিক প্রস্তুতি রাখিস। যাবি যখন সবদিক চিন্তা করেই যাবি।’ আংকেলের বাসায় বসেই আবু সাঈদের খবর পেলাম। একটা ছেলে কীভাবে রাস্তায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের গুলি খেয়ে মরে গেল! আর কোনো ভয় কাজ করছিল না ঐ দৃশ্য দেখার পর। ছাত্রদের উপর হামলার প্রতিবাদে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। সেটা এখন ছাত্র-হত্যার বিচার চেয়ে করতে হবে। এইটুকুই পার্থক্য।

বাড়ি ফিরে দেখি আমি বলার আগে মা নিজে ডেকে আন্দোলনের ক্লিপগুলো দেখাচ্ছে। আমার এক কাজিন ইকন যশোরে ছিল ঐদিন পথে, ওর ছবি দেখালো। আমি তখন আস্তে করে বললাম, ‘তোমার মেয়েকে যেতে দিবা তো?’ আম্মু প্রথমে বললো, ‘যাবি। এটা তো তোদের সবার ব্যাপার এখন।’ কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে একটা কল পেয়ে তার মন পুরো বিগড়ে গেল। ছাত্রলীগ যে আমাদের কয়েকটাকে সকাল থেকেই টার্গেট করে ফেলেছে, তার কানে খবরটা চলে এলো। এরপর কোনোভাবেই তাকে বোঝাতে পারি না। বাড়ির তিনটা মানুষ তখন অন্য দেশে হাসপাতালে। তাদের সাথে আমাকে নিয়েও দুশ্চিন্তা করতে হলে সে কুলাতে পারবে না, এমনটা বারবার বলছিল। এই ঘর আর বাইরের দ্বন্দ্বে আমার একদম পাগল পাগল লাগছিল। এই সময়টা মনে কী চলেছে লিখে বোঝাতে পারছি না। বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে মেঝেতে বসে পড়ি। কান্না আসছিল, কাঁদতেও পারছিলাম না। একবার বালতির ভেতর মাথা ডুবিয়ে রাখি। আরেকবার শ্যাম্পু কাটার ব্লেড হাতে নিয়ে ভাবি টান দেবো কিনা। শেষে মনে হলো এভাবে না মরে রাস্তায় মরতে পারি জেনে বের হওয়াই ভালো। আম্মু ততক্ষণে কান্না শুরু করেছে। বাথরুম থেকে বের হলে আর কোনো বাধা দিল না।

বাথরুমে ঢুকে দরজা আটকে মেঝেতে বসে পড়ি। কান্না আসছিল, কাঁদতেও পারছিলাম না। একবার বালতির ভেতর মাথা ডুবিয়ে রাখি। আরেকবার শ্যাম্পু কাটার ব্লেড হাতে নিয়ে ভাবি টান দেবো কিনা। শেষে মনে হলো এভাবে না মরে রাস্তায় মরতে পারি জেনে বের হওয়াই ভালো। আম্মু ততক্ষণে কান্না শুরু করেছে। বাথরুম থেকে বের হলে আর কোনো বাধা দিল না।

একটু শান্ত হয়ে অনলাইনে গিয়ে দেখি আরেক জিনিস। কাল আশুরার জন্য সেন্ট্রাল থেকে সমন্বয়করা নাকি কোনো কর্মসূচী রাখছে না। আমরাও আর একটা দিন দেখবো কিনা, বড়রা ভেবে দেখতে বলেন। এমনিই লোকবল যখন কম। আমার মনে হচ্ছিল একবার যখন প্রচার করা হয়ে গেছে, কাল আমরা থাকবো জেনে চেনা-অচেনা অনেকেই বের হবে। শেষ মুহূর্তে তারিখ বদলালে ওরা বিপদে পড়বে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ পিছাতে চাইলে আর কিছু করার থাকলো না। আমরা সময় বদলে ১৮ জুলাই আর জায়গা বদলে শহরের একদম মূল পয়েন্ট ভায়নার মোড় ফিক্সড করি।

১৭ জুলাই

সকালে ঘুম থেকে উঠে দুইটা খবর পাই। আমাদের পাশের উপজেলা শ্রীপুরে শিক্ষার্থীরা সকালে মিছিল করে ফেলেছে। আর সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে ছাত্রদলের ডাকা সমাবেশে কয়েকজন গেলে সাথে সাথেই ছাত্রলীগ ওদের আটকে পুলিশে খবর দিয়েছে। স্থানীয় মিডিয়াগুলো পরে খবর দেখাচ্ছিল- ‘কোটা আন্দোলনকারী সন্দেহে’ কয়েকজন আটক। দুপুর থেকেই মাগুরার চেহারা বদলে যায়। শহরের মোড়ে মোড়ে আর স্কুল-কলেজের সামনে পুলিশ গিজগিজ করতে থাকে। বিজিবির কয়েকটা গাড়ি আসে। সাথে ছাত্রলীগ টহল দিতে থাকে। এদিকে আমরাও যে যার মতো যোগাযোগ বাড়াতে থাকি। বিকেলে পড়তে যাই মেঘলার বাড়ি। ওখানে ওর বোন যবিপ্রবির রোদেলা আপু আর ঢাবির সিঁথি আপু ছিল। জুনিয়র কয়েকটাকে ডেকে নিই। স্যার, আংকেল-আন্টি সবাই গোল হয়ে বসে আলাপ করতে থাকি। পড়া তো দূর স্বাভাবিক কিছুই কারো মাথায় আসছিল না।

বড়রা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই কোটা আন্দোলন আগেও একবার হয়েছে। আজ সন্ধ্যার ভাষণে হাসিনা একবার দাবি মেনে নিলে সবাই উল্টো ধন্য ধন্য করবে। এর ভেতর আমাদের রাস্তায় নামা খালি খালি আত্মঘাতী কাজ হবে। আমরাও বলি যে মানুষ মরার পর কোটা দিয়ে কী আর থামানো যাবে? পাশেই ছিল থানা। ওখানে চক্কর দিয়ে আসার প্ল্যান করতে থাকি। হঠাৎ সিঁথি আপু আমাদের ডেকে তার হলে থাকা বন্ধু-বান্ধবের পাঠানো কিছু ফুটেজ দেখায়। ছাত্রলীগ আর পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ঐদিন যে বীভৎস তাণ্ডব চালিয়েছিল, বইয়ে পড়া একাত্তরের ২৫শে মার্চ রাতটা চোখের সামনে দেখছি বলে মনে হতে থাকে।

মেঘলার বাবা-মা ওকে থামাতে পারবে না বুঝে গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। মন খারাপ নিয়ে বেরোই। পথে ক্লাস টেনের একদল মেয়ে ডেকে অবস্থা কী শোনে, স্কুল থেকে বাঁচিয়ে আনা একটা টিফিন আমাকে দিয়ে দেয়। আর যদি দেখা না হয়! সবাই কেমন যেন হয়ে গেছিলাম। পুলিশ, বিজিবির গাড়ি দেখতে দেখতে বাড়ি ফিরি। রাতে মারিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে শিখি টিয়ার শেল ছুঁড়লে কী কী করতে হয়। রান্নাঘর থেকে মরিচগুঁড়ো এনে ছোটবোনের পাউডারের কৌটায় ভরি। খুন্তি-বেলন কিছু নেবো নেবো করেও নিই না। মারতে এলে মারতে তো পারবোই না উল্টো ব্যাগ চেক করলে রাস্তায় ধরা খাবো। শেষমেশ আমরা বের হতে পারছি ভেবে স্বস্তি লাগছিল। আবার ঘুমিয়ে থাকা মা-বোনের দিকে তাকিয়ে ভয়ও করছিল। এই টানাপোড়েনটা জুলাইয়ে আর পিছু ছাড়েনি।

১৮ জুলাই

চেনা-অচেনা মানুষের কলে সকাল শুরু হয়। সবাই জানতে চায় জায়গা আর সময় নিশ্চিত কিনা। আমার মা অসম্ভব বদলে যায় সেদিন। জড়িয়ে ধরে সাহস যোগায়। একা গেলে পথে আটকে যেতে পারি ভেবে বা যতটুকু পারা যায় সাথে রাখার চেষ্টা হিসেবেই তার সাথে তার অফিস অবধি যেতে বলে। ভায়নার মোড়ে তার অফিস কিছুক্ষণের ভেতর আমাদের ছোট-খাট ঘাঁটি হয়ে যায়। আমরা ছিলাম ৯-১০ জন। প্রিয়ন্তীর মা সুরভী আন্টি এসেছিলেন বাচ্চাদের মিছিলে যুক্ত হতে। দশটার পর খবর পেতে থাকি শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ আর ছাত্রলীগ মিলে ছাত্র-ছাত্রী দেখলেই আটকে দিচ্ছে। জানালা দিয়ে দেখি বিজিবির বড় একটা গাড়ি রাখা মোড়ে। পুলিশ ঘনঘন টহল দিচ্ছে। আমরা যতজন হতে পারি তার কয়েকগুণ ফোর্স অলরেডি মাঠে! সময় নষ্ট না করে যারা একসাথে ছিলাম চৌরঙ্গী মোড় চলে যাই। ঠিক করি যদি ভায়নাতে না নামা যায় এই কয়জন এখানেই বসে পড়বো। তবু বাড়ি ফিরে যাবো না।

১৮ ই জুলাই ভায়নার মোড়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে পুলিশের বাধা। ছবি: জয়ন্ত জোয়ার্দার

সবশেষে সকাল প্রায় সাড়ে এগারোটায় আমরা সর্বসাকুল্যে দেড়শ জন ভায়নায় জড় হয়ে বসে পড়ি। মেয়েরা ছিলাম সামনের সারিতে। পুলিশ আমাদের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের কোটার দাবি তো মেনে নেওয়া হবে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাহলে আবার কেন আসছো?’ আমরা একসাথে চিৎকার করে বলে উঠি, ‘কোটা লাগবে না। আপনারা আমাদের যে ভাইদের গুলি করে মেরে ফেলছেন তাদের ফিরায়ে দেন।’ তখনি তারা তেড়ে এসে আমাদের উঠিয়ে দেয়। আমরা মিছিল নিয়ে যশোরের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা ধরে আগাতে থাকি। ঐদিন যারা পথে নেমেছিল, অধিকাংশই জীবনে প্রথম। আমার আগের অভিজ্ঞতা থাকলেও এমন আগুন মিছিলে কখনো হাঁটিনি। পিছনে পুলিশ থাকায় আমাদের প্রায় দৌড়াতে হচ্ছিল। এর ভেতর কেউ হোঁচট খায়, কেউ পানির পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়। কারা যেন কয়েক বোতল পানি এগিয়ে দিল আমাদের। বিহ্বল হয়ে হাঁটছিলাম আর দেখছিলাম আমাদের হাতগুলো কীভাবে একসাথে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উপরে উঠছে। আর কখনো জোরে কথা না বলা মানুষটাও জোর গলায় স্লোগান দিচ্ছে – ‘আমার ভাই মরলো কেন, খুনী হাসিনা জবাব দে!’

মিছিল মৎস্য ভবনের সামনে পৌঁছালে পুলিশ বলে, আর এক মিনিট চললে তারা অ্যাকশন শুরু করবে। ইচ্ছে করেই শহর থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়ে তারা আমাদের আটকায়। মিছিলের সামনে ছিলাম মেয়েরা। বড় ভাইয়েরা দ্রুত আমাদের পিছন দিকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করে। আর ঐ মুহূর্তেই পুলিশ সামনে চলে আসা ছেলেদের লাঠি আর রাইফেলের বাট দিয়ে মারতে শুরু করে। কয়েকজন রাস্তায় পড়ে যায়। ওদের বাঁচাতে আমরা রাস্তা থেকে খোয়া কুড়িয়ে মারতে গেলে আমাদেরকেও ধাওয়া করে ছোট অলি-গলির ভেতর নিয়ে যায়। সহজেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সবার থেকে। সাথে থাকা একজন বেশ আহত হয়েছিলেন। ওনাকে নিয়ে দৌড়ানোও সম্ভব হচ্ছিল না। একটা বাড়ির দরজা খোলা দেখে কিছু না ভেবেই ঢুকে পড়ি। সাথে সাথে গুলির আওয়াজ পাই। ঐদিন ওখানে পুলিশ দুইটা ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতেই খেয়াল করে দেখি, যে দশ-বারোজন আছি প্রাপ্তি আর মুনিয়া আপু বাদে কাউকে চিনি না। অথচ ঐ মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ওদের চেয়ে আপনজন আর কেউ নেই।

১৮ ই জুলাই ভায়নার মোড়ে শিক্ষার্থীদের অবস্থান ও মৎস্য ভবনের দিকে মিছিল। ছবি: নিশাত আহমেদ
মৎস্য ভবন এলাকায় পুলিশের হামলা। ছবি: জয়ন্ত জোয়ার্দার

ঐ এলাকার সমস্ত মানুষ ততক্ষণে জেনে ফেলেছে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের খুঁজছে। ভয় করছিলাম বাড়িওয়ালা তাড়িয়ে দেয় কিনা। অথচ একটা আন্টি এসে আমাদের নিয়ে গেলেন সবচেয়ে ভেতরের ঘরে। নিজেদের বিপদ হতে পারে জেনেও অজানা অচেনা ছেলে-মেয়েগুলোর জন্য তারা যে মায়া দেখিয়েছিলেন, কখনো ভুলবো না। আমাদের তখনো ঘোর কাটেনি। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পাওয়া ছেলেটা কাতরাচ্ছিল। ওর জন্য বরফ আনলো ঐ বাড়ির ছোট একটা বাচ্চা। আমাদের পানি খাওয়ালো। এদিকে পুলিশ বাড়ি বাড়ি খোঁজ করছে। আমরা আলো নিভিয়ে শব্দ না করে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। ছোট বোনটা স্কুল থেকে ফিরে একা একা কী করছে? প্রেমিক কোনদিকে গেল? ধরে ফেললে আশ্রয় দেওয়া এই আন্টির কী হবে? উনি বাইরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসছিলেন বারবার।

পুলিশ মোটামুটি চলে গেছে বলে মনে হলে আমরা দুই-তিনজন করে বের হতে থাকি। সবশেষে আমি আর মুনিয়া আপু বের হয়ে আরেকদফা সিভিল ড্রেসে থাকা ডিবি পুলিশের ধাওয়া খাই। এবার একটা আংকেল ছুটতে থাকা আমাদের নিজে ডেকে তাদের বাড়ি ঢুকতে বলেন। পরে জেনেছি, এই সংহতি সব জেলাতেই সাধারণ মানুষ জানিয়েছিলেন। বিনা ভাড়ায় রিকশাঅলারা ছাত্রদের পৌঁছে দিয়েছেন, স্লোগানে গলা মিলিয়েছেন। দোকানদার মিছিলে খাবার-পানি নিয়ে ছুটেছেন। পথে ছাত্রদের কষ্ট কমাতে গ্যারেজ থেকে পানি ছিটিয়ে দিয়েছে। এতদিন কেবল ছাত্র-জনতার এমন তীব্র একতার গল্প শুনেছি। জীবন দিয়ে তা দেখে ফেললে কী যে অদ্ভূত লাগে!

বাইরে বাকিদের সাথে কী হলো, জেনেছি বাড়ি ফিরে। কেউ আমাদের মতোই কোনো বাড়িতে উঠেছিল। কেউ দোকানে আশ্রয় নিয়েছিল। কেউ মেইনরোডের দিকে ছুট দিয়েছিল। আমার ক্লাসমেট এশা সামনে মিডিয়ার একজনকে দেখে বলতে থাকে যে পুলিশ কোনো নারী কনস্টেবল আনে নি, যেন-তেনভাবে মেয়েদের গায়ে হাত দিচ্ছে। ওকে তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করা হয়। ছেলেরা কতজন গ্রেপ্তার হয়েছে ঠিকঠাক জানতেও পারি না। থানায় পুলিশ প্রথমে ওদের বলে, আর আন্দোলনে আসবো না লিখে মুচলেকা দিলে ছেড়ে দেবে। কেউই রাজি হয় না। ওদের নামে পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর, আগুন লাগানো এসব অদ্ভূত কারণ দেখিয়ে মামলা হয়ে যায়।

আম্মু বাসায় ফিরে জানায়, সন্ধ্যায় তাদের অফিসে ছাত্রলীগের কর্মীরা উঠে ম্যানেজারের রুমে গিয়ে তার নামে বিচার দিয়েছে। তাকে ডেকে এনে বলেছে, ‘সরকারি চাকরিজীবীর মেয়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলনে গেলে আমাদের তো ব্যবস্থা নিতে হবে।’ আম্মুকে কী বলবো কিছুই বুঝছিলাম না।

এর ভেতর তীব্র মেজাজ খারাপ হলো প্রেসের লোকজনের ফোনে। শহরে এত এত সাংবাদিক, আমরা যখন মার খাচ্ছিলাম মাত্র ২-৩ জন ছিলেন। কয়েকজন আমার কাছে তথ্য চায় কী হলো আমাদের সাথে সকালে। যতদূর ঘটনা জানি বলে এটাও বললাম যে আমিই যদি সব তথ্য দিই আপনার আর কাজ কী! আপনি স্পটে কেন যান নি! তখন অবধি সারাদেশে ৫৬ জন শহীদের খবর পেয়েছি। নরসিংদীর তাহমিদ, ঐটুকু একটা বাচ্চা মরে গেল! ঢাকায় ফারহান, আমার ক্লাসে পড়া একটা ছেলে মরে গেল! তখন কি আর জানি লাশের সংখ্যা হাজার ছাড়াবে? রাত সাড়ে আটটার দিকে প্রথম আলোর মাগুরা প্রতিনিধি আশিক ভাই কল করে জানায় এশাকে জামিনে ছেড়েছে। কথা বলতে বলতেই নেটওয়ার্ক চলে যায়। তখনো বুঝিনি গোটা বাংলাদেশ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। কল্পনাও করতে পারিনি আগামী কয়েকদিন কী বীভৎস রাষ্ট্রীয় খুন চলবে।

১৯ জুলাই

সেদিন ছিল শুক্রবার। সকালে স্টেডিয়াম গেটে যাই। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির স্পটে। যার‌ কাছে যতটুকু খবর আছে শেয়ার করি। রাহাদ বলে, ‘এখন যদি মরেও যাই, কেউ জানতে পারবে না। আমরা পড়ি ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার ও নাম না জানা আরো অনেকে শহীদ হন। আবারও কত মানুষ এই ‘আরো অনেকে’র ভিতর হারায় যাবে।’ মাগুরার কয়েকজন মারা গেছিলেন অন্যান্য জায়গায়। লাশ আসার খবর পাই ঝাপসা। সত্যিই তখন সবার নাম জানার সুযোগ ছিল না।  

দুপুরে আমার প্রেমিক সোহানকে কল করি। কল ধরে তাজ ভাই। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে জানায়। ও গিয়েছিল আবৃত্তির ক্লাসে। ফেরার পথে সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে এলে ছাত্রলীগের ছেলেরা ধরে নিয়ে যায় ভেতরে। নেতা নির্দেশ দেয় পা ভেঙে দিতে, যাতে আর মিছিলে যেতে না পারে। বাধ্য কর্মীরা দশ-বারোজন মিলে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাঠি-হাত-পা সব চালায়। (এই সময়টার কথা লিখতে গিয়ে আমার এখনো থেমে যাওয়া লাগছে বারবার। আগাতে পারছি না। ভাবতেও পারছি না)। আমি গিয়ে দেখি ওর নিজের পায়ে হাঁটার শক্তিটুকু নেই। দুই পা ফুলে গেছে। হাত আর মাথায় জায়গায় জায়গায় কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। ও আমাকে খালি বলছিল, ‘কত মানুষ তো মরেই গেল, আমি কেবল মাইর খাইছি।’ কী ভয়াবহ একটা সময়ে দাঁড়ালে মানুষ কেবল বেঁচে আছে বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে! বারবার মনে হচ্ছিল আমার জন্যেই ওর সাথে এমন হলো। এইটুকু জীবনে এত অসহায় আমার আর কখনো লাগেনি। যেন একটা ডিস্টোপিয়ান সিনেমার ভেতর আটকে পড়েছি, যেটা থেকে আর বেরোতে পারব না।

বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে আবার অশান্তি হলো। তার অফিসের লোকজন ততক্ষণে তাকে প্রায় একঘরে করে ফেলেছে। আমার জন্য তার চাকরি নিয়ে সত্যি টানাটানি হলে কী হবে ভাবতে বললো। আমার মা সিঙ্গেল মাদার, তার উপার্জন দিয়েই সংসার চলে। বুঝতে পারছিলাম দুশ্চিন্তা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এত অস্বাভাবিক সময়ে কি এসব ভেবে ঘরে বসে থাকতে পারতাম? এদিকে ইন্টারনেট নেই। কোনো জায়গার খবর পাচ্ছি না। রাতে হঠাৎ শুনি কারফিউ জারি করে দিয়েছে! এরকম চললে রাস্তায় বসে গায়ে আগুন ধরায়ে দেবো ভাবতে থাকি। এইযে এক জুলাইয়ে এত ট্রমা খেলাম, বারবার সুইসাইডাল হয়ে গেলাম, এর বিচার কার কাছে চাই?

২০ জুলাই

সকালে হাওড়া থেকে অপূর্বদা কল করে। চমকে উঠি। নেটওয়ার্ক এত জঘন্য ছিল কিছুই প্রায় বলতে পারি না। তবু মনে জোর পাই, কাঁটাতারের ওপারেও কেউ কেউ আমাদের জন্য ভাবছে, লড়াইটা বুঝছে। কুষ্টিয়া ছাত্র ফ্রন্টের লাবণী আপু কল করেন। তাদের সাথে আমার কাটাকুটি হয়ে গেছে দুই বছর আগে। শুনলেন মাগুরার কী অবস্থা, এখন কী ভাবছি। পরদিন খবর পাই উনি গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন।

সকালে হাওড়া থেকে অপূর্বদা কল করে। চমকে উঠি। নেটওয়ার্ক এত জঘন্য ছিল কিছুই প্রায় বলতে পারি না। তবু মনে জোর পাই, কাঁটাতারের ওপারেও কেউ কেউ আমাদের জন্য ভাবছে, লড়াইটা বুঝছে।

এদিকে বিকাশ কাজ করছিল না অফলাইনেও। দ্রুত পাড়ার দোকানে ছুটি মোবাইল রিচার্জের কার্ড কিনতে। সেখানে একজন আন্টি চিল্লাতে থাকেন। তার ঘরে বাজার নেই, কাছে নগদ টাকাও নেই। বিকাশ না চললে এখন কী কিনবেন আর কী খাবেন! অন্যদিকে পাড়ারে এক আওয়ামী লীগ নেতা ঐদিন সকাল থেকেই গাড়ি গাড়ি বালি আনা শুরু করে। অসহ্য শব্দ ৫ মিনিট পরপর। খোঁজ নিয়ে জানি রাতারাতি সে কীভাবে যেন মেলা টাকা হাতে পেয়ে আরেকটা বাড়ি করা শুরু করেছে, একটুও তর সয় নি! কারফিউ তো আর তাদের জন্য না।

২১ জুলাই

প্রথমে মনে হচ্ছিল আজ উচ্চ আদালত রায় দিয়ে আন্দোলন চাপা দিয়ে ফেলবে। কিন্তু ৫% মুক্তিযোদ্ধা, ১% আদিবাসী, ১% প্রতিবন্ধী – এরকম ফাজলামি মেনে নেওয়ার মতো ছিল না। আমরা তৃতীয় প্রজন্মের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমাতে বলেছিলাম। তারা আদিবাসী আর প্রতিবন্ধী কোটাও কমিয়ে দিল। নারী কোটা তুলেই দিল। সবচেয়ে বড় কথা এত মানুষ খুন করে ফেলার পর কোটা দিয়ে আর কীসের কী?

বিকালে সাইকেল নিয়ে বের হয়ে মোশাররফ আংকেলের বাসায় চলে গেলাম। আংকেল বললেন, ‘তোরা যতটুকু পেরেছিস করেছিস। মন খারাপ না করে মাথা ঠাণ্ডা রাখ। এইবারের তীব্রতা ৯০’র থেকেও বেশি। এত সহজে কিছুই থামবে না।’ আংকেলের মেয়ে আত্মজার বয়স তখনও একবছর পুরো হয় নি। আমরা ওকে হাত মুঠো করে স্লোগান দেওয়া শিখাচ্ছিলাম। বেচারি আমাদের অত্যাচারে চিপসের প্যাকেট ধরেই ঝাঁকাতে শুরু করলো। এইটুকুতে এত হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমরা, ভাবছিলাম যেখানে যুদ্ধ চলে সেখানে মানুষ কীভাবে টিকে থাকে!

২২ জুলাই

ঢাকার খবর পেতে কাছে যতজনের নাম্বার ছিল টেক্সট করতে থাকি। নিজের চোখ-কান ছাড়া কারো কাছে কোনো অথেনটিক সোর্স নেই। টুকরো টুকরো খবর পাই রায়েরবাগে অলি-গলিতে ঢুকে পুলিশ গুলি করছে। যাত্রাবাড়ী আগুন হয়ে আছে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোঁড়া হচ্ছে। ঘরের ভেতর মানুষ মরে যাচ্ছে। সিলেট থেকে রাজনদা জানালেন ওখানে গতকাল ৬ জন মারা গেছে। রাজশাহীর খবর নিতে লগ্নকে কল করি, ফাহিমের কাছে খুলনার খবর চাই। সবাই একরকম কথা বলে।

মানুষ এভাবে মরে যাচ্ছে আর কিছুই করতে পারছি না! আমাদের ১৮ তারিখের সেই ছোট মিছিলের কথা মনে পড়ে। ওদের কেউ তখন জেলে, কেউ মার খেয়েছে, কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছে, কারো কারো সাথে যোগাযোগ করতেই পারছি না। আবার একসাথে পথে নামার কথা ভাবছিলাম কিন্তু সম্ভব হয়ে উঠছিল না কোনোভাবেই। মন বিষিয়ে যাচ্ছিল। রাতে দেখি বাড়িতে একটা মাত্র সিডি আছে। মৌসুমীদির (মৌসুমী ভৌমিক) শেষ অ্যালবাম, songs from 26H. ল্যাপটপের ধুলো ঝেড়ে চালিয়ে দিই। অন্ধকার ঘরে তিনটে প্রাণী শুনতে থাকে – ‘জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণাধারায় এসো।’

২৩ জুলাই

একাত্তরের দিনগুলিতে পড়েছিলাম জাহানারা ইমাম যুদ্ধের ভেতর শোকেসে উঠিয়ে রাখা সব ভালো থালা-বাটি বের করে ফেলেছিলেন। আজ আমার মাকে দেখলাম ঐ কাজ করতে। ফ্রীজে যা মাংস ছিল রান্না করে ফেলেছে। লুচি ভেজেছে। একবার আমায় তুমুল বকে যাচ্ছে, একবার জড়িয়ে ধরছে। মাথার ভেতর জমাট আতঙ্ক। মন যতটা অন্যদিকে রাখা যায়! দুপুরে আমিও বের করি একটা বই। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা। ‘জন্মভূমির বর্ণপরিচয়’ তখন নতুন করেই তো পড়ছিলাম। সবার চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল খুনীরা। আর স্বাধীন দেশে এই নরকে বসে আমরা নিজেদের বারবার বলছিলাম, ‘তুমি ভয় পাওনি’। বিকেলে হাঁটতে বের হই। কারফিউ চলছে, দেখে মনে হয় না। মাঝে-মাঝে রোবটের মতো অস্ত্র তাক করে টহল দেওয়া আর্মির গাড়ি চোখে পড়ে। রাস্তায় একজন বাবা তার মেয়েকে কোলে নিয়ে গান গাইছিলেন-আমরা সবাই রাজা। কী অদ্ভূতভাবে জুলাই ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে!

একাত্তরের দিনগুলিতে পড়েছিলাম জাহানারা ইমাম যুদ্ধের ভেতর শোকেসে উঠিয়ে রাখা সব ভালো থালা-বাটি বের করে ফেলেছিলেন। আজ আমার মাকে দেখলাম ঐ কাজ করতে। ফ্রীজে যা মাংস ছিল রান্না করে ফেলেছে। লুচি ভেজেছে। একবার আমায় তুমুল বকে যাচ্ছে, একবার জড়িয়ে ধরছে। মাথার ভেতর জমাট আতঙ্ক।

২৪-৩১ জুলাই

ইন্টারনেট পাওয়ার পর মনে হলো না পাওয়াই ভালো ছিল। যা জানছিলাম আর দেখছিলাম, স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। এত সহজে এত মানুষ মেরে ফেলা যায়! প্রতিদিন কোথাও না কোথাও গুলি চলে, হাসিনা সম্ভবত দেশের সব এলাকার মানুষের রক্ত টেস্ট করে দেখতে চাইছিল। আর আমরা প্রতিদিন আক্ষেপ করি মাগুরা এমন একটা সময়েও একদম চুপ হয়ে আছে। ততদিনে ছাত্র আন্দোলন গণ-আন্দোলন হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলো জড়িয়ে গেছে। কিন্তু মাগুরায় তারা কেউই সাহস করলো না নিজেরা আগে বেরোতে!

সারাদেশে পুলিশ রেইড দিচ্ছে তখন। দিনে গড়ে হাজারখানেক লোক গ্রেপ্তার হচ্ছে। মাগুরাতে দুইজন এইচ এস সি পরীক্ষার্থী জেলে, পরীক্ষা দিতেও তাদের জামিন দেবে না। আমাদের ক্লাসমেট নিশাত গ্রেপ্তার হয় বাড়ি থেকে। ঘরে বসে অসহ্য ধরে গেলে আমরা দেয়াল লিখতে যাই। মারিয়া, প্রিয়ন্তী, অথৈদি রাত জেগে কলেজপাড়ার দেয়ালগুলো বদলে ফেলে। এক বিকেলে আমি, প্রান্ত, চৈতী আমাদের স্টেডিয়ামপাড়ার অলি-গলিতে লিখি।

৩০ জুলাই বয়েজ স্কুলের দেয়ালে লেখার সময় সিয়াম (রাবি), সিফাত (যবিপ্রবি), মুন্না (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়) আর সানি (রাজেন্দ্র কলেজ) নামের চারজনকে ছাত্রলীগ ধাওয়া করে ধরে ফেলে। তাদের গ্রেপ্তার করে আবার সেই পুলিশের উপর হামলার মামলা দেওয়া হয়।

৩০ শে জুলাই মাগুরা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে এই দেয়াল লিখনের পর ছাত্রলীগ তাড়া করে চারজনকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। ছবি: নাফিসা নাওয়ার।

৩১ জুলাই সকালে বাম গণতান্ত্রিক জোট চৌরঙ্গীর মোড়ে শোক মিছিল ডাকে। ওদের লোকবল বরাবর কম। নয়-দশ জন যেতেই পুলিশ বাজেভাবে ব্যানার কেড়ে নেয়। দাঁড়াতেই দেয় না। পরেরদিন সারাদেশে শহীদদের স্মরণে একটা কর্মসূচী দেওয়া হয়। আমরা ঠিক করি যতটুকু লোকবল আছে তাই নিয়েই পথে কিছু একটা করবো, আর বসে থাকা যাচ্ছে না! রাতে আলাপ করে ঠিক করি গানের মিছিল হবে।

৩১ শে জুলাই চৌরঙ্গী মোড়ে বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা সমাবেশ ভণ্ডুল করতে পুলিশ ব্যানার কেড়ে নিয়ে হেনস্থা করে। ছবি:সাঈদুর রহমান

১লা আগস্ট

বিকেলে প্রথমে চলে যাই মেঘলার বাড়ি। আমাদের বন্ধু রাইসা আসে ঢাকা থেকে। জীবনে প্রথম টিয়ার শেল-সাউন্ড গ্রেনেডের ভেতর পড়ার গল্প করে। পথে বেরিয়ে বুঝি যতজন আসতে চেয়েছিল আসবে তার অর্ধেক। থানার সামনে দিয়ে ছাত্রলীগের মিছিল যেতে দেখি। আমরা সবমিলে ৩০ জন হলে ওরা হয়তো হবে ৩০০ জন। কোথায় দাঁড়াবো সেটা নিয়ে তখনো আমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। বড়রা কেউ কেউ বলেন আজ থাক, শহরে যখন ওরা দলবেঁধে এভাবে ঘুরছে। আমরাও জেদ ধরি। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান গাইবো। কী করবে এর জন্য?

জজকোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে পড়লে পথচারী কয়েকজনও আমাদের সাথে যোগ দেন। আমরা গাইতে থাকি। ওনারাও গলা মেলান। খানিক পরে প্রেসক্লাব থেকে একজন সাংবাদিক বেরিয়ে এসে বলেন, ‘তোমাদের আশ-পাশে সিভিল ড্রেসে ডিবি পুলিশ আছে। ঝামেলা করবে। দ্রুত চলে যাও।’ আমরা গাইতে গাইতে একসাথে চৌরঙ্গী অবধি যাই। বাড়ি ফেরার সময় ডিবি পুলিশ সিঁথি আপুদের ধাওয়া করে আটকে নাম-পরিচয় শুনে রাখে। রাইসা-মেঘলাদের পিছনেও একজন যেতে থাকে। ওরা জলদি এশার বাড়ি ঢুকে পড়ে। এই দেশে গান গাওয়াও তখন এমনই অপরাধ ছিল। রাগ হতে থাকে বাড়ি ফিরে, কেন মাত্র এই কয়টা মানুষ হোলাম! কেন কিছুই করতে পারলাম না!

২রা আগস্ট – ৩রা আগস্ট:

এক তারিখের ঐ ঘটনার পর আমাদের বাড়ি থেকেই অলিখিত কারফিউ দিয়ে দিল, আর বেরোনো যাবে না। দুই তারিখ ঢাকায় শহীদ মিনারে দ্রোহযাত্রায় মানুষের ঢল দেখে মনে হলো চোখ সার্থক! এত মানুষ একজোট হলে আমরা পারবো। নয় দফা থেকে বেরিয়ে ওখানেই প্রথম সরাসরি হাসিনা সরকারের পদত্যাগ চাওয়া হয়। এরপরেও তারা থামলো না। আবার গুলি চললো, আবার মানুষ মরলো। এই দুইদিনে হঠাৎ করে মাগুরাতেও কিছু একটা হলো। জুলাই ভর নীরবতা শেষে সবাই দেখি বেরোনোর পরিকল্পনা করছে।

সবদিক খোঁজ-খবর করে দেখি ৪ তারিখ ভায়না আর পারনান্দুয়ালী ব্রিজ, কাছাকাছি দুইটা জায়গায় দুইটা আলাদা সমাবেশের আলাপ চলছে। তখন অনলাইন গ্রুপগুলোতে পাঁচজন সমন্বয়কের নাম ঘুরছিল। অফিসিয়াল কমিটি না, কাজ চালানোর জন্য কাউকে দায়িত্ব নিতে হয় তাই। আমার পরিচিত রাবির জাকারিয়া ভাইকে দেখলাম ঐ লিস্টে। ওনার কাছে শুনলাম ঘটনা কী। জানালেন, পারনান্দুয়ালী মূলত বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। তাই ছাত্রদল চাইছে ওখানে থাকতে। যাতে হামলা হলে সহজে শেল্টার পায়। আবার একই কারণে অনেকে ওদিকে যেতে চাইছে না। তাছাড়া ভায়না মাগুরা শহরের একদম মূল পয়েন্ট। এখন যেহেতু একেবারে বাঁচা-মরা প্রশ্ন, ক্যাচাল না করে দুইটা স্পটেই সমাবেশ হবে। বিএনপিপন্থী মানুষজন মূলত পারনান্দুয়ালীতে থাকবে। বাকিদের যার যেখানে ইচ্ছে যাবে। বুঝলাম, কেন দুই জায়গায় সমাবেশ।

এরপর বামজোটের খবর নিলাম বাসদের শম্পা বসুর কাছ থেকে। তারাও ৪ তারিখ সমাবেশ করতে চাইছিল শহরের ভেতর অন্য আরেক জায়গায়। আগের দিন ওনাদের যেভাবে হেনস্তা করেছে পুলিশ, সেটা ভেবে বললাম অল্প কয়েকজন আলাদা দাঁড়িয়ে বিপদে না পড়ে আমাদের সাথে ভায়না থাকতে। রাজি হলেন। আমাদের পরিকল্পনা তো সব হলো। তিন তারিখ শহরের জামরুলতলায় আওয়ামী লীগও ঘোষণা দিয়ে বড় একটা মিটিং ডাকলো। কাল কীভাবে আমাদের ‘আপ্যায়ন’ করবে সেই আলাপ করতে। রাতে ছাত্রলীগের ছেলেরা রাখ-ঢাক না রেখে সরাসরিই হুমকি দিতে থাকলো অনলাইনে। এসব দেখে ঠিক করি বাড়িতে কোনোভাবেই কিছু বলা যাবে না। কোনো প্রস্তুতির বিষয় নেই সেদিন। ততদিনে জেনে গেছি বেরিয়ে পড়ার পর আর ভয় লাগে না।

৪ঠা আগস্ট

সকালে অপেক্ষা করি মা কখন বের হবে। আজ তাকে জানিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। নতুন কেনা বাটন ফোনে অল্প কয়েকটা নাম্বার সেভ করে নিই। বেরোনোর আগে প্রেমিককে কল দিয়ে বলি গোসল করতে যাচ্ছি, যাতে অন্তত কিছুক্ষণ খোঁজ-খবর না করে! কেউ চিন্তায় পড়ে আটকে দিক, চাইছিলাম না। ছোটবোন ছিল বাড়িতে। এমনিতে সারাদিন আমরা ঝগড়া-মারামারি করি। যেন কেউ কাউকে দেখতেই পারি না। ঐদিন মেয়েটা প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে যায় বেরোনোর সময়। জড়িয়ে ধরে রেখে দেয় কিছুক্ষণ।

বেরোনোর পর পাড়ার আংকেল-আন্টিরাই প্রথম আটকে দিল। বললো শহরের ভেতর খুব মারামারি হচ্ছে, সোজা বাড়ি যাও। ওদের বোঝানো গেল না। সবাই ভয় পেয়ে ছিল। বাড়ি ফিরছি বলে অন্য গলিতে ঢুকে একটা রিকশা পাই। রিকশাঅলা নিয়ে যান যতদূর সম্ভব। পুলিশ মেইনরোড আটকে আড়াআড়ি বসে ছিল। কিছুই চলতে দিচ্ছিল না। ভেতর দিয়ে হেঁটে কলেজপাড়ার দিকে যাই। পথে কয়েকজনকে দেখি হাত-পা-মাথায় রক্ত মাখা অবস্থায় উল্টোদিকে ছুটছে। ঐ এলাকার লোকজনও সামনে আগাতে নিষেধ করেন। কী করি, কোনদিকে যাই, কিছুই বুঝছিলাম না।

কলেজের পিছনে এসে দেখি এক দিদি দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো ওনার কেউ আহত হয়েছে। আমাকে বলতে থাকেন, ‘তুমি গেলে আমাকেও সাথে নিয়ে যাও। আমার ছোট একটা বাচ্চা, বাসায় ঘুম পাড়ায়ে রেখে আসছি। একা একা আছে বাচ্চাটা। এখানে এসে আটকা পড়ছি। যদি না যেতে পারি…’ কথা শেষ করতে পারেন না কান্নার জন্য। সম্ভবত ওনার মনে পড়ছিল আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো কীভাবে ঘরের ভেতরেও গুলি খেয়ে মরে গেছে। আমরা কেউ কাউকে চিনি না। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরলেন। দুইজন একসাথে আগাতে থাকলাম। আতর আলী রোডে এসে ওনার যাওয়ার একটা ব্যবস্থা হলো‌।

‘তুমি গেলে আমাকেও সাথে নিয়ে যাও। আমার ছোট একটা বাচ্চা, বাসায় ঘুম পাড়ায়ে রেখে আসছি। একা একা আছে বাচ্চাটা। এখানে এসে আটকা পড়ছি। যদি না যেতে পারি…’ কথা শেষ করতে পারেন না কান্নার জন্য। সম্ভবত ওনার মনে পড়ছিল আমাদের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো কীভাবে ঘরের ভেতরেও গুলি খেয়ে মরে গেছে।

শহরের ভেতর দেখি একদম ঠাণ্ডা পরিবেশ। ছাত্রলীগ কলেজের সামনে যেখানে জটলা করে থাকতো, পুরো খালি। তখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে ছিঁটেফোটা। পৌরসভার সামনে দাঁড়ালাম। এমনিই চোখে কম দেখি। পানি লেগে চশমার কাঁচ আরো ঝাপসা হয়ে গেল। দূর থেকে অস্পষ্ট মনে হলো ভায়নায় অনেক মানুষ জমেছে। এমন সময় কল দিলেন বাসদের শম্পা বসু আন্টি। মনে পড়লো, আমার তো বামজোটের ওনাদের সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা। কাছাকাছি এক দোকানেই ছিলেন নয়-দশ জন। ভায়না গেলাম একসাথে।

ঐদিন ছোট-বড় সবাই পথে। তনয়া আমার মাথায় এক টুকরো লাল কাপড় বেঁধে দিল। প্রমি আপু এসে জড়িয়ে ধরলো। মাহাথির ভাইকে দেখলাম পাশে ছুটোছুটি করতে। আমাদের কলেজের ইমরান স্যার দেখলাম ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন। এক আন্টি বিস্কুটের প্যাকেট বিলি করছেন। আর একটা ছবি মনে গেঁথে আছে। কারো মাথা থেকে লাল কাপড় পড়ে গিয়েছিল পথে। ধুলো মেখে ছিল। নাবিল ভাই যত্নে ওটা তুলে নিলেন। ধুলো ঝেড়ে কাছে রাখলেন। আঠারো জুলাইয়ের পর ঐ প্রথম ভায়না এসে হাঁটতে আর ভয় লাগছিল না। পুলিশ-আর্মি-বিজিবির বিচ্ছিরি গিজগিজ দেখতে হচ্ছিল না। আমি আর তায়েবা আপু ঘুরে ঘুরে মানুষের ভীড়ে শুধু হেঁটেই বেড়ালাম কিছুক্ষণ।

একটা ছেলে তরতর করে বেয়ে উঠে সবচেয়ে উঁচু বিলবোর্ডের উপরে পতাকা টাঙিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল মাগুরা যেন মুক্ত হলো! জাতীয়তাবাদী আবেগ তো নেই। তবু কেমন যেন কান্না এলো লাল-সবুজ কাপড়টা উড়তে দেখে। লাল বৃত্তটা তো মানুষের দেয়া রক্তেরই প্রতীক। বারবার বারবার কেন যে রক্ত দিতে হয় আমাদের! এরপর রাস্তায় গোল হয়ে বসে আমরা স্লোগান দিচ্ছিলাম। তখন খবর এলো পারনান্দুয়ালীর ওদিকে পুলিশ-ছাত্রলীগ মিলে গুলি ছুঁড়ছে। ছাত্রদলের রাব্বি নামে একজন মারা গেছে। কীসের থেকে কী হলো! তাহলে এখানে বিন্দুমাত্র ঝামেলা না করে অন্যদিকে ওরা তাণ্ডব চালাচ্ছে! এতদিন দূরের কত খবর দেখছিলাম। কিন্ত আমার থেকে মাত্র দশ মিনিট দূরত্বে একটা জলজ্যান্ত মানুষ লাশ হয়ে গেল, মেনে নিতেই পারছিলাম না।

একটা ছেলে তরতর করে বেয়ে উঠে সবচেয়ে উঁচু বিলবোর্ডের উপরে পতাকা টাঙিয়ে দিল। মনে হচ্ছিল মাগুরা যেন মুক্ত হলো! জাতীয়তাবাদী আবেগ তো নেই। তবু কেমন যেন কান্না এলো লাল-সবুজ কাপড়টা উড়তে দেখে। লাল বৃত্তটা তো মানুষের দেয়া রক্তেরই প্রতীক। বারবার বারবার কেন যে রক্ত দিতে হয় আমাদের!

পুলিশ ভায়নার দিকে আসতে থাকে কিছুক্ষণ পর। আমরা আপত্তি করলেও ছেলেরা আবার আগের দিনের মতো মেয়েদের পিছন দিকে সরে চলে যেতে বলে। আর ঐ এলাকার লোকজন সেদিন নিজেরাই বের হয়ে এসে আমাদের তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চায়। স্পটে যখন থাকতে দিচ্ছে না, তখন কারো বাড়ি লুকিয়ে থাকতেও ইচ্ছে হয় না। তায়েবা আপুর বাড়ি ছিল শহরের উল্টোদিকে। তাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার বাসায় চলে আসি। এরপর সারাদিন শুধু একেকটা মৃত্যুর খবর। পারনান্দুয়ালীতে গুলি লাগা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফরহাদ পরে মারা যায়। পাশের উপজেলা মুহম্মদপুরে থানা-ঘেরাও করেছিল মানুষ। ওখানে পুলিশ গুলি করলে সুমন আর আহাদ নামে দুইজন ছাত্র মারা যায়। আহাদের বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। ঐদিন সারাদেশে পুলিশ আর লীগ মিলে শখানেক মানুষ খুন করে। লাশের সংখ্যা গুনতে গুনতে ক্লান্ত হয়ে যাই। সন্ধ্যায় আবার কারফিউ জারি হলো। মা ফিরে জানালো আজ তাদের অফিসে কারা ইট ছুঁড়েছে, সেজন্যেও তাকে কথা শুনিয়েছে। এসব ঝুট-ঝামেলা নাকি আমার জন্য। তাকে বলি আর একটা দিন ধৈর্য ধরতে। কাল একটা শেষ ফয়সালা তো হবেই!

৪ঠা আগস্ট পারনান্দুয়ালী ব্রিজের একপাশ থেকে অপরপাশে থাকা আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা।পরে এখানেই দুইজন শহীদ হন। ছবি: আবদুল আজিজ

৫ই আগস্ট

সারারাত অসহ্য দুশ্চিন্তায় ঘুম হলো না। নিউজফিড স্ক্রল করছিলাম পাগলের মতো। ছেলে-মেয়েরা ফোনের ওয়ালপেপারে নিজেদের নাম-ঠিকানা দিয়ে রাখছিল। যাতে মরে গেলে লাশ পরিবারের কাছে দিতে সহজ হয়। কিছু ভাবতে পারছিলাম না আর। ভোরে পাড়ার তিশা আপু নক দিয়ে বললো, ‘চল হেঁটে আসি। আজকের পর হয় আমরা সেই আগের মতো স্বস্তি নিয়ে বাইরে বের হবো নাইলে আর কখনো পারবো না।’ ১৮ জুলাই তারা দুই বোন মিছিলের জন্য বেরোনোর পর পাড়ার আওয়ামী লীগ নেতার নজরে পড়ে যায়। একদম প্রতিবেশী হওয়ায় সে বাড়ি গিয়েই হুমকি দিয়ে আসে আর না বেরোতে। আমরা হেঁটে মেইনরোডে উঠলাম। রাস্তা জুড়ে তখনো ভাঙা কাঁচ, পোড়া গাড়ির টুকরো, লাঠি-সোটা পড়ে আছে।

ভায়না পৌঁছানোর আগেই দেখলাম বিজিবির বেশ কয়েকটা গাড়ি শহর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। গাড়ির উপর বিছানা-বালিশ দড়ি দিয়ে বাঁধা। ওটা দেখে নিশ্চিত হলাম টহল দিতে বের হয়নি, একবারে চলে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ নাকি সব ফোর্স একসাথে ঢাকায় মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? আতঙ্কে আবার বুক কাঁপতে শুরু করলো। এদিকে বাড়ি ফিরে দেখি, মা ঘুম থেকে উঠে না পেয়ে চিন্তায় আধমরা হয়ে গেছে। তাকে শান্ত করলাম। ঢাকায় কয়েকলাখ মানুষ পথে বেরিয়ে গেছে এতটুকু জানা গেল। ইন্টারনেট চলে যেতেই আতঙ্ক তীব্র হলো। আর কত লাশ পড়বে! দুপুরের পর শুনি হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছে। প্রথমেই ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘তোমার আর চিন্তা নেই’।

তখনো অনেক বড় বড় সমস্যা রয়ে গেছে। দেশ সামরিক শাসনে চলে যাবে না অন্তবর্তী সরকার হবে? হলে কারা দায়িত্ব নেবে? গণঅভ্যুত্থানে পথে নেমেছিল নানা মতাদর্শের মানুষ। এখন তারা নিজ নিজ চিন্তার জায়গা থেকে আলাদা হয়ে পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। এতসব জটিল জিনিসের ভেতর আমার শুধু মনে হতে থাকে, তাহলে আবার সাইকেল নিয়ে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ইচ্ছেমতো চক্কর দিতে পারবো! পুলিশ ধরে ফোন চেক করবে না। কলেজের মাঠে গোল হয়ে বসে আবার গান গাইতে পারবো। ছাত্রলীগ আমাদের ধরতে তেড়ে আসবে না। মিছিলের ক্লিপ দেখে যে লিস্ট বানিয়েছিল, তা আর কাজে লাগবে না। জেলে থাকা ছেলেগুলো ছাড়া পাবে। এতটুকু চাওয়ার জন্য কত কত মানুষ মরে গেল!

আমার শুধু মনে হতে থাকে, তাহলে আবার সাইকেল নিয়ে শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ইচ্ছেমতো চক্কর দিতে পারবো! পুলিশ ধরে ফোন চেক করবে না। কলেজের মাঠে গোল হয়ে বসে আবার গান গাইতে পারবো। ছাত্রলীগ আমাদের ধরতে তেড়ে আসবে না। মিছিলের ক্লিপ দেখে যে লিস্ট বানিয়েছিল, তা আর কাজে লাগবে না। জেলে থাকা ছেলেগুলো ছাড়া পাবে। এতটুকু চাওয়ার জন্য কত কত মানুষ মরে গেল!

মাগুরা শহরের কলেজ পাড়ার দেয়ালে জুলাইয়ের দেয়াল লিখন। ছবি: শায়েখ উদ্দীন সোহান

বিকেলে বেরিয়ে আবার মন খারাপ হলো। একদল খুনী খুন করে পালিয়ে গেছে। আরেকদল সাথে সাথে সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে যেখানে-সেখানে আগুন ধরাচ্ছে। ভাঙচুর করছে। দেশে তখন সরকার বা প্রশাসন কিছুই নেই। পুলিশ আটকাবে কী, নিজেরাই পালিয়েছে। সেনাবাহিনী সেরকম রেসপন্স করছে না। সাধারণ মানুষই কেউ ভাঙচুর করছে, কেউ আগলে রাখছে। কেউ হামলা করছে, কেউ পাহারা দিচ্ছে। সন্ধ্যার পর তিশা আপু চলে এলো বাসায়। বেরোলাম। কিছুই ভাল্লাগছিল না। অন্তত আমাদের পাড়ায় যেন কেউ কোনো ঝামেলা করতে না পারে, সেই আলাপ করলাম বড়দের সাথে। অবশ্য ভাবিওনি হাসিনা গেলেই সব মিটে যাবে। আমাদের জুলাই তো শেষ হয় না আসলে। হেঁটে যেতে হয় নতুন নতুন মিছিলে, পুরনো বন্ধুদের সাথে আরো অনেক নতুন মানুষের সাথে জুড়ে। যে দেশ, যে দুনিয়া আমরা চাই, তা তো এখনো বহুদূরের পথ।

নাফিসা নাওয়ার নিঝুম: উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থী, মাগুরা। ইমেইল: nafisanaowar.mgghs.3.14@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •