জুলাই আন্দোলন: কালার রেভল্যুশন, রেভল্যুশন নাকি গণ-অভ্যুত্থান?

জুলাই আন্দোলন: কালার রেভল্যুশন, রেভল্যুশন নাকি গণ-অভ্যুত্থান?

মোশাহিদা সুলতানা

শিক্ষার্থী জনতার গণঅভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া ছাপিয়ে বিশ্ব জুড়েই তা এক বড় আলোচনা বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সেই বিতর্কের একটি মুখ্য বিষয় এই লেখায় পর্যালোচনা করা হয়েছে।

১। ভূমিকা

ভারতীয় গণমাধ্যমসহ দেশে ও দেশের বাইরে কেউ কেউ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ‘কালার রেভল্যুশন’ বলছেন। কালার রেভল্যুশন বলতে সাধারণত সেসব বিপ্লবকেই বোঝানো হয়, যেসব বিপ্লবে সরকারবিরোধী শক্তিগুলো বহিঃশক্তি (বিদেশি অর্থায়নে এনজিও, মিডিয়া, গণতন্ত্র সহায়তাদানকারী সংস্থা) দ্বারা প্রভাবিত হয়, আন্দোলনকারী শক্তি অবৈধ ভোটে নির্বাচিত শাসক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দিয়ে পরিচালিত হয় ও বিদেশি রাষ্ট্রসমর্থিত দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় আন্দোলনে নামে।

‘কালার রেভল্যুশন’ শব্দবন্ধ মূলত সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোর জন্য ব্যবহার করা হয়, যেখানে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং পরবর্তী সময়ে শাসক পরিবর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যারা এই রেভল্যুশনগুলোকে কালার রেভল্যুশন বলে মনে করেন, তারা বিশ্বাস করেন যে এই রেভল্যুশনগুলোর ক্ষেত্রে শাসক পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। (Stewart 2012) ২০০০ সালে সারবিয়ার বুলডোজার রেভল্যুশন, ২০০৩ সালে জর্জিয়ার রোজ রেভল্যুশন, ২০০৪ সালে ইউক্রেনের অরেঞ্জ রেভল্যুশন এবং ২০০৫ সালে কিরগিজস্তানে টিউলিপ রেভল্যুশনকে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সফল রেভল্যুশন হিসেবে দেখা হয়। এসব বিপ্লব সম্পর্কে রাশিয়ার ব্যাখ্যা হচ্ছে: এগুলোর পেছনে মূলত মার্কিন চক্রান্ত রয়েছে। আন্দোলনের সফলতার পেছনে রয়েছে এনজিওর ভূমিকা, তরুণদের মধ্যে পশ্চিমা লিবারেল ডেমোক্রেসির প্রতি ঝোঁক, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো সম্প্রসারণ নীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যমের প্রভাব। (Mitchell 2012)

ভারতীয় মিডিয়া (Rodigues 2024, Akya 2024) বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে ‘কালার রেভল্যুশন’ আখ্যা দিতে গিয়ে এর সঙ্গে আরও কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত একটি লেখার কথা উল্লেখ করা যায়। ৮ আগস্ট ২০২৪-এ এশিয়ান টাইমসে প্রকাশিত ‘Bangladesh as Color Revolution on India’s Doorstep’ শীর্ষক প্রবন্ধের লেখক Akya Chan বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানকে ইউরোপের বিভিন্ন কালার রেভল্যুশন এবং ‘আরব বসন্ত’ আন্দোলনের উদাহরণগুলোর সঙ্গে তুলনা করে কয়েকটি কারণ দেখিয়ে বিশ্লেষণ করেন:

১) একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের কারণে গণবিক্ষোভ শুরু হয়, যা সরকার সাধারণত একটি ছোট ও সাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করে। ২) একাধিক সামাজিক গোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণ; বিক্ষোভ প্রথমে সাধারণত তরুণদের নেতৃত্বে শুরু হলেও শিগগিরই সমাজের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ৩) প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য ব্যবহার, বিশেষ করে যোগাযোগের জন্য বিভিন্ন এনক্রিপটেড বা সুরক্ষিত অ্যাপের ব্যবহার হয় (যেখানে বিদেশি রাষ্ট্রের সহায়তা থাকতে পারে বা না-ও থাকতে পারে)। ৪) আন্দোলনের তহবিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা এবং এনজিওর নতুন করে খোলা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে আসে। ৫) আন্দোলনে মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক খবর প্রচারিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে তরুণীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে এমন গ্রাফিক ছবি এবং মানুষের দেহ ক্ষতবিক্ষত করা বা টুকরো টুকরো করে ফেলার ছবি বা ভিডিও ইত্যাদি।

ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে বিভিন্নভাবে আধিপত্য কায়েম করে। হাসিনার শাসনামলে ভারতের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত হত্যা, ট্রানজিট, পানি বণ্টন, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে আধিপত্যবাদী নীতি চর্চা করেছে, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তা অনিশ্চয়তা ও হুমকির মুখে পড়েছে। এ কারণেই বাংলাদেশের তরুণদের এই বিজয়কে অবমূল্যায়ন করার অংশ হিসেবে ভারতীয় মিডিয়া আন্তর্জাতিক প্রভাবকে আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছে। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও একই বক্তব্য প্রচারে আগ্রহী। কারণ, এর মাধ্যমে তরুণদের আকাঙ্ক্ষাকে অবমূল্যায়ন করা যায় এবং আওয়ামী লীগ সরকার পতনের অভ্যন্তরীণ কার্যকারণগুলোকে আড়াল করে বিদেশি ষড়যন্ত্রের ফলাফল হিসেবে হাজির করা যায়।

অন্যদিকে কিছু বিষয় যেমন: ডক্টর ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনটন প্রশাসনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ডক্টর ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে গ্রহণ করা, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল এন্ডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রায়সির (এনইডি) অর্থায়নে চালিত সুইডেনভিত্তিক নেত্র নিউজে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও নিপীড়নের সংবাদ প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ২০২১ সালে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারের একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ, ঐতিহাসিকভাবে এনজিও তৎপরতার ধারাবাহিকতা, অন্তর্বর্তী সরকারে এনজিও কর্মীদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা মনোনয়ন, বাইডেনের সঙ্গে ডক্টর ইউনূসের একান্ত সাক্ষাৎ, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস কর্তৃক মাহফুজ আলমকে আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে পরিচয় করিয়ে দেওয়া–এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের নিদর্শন হিসেবে মনে হওয়ার যথেষ্ট কারণ তৈরি করেছে।

কালার রেভল্যুশন যদি বহিঃশক্তির প্রভাবের সমার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে: জুলাই অভ্যুত্থানকে কালার রেভল্যুশন বলার পক্ষে ও বিপক্ষে উভয় দিকেই বক্তব্য রয়েছে। তবে সেগুলো কতটা যুক্তিযুক্ত তার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। লক্ষণগুলো আসলে কতটুকু পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তিগুলোকে গ্রহণ বা খারিজ করতে সক্ষম, তা নির্ভর করে এগুলো একটা আরেকটার চেয়ে কতটা বেশি গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য তার ওপর। আমি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সে সময়ের ঘটনা বিশ্লেষণে নিজের স্মৃতি ও নোট থেকে অনেক কিছু উল্লেখ করেছি। আবার বেশ কিছু স্থানে সংবাদমাধ্যমের তথ্য ব্যবহার করেছি। অভ্যুত্থান-পরবর্তী বিভিন্ন সংলাপে উপস্থিত থেকে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য থেকে নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আলোচনায় এনেছি।

এই প্রবন্ধে বেশ কিছু প্রশ্ন চিহ্নিত করে এর উত্তর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছি কেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্বপরিকল্পিত হতে পারে না এবং শুধু বহিঃশক্তি নয়, যে কোনো একক শক্তি যেমন: জামায়েত ইসলামি বা বিএনপির পক্ষে এককভাবে এর মূল পরিকল্পনাকারী হওয়া সম্ভব ছিল না। প্রথমেই আন্দোলনের পটভূমি বিশ্লেষণ করে চিহ্নিত করেছি কোন কারণগুলো সংস্কারবাদী কোটা আন্দোলনকে বিদ্রোহে রূপান্তরিত করেছিল, যা দু-মাসের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিকে পরিচালিত করেছিল। দ্বিতীয়ত দেখিয়েছি, এই আন্দোলন কি আসলেই কোনো মাস্টারমাইন্ড দিয়ে পরিকল্পনা করা সম্ভব ছিল। এনজিও বা বিদেশি অর্থায়ন কি আসলে এখানে কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম ছিল? তৃতীয়ত দেখিয়েছি, সশস্ত্র বাহিনী কেন ও কীভাবে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। চতুর্থত দেখিয়েছি, কোন পর্যায়ে গিয়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এবং শেষে অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ও কার্যক্রম কেন ছয় মাস পর্যন্ত এই অভ্যুত্থানকে একটি রেভল্যুশন বলতে ব্যর্থ হয়েছে। এই কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করে দেখাব কেন জুলাই আন্দোলনকে কালার রেভল্যুশন বা রেভল্যুশন কোনোটিই বলা যায় না।

এই প্রবন্ধে বেশ কিছু প্রশ্ন চিহ্নিত করে এর উত্তর বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছি কেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পূর্বপরিকল্পিত হতে পারে না এবং শুধু বহিঃশক্তি নয়, যে কোনো একক শক্তি যেমন: জামায়েত ইসলামি বা বিএনপির পক্ষে এককভাবে এর মূল পরিকল্পনাকারী হওয়া সম্ভব ছিল না।

২। পটভূমি থেকে উত্থিত প্রশ্ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে একটি গণবিদ্রোহের কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়।

২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে ২০১৮ সালের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাতিলকৃত ‘কোটা ব্যবস্থা’ পুনর্বহাল করা হলে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এই কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য সরকারি চাকরির ৩০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হতো। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ছিল: স্বাধীনতা যুদ্ধের ৫০ বছর পর এটি একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে, যা সরকারি চাকরিতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ কার্যক্রমকে দুর্বল করে দিয়েছিল। কোটার অপব্যবহার কার্যত আওয়ামী লীগের সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষকতা বণ্টন করার একটি কৌশলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। যদিও প্রাথমিকভাবে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল এই অন্যায্য কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পরবর্তী ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে এই সংস্কারবাদী আন্দোলনই গণবিদ্রোহে রূপান্তরিত হয়।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়করা এবং বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে দেওয়া একটি বহুল প্রচারিত বক্তৃতায় অধ্যাপক ইউনূস এই আন্দোলনকে একটি ‘নিখুঁতভাবে পরিকল্পিত অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেন এবং মাহফুজ আলম নামের একজন ছাত্র সমন্বয়ককে এর ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।

যদিও এই বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া উচিত নয়। কারণ, এটি একটি আলংকারিক বক্তৃতার অংশ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। তবে এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তৈরি হয়। এই বিদ্রোহ কি কোনো ‘মাস্টারমাইন্ড’ দ্বারা নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করা যেতে পারে? অভ্যুত্থানের সময় পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিক্ষার্থীদের পরিকল্পনা, সমন্বয় এবং কৌশলগুলোর প্রকৃতি কি আগে থেকে পরিকল্পনা করার মতো বিষয় ছিল? কেন অন্যান্য গোষ্ঠী ও শ্রেণি-পেশার মানুষ ছাত্রদের সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন, যার মধ্য দিয়ে এটি একটি গণবিদ্রোহে পরিণত করেছিল? বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী হাসিনাকে সমর্থন না করে কেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল? আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দুর্বল হওয়ার পেছনের কারণগুলো এখানে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

৩। কেন এই গণ-অভ্যুত্থান পূর্বপরিকল্পিত হওয়া সম্ভব ছিল না

৩.১। ঘটনার সূত্রপাত করেছেন শেখ হাসিনা নিজেই

১৪ জুলাই একটি অপ্রয়োজনীয় উসকানিমূলক বক্তৃতায় শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের বদলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করা রাজাকারদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের সরকারি চাকরি দেওয়া উচিত কি না। এই কথার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বংশধর বলে যে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল, তা তাদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

তারা তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল থেকে হাসিনা ও আওয়ামী লীগ কর্তৃক নিয়মিতভাবে বিরোধীদের এই ধরনের রাজনৈতিক লেবেলিং ও ট্যাগিং করার চর্চাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ‘ঠিক আছে, আমরা রাজাকার কিন্তু আপনি স্বৈরাচার বলেই আমাদের রাজাকার বলছেন’–এ রকম অর্থ তৈরি করে স্লোগান দেয়: ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’

শেখ হাসিনার এই উসকানিমূলক মন্তব্য এবং তার বিপরীতে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পূর্বপরিকল্পিত হতে পারত না। এই স্লোগানের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গর্ব করে বলেন, ছাত্রলীগ এই প্রতিবাদ আন্দোলন দমন করার জন্য যথেষ্ট। (প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪) ছাত্রলীগের প্রতি মূল দল আওয়ামী লীগের এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে আক্রমণ করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগের নৃশংস হামলার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ছাত্র-কর্মীদের এই আগ্রাসি বক্তব্য ও দমনমূলক পদক্ষেপের সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। প্রতিবাদকারী ছাত্রদের দ্বারা এগুলো পূর্বপরিকল্পিত হতে পারত না।

১৬ জুলাই ঢাকা শহর থেকে ৩০০ কিমি দূরে উত্তরবঙ্গের রংপুরে পুলিশের গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হন। তার অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পুলিশের বন্দুকের সামনে অকুতোভয় ভঙ্গিতে বুক পেতে দিয়ে পুলিশকে গুলি করতে আহ্বান জানানোর ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমতে থাকে। পুলিশের মুখোমুখি আবু সাঈদের ভাবমূর্তি আইকনিক হয়ে ওঠে, সাহসিকতার এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ সংক্রমিত হয় শিশু-কিশোর, তরুণ, বয়স্ক সবার মধ্যে। এই স্বতঃস্ফূর্ততাও পরিকল্পিত হতে পারে না।

সাহস ও আত্মত্যাগের এ ঘটনা সারা দেশে বহু মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাদের মধ্যে ছিলেন শ্রমিক এবং বিভিন্ন পেশার দরিদ্র মানুষ, যারা পরবর্তী রাস্তার লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবরে ও জনভাষ্য আয়োজিত বিভিন্ন সংলাপে আহত, নিহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং এলাকাভিত্তিক আন্দোলনকারীদের ভাষ্যে এই মানুষদের অংশগ্রহণের চিত্র বের হয়ে আসে। এই পুলিশি হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিক্রিয়ায় মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ পূর্বপরিকল্পিত হতে পারত না।

১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহতদের জন্য গায়েবি জানাজা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের ওপর পুলিশ এবং ছাত্রলীগ বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের এই হামলা থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় এবং শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসের ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে যেতে বলে। এই হামলার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত পদক্ষেপের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব উপায়ে ছাত্রলীগের কর্মীদের তাদের আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার করেছিল। এদিন অনেকেই ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাতারে যুক্ত হয়। এ ঘটনাটি রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এই ভারসাম্য বিনষ্ট করা পূর্বপরিকল্পিত হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, এই সবকিছু যেসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় হয়েছে তার পেছনে ছিল শেখ হাসিনা সরকার ও তার ঘনিষ্ঠদের প্ররোচনায় সংঘটিত সহিংসতা।

৩.২ অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণির অংশগ্রহণ পূর্বপরিকল্পিত হতে পারে না।

১৭ জুলাই ছাত্রলীগের কর্মীদের আবাসিক হল থেকে বের করে দেওয়া এবং বহু ছাত্রলীগ কর্মী একযোগে ছাত্রলীগ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করায় শেখ হাসিনা সরকার যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়। এদিনের পর সরকার বুঝতে পারে ছাত্রলীগকে কাজে লাগিয়ে এই আন্দোলন দমন আর সম্ভব নয়। এর জবাবে হাসিনা সরকার ১৮ জুলাই পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী পাঠিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে ক্যাম্পাসের হল থেকে জোর করে বের করে দেয়। ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ছাত্র প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় ঘাঁটি ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সরকারের এই দমনমূলক পদক্ষেপে আন্দোলন সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এ ঘটনার প্রভাবে ছাত্র-আন্দোলনটি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। কেননা, এই বিপর্যয়ের মুখে সংঘবদ্ধ হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর পাশাপাশি উত্তরা, রামপুরা, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকার সাধারণ মানুষ আন্দোলনকারীদের সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দমন-পীড়ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মাদরাসার অনেক শিক্ষার্থীকে এই সংগ্রামে যোগ দিতে বাধ্য করেছিল। রাস্তায় বিক্ষোভকারী ছাত্ররা তাদের পরিবারের সদস্য এবং শিক্ষকদেরও তাদের সমর্থনে নিয়ে আসে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্র-ছাত্রী এবং দরিদ্র পরিবারের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ আন্দোলনে বহু শ্রেণির মানুষ যোগদান করতে এগিয়ে আসে। মানুষের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন, পুলিশের আগ্রাসি ভূমিকা এবং সাধারণ নিরস্ত্র মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন সহ্য করতে না পেরে মানুষের এই রাস্তায় আসা কোনো বহিঃশক্তির পক্ষে পরিকল্পনা করে করা সম্ভব ছিল না।

১৯ জুলাই থেকে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণে দমন-পীড়নের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সমাবেশ রোধ করতে সরকার দীর্ঘস্থায়ী কারফিউ ঘোষণা করে এবং ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের সমাবেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য সাঁজোয়া যান নামানো হয়। ১৯ তারিখ প্রায় চুরাশি জনের মৃত্যুর খবর আসে। (প্রথম আলো ২০২৪) কিন্তু ধারণা করা হয় আরও বেশি মানুষ সেদিন পুলিশের হামলায় নিহত হয়েছিল। কারণ, অনেক মানুষ চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরে মৃত্যুবরণ করেন। স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার আর কোনো পথ সেদিন সরকারের ছিল না। এদিন দেশের জনগণ আরও সংকল্পবদ্ধ হয়। এদিন তরতাজা আরও তরুণের মৃত্যুর খবর মানুষকে আরও বেশি ক্ষুব্ধ করে তোলে। সাধারণ মানুষ এর প্রতিক্রিয়ায় পাড়ায় পাড়ায় সংঘবদ্ধ হয়ে পথে বের হয়ে আসে।

পুলিশি নৃশংসতায় ব্যাপক হতাহতের প্রতিবাদে ১৯ জুলাই আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি জানানো হয়, যার মধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের পদত্যাগের দাবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২৬ জুলাই ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ) পুলিশ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে এবং পরবর্তী সময়ে একটি বিতর্কিত ভিডিও প্রকাশ করে। যেখানে দেখা যায় গ্রেফতার ছাত্রনেতারা আন্দোলন বন্ধের ঘোষণা দিচ্ছেন। এই সন্দেহজনক ভিডিও রেকর্ডিংকে বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি এবং অবশিষ্ট ছাত্রনেতা ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করে।

এর ফলে ছাত্রনেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে আন্দোলন বন্ধ করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং ১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনার ডাক দেওয়ার ভান করে হাসিনা সরকারের পুলিশি দমন-পীড়ন অব্যাহত রাখার কৌশল নিয়ে রাজনৈতিক পরিসরে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

নয় দফা দাবির মধ্য দিয়ে আন্দোলনটি কোটা সংস্কারের দাবি থেকে আরও বৃহত্তর রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলনে পরিণত হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: রাষ্ট্রীয় সহিংসতায় নিহত, আহত ও অপহৃত সবার জন্য ন্যায়বিচার আদায়ের আকাঙ্ক্ষা। ১৯ থেকে ২৯ জুলাই সময়ের মধ্যে আন্দোলনের প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মেট্রোরেল ও বিটিভিতে হামলা-পরবর্তী ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য দেখে শেখ হাসিনার আবেগাপ্লুত হওয়া এবং অন্যদিকে পুলিশি সহিংসতায় নিহতদের প্রতি অবহেলা জনমনে ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। কোটা সংস্কারের লক্ষ্য থেকে সরে এসে আন্দোলনের দিক পরিবর্তন হয় ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যের দিকে। এই আন্দোলন তখন আর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আন্দোলনের দিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। অবশেষে ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা পরিণত হয় শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফার দাবিতে।

পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিয়ে শহীদ হওয়া আবু সাঈদ জুলাই অভ্যুত্থানের একটি আইকনে পরিণত হয়। অগণিত মানুষ আবু সাঈদের সাহস থেকে অনুপ্রাণিত হয়। শিক্ষার্থীদের সংকল্প ও আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়ে শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় স্বল্প মজুরি ও ব্যাপক পুলিশ নিপীড়নের কারণে শ্রমিকদের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ।

দেশের মানুষ শেখ হাসিনা সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি, প্রতারণামূলক নির্বাচন ও অর্থনৈতিক সংকটে এমনিতেই বিক্ষুব্ধ ছিল। সরকারের অর্থনৈতিক নীতির কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ রকম একটা পরিস্থিতি শিক্ষার্থীরা যখন সব ধরনের হুমকি ও দমন-পীড়ন উপেক্ষা করে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, দেশের সাধারণ মানুষ তখন তাদের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে রাস্তায় নেমে আসে। এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করতে হলে শুধু সেই মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গ দেখলে চলবে না, তাদের এই অংশগ্রহণকে হাসিনা সরকারের আমলে ক্রমাগত নিপীড়ন, বৈষম্য, মর্যাদাহানির অভিজ্ঞতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ হিসেবেও দেখতে হবে।

এই আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণ ব্যাখ্যা করতে হলে শুধু সেই মুহূর্তের স্ফুলিঙ্গ দেখলে চলবে না, তাদের এই অংশগ্রহণকে হাসিনা সরকারের আমলে ক্রমাগত নিপীড়ন, বৈষম্য, মর্যাদাহানির অভিজ্ঞতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ হিসেবেও দেখতে হবে।

৩.৩ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দুর্বল হওয়ার পেছনে বহিঃশক্তির ভূমিকা নগণ্য

গণ-অভ্যুত্থানের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন আসলে কতটুকু সরকারি সুবিধা হাসিলের জন্য আর কতটুকু প্রকৃত অর্থে আদর্শিক কারণে ছিল, তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের তর্কে লিপ্ত থাকতে পারেন। তবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ও উন্নয়নের নামে লুটপাট বহুদিন ধরেই সরকারের ওপর অনাস্থার কারণ হয়েছিল। হাসিনা ও তার মন্ত্রীরা বহুদিন ধরেই কখনো জনগণকে হেয় করে, কখনো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের হেয় করে, কখনো সাংবাদিকদের হেয় করে, কখনো নিজ দলের কর্মীদের হেয় করে উসকানিমূলক বক্তৃতা দিতেন। যে কোনো সমস্যার দায়ভার অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, নিজেরা যে কোনোভাবে দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা–এগুলো বহুদিন ধরে মানুষের মধ্যে নানান ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। আবু সাঈদের বুকে গুলি করে এই সরকার আরও একবার প্রমাণ করেছিল যে সরকার জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার্থে নয়; বরং জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। এই অনুভূতি যদিও এর আগেও ছিল, এ ঘটনা নতুন স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। যার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন লোপ পেতে থাকে।

ছাত্র আন্দোলনের একটি সমষ্টিগত প্রভাব ধীরে ধীরে সাধারণ জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থনের অবসান ঘটায়। শুরুতে এই সমর্থন হ্রাসের লক্ষণগুলো স্পষ্ট না হলেও প্রথমে ছাত্রলীগ থেকে বিপুল পরিমাণ কর্মী-সদস্যের পদত্যাগ, দ্বিতীয়ত শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমজীবী মানুষ ও আইনজীবীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জনমনে প্রভাব সৃষ্টি করে। এরপর পুলিশ ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। পরের দিকে আন্দোলনের প্রতি সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থন শাসন ব্যবস্থার মধ্যে বিভাজন তৈরি করে দিতে সমর্থ হয়। এই সবকিছুর সম্মিলত প্রভাব শেখ হাসিনা সরকারের সমর্থনে গড়ে ওঠা সামাজিক ঐক্য ভেঙে দিতে সমর্থ হয়।

৪। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হাসিনাকে সমর্থন না করে কেন অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল?

আন্দোলনের ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে হাসিনা শাসনের পক্ষে-বিপক্ষে বড় ধরনের বিভাজন তৈরি হয়। বিমানবাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর জন্য তাদের হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে অস্বীকার করে বলে জানা গেছে। অন্যদিকে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের হেলিকপ্টারগুলো বিক্ষুব্ধ জনতার ঘেরাওয়ের মধ্যে আটকে পড়া পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করার পাশাপাশি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।

জানা গেছে, এই সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা কর্তৃক নিযুক্ত সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা হাসিনার সমর্থনে কাজ চালিয়ে যান। তবে সেনাবাহিনীর জুনিয়র অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং তারা সাধারণ জনগণের দিকে গুলি করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। ২৯ জুলাই সেনাপ্রধানের ডাকা এক সম্মেলনে এক নারী সেনা চিকিৎসকসহ বেশ কয়েকজন জুনিয়র অফিসার ছাত্র ও অন্য বিক্ষোভকারীদের হত্যার বিষয়ে তাদের হতাশা প্রকাশ করেন এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থনকারী নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের কথা উল্লেখ করেন। ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের ডাকা পরবর্তী সম্মেলনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মরত সেনা বিক্ষোভে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাতে অনীহার কথা জানিয়ে দেন।

৪ আগস্ট রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সাবেক সেনাপ্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নে অংশ না নেওয়ার অবস্থান নেন, যা একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায়। এই সিদ্ধান্ত ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছিল। এ ধরনের পদক্ষেপ পূর্বপরিকল্পিত হওয়া সম্ভব ছিল না।

৪ আগস্ট রাজধানীর রাওয়া ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে সাবেক সেনাপ্রধানসহ সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সশস্ত্র বাহিনীকে ছাত্র-জনতার মুখোমুখি না দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। সামরিক কর্মকর্তা ও সৈন্যদের বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নে অংশ না নেওয়ার অবস্থান নেন, যা একপর্যায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটায়।

বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করে ৩ আগস্ট ব্যাপক বিক্ষোভের পর শিক্ষার্থী সমন্বয়কারী এবং আন্দোলনের অন্য নেতারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ এবং ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার জন্য এক দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের অভ্যন্তরীণ বিতর্ক ও পরামর্শের ফলস্বরূপ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব আন্দোলনের বিরোধিতা না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বলপ্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগের মরিয়া হয়ে প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল শেষ পর্যন্ত। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা বলপ্রয়োগ করে আন্দোলনকে দমন করার হুমকি দেয়। ক্ষমতায় থাকার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার এবং তার দলীয় কর্মী বাহিনীর এই চূড়ান্ত প্রচেষ্টা ছাত্র এবং সাধারণ জনগণ রাস্তার লড়াইয়ে সফলভাবে প্রতিহত করেছিলেন।

৫। কোন পর্যায়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন?

প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন অবরোধের জন্য দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শনে ছাত্র সমন্বয়করা ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির আহ্বান জানায়। মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি প্রথমে ৬ তারিখ ঘোষণা করা হলেও, ব্যাপক জনসমর্থনের কারণে সমন্বয়করা ঘোষণা দিয়ে ৫ তারিখে এগিয়ে আনে।

শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকা শহরে বিক্ষোভকারীদের প্রবেশের সমন্বয় সাধন করে। এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের পথে স্থাপিত অসংখ্য চেকপয়েন্টে তাদের বিরোধিতা না করে মিছিলগুলোকে নির্বিঘ্নে এগিয়ে যেতে দেয়। বিভিন্ন দিক থেকে লাখ লাখ বিক্ষোভকারী মিছিল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে আসতে থাকে। এই বিশাল শক্তি প্রদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রধানরা শেখ হাসিনাকে বলেন, ভিড়ের ওপর গুলি চালিয়েও তারা আসন্ন মিছিল থামাতে পারেননি।

এটি ছিল সেই অন্তিম মুহূর্ত, যা হাসিনাকে ক্ষমতা ত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল। একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। এই অন্তিম মুহূর্ত তৈরির কারিগর ছিলেন হাসিনা নিজেই। অভ্যুত্থানে জনতার বিপুল অংশগ্রহণ যেমন এখানে ছিল, তেমনি সশস্ত্র বাহিনীর সিদ্ধান্ত শেষের দিকে আরও রক্তক্ষয় এড়িয়ে যেতে সহায়ক হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৫ বছরে সামরিক বাহিনী যেই গোষ্ঠীস্বার্থভিত্তিক সরকার-সামরিক বন্ধন (government-military complex) জোরদার করেছিল, তাতে সাধারণ মানুষের ধারণা ছিল সামরিক বাহিনী হাসিনা সরকারের আজ্ঞাবহ হবে। সামরিক বাহিনীর রাস্তায় নেমে আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা দেওয়া প্রথম দিকে এ কারণে সন্দেহ উদ্রেক করেছিল। সেনাবাহিনীর মাঠে থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার মুহূর্তগুলোতে মানুষের বিপুল সমর্থন ও ভালোবাসা অর্জন করে।

অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনীর জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাজ করা কঠিন হয়ে যেত, যদি সেনাবাহিনী হাসিনা সরকারের পক্ষে অবস্থান নিত। সেনাবাহিনীর নিরীহ মানুষের ওপর গুলি চালানো প্রত্যাখ্যান করার পেছনের কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, সেনাবাহিনী বহিঃশক্তি দিয়ে প্রভাবিত হয়ে আক্রমণ থেকে বিরত থেকেছিল। সেনাবাহিনী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় অংশগ্রহণ করে এই সময়ে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে, শেখ হাসিনা সরকারের সময় এই সুবিধা গ্রহণ করেছে বিধায় সেনাবাহিনীর তার প্রতি অনুগত থাকার কথা। কিন্তু এর বিপরীত ঘটনা লক্ষ করা যায়।

এর কারণ হতে পারে দুটো। প্রথমত, সামরিক বাহিনীর নওজোয়ানরা নিরীহ জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করায় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বা চেইন অব কমান্ড ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। এটা আঁচ করেই হয়তো সেনাবাহিনী হাসিনার পক্ষ হয়ে গুলি চালাতে বিরত থাকে এবং তাদের সহায়তায় শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। দ্বিতীয়ত, গভর্নমেন্ট-মিলিটারি কমপ্লেক্স এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে সামরিক বাহিনীর ব্যবসা ও অবকাঠামোতে অংশগ্রহণ আর আওয়ামী লীগ থাকা না-থাকার ওপর নির্ভর করে না। বরং গুলি চালালে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে যে ব্যাপক অসন্তোষ হতো, তা সেনাবাহিনীর জন্য বেশি ক্ষতিকর হতে পারত। সেনাবাহিনীর এই সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনার অন্তিম ক্ষণ ঘনিয়ে আনার ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৬। কালার রেভল্যুশন না রেভল্যুশন?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমি, ঘটনাক্রম, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই অভ্যুত্থান কোনোভাবেই পরিকল্পনা করে করা সম্ভব ছিল না। এই অভ্যুত্থানে বিভিন্ন ধরনের জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ, বিচ্ছিন্নভাবে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ, আবার একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সঙ্গে দূর থেকে সংগতি বজায় রাখা–এই সবকিছু আন্দোলনকে একটি নির্দিষ্ট পরিণতির দিকে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেনাবাহিনীর সমর্থন, যা আবার তৈরি হয়েছে সেনা সদস্যদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সরাসরি আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে।

এই সময়ে বেশকিছু র‍্যাপ সংগীত তৈরি হয়েছিল, যা মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। তরুণদের উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু কোনোভাবেই বলা যায় না যে এই র‍্যাপ সংগীত কোনো বহিঃশক্তির স্পন্সরের কারণেই বানানো সম্ভব হয়েছিল। আবার নেত্র নিউজ বিভিন্ন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টের মাধ্যমে জনমনে কিছু ধারণা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও এগুলো কখনোই যথেষ্ট কারণ ছিল না এই আন্দোলনকে বেগবান করার ব্যাপারে। নানারকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন কোনো একক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে করা সম্ভব ছিল না। এখানে এমন বিচ্ছিন্ন ও সংগঠিত উভয় ধরনের মানুষের সহাবস্থান ও সহযোগিতা ছিল যে এমনকি কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও এখানে এককভাবে ভূমিকা রাখতে পারতো না।

তাই সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোতে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের সহায়তা দিয়েছিল বলে কেউ কেউ প্রচার করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সে ধরনের কোনো সহায়তা এখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তাই এই আন্দোলনকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযোজিত কোনো রেভল্যুশন বলা যাবে না।

পোস্ট সোভিয়েত দেশগুলোতে দেখা গেছে, বারবার যুক্তরাষ্ট্রের অবদানকে সামনে আনা হয়েছে। যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের আলামত পাওয়া গেছে, কিন্তু এসব অবদানের বিশ্বাসযোগ্যতা সীমিত ছিল। বহিঃশক্তির অবদানকে সরাসরি প্রমাণের সুযোগ পাওয়া যায়নি। কারণ, আন্দোলনের শক্তি প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বহিঃশক্তির তৎপরতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। বরং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাটো সম্প্রসারণ নীতি এবং সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোর ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ার অভিপ্রায় এ ক্ষেত্রে বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপের নির্ধারক হিসেবে ব্যাখ্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। তাই যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের পেছনের আকাঙ্ক্ষা এবং গণ-আন্দোলনগুলোর আকাঙ্ক্ষার মধ্যে যে মিল পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানোকে অনেকাংশেই ব্যাখ্যা করা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান আবশ্যক ছিল না। ব্যাখ্যা হিসেবে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কথা বলাই যায়, কিন্তু সরাসরি প্রমাণ করা যায় না যে এই আন্দোলন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার ফল। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারত রাষ্ট্রের আধিপত্যের প্রতি বিরোধী মনোভাব গত এক দশকে বেড়েছে। ভারতের আধিপত্যবাদী নীতি এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সম্প্রসারণ নীতির কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের নানান টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের পর প্রতিবেশী ভারতের আধিপত্যকে বিরোধিতা করা দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের এই নতুন সংযোজন তাই আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের অবদানকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।

ন্যাশনাল এন্দাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির কার্যক্রম সারা বিশ্বের একশটির বেশি দেশে বিদ্যমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক নীতির অংশ হিসেবে ডেমোক্রেসি অ্যাসিসটেন্স সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দিয়ে থাকে। এর মানে এই নয় যে, সব দেশেই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ধনে কালার রেভল্যুশন হবে। বরং বলা যায়, স্বৈরাচারী সরকারগুলো নিজেদের প্রয়োজনেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে বড় করে হাজির করেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি অর্থ বা শক্তি অপচয় না করেই তার কর্তৃত্ব প্রদর্শনের জন্য আন্দোলনের শেষের দিকে এসে তাদের অবদানগুলো সুচিন্তিতভাবেই প্রচার করেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ এমন একটি দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত, যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সম্পর্কে কৌতূহল তৈরি হয়, কিন্তু তা ঠিক নিবারণ হয় না। নেত্র নিউজের সম্পাদক যখন ডক্টর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখনও মনে হয় এখানে কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অবস্থান রয়েছে। আদতে এ ধরনের প্রচারণার একটি বাজার সবসময়ই ছিল। এখনো আছে।

জুলাই আন্দোলন বুঝতে হলে এ ধরনের আলামত দিয়ে ভেতরের হিসাব-নিকাশ বোঝার চেষ্টা করলে আসল ঘটনাগুলো আড়াল হয়ে যাবে। অনেক গোষ্ঠীই চায় এ ধরনের বোঝাপড়া সর্বজনের কাছে গ্রহণীয় হোক। কিন্তু জুলাই আন্দোলনকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এ ধরনের আশঙ্কা আর থাকার কথা নয়। উপরের আলোচনায় এই বিষয়টি তুলে ধরেছি যে এই আন্দোলনের কোনো কিছুই পূর্বপরিকল্পিত নয়। একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু সাহায্য, কূটনৈতিক মন্তব্য ও খোঁজখবর যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য যোগসাজশ সম্পর্কে জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। এটা হয়েছিল আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে যখন কোটা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছে নিজ অভ্যন্তরীণ গতিশীলতার মধ্য দিয়ে। তাই এই অভ্যুত্থানকে কালার রেভল্যুশন বলা যাবে না।

তাহলে এই আন্দোলনকে কালার রেভল্যুশন বলতে না পারলে কি শুধু রেভল্যুশন বা বিপ্লব বলা যাবে? এই উত্তর খুঁজতে হলে আন্দোলনকারীদের পরবর্তী কার্যক্রমের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দেখা গেছে, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য আদর্শিক অবস্থানের অভাব রয়েছে। এই আন্দোলন কোনো আদর্শ দিয়ে চালিত হয়নি। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হলেও এবং আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ে নতুন দল গঠনের চেষ্টা হলেও, এখানে এত ভিন্ন মতের মানুষদের সমন্বয়ের চেষ্টা চলছে যে এখানে কোনো নির্দিষ্ট আদর্শের ভিত্তিতে কার্যপরিধি সংজ্ঞায়িত করার বিষয় উঠে আসেনি। আপাতত মনে হচ্ছে, নির্বাচন করার দিকেই তাদের ঝোঁক বেশি। অর্থাৎ এই অভ্যুত্থানের ফলে শ্রেণি কাঠামো, উৎপাদন কাঠামো, অথবা জনমুখী সরকার গঠনে আদর্শিক অবস্থান পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। কাজেই এটি হতে পারে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান, যা যে কোনো সময় আবার একটি অর্থনৈতিক ভিত্তির অভাবে স্বৈরাচারী সরকার গঠনের দিকে যাত্রা শুরু করতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ধরনের সংস্কারের কথা বলছে এবং সেই অনুযায়ী কমিশন করে, ক্ষেত্রবিশেষে টাস্কফোর্স গঠন করে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা শাসন ব্যবস্থার উপরিকাঠামোর ওপর উদারনৈতিক নীতিই বাস্তবায়ন করে চলেছে, যা কাঠামোগতভাবে মৌলিক পরিবর্তনের পক্ষে কাজ করছে না। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন করে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নই এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু উৎপাদন কাঠামোর মধ্যে তার যেমন কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি, এবারের অভ্যুত্থানের ছয় মাসের পরেও তেমন মৌলিক কোনো সংস্কার ঘটার সম্ভাবনা দেখা যায়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে স্থবিরতা কাজ করেছিল আগেও, তা এবারও লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে ছাত্র-জনতার মধ্যে সংস্কারের অভিপ্রায় লক্ষ করা যাচ্ছে।

বিদ্যমান কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে এই আকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সম্ভব কি না, তা সময় বলে দেবে। এখনো এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বলার মতো ঘটনা ঘটেনি। এদিক থেকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর পরিবর্তন অনেকটা সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোতে বা আরব দেশগুলোতে রেজিম চেঞ্জের সঙ্গে মিলে যায়। যদিও পটভূমি ভিন্ন হওয়ায় সব দেশের ফলাফলকে এক করে দেখার সুযোগ নেই, তবুও এই অভ্যুত্থান রেজিম চেঞ্জের মধ্যেই সীমিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছে। কেউ কেউ মনে করেন, রেভল্যুশন হওয়ার জন্য উৎপাদন কাঠামো পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই, গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠাই বিপ্লব বলার জন্য যথেষ্ট। এদিক থেকে বাংলাদেশে পূর্ব-অভিজ্ঞতার দিকে আলোকপাত করা প্রয়োজন। অতীতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণতান্ত্রিক সরকারের আবির্ভাব ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। স্বৈরাচারী শক্তি বারবার এসেছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশে সেই রেভল্যুশন হবে কি না, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোতে যেই আন্দোলনগুলো হয়েছিল, তাদের কালার রেভল্যুশন বলা হলেও যেই শাসকই এসেছিল তারা কেউই টেকেনি। বারবার স্বৈরাশাসক এসেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার মদতপুষ্ট ইয়ানুকোভিচ জাল ভোটে নির্বাচিত হয়ে অরেঞ্জ রেভল্যুশনের পর বাধ্য হন আরেকবার নির্বাচনের। পরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসেন ইউশচেঙ্কো, কিন্তু আশানুরূপ পরিবর্তন না আনতে পারায় তার প্রতি অনাস্থা বাড়তে থাকে এবং কয়েক বছর পরই আবার রাশিয়ার মদতপুষ্ট ইয়ানুকোভিচ নির্বাচিত হয়ে আসেন। এ রকম জর্জিয়াতে রোজ রেভল্যুশনের পর শাকাশভিলি, কিরগিজস্তানে টিউলিপ রেভল্যুশনের পর বাকিয়েভের মতো শাসক নির্বাচিত হলেও তারাও স্বৈরাচারী হয়ে ওঠেন। মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে শুরু করে দুর্নীতি ও লুটপাটে জড়িয়ে পড়েন। দুর্বল অর্থনৈতিক ভিত ও অস্থিতিশীলতার জন্য জনগণই তাদের প্রত্যাখ্যান করে। কাজেই এসব দেশেও আসলে বিপ্লব হয়নি। অন্যদিকে বেলারুশে একই কায়দায় বিপ্লব করার চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। এসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখে বেলারুশের সরকার কিছু পন্থা অবলম্বন করে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল দুর্নীতি দমনের নামে গ্রেফতার, বহিঃশক্তির সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের ভয় দেখানো ইত্যাদি।

দেখা যাচ্ছে, কালার রেভল্যুশন বলা হোক বা না-হোক, তাতে শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তন হলেও এমনকি গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা হয় না। অর্থনৈতিক ভিত তৈরি না করলে, পরনির্ভরতা বৃদ্ধি পেলে এবং সর্বোপরি গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন না হলে এ ধরনের দেশগুলোতে মৌলিক পরিবর্তন সাধন হয় না। এসব অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে সে অর্থে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।

৭। উপসংহার

আওয়ামী লীগ সরকারের স্ব-প্ররোচিত ক্ষতি ছাত্রনেতাদের দ্বারা পরিকল্পিত ছিল না। আওয়ামী লীগ নতুন পরিস্থিতিতে তার পুরোনো দমন-পীড়নের পদ্ধতি ব্যবহার করেছে ও সমন্বয়করা উদ্ভাবনী ও সিদ্ধান্তমূলক পাল্টা পদক্ষেপ ও কৌশল ব্যবহার করেছে। যথার্থভাবে নতুন পদ্ধতি দিয়ে সরকারকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা আন্দোলনকারীরা প্রদর্শন করেছিল।

অন্য আরও অনেক দলের পাশাপাশি প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অনেকেই দাবি করেন, তাদের কিছু কর্মী ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে থেকে এই আন্দোলনের পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেছিলেন। আসলে রাজনৈতিক এবং আদর্শগত পার্থক্য নির্বিশেষে ডান, বাম এবং মধ্যপন্থি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই। এখানে একক কোনো দল বা গোষ্ঠী পুরো অভ্যুত্থানের ওপর নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবস্থানে ছিল না।

সংগঠিত ছাত্রগোষ্ঠীগুলোর পরিকল্পনা ও সমন্বয় আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তবে এর গতিপথ এবং ফলাফল পূর্ণাঙ্গ কোনো নকশা নির্ধারণ করেনি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নাম পরিবর্তন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করা হয়। কৌশলগতভাবে এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। শিক্ষার্থীরা পরিকল্পনা করে বা নির্দেশ দিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল এবং সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থান পরিবর্তন করায়নি। তাদের প্রতিবাদ চূড়ান্ত সাফল্যকে সহজতর করেছিল মাত্র।

ঢাকা শহরজুড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসার ছাত্রছাত্রীদের যোগদান এই আন্দোলনকে গতি দিয়েছিল। ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে এবং চট্টগ্রামের মতো অন্য শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকামুখী প্রধান মহাসড়কগুলোতে যান চলাচল বন্ধ করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়েছিল।

শিক্ষার্থীদের অভিভাবক এবং শিক্ষক ছাড়াও পোশাক এবং অন্যান্য শিল্পের শ্রমজীবী মানুষ এবং অন্য অনেক পেশাগত গোষ্ঠী তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। শিক্ষার্থীদের সংকল্প এবং আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। হেলিকপ্টার এবং সাঁজোয়া বাহন ব্যবহার, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দমন-পীড়ন করা সত্ত্বেও হাসিনা সরকার বিক্ষোভ দমন করতে পারেনি। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান বলপ্রয়োগ ও দমন-পীড়ন আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং শাসন করার বৈধতা লোপ করে।

প্রতিটি এলাকায় ছাত্র, যুবক, বেকার, বিভিন্ন পেশাজীবী ও ক্ষেত্রবিশেষে রাস্তার গ্যাং প্রতিরোধ তৈরি করেছিল। সাধারণ মানুষ রাস্তায় লড়াই করা ছাত্র এবং অন্য কর্মীদের খাবার, পানীয় এবং আশ্রয় প্রদান করেছে। বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির লোকজন নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী ক্যাডারদের বিরুদ্ধে রাস্তায় লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল, তা হাসপাতাল/মর্গে আনা মৃত ও আহতদের দেহ গণনা এবং পরিচয় থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বিদ্রোহের ভিত্তি আগেই প্রস্তুত হয়েছিল। প্রয়োজন ছিল শুধু একটি স্ফুলিঙ্গের। ছাত্র আন্দোলন সেই স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে। এই আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থান বলা যায়। কালার রেভল্যুশন বা রেভল্যুশন বলা যায় না। এই গণ-অভ্যুত্থানের যদি কোনো মাস্টারমাইন্ড থেকে থাকে, তাহলে সেই মাস্টারমাইন্ড কোনো বহিঃশক্তি যেমন না, তেমনি এর প্রযোজক কোনো একক গোষ্ঠীও নয়। এর মাস্টারমাইন্ড একজনের পক্ষেই হওয়া সম্ভব। তিনি হলেন শেখ হাসিনা নিজে। আন্দোলন দমনে এতটা বেপরোয়া হয়ে হাজারের ওপর মানুষ খুন করে ও ২০ হাজারের মতো মানুষকে আহত করে পঙ্গু করে দিয়ে তিনিই মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছেন। কোনো পরিকল্পিত শক্তি, এনজিও, মিডিয়া বা ব্যক্তির পক্ষে এই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে এ রকম প্রভাব তৈরি করা সম্ভব ছিল না, যতটা শেখ হাসিনার নিপীড়নমূলক নীতির মাধ্যমে ঘটেছিল। 

ড. মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইমেইল: moshahida@du.ac.bd  

তথ্যসূত্র:

১। Stewart, S. 2012. Democracy promotion before and after the ‘colour revolutions’, Routledge, London and New York.

২। Mitchell, A. L. 2012 ‘The Color Revolutions’, University of Pennsylvania Press, Philadelphia

৩। Akya, C. 2024. “Bangladesh as color revolution on India’s doorstep” Asian Times. 8th August 2024. Available at https://asiatimes.com/2024/08/bangladesh-as-color-revolution-on-indias-doorstep/

৪। Rodriguez S. 2024 Geopolitical Games that the U.S. plays through National Endowment for Democracy, The Sunday Guardian, September 1, Available at

GEOPOLITICAL Games that THE U.S. plays through National Endowment for Democracy

৫। ক্যাম্পাসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জবাব দিতে ছাত্রলীগ প্রস্তুত, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২৪

৬। আরও চারজনের মৃত্যু, নিহত বেড়ে ২০১, প্রথম আলো, ২৫ জুলাই ২০২৪

৭। উত্তরার সংঘর্ষেই ১১ জনের মৃত্যু, আহত অনেকে, প্রথম আলো, ১৯ জুলাই ২০২৪; সংঘর্ষে তিন দিনে নিহত ১০৩, প্রথম আলো, ২০ জুলাই ২০২৪

৮। যুগান্তর, সেনাবাহিনীর সেই বৈঠক থেকে পরিস্থিতি বদলে যায় যেভাবে, ২০ আগস্ট ২০২৪ https://www.jugantor.com/national/840565

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •