এরশাদ আমলের সামরিক শাসন ও লুম্পেন পুঁজির সম্প্রসারণ

২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১৪

এরশাদ আমলের সামরিক শাসন ও লুম্পেন পুঁজির সম্প্রসারণ

মেহেদী হাসান

বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশবিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণিবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। চতুর্দশ কিস্তিতে মূলত লে. জে. হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের সময়কালে রাজনৈতিক অর্থনীতির বিভিন্ন ধারা, লুম্পেন পুঁজির আধিপত্য এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাবের কিছু দিকের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।

প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রকে বুর্জোয়া শ্রেণি ততক্ষণ পর্যন্তই সহ্য করে, যতক্ষণ তা বুর্জোয়া শাসকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করে। যখনই এই সংস্থাগুলো বুর্জোয়াদের হাতছাড়া হয়ে যায় এবং তারা জনসাধারণের ক্ষুদ্রতম স্বার্থ রক্ষা করতে চায়, তখনই বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্তগুলো পর্যন্ত বাতিল করে দেয়। নানা অজুহাত দেখিয়ে প্রয়োজন হলে বলপ্রয়োগ করে এদের ভেঙে দেয়। কায়েম করে ফ্যাসিবাদী শাসন।আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র শ্রেণি-শাসন ও শ্রেণি-শোষণ বজায় রাখার জন্য যে দুটি সংস্থা ব্যবহার করে তার একটি হলো আমলাতন্ত্র, অপরটি সশস্ত্র সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী। বুর্জোয়া শ্রেণির অর্থনৈতিক ক্ষমতা রাষ্ট্রের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। কারণ, এঙ্গেলস-এর মতে, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সম্পদ পরোক্ষভাবে অথচ সবচেয়ে নিশ্চিতভাবে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখে; প্রথমত: আমলাতন্ত্রকে দুর্নীতিপরায়ণ করে, দ্বিতীয়ত: গভর্নমেন্ট ও স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে বোঝাপড়ার সাহায্য নিয়ে স্বৈরাচারের কাছে সকলেই সমান সমানভাবে মূল্যহীন।

সর্বজনের ভাগ্য কারা নির্ধারণ করে

অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে শাসকশ্রেণির, বিশেষ করে বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে এক ধরনের সংকটের কারণে। বাংলাদেশে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক দলগুলোর ভেঙে পড়া এবং বিভিন্ন কারণে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় টিকে থাকে; আপাতত স্থিতিশীল সৃষ্টিকারী উপাদান হিসেবে জনগণের সামনে প্রতীয়মানও হয় অন্তত কিছুকালের জন্য। সামরিক বাহিনী ও তার মিত্র আমলাতন্ত্র একই শ্রেণির দুটি দল হলেও স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে, যা রাষ্ট্রকাঠামোর ওপর কর্তৃত্ববাদী সংকটের ইঙ্গিত দেয়। উল্লেখ্য যে, অর্থনীতির বিরাষ্ট্রীয়করণ, সামরিক বাহিনীর ‘বেসামরিককরণ’ (অভিযোগ রয়েছে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের তুষ্ট রাখার জন্য সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়োগের বিস্তার ঘটে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে। ধর্মকে রাষ্ট্রের নৈতিক-আদর্শিক ক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার মতো সংকটের উপাদানগুলো বিএনপির শাসনামলে সম্ভব হয়েছিল। শামসুল আলমের ভাষ্যমতে, “এটা যুক্তিযুক্ত হতে পারে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ একটি বিস্তৃত সংকটের পরিস্থিতিতে ঘটে – রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, মতাদর্শগত এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে ঐতিহাসিক ব্লকের (শাসকশ্রেণির) বিভিন্ন দল (রাষ্ট্রীয় পুনর্বিন্যাস) প্রক্রিয়াটিতে তাদের নিজস্ব ছাপ রাখার জন্য একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, তবে কোনো দলই এটি করতে পুরোপুরি সফল হয় না। নাগরিক সমাজের প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের সঙ্গে তার পেশাদারিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই, বরং একটি সমস্যাগ্রস্ত ঐতিহাসিক ব্লককে রক্ষা করা এবং সেই ঐতিহাসিক ব্লকের মধ্যে শ্রেণি ও শ্রেণি গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য তাকে যথাযথ আধিপত্যবাদী পথে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে এ ধরনের হস্তক্ষেপ সংঘটিত হয়।”

“স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পুঁজি আহরণ ও বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল। রাষ্ট্র সঞ্চয়ের ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা গ্রহণ করেছে যাতে সঞ্চিত মূলধন উৎপাদনশীল খাতে তার পথ খুঁজে পায়। কিন্তু পুঁজিবাদী রূপান্তরের পরিবেশ তৈরিতে সরকার, রাষ্ট্র শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।” বক্তব্যটি কামরুল আলমের। এ বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করে আরও বলা দরকার যে, ব্যক্তিপুঁজির পুঞ্জীভবন ঘটাতে গিয়ে সরকার স্বাধীনভাবে কোনো প্রস্তাবনা হাজির করতে পারেনি সেটি আমরা আগেই দেখেছি। সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অনুগত হয়েই তাকে এ কাজটি করতে হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কেন্দ্রস্থ পুঁজিবাদী রাষ্ট্র-সংস্থার অনুগামী এবং অনুগত রাখা ও দেশের অভ্যন্তরে কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণের বিশ্বব্যাংকীয় প্রস্তাবনাগুলোকে (প্রকৃত অর্থে আদেশ-নির্দেশ) বিবেচনা করেই সে কাজগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একদিকে দেশের বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্র এবং অন্যদিকে নানাবিধ নির্ভরশীলতার কারণে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নির্দেশিত পথেই অগ্রসর হওয়ার যাবতীয় বিধি-ব্যবস্থা অনুসরণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্বব্যাংকীয় প্রস্তাবনার একটি নমুনা উল্লেখ করা প্রয়োজন।

‘বিডি – ২৮৭০, বাংলাদেশ – বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং আশু করণীয়’ – ১৯৮০ সালের ২১ মার্চ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “…মনে হচ্ছে, প্রধানত তিনটি কারণে ব্যক্তিগত বিনিয়োগ মন্থর হয়ে আছে। প্রথমত, এ জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন লাভ এবং ঋণ ও আমদানি লাইসেন্স পাওয়া কষ্টকর। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ শিল্পে রাষ্ট্রীয়খাতে প্রাধান্য ব্যক্তিগত খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে। সরকারের বারবার প্রতিশ্রুতি এবং অনুকূল বিনিয়োগ নীতি ঘোষণার পরও বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত হতে পারছে না যে আর কোনো জাতীয়করণ করা হবে না। তা ছাড়া ব্যক্তিগত পুঁজির ব্যাপক সম্প্রসারণের ক্ষেত্র খুবই সীমিত। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারকে অবশ্যই বাস্তববাদী (অর্থাৎ তথাকথিত উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থার অনুগামী) হতে হবে। …গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক খাতগুলোকে ব্যক্তিগত (বিদেশি পুঁজিপতিদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগসহ) বিনিয়োগের জন্য নির্দিষ্ট করা দরকার।

“তৃতীয়ত, কোন কোন খাতে বিনিয়োগ লাভজনক, পুঁজিপতিরা তা বুঝে উঠতে পারছে না। ব্যক্তি উদ্যোক্তার অভাবও আছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত, পুঁজিপতিদের সাহায্যে এগিয়ে আসা। (বিশ্বের অধিকাংশ পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিপুঁজির মালিকরা জনগণের করের অর্থেই ধনী হয়েছে। রাষ্ট্র নানাবিধ পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে তাদের ধনী বানায়। সে হিসেবে ধনীদের ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে কিছু নাই। সামাজিক সম্পদের ওপর তারা দখলীস্বত্ব কায়েম করে।)

“বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করার ক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। …সরাসরি এবং চট্টগ্রামের মুক্ত রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত এলাকার মাধ্যমে বিদেশি পুঁজিকে উৎসাহিত করা হয়েছে।…রাষ্ট্রায়ত্ত খাত প্রভাবিত অর্থনীতিকে মিশ্র অর্থনীতিতে রূপান্তরের কাজ কঠিন। মিশ্র অর্থনীতি সৃষ্টিতে বিদেশি এবং বাংলাদেশি পুঁজিপতিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

সরকার ব্যক্তিগত পুঁজির আকার ও শক্তিবৃদ্ধির জন্য যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তা সীমিত। অর্থনীতির বিকাশের ক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হলে আরও ব্যাপক কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে।”

অবশ্য বিশ্বব্যাংকের এই সুপারিশমালা হঠাৎ করে একদিনে আসেনি। আওয়ামী লীগের প্রথম সরকারের আমল থেকেই ক্রমান্বয়ে পলিসিতে বিষয়গুলো একটু একটু করে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পরবর্তী সময়ে তারই ধারাবাহিকতায় ২৬ এপ্রিল ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া বিশ্বব্যাংকের সুপারিশ ছিল: (ক) রেশনের ভর্তুকি ক্রমেই তুলে নিতে হবে; (খ) যানবাহনের ভাড়ার হার বাড়াতে হবে; (গ) সার ও অন্যান্য কৃষি উপকরণের ভর্তুকি হ্রাস করতে হবে; (ঘ) পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা প্রভৃতির গ্রাহক মূল্য বাড়াতে হবে।’

বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে রেল ভাড়া থেকে শুরু করে বেশ কিছু পণ্যের দাম বৃদ্ধি (পুনর্নির্ধারণ) করে সরকার। ৯ শতাংশ থেকে শুরু করে ১০০ শতাংশ দাম বৃদ্ধি করা হয়।১০ তবে উপরোক্ত পদক্ষেপেও বিশ্বব্যাংক সন্তুষ্ট হয়নি। তারা সরকারের কাছে আরও সুস্পষ্ট পদক্ষেপের আহ্বান জানায়। ফলশ্রুতিতে পুনরায় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো হয়। তৎকালীন (৫ জুলাই ১৯৮০ সাল) বস্ত্রমন্ত্রী মনসুর আলী সংবাদ সম্মেলনে সুতা ও কাপড়ের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করলে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন: এই সিদ্ধান্তের পেছনে বিশ্বব্যাংকের কোনো ভূমিকা ছিল কি? জবাবে জনাব মনসুর আলী বলেন: “সুতার দাম বৃদ্ধির জন্য চাপ ছিল, নতুবা তারা এই খাতে সাহায্য দেবে না বলে জানিয়েছে।”১১

অজয় দাশ গুপ্ত এবং মাহবুব জামান নীতিনির্ধারণে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকার বিষয়ে বলছেন, “প্রসঙ্গত বলা দরকার, বাংলাদেশে বস্ত্র কারখানা এবং তাঁত শিল্পের জন্য সুতা ও তুলা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই আমদানি ব্যয়ের একটা অংশ মেটানো হয় বিশ্বব্যাংকের অন্তর্ভুক্ত আইডিএ-র কাছ থেকে ঋণ এনে। আর এই সুযোগে ঋণদাতা নিয়েছে নির্দেশদাতার ভূমিকা।…কৃষি উপকরণ, যেমন: সার, পাওয়ার পাম্প, কীটনাশক প্রভৃতির ব্যবসা বেসরকারি খাতে তুলে দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক সুপারিশ করেছিল এবং বাংলাদেশ সরকার সে অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছে।”১২ এবং মজার বিষয় হলো, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তিনি বিশ্বব্যাংকের এই পরামর্শ-নির্দেশের কোনো বিরুদ্ধাচরণ করেননি। উপরন্তু ভাষা একটু এদিক-সেদিক করে মূল উপজীব্যকে অটুট রেখে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে লুণ্ঠনের পরিধি-আয়তন আরও বৃদ্ধি করেছেন। নিজের ব্যক্তিগত ধনসম্পদ বৃদ্ধির পাশাপাশি এই কাজের ফলে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-সংস্থাগুলো তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে দিতে কোনো প্রকার কার্পণ্য করেনি।

সম্পত্তিবান মালিক শ্রেণির বিদগ্ধ বিক্রেতা বুদ্ধিজীবীদের এরশাদের কবিত্বশক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, মূলধারার গণমাধ্যমের ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ কৌশলে সরকারের পক্ষাবলম্বন করা সত্ত্বেও ইতিহাস তার প্রমাণ রেখে গেছে পরতে পরতে যে, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ‘হয়ে ওঠা’ অজনগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোর একজন যোগ্য ব্যবস্থাপক জেনারেল এরশাদ, যিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তার সামরিক শাসনামলে এবং পরবর্তীকালের বেসামরিক শাসনামলেও তিনি যে শব্দটি দ্বারা নিজেকে অলংকৃত করেছেন তার নাম হলো দুর্নীতি। কথিত আছে যে, তার সরকার কর্তৃত্ববাদী চর্চা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং দুর্নীতির দায়ে দুষ্ট। বিশেষভাবে এরশাদ সরকার সম্পর্কে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং যার কারণে সাজাপ্রাপ্ত (দোষী সাব্যস্ত হওয়ার কথা ছিল যেসব কারণে সেসব বাদ দিয়ে যে কারণগুলোতে তিনি সাজাপ্রাপ্ত হন প্রকৃত অর্থে সেসব মামলা ছিল প্রহসনমূলক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যার ফলে, পরবর্তী সময়ে সাজা মওকুফ কিংবা খালাসপ্রাপ্ত হয়ে পুনরায় রাষ্ট্রনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তার আর কোনো বাধা থাকেনি।) হন মোটাদাগে সেগুলো হলো:

১. তহবিল তছরুপ: কথিত আছে যে তিনি এবং তার সহযোগীরা সরকারি তহবিল ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজে লাগানো এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। ২. ভূমি দখল: তার বিরুদ্ধে বের হওয়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি নথিপত্রে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি এবং তার পরিবার সরকারি ও অন্যের ব্যক্তিগত জমি অবৈধ প্রক্রিয়ায় দখল করেন। ৩. রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা: তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সংহত করেন। এর জন্য প্রয়োজনে বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দল/সংগঠনকে ঘুষ দেওয়া থেকে শুরু করে নির্বাচনকে ম্যানিপুলেট করেছেন। ৪. সম্পদ পুঞ্জীভবন: তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া যায় তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগটি হলো সম্পদের পুঞ্জীভবন। ক্ষমতা থাকাকালীন ক্ষমতা ব্যবহার করে আত্মসাৎকৃত এসব ধনসম্পদের উৎস সম্পর্কে তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। বাস্তবে তার দৃশ্যমান সম্পদের পাহারায় থাকে ‘অদৃশ্যমান হস্ত’, যার ফলে তিনি প্রকৃত অপরাধের কারণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেই বাকিটা জীবন রাজনৈতিক দাবার ঘুঁটি হয়ে পার করে দিতে পেরেছেন। এটি মূলত এক ধরনের ইনডেমনিটি; মূলধারার বড় রাজনৈতিক শক্তির লেজুড় হিসেবে থাকার শর্তে তিনি এবং তার পরিবার উপযুক্ত শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েছেন।

জিয়াউর রহমান আমলের ‘উন্নয়ন’ ধারণাটির আরও ‘সংস্কার’ করেন এরশাদ। মুনাফা এবং বাজারকে কেন্দ্র করে জিয়াউর রহমানের সংক্ষিপ্ত ‘উন্নয়নের’ শাসনামলকে দীর্ঘ করেন তিনি। এ সময় আগের শাসনামলের তুলনায় অধিকতর মাত্রায় বাংলাদেশ বিশ্ববাজারের সঙ্গে একীভূত হতে থাকে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পরামর্শ এবং পরিকল্পনা মোতাবেক। দেশের অভ্যন্তরে বিত্তশালী গঠনের রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া এর পাশাপাশি চলতে থাকে। সঙ্গে চলতে থাকে রাজনৈতিকভাবে তার ক্ষমতা পাকাপাকি করার ব্যবস্থা। চুরি, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় পূর্বে ‘হয়ে ওঠা’ বিত্তশালীদের একাংশ যারা ইতোমধ্যে মূলধারার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল সেখান থেকে আরও সুবিধা-পৃষ্ঠপোষকতা দানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। সে হিসেবে তিনি ছিলেন জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরি যেমন দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে তেমনি কর্মপ্রক্রিয়ার দিক থেকে। জিয়াউর রহমান যেমন বিরাষ্ট্রীয়করণ-বেসরকারিকরণ, ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণ, বাজার, বেসামরিক-সামরিক আমলাতন্ত্রের বিকাশ, পুঁজির আদি সংবর্ধন প্রক্রিয়ার বিস্তার ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন তেমনি এরশাদ এসব প্রক্রিয়াকে রীতিমতো ‘শিল্পের’ পর্যায়ে নিয়ে যান। তার কবিত্বগুণের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন মূলধারার তাবৎ গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবীমহল। এতৎসত্ত্বেও ‘পল্লীবন্ধু’র ‘শিল্পসমৃদ্ধ উন্নয়ন’ বয়ান ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ধনী-দরিদ্র বৈষম্য-ব্যবধানকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যা আবার আন্তর্জাতিক ‘উন্নয়ন’ সংস্থাগুলোর (বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি) দ্বারা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।

এরশাদ সরকারের আমলে ‘উন্নয়ন’-এর জাঁতাকলে একদিকে দরিদ্র, অনাহারী মানুষের জ্যামিতিক হারে সংখ্যাবৃদ্ধি, অন্যদিকে গাণিতিক হারে কোটিপতিদের সংখ্যাও বৃদ্ধি হতে থাকে। এই কোটিপতিদের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া নিয়ে আনু মুহাম্মদ তার কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ-এ লিখেছেন:

“প্রধানত ঢাকা শহরে কেন্দ্রীভূত দেশের কোটিপতিদের নিয়ে ’৮০-র দশকে পরিচালিত এক গবেষণায় তাদের বিত্তের উৎস নির্দেশ করা হয়েছিল নিম্নরূপ: ‘ক. সরকারি ক্ষমতা কবজা করে পরিত্যক্ত বা সাধারণ সম্পত্তি দখল, সরকারি সম্পদ হস্তগত করা, চুরি, জালিয়াতি; খ. চোরাচালানি, মাদকদ্রব্য ব্যবসা, মজুতদারি, কালোবাজারি, মুদ্রা ব্যবসা, হুন্ডি, আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং; গ. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অর্থসংস্থানকারী সংগঠন থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা মেরে দেওয়া; ঘ. আমদানি কমিশন; ঙ. সরকারি বিধিনিষেধ, নিয়ন্ত্রণ, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি, পারমিট ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি।’ এসব আয়কে বলে অনুপার্জিত আয় বা চলতি কথায় কালোটাকা। সোজাসুজি চোরা বা দুর্বৃত্ত আয় বললে ঠিক হয়।

বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ থেকে এটি স্পষ্ট যে, ’৯০ দশকে কালো বা দুর্বৃত্ত বা চোরা অর্থনীতির আরও অনেক প্রসার ঘটে। বর্তমান (২০০৫ সাল অনুযায়ী) হিসাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশের সমান এই অর্থনীতি। সরকারি হিসাবে জিডিপির পরিমাণ হলো তিন লাখ কোটি টাকার ওপরে, অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা দুর্বৃত্ত বা চোরা অর্থনীতি আয়তন সরকারি হিসাবে এর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু এর প্রভাব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজে আছে। অব্যাহত সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা, দখল লুট, অস্ত্র মাদকদ্রব্য নারী পাচার সবকিছুর প্রসারে এর ভূমিকা প্রত্যক্ষ।”১৩

বাংলাদেশের অর্থনীতি গঠনের শুরু থেকেই নানা উপায়ের চোরাই অর্থনীতির উপাদান বিশেষভাবে সক্রিয়। বলা যায় এককভাবে মূল উপাদান। যত-না উৎপাদনশীল খাতের অংশ তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি চোরাই খাতের অবদান এবং যার এক ধরনের উল্লম্ফন ঘটে সামরিক সরকার ‘পল্লীবন্ধু’ এরশাদের ‘উন্নয়ন’ দশকে। আনু মুহাম্মদ তার গবেষণায় এই অর্থনীতি গঠনে বাইশটি কার্যকরী উপাদান চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন। এগুলো হলো:

“১. নিয়োগ, বদলি, বিলপ্রাপ্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঘুষসহ নানাবিধ দুর্নীতি; ২. লিজসহ বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাধারণ সম্পত্তিসহ বিভিন্ন জমি-জলা সম্পত্তি দখল ও লুট; ৩. অস্ত্র উৎপাদন, আমদানি ও ক্রয়-বিক্রয় (বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের তালিকায় এ রকম একজনের নাম পাওয়া যায়। মুসা বিন শমসের।); ৪. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের লোকসান বা সিস্টেম লস নামে আত্মসাৎ ও লুণ্ঠন প্রক্রিয়া, বেসরকারিকরণের নামে সম্পদ দখল, লুণ্ঠন এবং তার কমিশন; ৫. ব্যাংক থেকে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের নামে বিপুল অঙ্কের ঋণ আত্মসাৎ ও জালিয়াতি; ৬. আমদানি-রপ্তানি জালিয়াতি; ৭. রপ্তানিমুখী খাতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি, আমদানি ও রপ্তানি সুবিধা আত্মসাৎ করার জন্য গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন ধরনের ভুয়া কারখানা প্রদর্শন (রপ্তানিমুখী শিল্পকারখানার জন্য সরকার ১৯৭৮, বিশেষত ’৮০-র দশক থেকে অব্যাহতভাবে নানা সুবিধা দিয়েছে। এর মধ্যে আছে: মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা, রপ্তানি খাতের জন্য নগদ অর্থ সহায়তা, আয়করে রেয়াত, বৈদেশিক মুদ্রার সুবিধা ইত্যাদি;১৪ ৮. অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক কিংবা বিপর্যয় সৃষ্টিকারী আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা, খরচ বেশি দেখানো বা ক্ষতিপূরণ থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করে তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ কোম্পানিসহ বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি থেকে উচ্চ কমিশন; ৯. কমিশন লাভ ও বরাদ্দ আত্মসাতের জন্য ‘বিদেশি সাহায্য’যুক্ত ভুল, ক্ষতিকর বা উচ্চ ব্যয় প্রদর্শিত প্রকল্প তৈরি ও পাস; ১০. সামরিক-বেসামরিক, সরকারি, আধাসরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ক্রয়বিক্রয় ও নির্মাণ; ১১. বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস বিল এবং রাজস্ব ফাঁকি; ১২. দরপত্র দখল নিয়ে ভাগ-বাঁটোয়ারা; ১৩. মাদকদ্রব্যের আমদানি, বিতরণ ও বাণিজ্য; ১৪. বিদেশে চাকরি প্রদানের নামে ‘আদম ব্যবসা’, শিশু ও নারী পাচার; ১৫. পতিতাবৃত্তি, পর্নোগ্রাফিসহ যৌন বাণিজ্য তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ; ১৬. ছিনতাই, ডাকাতি; ১৭. খুন, মাস্তানি ও নানা অপরাধের পেশাদার তৎপরতা; ২০. পুলিশ ও নিয়োজিত ব্যক্তিদের দ্বারা পরিবহণ, খুদে ব্যবসা, নির্মাণ থেকে নিয়মিত টোল বা চাঁদা আদায়; ২১. উন্নয়ন বরাদ্দ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, উপবৃত্তি, দুস্থ মাতা কর্মসূচি, ত্রাণ তহবিল ইত্যাদি আত্মসাৎ; ২২. চোরাচালান।”১৫

এই ক্ষেত্রগুলোর অধিকাংশই জন্মসূত্রে বাংলাদেশের পাওয়া। যুদ্ধোত্তর বেসামরিক কিংবা সামরিক আমলের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অর্থনেতিক এই কাঠামোর ‍ওপর দাঁড়িয়েই ‘সংস্কার’-এর উদ্যোগ গ্রহণ করেন সামরিক শাসক এরশাদ। লুণ্ঠনের কাঠামোকে অক্ষত রেখে চোরাই কোটিপতিদের নানা সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে তাদের চোরাই অর্থ বৈধ করার ব্যবস্থা করা (প্রচলিত ভাষায় ‘কালো’ টাকা ‘সাদা’ করা) কিংবা কখনো কখনো কোনো কোনো ব্যক্তিকে লঘু শাস্তি দিয়ে উদাহরণ তৈরি করার চেষ্টা করেছে এরশাদ সরকার। কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকার কারণে শেষ পর্যন্ত ন্যূনতম শাস্তিটুকুও অপরাধীরা পায়নি। বরং উল্টো এর ফলে লাভবান হয়েছে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী–তারাই আবার ক্ষমতাবান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছে, তারাই আবার পরবর্তী সময়ে অধিকতর রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগ করেছে; অন্যদিকে বিপন্ন হয়েছে প্রাণ-প্রকৃতি-সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।

আগেই বলা হয়েছে যে, এরশাদ তার ক্ষমতাবলে পূর্বতন কাঠামোর আকার-আয়তন এবং প্রক্রিয়ার গতিবৃদ্ধি করেছেন। ’৮০-র দশকে শুরু হওয়া বাজারকেন্দ্রিক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছেন। সেই মতে, জিয়াউর রহমানের শাসনকালের বাজারের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার নীতির প্রতি দৃঢ় থেকে ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের জন্য যদ্দূর হাত প্রসারিত করা যায় করেছেন। দুর্নীতি-অপরাধ১৬, লুটপাট এই প্রক্রিয়াতেই বেড়েছে। জনগণের সম্পদ দেশি-বিদেশি ব্যক্তিপুঁজির হস্তগত হয়েছে। সর্বোপরি জনগণের শিল্প গড়ার পরিবর্তে পরনির্ভরশীল অর্থনীতির শ্রীবৃদ্ধিই ঘটেছে। কোনো কোনো গবেষক মনে করেন যে, বাংলাদেশে ধনসম্পদ অর্জনের যে প্রক্রিয়াটি দাঁড়িয়েছে সেটি ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর ধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ; যার লক্ষণগুলো মোটামুটি একই ধরনের। দূর কিংবা নিকট সম্পর্কের আত্মীয়স্বজন কিংবা দলীয় কিংবা কমিশনের বিনিময়ে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে নিজের লোক করে নেওয়া; মোটা দাগে এ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এই পুঁজি সম্প্রসারিত হয়। এ ধারায় মোটামুটি একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, একদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতগুলোকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রচেষ্টা এবং অন্যদিকে লুণ্ঠনজীবী কোটিপতিদের সম্পদ পুঞ্জীভূত কেন্দ্রীভূত করার প্রয়াস; শ্রেণিগত ঐক্যের কারণে পারস্পরিক বিনিময়ের মধ্য দিয়েই হয়েছে। মোদ্দাকথা, ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের অর্থ হলো, বেসরকারি খাতের মূলধনের বিকাশ মানে ব্যাংকের টাকা লুট আর প্রাইভেটাইজেশন মানে আন্তর্জাতিক পুঁজির সহযোগী খাতে শ্রমশক্তি লুণ্ঠন প্রক্রিয়ায় পুঁজির কেন্দ্রীভবন-পুঞ্জীভবন-সম্প্রসারণ।

এরশাদ তার ক্ষমতাবলে পূর্বতন কাঠামোর আকার-আয়তন এবং প্রক্রিয়ার গতিবৃদ্ধি করেছেন। ’৮০-র দশকে শুরু হওয়া বাজারকেন্দ্রিক উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটিয়েছেন। সেই মতে, জিয়াউর রহমানের শাসনকালের বাজারের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেওয়ার নীতির প্রতি দৃঢ় থেকে ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের জন্য যদ্দূর হাত প্রসারিত করা যায় করেছেন।

অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে কৃষিপণ্যের নিম্নমূল্যের কারণে লাভবান হওয়া মধ্যস্বত্বভোগী বৃহৎ পাইকার, মহাজন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই মূলত এই পুঁজিবাদেরই আশীর্বাদপুষ্ট। পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, ফসলের নিম্নমূল্য এবং কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে যাওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে সংকট তৈরি হয় তার সমাধানের জন্য দরিদ্র, ক্ষুদ্র, মাঝারি কৃষকরা জোতদারদের কাছে তাদের জমি বিক্রি করে দেন বা বন্ধকের দিকে হাত বাড়ান অথবা জমি কিংবা আগাম ফসল বিক্রি করে দেন জোতদারদের দেওয়া দামেই। পাইকার-মহাজন এবং সংশ্লিষ্ট আমলাদের সুসংগঠিত চক্রান্তের সামনে অসহায়ের মতো কৃষক তাদের শ্রম উৎপন্ন ফসল অনেক কম দামে বিক্রি করে দেন। ভূমিহীন দিনমজুরদের সংখ্যা বাড়ে এবং এই শ্রমকেই সস্তা দামে কেনে জোতদার-মহাজন-বড় কৃষকরা। অতীতের কোনো সরকারই এর বিরুদ্ধে জোরালো সক্রিয় কোনো ভূমিকা গ্রহণ করেনি, বাকসর্বস্ব প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া।

আরেকদিকে গ্রামীণ ভূমিব্যবস্থা এবং ক্ষমতার কাঠামোর বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা জিইয়ে রাখা অবশ্য সাম্রাজ্যবাদের জন্য লাভজনক। ষাট দশক থেকে স্থায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে গম সরবরাহ করে কাজের বিনিময়ে খাদ্য ইত্যাদি কর্মসূচি করে সংকট ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলছেন, “এতে লাভবান হয় সরাসরি দেশীয় শোষকদের মুরুব্বি সাম্রাজ্যবাদ কয়েকদিক থেকে: ১। তাদের উদ্বৃত্ত গমের স্থায়ী বাজার থাকছে, ২। এসব দেশে স্থায়ীভাবে সংকট বজায় রেখে নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে, ৩। প্রশাসনযন্ত্র এবং তাদের ওপর নির্ভরশীল পরগাছা শ্রেণিসমূহের মধ্যে দুর্নীতি বিস্তৃত করা সম্ভব হচ্ছে, ৪। মানুষকে করুণার মুখাপেক্ষী করে মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ৫। এগুলোর দাম পরিশোধের পদ্ধতিগত নিয়মানুযায়ী দেশীয় মুদ্রায় সে টাকায় অভ্যন্তরীণ তৎপরতা চালানো সহজ হয় এবং একইসঙ্গে এ রকম সংকটের সুযোগে এসব দেশের সরকারের ক্ষমতা আরও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়।”১৭

তিনি আরও বলছেন, “… বাস্তব ঘটনা থেকেই এটা সুস্পষ্ট যে এ সংকটগুলোতে প্রত্যক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের ক্ষমতার কাঠামোর শীর্ষে অবস্থানরত ধনী কৃষক, বড় ব্যবসায়ী (যাদের অধিকাংশ আবার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য, চেয়ারম্যান, এমপি প্রমুখ) সংশ্লিষ্ট আমলা, অন্যান্য শ্রেণি থেকে আগত সুবিধাভোগী কিছু ব্যক্তি এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ। যেহেতু পুরো অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্র এদের নিয়ন্ত্রণে সেহেতু এরা এই সংকট অব্যাহত রাখতেই সচেষ্ট থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ঐতিহাসিকভাবে তা-ই আমরা দেখেছি।”১৮

বণ্টন এবং অনুৎপাদনশীল খাতের বিকাশের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে উৎপাদনশীল রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ধ্বংসের। বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, “এখানে (বাংলাদেশে) শিল্প হচ্ছে না তার মূল কারণ – ১৯৭২ সাল থেকে যে প্রক্রিয়া এখানে শুরু হয়েছে – জাতীয়করণ ইত্যাদির ফলে আমরা দেখেছি এখানে ব্যক্তিগত পুঁজি ব্যবসায় খাতে চলে গেছে এবং ব্যবসায়ের যে মুনাফা সেটা এখন দাঁড়িয়েছে শিল্প, কৃষি ইত্যাদির মুনাফার চেয়ে অনেক বেশি মুনাফা। মুনাফাই হচ্ছে পুঁজির চালিকাশক্তি। পানি যেমন নিচের দিকে গড়িয়ে যায় তেমনি পুঁজি গড়িয়ে যায় মুনাফা যেদিকে বেশি। কাজেই শিল্প-পুঁজিকে গলিয়ে দিয়ে সেটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই ব্যবসায় বাণিজ্য খাতে। এবং এখানে শিল্প যারা গড়ে তুলছেন তারা নিজের পয়সায় খুব কমই করছেন। নানাভাবে ঋণ ইত্যাদি ব্যাংক থেকে নিয়ে অনেকে উধাও হচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। শিল্প-পুঁজি বলতে যে জিনিসটা সেটা কিন্তু এখানে হচ্ছে না। গ্রামাঞ্চলে ‍ভূমি-সংস্কার হচ্ছে না। ভূমি-সংস্কার শিল্পের উন্নতির পক্ষে অপরিহার্য একটা শর্ত, সেটা হচ্ছে না।”১৯

রাষ্ট্রায়ত্ত পুঁজির বিকাশ অন্যদিকে আবার বহুজাতিক কোম্পানির পুঁজির সম্প্রসারণের জন্য সমস্যাজনক যেমন, তেমনি দেশীয় কমিশনভোগী শাসক সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত ধন-সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বড় বাধা। অন্যদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত খাত তথাকথিত উদারনৈতিক বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বিধায় “দুর্বল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রধান (ঋণ)দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর পরামর্শ অনুযায়ী আরও উন্মুক্ত অর্থনৈতিক নীতিতে স্থানান্তরিত হয়। প্রভাবশালী অর্থনৈতিক অভিজাতরা এই পরিবর্তনকে সমর্থন করেছিল কারণ এই নীতির দ্বারা তারা খুবই উপকৃত হয়েছিল। নবগঠিত রাষ্ট্রে রপ্তানিমুখী শিল্প উন্নয়ন কৌশল এবং বাণিজ্য উদারীকরণ নীতিগুলো সফল হয় কারণ রাষ্ট্র শাসকশ্রেণির কাছ থেকে উচ্চমাত্রার স্বায়ত্তশাসন অর্জন করেছিল। সাধারণ নীতি-পরিকল্পনা-নির্দেশিকা সম্পর্কে আগ্রহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি জাতীয় ঐকমত্য ছিল। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই নীতির সমর্থনে ছিল।”২০ ফলে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-পুঁজির চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে মিল রেখেই এ অঞ্চলের অর্থনীতির গতি নির্ধারিত হয়।

সব মিলিয়ে তৃতীয় বিশ্ব হচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদীদের স্বর্গরাজ্য, যা ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীন যেমন ছিল, সে ধারাই কিছুটা এদিক-সেদিক করে অব্যাহত রয়েছে। শক্তিশালী অর্থনৈতিক নিয়মনীতির দেশে যে মুনাফা অর্জিত হতে পারে তার চেয়ে বহুগণ বেশি মুনাফা অর্জিত হয় (বাংলাদেশের মতো) তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। দালাল শ্রেণি তাদের সহযোগিতার জন্য ভালো প্রতিদান পায়। এর নেতারা মার্কিন সরকারের পাঠানো বৈদেশিক সাহায্যের সঙ্গে তাদের পকেট ভারী করার সুযোগ উপভোগ করেন।২১ আর এ কাজে সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা দিতে পারে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনী। সন্ত্রাস ও দমনের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে অবস্থানকারী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র ও প্রশিক্ষিত নিরাপত্তা বাহিনী ধরনের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তথাকথিত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কার্যক্রমে সচেষ্ট থাকে। সমরাস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় তথা মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স সম্প্রসারণের তাতে বড় সুবিধা। গণ-অসন্তোষ-প্রতিরোধ-প্রতিবাদ-বিদ্রোহ-বিপ্লব হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও নব্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এ পথে এগোনোর চেষ্টা চালায় দেশীয় শাসকদের সহায়তায়। কারণ, এতে ‘স্বাভাবিক’ মুনাফার হারের চেয়ে অধিক হারে মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা থাকে।

আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এজেন্ডা এবং বেসামরিক-সামরিক শাসকশ্রেণির দলীয় এজেন্ডা যে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ তা উপলব্ধি করা যায় জিয়াউর রহমান কিংবা জেনারেল এরশাদের দল গঠন প্রক্রিয়া এবং তাদের ঘোষণা, কর্মসূচি ইত্যাদি থেকে। সামরিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকেই ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। জেনারেল এরশাদও তাই করেন। রাজনৈতিক শক্তির বিভিন্ন স্রোত থেকে দলটির মূল গঠন উদ্ভূত: (১) সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্র থেকে তার সমর্থকরা, (২) ডানপন্থি মুসলিম ‘লীগ’ যা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল এবং যারা শেখ মুজিব শাসনামলে চাপের মধ্যে ছিল, (৩) বিভিন্ন বামপন্থি দল যারা শেখ মুজিব আমলে নিপীড়নের শিকার। বিএনপির ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। বিএনপি সতেরো দফা লক্ষ্যও ঘোষণা করেছিল যার মধ্যে “জনগণের গণতন্ত্র” প্রতিষ্ঠা করা, ‘রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ হ্রাস করে বেসরকারি খাতের ওপর আরও বেশি মনোনিবেশ’, ‘উৎপাদনমুখী নীতি’, ‘সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার’ এবং ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত ছিল।২২

শামসুল আলমের ভাষ্যমতে, অন্যদিকে “১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে সামরিক শাসনের তথাকথিত ‘সিভিলিয়ানাইজেশন’ প্রক্রিয়া জিয়া সরকারের রাজনৈতিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং এর দুটি আন্তঃসম্পর্কিত দিক ছিল: (১) সামরিক বাহিনীকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা, এবং (২) বোনাপার্টিস্ট চরিত্র অবলম্বন করে সামরিক বাহিনীকে যে কোনো শ্রেণি প্রভাবের ঊর্ধ্বে রাখা।”২৩ মজার বিষয় হলো, এরশাদের সামরিক সরকারও তারই পদাঙ্ক অনুসরণ করে। কিন্তু যে বিষয়টি সবসময় হিসাবে রাখা দরকার কিংবা বলা যায়, শাসকগোষ্ঠীর যে দিকটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো শ্রেণির প্রশ্নটি। সমাজের যে শ্রেণিটির ওপর উভয় সরকার ভর করে তারা মূলত অনুৎপাদক ভাড়াজীবী পুঁজির ধারক-বাহক; কেন্দ্রস্থ পুঁজির উপজাত সম্প্রদায়। বহুজাতিক পুঁজির স্থানীয় বাজারজাতকারী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়; যাদের পা বাংলাদেশে, মাথা বাইরে।

সরাসরি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীনতা অর্জনের পর “কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাধীনতার ফলে প্রথম শর্ত হিসেবে একটি লুম্পেন গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে বা যা পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি কমপ্রেডর গোষ্ঠী হলো যারা তার নিজের দেশকে বিদেশি স্বার্থের জন্য ক্লায়েন্ট রাষ্ট্রে পরিণত করতে সহযোগিতা করে। ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র এমন একটি যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পক্ষে নিশ্চিতভাবে অনুকূল শর্তে বিনিয়োগের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। সে ধরনের একটি রাষ্ট্রে, করপোরেট বিনিয়োগকারীরা সরাসরি ভর্তুকি এবং জমি অনুদান, কাঁচামাল এবং সস্তা শ্রমের জোগান, নামেমাত্র বা অস্তিত্বহীন কর, কয়েকটি কার্যকর (দালাল) শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করে। শ্রমিকরা যেখানে কোনো ন্যূনতম মজুরি বা শিশুশ্রম বা পেশাগত সুরক্ষা আইন এবং কথা বলার জন্য কোনো ভোক্তা বা পরিবেশগত সুরক্ষা উপভোগ করে না। যে সুরক্ষামূলক আইনগুলো বিদ্যমান রয়েছে সেগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয় না।”২৪

অবস্থাদৃষ্টে প্রমাণিত যে, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে নতুন ও পুরাতন ধনীদের সমর্থনে একটি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক-রাজনৈতিক শাসনের আবির্ভাব ঘটে, যার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী২৫ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র-সংস্থার ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। বেসরকারি খাতের সম্প্রসারণ সত্ত্বেও সামরিক শাসকরা রাষ্ট্রকে বাংলাদেশ মডেলের পুঁজিবাদের নতুন কোনো মডেল ‘উপহার’ দিতে পারেননি। তারা মতাদর্শগতভাবে (রেগ্যান-থেচার মডেলেই) বেসরকারিকরণ এবং (বণিক) পুঁজিবাদী বিকাশের নীতির দিকেই ঝুঁকেছিল। রাষ্ট্র যে নীতি মডেল অনুসরণ করে তা থেকে বোঝা যায় যে নতুন আবির্ভূত গোষ্ঠীর স্বার্থ এবং ক্ষমতাসীন বেসামরিক ও সামরিক আমলাদের আদর্শিক অবস্থান মিল আছে। অন্য কারণ ছিল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের দুর্বলতা এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পেটি বুর্জোয়া অবস্থান। এই দুই দলের দলাদলি (মুক্তিযুদ্ধ ও দলীয় রাজনীতির প্রভাবের কারণে) শাসকগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে। কেন দেশীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো তথাকথিত একটি উন্নয়নশীল দেশে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধির মডেলকে সমর্থন করে? ‘প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভিত্তি, অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহের ধরন এবং বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা’২৬ ইত্যাদিই হলো অন্যতম কারণ, যার ফলে সাম্রাজ্যবাদের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ সে ক্ষেত্রে মাত্রা বৃদ্ধি করে। এটি একটি বিষাক্ত দুষ্টচক্র যার ভেতর থেকে শাসকগোষ্ঠী বাইরে বের হতে পারে না বা মুনাফার সংবর্ধন আকাঙ্ক্ষার কারণে প্রকৃত অর্থে তারা চায় না বের হয়ে আসতে। এটি পুঁজির মালিক শ্রেণিগত একটি বৈশিষ্ট্য।

জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সরকারের অক্ষমতা এবং প্রগতিশীল শক্তির দুর্বলতার ফলে এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসে। জিয়া একটি ধ্রুপদি বোনাপার্টিস্ট কৌশল প্রয়োগ করে সংক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সামাজিক শক্তিকে তাদের ভাঁজে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তদনুসারে তিনি সামরিক-আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং একটি লোকরঞ্জনবাদী (পপুলিস্ট) প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে তার ক্ষমতার ভিত্তির ভারসাম্য বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। জিয়ার মতো এরশাদও নিজের টিকে থাকার জন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছিলেন, যার মধ্যে নিজের রাজনৈতিক দল গঠন এবং একটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু জিয়ার মতো এরশাদ কখনোই সামরিক বাহিনী থেকে স্বাধীন কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি গড়ে তুলতে চাননি। ফলে সামরিক বাহিনী এরশাদের প্রতি অনুগত থাকে এবং আরেকটি সামরিক ক্যু-র আশঙ্কা হ্রাস পায়। এরশাদ সামরিক বাহিনীকে উচ্চ বেতন দিয়েছেন এবং বিভিন্ন ‘বন্ধুপ্রতিম’ দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করেছেন (ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত নথিপত্র নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে এসব খাত বিস্তৃত হয়েছিল কমিশনের ওপর ভিত্তি করে; সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ, যারা এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল তারা এর ফলে প্রচুর অর্থবিত্তের অধিকারী হয়; যেসব খবর জনসমক্ষের অগোচরেই রয়ে গেছে।) তিনি সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে নিজের বশে রাখতে পেরেছিলেন। বেশিরভাগ পাবলিক সেক্টর করপোরেশনগুলো সেনা অফিসারদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং সামরিক ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালকের পদে বসিয়েছেন।”২৭ শামসুল আলমের ভাষ্যমতে, ‘এই প্রক্রিয়ার দুটি দিক ছিল: প্রথমত, রাষ্ট্র ও বিদেশি পুঁজির ওপর নির্ভরশীল একটি বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরি করা; এবং দ্বিতীয়ত, ইসলামকে আদর্শিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা। এই দুটি প্রক্রিয়া জিয়ার শাসনামলে শুরু হলেও এরশাদ সরকারের আমলে তা ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়।”২৮

১৯৮২ সালে ক্ষমতায় আসা শাসকগোষ্ঠী উন্মুক্ত দ্বার অর্থনৈতিক নীতির সুফল লাভের আশায় বেসরকারি খাতের পরিধি প্রসার অর্থাৎ উদারীকরণ নীতির পক্ষে শাসকগোষ্ঠী যে যুক্তিটি ব্যবহার করেছিল তা ছিল, সরকারি উদ্যোগগুলো অদক্ষ এবং মালিকানাকে বেসরকারি খাতে রূপান্তরিত করে তাদের অদক্ষতার আমূল উন্নতি করা যাবে, যা উৎপাদনশীল দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। বেসরকারিকরণে পক্ষের বিদগ্ধ উকিলরা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বরাবরই এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে এসেছে। কোনো কোনো গবেষকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, “বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, বেসরকারিকরণ নীতি উৎপাদনশীল দক্ষতায় খুব বেশি উন্নতি ঘটায়নি। আইএমএফের মতে, ‘বেসরকারিকরণের তিনটি প্রধান লাভ রয়েছে: নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং বেসরকারি শেয়ারহোল্ডাররা রাজনীতিবিদদের দ্বারা সংস্থাগুলোর অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে জড়িত হওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে; শেয়ারহোল্ডাররা ফার্মের উৎপাদনশীলতা উন্নত করতে সহায়তা করে উৎপাদন প্রণোদনা দিতে পারে; এবং আর্থিক সহায়তার জন্য সরকারের পরিবর্তে বেসরকারি পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে।” শুধু মালিকানা হস্তান্তর এ খাতের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে পারে না। এটি মূলত সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বাজার কাঠামো এবং উদ্যোক্তা শ্রেণির চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার প্রকৃতি এবং সে অনুসৃত নীতিকৌশল থেকে বোঝা যায় যে, রাষ্ট্রের শ্রেণিভিত্তি এবং অর্থনৈতিক অভিজাতদের অর্থনৈতিক স্বার্থই এ ধরনের উন্মুক্ত দ্বার নীতির অপরিহার্যতার মূল কারণ।২৯

উদারীকরণ নীতির প্রতি অনুগত থাকার ফলে সরকার উদার আমদানি ও রপ্তানি নীতির প্রস্তাব করে। দেশীয় সম্পদ সংগ্রহ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাস করে। বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প ইউনিটগুলোতে বিনিয়োগ করে মূলত বেসরকারি খাতের মূলধন ভার লাঘব এবং বিকাশকে কেন্দ্রে রেখে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। শুল্ক কাঠামোর সরলীকরণ, দেশীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্বাচনী প্রণোদনা, কর রেয়াত নীতি এবং অনুকূল সুদের হারের মতো পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হয়, কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী বেসরকারি শিল্পখাত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।

বিনিয়োগ সত্ত্বেও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের রুগ্‌ণদশার কথা উল্লেখ করে (সাব-সেল অর্থাৎ শিল্প ইউনিট যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নবগঠিত সংস্থা) প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী) কামরুল আলম জানিয়েছেন যে, “শুধু তিনটি খাত–পাট, রাবার ও প্রিন্টিং-এর ৩৯টি ইউনিট ছিল রুগ্‌ণ। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির তথ্যানুযায়ী, সরকার বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত ও অনুমোদিত শিল্প ইউনিটের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি ছিল রুগ্‌ণ। ১৯৮৯-৯০ এবং ১৯৯০-৯১ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৮৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আরেকটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৮৩-৮৪ থেকে ১৯৯০-৯১ সময়কালে পাট উৎপাদন খাতে পুঞ্জীভূত ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। সরকারি সংস্থা ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা।”৩০

একটি হিসাবে দেখা যায় যে, বেসরকারি পর্যায়ে শিল্প স্থাপনে উৎসাহ দিতে ৩৩টি পাটকল এবং ২৫টি বস্ত্রকল থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করে সেগুলো বাংলাদেশি মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ করেন এরশাদ।৩১ কোন প্রক্রিয়ায় এসব মিল ব্যক্তিমালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হলো, তার কিছুটা ধারণা করা যায় তার সরকারের পরিচালনার ধরন থেকে। “বেসরকারি খাতের পারফরম্যান্সও অসন্তোষজনক। বেসরকারি খাতের ঋণ পরিশোধের পারফরম্যান্স দেখায় যে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধির জন্য উদ্যোগগুলো কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, শিল্প ঋণ সংস্থা, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) বিভিন্ন তফসিলি বাণিজ্যিক ও শিল্প ব্যাংক কর্তৃক ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রহীতাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়। মোট ঋণের মধ্যে ৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মন্দ ঋণ, যা মুদ্রা ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। ঋণের টাকার বেশিরভাগই চলে যেত মুষ্টিমেয় কয়েকজনের হাতে। প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ২২৩ জন ঋণখেলাপির কাছে পড়ে ছিল। এর মধ্যে বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয় ৭১ জন, আইসিবি থেকে ১২ জন এবং বিএসআরএস থেকে ঋণ নেয় ৪০ জন। সরকারি খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হজার ১০০ কোটি টাকা। মোট ঋণের মাত্র ৩৬ শতাংশ গেছে শিল্পে এবং ২১ শতাংশ কৃষিতে।… বেসরকারি খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করায় সরকারি খাতে বিনিয়োগ কমলেও শিল্প খাতে বেসরকারি তহবিলের বিনিয়োগ হয়নি। এতে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি এবং জাতীয় সঞ্চয় ও বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।”৩২

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ হাসিল করে উদারীকরণের পথে লে. জে. এরশাদ এ রকম আরও বহু ধরনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। যেসব প্রক্রিয়ার মধ্যেই ছিল দুর্নীতির বীজ। প্রসঙ্গত, সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক প্রকল্প সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র-সংস্থার আর্থ-রাজনৈতিক প্রকল্পের বাইরের কোনো বিষয় ছিল না। আন্তর্জাতিক পুঁজির সহযোগী হিসেবে খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। প্রাইভেটাইজেশন ছিল যার মধ্যে অন্যতম। যে প্রক্রিয়ায় প্রাইভেটাইজেশনের ঘটনাটি মঞ্চস্থ হয় তার মধ্যেই দুর্নীতির বীজটি গ্রথিত থাকে। কমিশন, ঘুষ, উপরি ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ ব্যক্তিমালিকদের কাছে ফেরত দেওয়ার কারণে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পরবর্তী সময়ে শর্তভঙ্গের জন্য নব্য মালিকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো ধরনের তাগিদ যেমন তাতে থাকে না কিংবা নৈতিক শক্তি যেমন থাকে না তেমনি নব্য ধনীগোষ্ঠীও সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্র এবং ব্যবসা এভাবে পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ হয়; পুঁজি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা এ প্রক্রিয়াতেই জৈবিক সম্পর্কে পরস্পর পরস্পরের অঙ্গীভূত হয়। সুতরাং যেটি সাধারণত বলা হয় যে, দুর্নীতি ব্যবস্থার বাইরে আলাদা কিছু; বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। দুর্নীতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অঙ্গীভূত নীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত একটি বিষয়; নীতিরই অংশ। সে সূত্রে, বাংলাদেশের উদারনৈতিক প্রাইভেটাইজেশন নীতি-পরিকল্পনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ দুর্নীতি। অন্যদিকে এই দুর্নীতির খবর যাতে জনসমক্ষে প্রচার করা না হয় তার জন্য প্রয়োজন হয় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার। পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, “পূর্ববর্তী সরকারগুলোর তরফ থেকে বিভিন্ন সময় সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করা হলেও এরশাদ আমলে তা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়”৩৩ এবং এর ফলে জনগণের অগোচরেই এসব কার্যক্রম চলতে থাকে; দুর্নীতির বিস্তার ঘটে।

এরশাদ বিশ্বের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাবেন। যিনি ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও তার এবং তার পরিবারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়নি এবং পরবর্তী সময়ে বহাল তবিয়তে রাজনীতি করে গেছেন। সামান্য কয়েকটি নমুনা বিষয়টি অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট। যেমন: রাষ্ট্রপতি থাকাকালে পাওয়া উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে আর্থিক অনিয়মের মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। দুই যুগ পর হাইকোর্ট সেই সাজা বাতিল করে এরশাদকে খালাস দেন। জাপানি নৌযান কেনায় অনিয়মের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এরশাদের প্রথমে তিন বছর এবং পরে হাইকোর্টে আপিলে সাজা কমে দুই বছরের কারাদণ্ড হয়। গ্রেফতার হওয়ার পর দুই বছর কারাগারে কাটানোয় এরশাদকে নতুন করে আর ওই মামলায় দণ্ড ভোগ করতে হয়নি। জনতা টাওয়ার দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত এরশাদকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। প্রায় ১৭ বছর পর হাইকোর্ট সাজা কমিয়ে এরশাদকে ৫ বছরের কারাদণ্ড এবং ৫ কোটি ৪৮ লাখ ৭০ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা করেন। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলাকালে এরশাদের সাড়ে ৩ বছর কারাভোগ শেষ হওয়ায় আপিল বিভাগ পরে জরিমানার দণ্ড বহাল রেখে এরশাদকে অবশিষ্ট দেড় বছর সাজাভোগ থেকে অব্যাহতি দেন। এ ছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান, টেলিকম দুর্নীতি, পোলট্রি ফার্ম দুর্নীতি মামলা, আয়কর ফাঁকি, জাহাজ কেনায় দুর্নীতি, রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, হরিপুরে তেল অনুসন্ধানে দুর্নীতি এবং রাডার কেনায় দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে আরও ১৯টি মামলা ছিল এরশাদের বিরুদ্ধে।৩৪

এরশাদ বিশ্বের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাবেন। যিনি ব্যাপক মাত্রায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকা সত্ত্বেও তার এবং তার পরিবারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়নি এবং পরবর্তী সময়ে বহাল তবিয়তে রাজনীতি করে গেছেন। সামান্য কয়েকটি নমুনা বিষয়টি অনুধাবনের জন্য যথেষ্ট।

ক্ষমতার চূড়া থেকে এরশাদের পতনের দৃশ্যটি খুব কাছ থেকে দেখেছেন সে সময় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের দায়িত্ব পালনকারী মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খান। পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর পদচ্যুত রাষ্ট্রপতি শেষবারের মতো তার অফিসে যান। সেখানে তিনি আধা ঘণ্টা ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত কাগজপত্র সরিয়ে নেন এবং তার ব্যক্তিগত সচিব ৪ কোটি ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অফিস থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন।”৩৫

ক্ষমতায় থাকাকালীন এবং ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জেনারেল এরশাদের দুর্নীতি নিয়ে নানা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ১৯৮৬ সালে ব্রিটেনের ‘দ্য অবজারভার’ পত্রিকা এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। “… মরিয়ম মমতাজ নামে এক নারী নিজেকে এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী দাবি করে দৈনিক অবজারভার পত্রিকাকে বলেন, জেনারেল এরশাদ আমেরিকা ও সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এবং ওয়াশিংটন পোস্টসহ নানা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এরশাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের শিরোনাম হয়েছিল। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দুর্নীতির মামলায় কারাগারেও থাকতে হয়েছে তাকে।”৩৬

পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর পদচ্যুত রাষ্ট্রপতি শেষবারের মতো তার অফিসে যান। সেখানে তিনি আধা ঘণ্টা ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত কাগজপত্র সরিয়ে নেন এবং তার ব্যক্তিগত সচিব ৪ কোটি ৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা অফিস থেকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন।”

তিনি তার শাসনামলে রাষ্ট্র এবং অর্থনীতির পুনর্বিন্যাসের সময়কালে অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর ক্ষমতা এবং কৌশলগুলোতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটান। বেশিরভাগ পরিত্যক্ত সম্পদ বরাদ্দ হওয়ার পর পুঁজির আদিম শিকারি, সুবিধাভোগী এবং পুরোনো মালিকরা এ সময়কালে ধীরে ধীরে পুনরায় সংগঠিত হয় এবং ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে উপদলগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপন করে। নব্য সম্পত্তিবানদের অনেকেই রাজনৈতিকভাবে প্রত্যক্ষ সুবিধার ভাগীদার ছিলেন এবং তারা বিদ্যমান গোষ্ঠীগত কাঠামোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিলেন। এ ধারায় আদিম সঞ্চয় প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বিকাশে বিনিয়োগ এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের শর্তও তৈরি হয়। পাশাপাশি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতা অর্জনেরও শর্ত তৈরি হয়।৩৭ বলা বাহুল্য যে, সামগ্রিক পুঁজির খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ উৎপাদনশীল পুঁজি গঠনের শর্ত পূরণে এগিয়ে আসে। কিন্তু সামগ্রিক অর্থনীতির উৎপাদনশীল বিনিয়োগের ক্রমাগত অবনতির ধারাকে এই অংশ খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি।

‘উন্নয়ন তত্ত্ব’ বা ‘আধুনিকীকরণ তত্ত্ব’ সম্পর্কে বিশ্বের বহু তাত্ত্বিক তাদের বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, সর্বজনের আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সঙ্গে এসব তত্ত্বের খুব একটা সম্পর্ক থাকে না। শাসকশ্রেণি এবং তার ধামাধরা ভাড়াটে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীরা কথার ফুলঝুরি সাজিয়ে এসব তত্ত্ব সাধারণের সামনে উপস্থিত করেন। এর আড়ালে শোষণ-শাসনের যাবতীয় প্রক্রিয়াকে আড়াল করা হয়। তৃতীয় বিশ্ব নামক দেশগুলোতে এই ‘উন্নয়ন’ তকমার মুখোশে যা আবির্ভূত হয়েছে তা পরনির্ভরশীল পুঁজিবাদের তীব্র শোষণমূলক রূপ। আন্তঃদেশীয় করপোরেট বিনিয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় অর্থনৈতিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়। সমস্যাটি দরিদ্র, জমি বা অনুৎপাদনশীল জনসংখ্যা নয়; বরং দেশি-বিদেশি শ্রেণি শোষণ এবং শ্রেণি বৈষম্যমূলক উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত। বিনিয়োগকারীরা একটি দেশে যাবতীয় কার্যক্রম চালায় উন্নয়নের জন্য নয়, বরং নিজেকে সমৃদ্ধ করতে। মাইকেল প্যারেন্টির বক্তব্য এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ যে, “এসব দেশের (তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের) মানুষকে চাষাবাদ শেখানোর প্রয়োজন নেই। তাদের চাষের জন্য জমি এবং সরঞ্জাম দরকার। তাদের মাছ ধরা শেখানোর দরকার নেই। তাদের নৌকা এবং জাল এবং উপকূলের সম্মুখভাগ, উপসাগর এবং মহাসাগরগুলোতে অ্যাকসেস প্রয়োজন। জলে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা বন্ধ করতে তাদের শিল্পকারখানা দরকার। তাদের বোঝানোর দরকার নেই যে তাদের স্বাস্থ্যকর মান ব্যবহার করা উচিত। তাদের জল ফুটিয়ে নিতে বলার জন্য তাদের পিস কর্পস স্বেচ্ছাসেবকের দরকার নেই, বিশেষত যখন তারা জ্বালানি কিনতে পারে না বা জ্বালানি কাঠের অ্যাকসেস নেই। তাদের এমন অবস্থা দরকার যাতে তারা বিশুদ্ধ পানীয় জল, পরিষ্কার কাপড় এবং ঘরবাড়ি পেতে পারে।… তাদের জমি ও শ্রম ফিরিয়ে দিতে হবে যাতে তারা নিজেদের জন্য কাজ করতে পারে এবং নিজেদের ভোগের জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে পারে।”৩৮

সামরিক শাসনের দশকে বাংলাদেশের ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের সামগ্রিক চিত্রটি বিশ্লেষণ করে তার পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় সম্পর্কে আনু মুহাম্মদ বলছেন, “বাংলাদেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী তার নিজেদের দেশের বুর্জোয়া শাসক-শোষক শ্রেণির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুঁজির শোষণের শিকার। তাদের শোষণের বিনিময়ে এ দেশে শাসক-শোষকদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে প্রায় আন্তর্জাতিক মানের বিত্তশালী। যাদের ভূমিকা, আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির সক্রিয়তা বজায় রাখার জন্যও নির্ধারিত। নির্ধারিত এই দায়িত্ব ওপর থেকে চাপানো নয়, নিজেদের চাহিদার সঙ্গে বাইরের চাহিদার সম্মিলনেই এটা ঘটেছে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদের শোষণ থেকে মুক্তির অর্থ এ দেশীয় শাসক-শোষকশ্রেণির বিনাশসাধন এবং দেশীয় শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির অর্থ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলগুলো সমূলে উৎপাটন।”৩৯ (চলবে)

মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। ই-মেইল: mehedihassan1@gmail.com

আগের কিস্তি: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-১৩

তথ্যনির্দেশ

মধুসূদন চক্রবর্তী; মার্কসবাদ জানবো, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, দ্বিতীয় মুদ্রণ, জুলাই, ১৯৬১, কলিকাতা, পৃ. ৫৮।

এঙ্গেলস-এর অ্যান্টি-ডুরিং, অনুবাদ: সরদার ফজলুল করিম, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৩০।

Ali Riaz; State, Class and Military Rule in Bangladesh: 1972-1982, Ph.D. University of Hawaii, 1993, p. 49.

S. M. Shamsul Alam; The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh, South Asin Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P. 33.

শিরোনাম: হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ: তার সফলতা এবং বিতর্কের নানা দিক, আকবর হোসেন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ১৪ জুলাই ২০১৯, https://www.bbc.com/bengali/news-48979109.

S. M. Shamsul Alam; The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh, South Asin Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P. 34.

A. M. Quamrul Alam; ‍State and Capital Accumulation: The problems of Capitalist Transformation in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, Vol. XVII, no. 1 (1994), pp. 43-55, http://dx.doi.org/10.1080/00856409408723197.

অজয় দাশ গুপ্ত, মাহবুব জামান, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলে বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রাচ্য প্রকাশনী, ১৯৮১, ঢাকা, পৃ. ৬৮-৬৯।

প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০।

১০ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।

১১ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২।

১২ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭২।

১৩ আনু মুহাম্মদ; কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ, প্রথম সংস্করণ জানুয়ারি, ২০০৮, সংহতি প্রকাশন, ঢাকা, পৃ. ৫৬।

১৪ প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।

১৫ প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭।

১৬ Pillars of neoliberalism such as the privatisation and commodification of state functions created the social conditions for the rise of twin problems: corruption and crime. The deregulation of private enterprise and the privatisation of state functions have deepened the nexus between the political class and the capitalist class. Granting state contracts to private enterprises and cutting back on regulations, for instance, has provided immense avenues for bribes, kickbacks, and transfer payments to proliferate. Simultaneously, the increased precarity of life and the evisceration of social welfare increased the volume of petty crime, including through the drug trade.” Vijay Prashad; The Dangerously Appealing Style of the Far Right, The Forty-Eighth Newsletter (2023), November 30, 2023, https://thetricontinental.org/newsletterissue/argentina-elections-and-the-rise-of-the-far-right/.

১৭ আনু মুহাম্মদ; আনু মুহাম্মদ রচনাবলী, খণ্ড ১, বাঙ্গালা গবেষণা প্রকাশনা, ২০২৩, পৃ. ২৭১-২৭২।

১৮ প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭২।

১৯ বদরুদ্দীন উমর: ভাষা, শ্রেণি ও সমাজ, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৫, পৃ. ৫৪-৫৫।

২০ A. M. Quamrul Alam; ‍State and Capital Accumulation: The problems of Capitalist Transformation in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, Vol. XVII, no. 1 (1994), pp. 43-55, http://dx.doi.org/10.1080/00856409408723197

২১ Michael Parenti; Against Empire, City Lights Books, San Francisco, 1995, page-11-12.

২২ S. M. Shamsul Alam; The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh, South Asin Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P. 35.

২৩ –Ibid–

২৪ Michael Parenti; Against Empire, City Lights Books, San Francisco, 1995, p. 11.

২৫ সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মাইকেল প্যারেন্টির বিশ্লেষণ উল্লেখযোগ্য। তিনি তার বইতে দেখিয়েছেন যে, “Imperialism is older than capitalism. The Persian, Macedonian, Roman, and Mongol empires all existed centuries before the Rothschilds and Rockefellers. Emperors and conquistadors were interested mostly in plunder and tribute, gold and glory. Capitalist imperialism differs from these earlier forms in the way it systematically accumulates capital through the organized exploitation of labor and the penetration of overseas markets. Capitalist imperialism invests in other countries, dominating their economies, cultures, and political life, and integrating their productive structures into an international system of capital accumulation.” Ibid–p,5-6.

২৬ A. M. Quamrul Alam; ‍State and Capital Accumulation: The problems of Capitalist Transformation in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, Vol. XVII, no. 1 (1994), pp. 43-55, http://dx.doi.org/10.1080/00856409408723197

২৭ S. M. Shamsul Alam; The Military and the Crisis of Political Hegemony in Bangladesh, South Asin Bulletin, volume 10 number 2, (Fall, 1990), Published by Duke University Press, P. 36-37.

২৮–Ibid–

২৯ A. M. Quamrul Alam; ‍State and Capital Accumulation: The problems of Capitalist Transformation in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, Vol. XVII, no. 1 (1994), pp. 43-55, http://dx.doi.org/10.1080/00856409408723197

৩০ –Ibid–

৩১ শিরোনাম: রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এরশাদের সেরা ১০০ অবদান, সাঈদ আল হাসান শিমুল, ১৪ জুলাই ২০১৯, https://www.jugantor.com/politics/199215/রাষ্ট্রপ্রধান-হিসেবে-এরশাদের-সেরা-১০০-অবদান ও শিরোনাম: পল্লীবন্ধু এরশাদ: এক দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, খন্দকার দেলোয়ার জালালী, ২০২০, https://www.jugantor.com/viewers-opinion/325850/পল্লীবন্ধু-এরশাদ:-এক-দূরদর্শী-রাষ্ট্রনায়ক

৩২ A. M. Quamrul Alam; ‍State and Capital Accumulation: The problems of Capitalist Transformation in Bangladesh, South Asia: Journal of South Asian Studies, Vol. XVII, no. 1 (1994), pp. 43-55, http://dx.doi.org/10.1080/00856409408723197

৩৩ শিরোনাম: এরশাদনামা: আন্দোলন ও কেলেঙ্কারির যেসব খবর ছাপা হতো না, ২৪ মার্চ ২০২৪, https://www.prothomalo.com/bangladesh/ckefen2oqv ও সৈয়দ আবদাল আহমদ; স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামল: যেসব খবর ছাপা যায়নি, https://jpcbd.org/Resource/50/ershad.pdf

৩৪ শিরোনাম: এরশাদনামা; মোহাম্মদ আল-মাসুম মোল্লা, জুলাই ২০১৯, https://bangla.thedailystar.net/node/116053 ও শিরোনাম: এরশাদের দুর্নীতি মামলার আপিলের রায় ৯ মে, এপ্রিল ১২, ২০১৭, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, https://www.banglanews24.com/index.php/print/567134

৩৫ শিরোনাম: এরশাদের উত্থান, পতন ও পুনরুত্থান, মহিউদ্দিন আহমদ, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭, https://www.prothomalo.com/opinion/column/এরশাদের-উত্থান-পতন-ও-পুনরুত্থান

৩৬ শিরোনাম: হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ: তার সফলতা এবং বিতর্কের নানা দিক, আকবর হোসেন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা, ১৪ জুলাই ২০১৯, https://www.bbc.com/bengali/news-48979109

৩৭ Mushtaq H. Khan, The politcal Settlement, Growth and Technical Progress in Bangladesh, DIIS Working Paper, 2012:01, 2013, Denmark, p. 50.

৩৮ Michael Parenti; Against Empire, City Lights Books, San Francisco, 1995, p. 10.

৩৯ আনু মুহাম্মদ; সামরিক শাসনের দশকে, নবরাগ প্রকাশনী, ২০১১, পৃ. ২৩।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •