দিল্লীর দিল! শহরের নির্ঘুম মানুষ ও অসুস্থ পাখিদের বয়ান
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন
“স্বাধীন/আজাদ হচ্ছে সেই যে নিজের ইচ্ছামতো ঘুমাতে পারে এবং নিজের ইচ্ছেমতো জেগে উঠতে পারে।”
- শাকিল/মনোজ (ঘুমের শহরের প্রধানতম চরিত্র)।
সিনেমা সম্পর্কিত তথ্য
নামঃ ঘুমের শহর। সালঃ ২০১৫। ভাষাঃ হিন্দি। পরিচালকঃ শৌনক সেন। প্রযোজকঃ বীরেন্দ্র কুন্ডু। সম্পাদকঃ শৌনক সেন, শ্রেয়া চ্যাটার্জি। চিত্রায়নঃ শৌনক সেন, সেলিম খান। সুরকারঃ ঋত্বিক দে। শব্দঃ আমান মান সাহিল ধিংড়া। দৈর্ঘ্যঃ ৭৪ মিনিট। দেশঃ ভারত।
শহরে ঘুমানোর জায়গা খুজতে থাকা মানুষের চালচিত্র অথবা ঘুমাবো কোথায়?
পৃথিবীর গরিব, বড়লোক, মধ্যম আয়ের দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, উদীয়মান অর্থনীতির দেশ, উত্তর গোলার্ধের দেশ, দক্ষিণ গোলার্ধের দেশ ইত্যাদি নানান বাহারি শব্দের তকমাধারী সবগুলো দেশেই রয়েছে বিপুল সংখ্যক “গৃহহীন” মানুষ। সাধারণ কথায় যাদের থাকা, খাওয়া, পরা, ঘুমানো, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের কোন দায় রাষ্ট্র, তার কোন সংস্থা নেয়না। এবং অপরদিকে খুব ব্যতিক্রম এবং লাভ ছাড়া সুশীল সমাজ, বিদ্বান, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, এনজিও সহ সবাই সাধারনত এ “শ্রেণীর” সাথে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে, ছোয়াচে রোগের মতো। তাদের জীবন চলতে থাকে ঢেকে আড়াল করে রাখা ময়লা আবর্জনার মতো, সবার সামনে থাকলেও তাদের কেউ দেখেনা, দেখতেও চায়না। যদিও এই মানুষদের শোষণের উপর নির্মিত পৃথিবীজোড়া নানান তকমার শাসন ও অর্থ ব্যবস্থা এবং চলমান মানুষ কেন্দ্রিক সভ্যতা। সকল দেশের ছোট বড় শহরগুলোতে এরকম শ্রেণীর “পরজীবী” দেখতে পাওয়া যায়।
প্রতিবেশী পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়, সে দেশের রাজধানী নয়াদিল্লীতে রয়েছে বিশাল সংখ্যক “গৃহহীন” মানুষের দল, যাদের জীবনের প্রধানতম সমস্যা- ঘুমাতে না পারা এবং ঘুমানোর জন্য সামান্যতম জায়গার অভাব, এমনকি রাস্তায়, পার্কেও তাদের ঘুমানোর “অধিকার” নেই। এহেন মানুষদের একজন “শাকিল”। যে নিজের হিন্দু ধর্ম পরিচয় এবং “মনোজ” নাম বদলে ফেলেছে এলাকার মুসলিমদের সাথে মিলে থাকার সুবিধার্থে এবং “শাকিল” নাম পরিচয় গ্রহণ করেছে। বোঝা যায় ধর্মীয় “অপরিবর্তনশীলতা” এবং “পরিচয়” সব শ্রেণী ও মানুষের কাছে সমান নয়! তো সে সহ সম শ্রেণীর হিন্দু, মুসলিম নানাবিধ মানুষ নিয়ে, দিল্লী শহরের মিনাবাজার ও লোহা পুল এলাকার কাহিনী, প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন শৌনক সেন তার প্রথম পূর্নদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “ঘুমের শহরে” (২০১৫)।
সিনেমার শুরু হয় ধনবানদের ঝকঝকে তকতকে অংশের দিল্লীর রাস্তা দিয়ে, যখন সাথে শোনা যাচ্ছে মাঝরাতের খবর, খবরের শুভরাত্রি। রাস্তাঘাট নিরিবিলি, সবাই যার যার গৃহে। কিন্তু মিনাবাজারের শাকিলের চোখে, মনে, শরীরে ঘুমের বাসনা থাকলেও ঘুমানোর কোনপ্রকার জায়গা নেই। সে ঘুমানোর জায়গা খুঁজছে। সাথে সাথে বলে যাচ্ছে ঘুম নিয়ে তার বয়ান, ঘুম নির্ভর বয়ান, গভীর দর্শন, তত্ত্ব। সে জানায় যার ইচ্ছেমতো ঘুমানোর জায়গা রয়েছে এবং সে জায়গার রকমফেরের উপর ভিত্তি করে মেপে ফেলা যায় তার কত কি “ক্ষমতা” রয়েছে। শাকিলকে অনুসরণ করে চলতে থাকে মিনাবাজারের রাতের ঘুমের জায়গার বিবরণ, অবস্থা। তখন চলছিল শীতকাল, রাতের তাপমাত্রা সেদিন ছিল নয় ডিগ্রি, মাঝরাত অবধি ঘুমের জায়গা খুজে বেড়াচ্ছিল সে। মিনাবাজারে জামাল ভাইয়ের ব্যবস্থাপনায় ঘরে বাইরে মিলিয়ে থাকার ব্যবস্থা, ঢালাও বিছানা। ঘরে ঘুমানোর ভাড়া বেশী, বাইরে ঘুমানোর ভাড়া কম।
এরপর শুরু লোহা পুলের ঘুমের জায়গার বিবরণ, কাহিনী। সেখানে তখন গরমকাল, মাঝরাত, তাপমাত্রা ছত্তিরিশ ডিগ্রি। যমুনা নদীর উপরের লোহার ব্রিজের নিচে নানা বিচিত্র উপাদান দিয়ে চারিদিক ঘিরে তৈরি করা হয়েছে একপ্রকার “সিনেমা হল”। যেখানে চলছে বলিউডের হিন্দি সিনেমা, রয়েছে সেসব নায়ক নায়িকার পোস্টার। মালিক রণজিৎ স্বয়ং টিকেট বিক্রি, ছোট ডিজিটাল পর্দায় ইন্টারনেট থেকে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা চালানো, সব করে চলছেন! কাপড়ের বেড়ার ওপাশের প্রতিবেশী টঙ্গয়ের দোকানদার তার দোকান গুছিয়ে বাচ্চাসহ ঘুমাতে যাবে তাই রণজিৎকে জানিয়ে যায় যেন শব্দ/সাউন্ড কমিয়ে দেয়া হয়। রণজিৎ রাজি হয় কিন্তু মনে রাখতে হবে উপর দিয়ে চলছে মহাসমারোহে বিশাল যানবাহনের বহর। হাত কয়েক দূরে বয়ে যাচ্ছে নদী যমুনা, বর্ষাকালে যার দূষিত পানিতে ভেসে যায় আয়, আশ্রয় ও সাধের “সিনেমা হল”।
চারিদিকে মশামাছি, ডেঙ্গু, রোগশোক, জলাবায়ুর তীব্রতায় শীতে মরে যাওয়া মানুষ, ঝরা পাতার মতন পড়ে থাকে। প্রশাসন সরিয়ে নেয় ময়লাস্বরূপ সেসব লাশ। সিনেমা শুরুর দিকের শাকিলের রোগশোক নিয়ে বলা কথাগুলো মনে পড়ে। সে বলেছিল রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারে ঘুমালে মশা মাছি কম লাগে কারন দুপাশ দিয়ে দ্রুত ধাবমান গাড়ির বাতাসে সেসব তেমন সুবিধা করতে পারেনা! ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এসব থেকে খানিক নিস্তার পাওয়া যায়। যেন গুপ্তবিদ্যা সে তার চলচ্চিত্রকার বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছে।
সে বলেছিল রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারে ঘুমালে মশা মাছি কম লাগে কারন দুপাশ দিয়ে দ্রুত ধাবমান গাড়ির বাতাসে সেসব তেমন সুবিধা করতে পারেনা! ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এসব থেকে খানিক নিস্তার পাওয়া যায়। যেন গুপ্তবিদ্যা সে তার চলচ্চিত্রকার বন্ধুদের সাথে ভাগ করে নিচ্ছে।
প্রায় আড়াই বছর ধরে চিত্রায়ন হয়েছে “ঘুমের শহর” সিনেমার, ফলে ক্যামেরাসহ লোকগুলো ধীরে ধীরে তো শাকিলের বন্ধুই হয়ে থাকার কথা! কিন্তু হয়নি, হবেওনা। শ্রেণী ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব হয়নি শৌনকের বা সাথের অন্যান্য কর্মিদের, আর গরীব শাকিলের সে সুযোগ নেই। তাই বোধহয় বোধিপ্রাপ্ত মানুষের মতোই শাকিল একসময় বলতে থাকে, কোন কিছুর প্রত্যাশা ছাড়াই যে, “তোমরা শুধু ক্যামেরা, সিনেমাই করবা, আমার কোন কাজে আসবানা, আমিতো আগের জায়গায় থেকে গেলাম এবং আরো খারাপ অবস্থায়।”।
মাঝে খুব ক্লান্ত সময়ে সে বাড়ি ফিরে যায় থেকে যাবার জন্য, মন ভরে ঘুমানোর জন্য। কিন্তু বাবার সাথে, প্রতিবেশির সাথে, পরিবেশের সাথে সে খাপ খাওয়াতে না পেরে আবার ফিরে আসে দিল্লিতে। আসলে মহানগরের ক্লান্তি, প্রতিদিনের যাপন, স্বপ্ন,শারীরিক অসুস্থতা ধীরে ধীরে তাকে “বাড়ি” থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, সে চাইলেও আর বাড়ী ফিরতে পারছেনা। বিপরীতে বাড়িও অনেক দূরে চলে গেছে তাকে ছেড়ে, বাড়িও তাকে উগরে ফেলে দিয়েছে। চলতে থাকে তার ভাসমান দিল্লীর জীবন। একসময় মিনা বাজারের জামাল ভাইয়ের টঙ্গসহ ঘুমানোর ব্যবস্থা পুলিশ জোরপূর্বক উঠিয়ে দেয়, জামাল ভাই হয়তো ভেসে ভেসে অন্যত্র। শাকিলের শরীর ধীরে ধীরে ভারি হচ্ছে, অসুস্থ হচ্ছে, অসুখেরা ছড়িয়ে যাচ্ছে শরীরে। শীতের রাতের গভীরে তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, কোন বন্ধু, স্বজন নেই। ধীরে ধীরে কমছে তাপমাত্রা। সে হলুদ পাতার মতন ঝরে পড়ার অপেক্ষা করতে করতে চলছে, তার আর কিছু করার নেই।
“তুমি শুধু সে বস্তুর আদরযত্ন করতে পারোনা যারা একই দেশ, ধর্ম, রাজনীতি, স্বভাব বা মনোভাব পোষণ করে। জীবন নিজেই আত্মীয়তা। আমরা সবাই বায়ু সম্প্রদায়। যে সমস্ত শ্বাস নেওয়া হয় তার মধ্যে পার্থক্য করা উচিত নয়।”
- নাদিম শেহজাদ (‘সব যারা নিঃশ্বাস নেয়’ সিনেমার অন্যতম চরিত্র এবং মোহাম্মদ সৌদ ও নাদিম শেহজাদের মা তাদের এমন দর্শনে অনুপ্রাণিত করেছিলেন)।
যারা নিঃশ্বাস নেয় তারা সবাই সমান
শৌনক সেনের “সব যারা নিঃশ্বাস নেয়” (২০২২) ফের দিল্লীর গল্প বলে। এবার পাখি এবং দুই ভাইয়ের গল্প, যাদের সাথে এসে যোগ দেয় সালিক নামের আরেক সদ্য তরুণ। এ তিনজন মিলে চেষ্টা করে চলেছে কি করে আরো ভালো এবং আরো নিরাপদ রাখা যায় দিল্লীর পাখিদের, বিশেষ করে ভুবন চিলদের। আগের সিনেমার মতন এখানেও সরাসরি ধারন করা সব কিছু মানে সিনেমা দেখতে দেখতেই বোঝা যায় চলচ্চিত্রকারের উপস্থিতি, আগ্রহ ও অংশগ্রহণ, যা “ডাইরেক্ট সিনেমা” বা “সিনেমা ভেরিতে”* বলে পরিচিত। চারশত ঘণ্টার ফুটেজ থেকে একানব্বই মিনিটের সিনেমা বানিয়েছেন শৌনক। দিল্লীর নানাবিধ দূষণের ভিতর দিয়েও এখনো যেসব চিলেরা বেচে আছে তাদের আহত অবস্থায় চিকিৎসা করে আবার আকাশে ফিরিয়ে দেয়ার গল্পতে সীমাবদ্ধ থেকেও “ঠিক” অন্য যেকোন “নেচার ডকুমেন্টারি” বা “এডভোকেসি/এনিম্যাল এডভোকেসি” বা শুধুমাত্র “রেস্কিউ” প্রামাণ্যচিত্রে সীমাবদ্ধ নেই “সব যারা নিঃশ্বাস নেয়”।
এবার পাখি এবং দুই ভাইয়ের গল্প, যাদের সাথে এসে যোগ দেয় সালিক নামের আরেক সদ্য তরুণ। এ তিনজন মিলে চেষ্টা করে চলেছে কি করে আরো ভালো এবং আরো নিরাপদ রাখা যায় দিল্লীর পাখিদের, বিশেষ করে ভুবন চিলদের।
দিল্লীর মুসলিম দুই ভাই মোহাম্মদ সৌদ ও নাদিম শেহজাদের সাথে পরে যোগ দেয়া সালিক, তারা সবাই মুসলিম কিন্তু ভারতের ধারাবাহিক সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়ভিত্তিক আরেকটা সিনেমা বানানোর উপাদান থাকলেও সে ঝোঁক থেকে দারুণভাবে বিরত থেকেছেন নির্মাতা। বরং আপনি চাইলে “সংখ্যালঘু নির্যাতন” খুঁজে নিতে পারেন কিন্তু শৌনকের গল্পে করুণ সুরে, মিহিভাবে তাদের “রক্ষা কর” “সবাই সমান” এ ধরণের “নিম্ন মধ্যবিত্ত” সুবিধাবাদী এবং অপরাধকে হালকা করার মতো বয়ানের ধারে কাছেও নেই। বরং রয়েছে ধৈর্য ধরে দিনের পর দিন ধরে অপেক্ষা করা, যদি ব্যবহার করার মতো কিছু ঘটে, কারণ মনে রাখতে হবে এ সিনেমার অন্যতম প্রধান চরিত্রেরা হচ্ছে তিন মানুষের সাথে দিল্লীর ভুবন চিল। আর এই অপেক্ষার ফলে তৈরি হয়েছে চমৎকার কবিতার মতন দৃশ্যসকল যারা ডিস্টোপিয়ান সময়ের সহযাত্রী হিসেবে সমসাময়িক দৃশ্যভাষায় কথা বলে। পরিস্থিতি নিয়ে নিজের মতামতের বাইরে থেকে অবস্থার গভীর সংবেদনশীলতা ও ধরণ দৃশ্যমান করে।
দিল্লীর দিল
দিল্লী শহর নিয়ে অতীতকাল থেকে বর্তমান অবধি নানাবিধ ভাবে, ধরণে নানারকম বই প্রকাশিত হয়েছে, রয়েছে নানান চিত্রকলা, ফটোগ্রাফ এবং মিরা নায়ারের প্রামাণ্যচিত্র “জামে মসজিদ স্ট্রিট জার্নাল” (১৯৮৯, ২০ মিনিট।), সহ অনেক সিনেমা, অনেক ধরণের সিনেমা। এমন যাত্রায় দিল্লী নিয়ে যথাযথ দুই প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে হাজির নির্মাতা শৌনক সেন। তার প্রথম সিনেমায় দেখিয়েছেন রাতের দিল্লীতে শুধুমাত্র ঘুমের জায়গা নেই কিরকম বিশাল সংখ্যক একদল মানুষের। তাদের ভিতর হিন্দু-মুসলিম-উঁচু জাত-নিচু জাত-নারী-পুরুষ-বাচ্চা-হিজড়া সবাই রয়েছেন। দারিদ্র সৃষ্ট ক্ষুধা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সংকট এমনকি রাতে শুধুমাত্র ঘুমানোর জায়গাহীনতা তাদের সমস্ত ধর্ম-বর্ণ-জাতপাতের বাইরে একত্রিত করে তুলেছে। যেকোন বড় শহরের মতোই দিল্লীর গরীবদের রাস্তার বাস, উপার্জন পুলিশ এসে উচ্ছেদ করে দেয় নানান আইনের উছিলায়, যেকোন সময়ে।
গরীবদের অবস্থা পৃথিবীর সবজায়গায় সমান, সমান ভাবেই অত্যাচারিত তারা। তাদের একজন শাকিল/মনোজ এবং লোহাব্রিজ নামক জায়গা নিয়ে এমনতর সিনেমা “ঘুমের শহর” নামে উপস্থাপন করেন শৌনক। তবে নানা শ্রেণী, পেশার মানুষ নিয়ে মুম্বাই, কলকাতা, দিল্লী বা লাহোরসহ দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহরগুলো নিয়ে অনেক ধরণের শিল্পকর্ম, সিনেমা, বই রচিত হলেও আরেক শহর ঢাকার এমন শ্রেণীর মানুষ নিয়ে খুব গুরুত্ববহন করে ধরণের কাজ সব মাধ্যমেই কম এবং তা সিনেমার ক্ষেত্রে আরো কম। তবে ঢাকা শহরের নানান সম শ্রেণীর মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে নাসির আলী মামুনের “ঘর নাই” দারুণ একটা বই। যে বইয়ে “ঘুমের শহরে” সিনেমার মতো সংবেদনশীলতা সহকারে উপস্থিত ঘর ছাড়া মানুষেরা।
পাশাপাশি আরেক সিনেমা দিল্লীর ভুবন চিলদের উদ্ধার করে আবার নিজ বাসস্থানে ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে কাজ করে চলেছেন যে নানা বয়সী তিন যুবক তাদের নিয়ে। তাদের প্রচলিত ব্যক্তিগত মানবিক স্বরের বাইরের একটা ভিন্ন স্বর প্রদর্শিত হয় “সব যারা নিঃশ্বাস নেয়” সিনেমায়। এ প্রামাণ্যচিত্রের বয়ান, উপস্থাপন একটা গভীর অনুভূতির সহযাত্রী করে নেয়। নির্মান, চিত্রনাট্য, সম্পাদনা, চিত্রায়ন সব মানানসই এবং কখনো তা চমৎকার, গভীর। যদিও শুরুর দিকে একটা চিল সালিকের চশমা নিয়ে যাওয়ার পরের দৃশ্যেই সেই একই রকম চশমা পরে তাকে দেখা যায় এবং তারপরের এক দৃশ্যে সে চশমা নিয়ে যাওয়া নিয়ে কথা বলে এবং চশমা ছাড়া! সংলাপ বাদ দিয়ে শুধু চলচ্ছবির সম্পাদনা হিসেবে খুব মানানসই, চমৎকার কিন্তু সংলাপ ও সাবটাইটেলসহ মিলিয়ে যেহেতু সিনেমা, সেহেতু খানিক রসভঙ্গ হয় এরূপ একপেশে সম্পাদনায়! চারশত ঘণ্টার ফুটেজের ভিতর থেকে নিশ্চয়ই আরেকটা বিকল্প বের করা যেত যা আরো কার্যকর হতো। শব্দনকশা এবং সঙ্গীত আরো ঠিকঠাক, ডিটেইল ও গভীর হলে চমৎকার হতো।
এখানে মনে রাখা প্রয়োজন এসব সিনেমা, বিশেষ করে আলোচিত দ্বিতীয় সিনেমার অধিকাংশ অর্থায়নের উৎস ইউরোপ-আমেরিকা কেন্দ্রিক নানা তহবিল। মানে উৎস দেশ ভারত থেকে অর্থায়ন কম। এখানে চিরাচরিত কিছু প্রশ্ন ভাবা খুব জরুরী, যেমন “কেন গণপরিসরে এসব সিনেমা প্রদর্শন করার সুযোগ কম?” “কেন এসব সিনেমার ক্ষেত্রে স্থানীয় অর্থায়নের সুযোগ কম বা প্রায় নেই?” “কেন এসব সিনেমাকে “ভালো” তকমা দেওয়ার পরেও দর্শক কম দেখে?” “কেন দর্শক রুচির পরিবর্তন ও উন্নয়ন নেই?”
“ঘুমের শহর” এবং “সব যারা নিঃশ্বাস নেয়” দুটো সিনেমাই নানান উৎসবে প্রদর্শিত, প্রশংসিত। বিশেষ করে দ্বিতীয় সিনেমা, যা একই সাথে জিতেছে সানডান্স ও কানের দুই সর্বোচ্চ পুরস্কার এবং অস্কারের চূড়ান্ত তালিকায় ছিল! যা খুব বিরল এবং মাত্র হাতেগোনা কিছু সিনেমার ক্ষেত্রে ঘটেছে।
বলা যায় দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষত বিগত দশকজুড়ে ভারতে একের পর এক দুর্দান্ত যেসব প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হচ্ছে তার ভিতরের অন্যতম দুই চলচ্চিত্র হচ্ছে শৌনক সেনের আলোচিত সিনেমাদ্বয়। যে সিনেমা মনোযোগ সহকারে পরিস্থিতির উপস্থাপন করে, “অপর” ভাবনার সাথে সহমর্মিতা যাপন করে। বর্তমান ডিস্টোপিয়ান সময়ের একধরনের যথাযথ বয়ান পরিবেশন করে। যার ফলে প্রচলিত “মানবিকতা” “উন্নয়ন” “পোষা” প্রাণীর প্রতি ভালবাসা, “অধিকার” “সমতা” ইত্যাদি ইত্যাদির সীমাবদ্ধতা প্রকটতর হয়। ধরা যায় শৌনক সেন প্রচলিত ধারার “রাজনৈতিক সিনেমা” না বানিয়েও দুর্দান্তভাবে এ দুই সিনেমায় পরিবেশন করেছেন মানুষ, পরিবেশ, প্রকৃতি এবং সমসাময়িক প্রাণের রাজনীতি।
মুহম্মদ আনোয়ার হোসেন: চলচ্চিত্রকার ও সমালোচক। ইমেইল: maangorepublik@gmail.com
দোহাই
*“সিনেমা ভেরিতে” শব্দটা মাথায় এলে তারেক মাসুদের (ডিসেম্বর ৬, ১৯৫৬ – আগস্ট ১৩, ২০১১) কথা মনে পড়ে। তার এক লেখায় পড়েছিলাম তিনি নিজের যৌবনের দীর্ঘদিন সিনেমা না বানাতে পারার অবস্থায় ছিলেন কিন্তু বন্ধুরা সব পরিচালক হয়ে গেছে, এমত অবস্থায় তিনি রসিকতা করতেন যে তার হল, “সিনেমা দেরিতে” । কারন তখনকার সময়ে সিনেমা ভেরিতে ধরন খুব আলোচিত ছিল।
https://en.wikipedia.org/wiki/Shaunak_Sen
নিচের ইউটিউব লিঙ্কে দেখা যাবে “ঘুমের শহর” (২০১৫) ।
https://www.youtube.com/watch?v=ROSnRGiMpWE
https://mubi.com/en/notebook/posts/while-we-filmed-behind-the-daring-spirit-of-indian-documentaries
https://www.allthatbreathes.com/
https://www.himalmag.com/comment/all-that-breathes-oscars-india-muslims-documentary-film