সামরিক শাসন থেকে ‘বেসামরিক’ সরকার

বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর-৬

সামরিক শাসন থেকে ‘বেসামরিক’ সরকার

আনু মুহাম্মদ

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের হানাদার সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এরপর ৫৩ বছর অতিক্রম করছে এই দেশ। এই সময়ে দুইজন রাষ্ট্রপতি খুন হয়েছেন, দুই দফা প্রত্যক্ষভাবে সামরিক শাসন এসেছে, সামরিক বাহিনীর ভূমিকা বেড়েছে, সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৬ বার, নির্বাচনের নানা রূপ দেখা গেছে, শাসনব্যবস্থা ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে দুবার স্বৈরশাসকের পতন হয়েছে। পাশাপাশি অর্থনীতির আয়তন ক্রমে বেড়েছে, জিডিপি ও বিশ্ববাণিজ্যে উল্লম্ফন ঘটেছে, অবকাঠামো ছাড়াও সমাজে আয় ও পেশার ধরনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সম্পদের কেন্দ্রীভবন ও বৈষম্যও বেড়েছে, কতিপয় গোষ্ঠীর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কর্তৃত্বে আটকে গেছে দেশ। এই ধারাবাহিক লেখায় এই দেশের একজন নাগরিক তাঁর ডায়েরী ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। ষষ্ঠ পর্বে প্রধানত ১৯৭০ দশকের শেষ কয়েক বছরে সামরিক শাসনের নির্বাচিত সরকারে রূপান্তর, বিভিন্ন দল, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংসদ নির্বাচন ছাড়াও স্বেচ্ছাশ্রম, আখচাষী, পতিতালয়, রংপুর দুর্ভিক্ষ, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন অনুসন্ধান অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করা হয়েছে।

জিয়ার দল, সরকার ও রাজনীতি
প্রধান সামরিক শাসক থেকে জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক নেতা, বেসামরিক সরকারের প্রধান হবার ধাপগুলো এরকম: গণভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট পদের স্বীকৃতি; দল গঠন- জাগদল, জাগফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি); গণভোট-প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-সংসদ নির্বাচন; রাজনৈতিক দলবিধি- ঘরোয়া রাজনীতি- সীমিত রাজনীতি- বিভিন্ন শর্তে উন্মুক্ত রাজনীতি।

জিয়াউর রহমান তার দল গঠন নিয়ে কথা বলতে এবং তাতে যোগদানের আহবান জানাতে বিভিন্ন দলের সাথে যোগাযোগ করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগ ও জাসদের সাথেও যোগাযোগ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি সায়েমের সামনে মিজানুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের উদ্দেশ্যে উত্তেজিত হয়ে জিয়া বলেছিলেন, ‘হু ইজ আ বেটার আওয়ামী লীগার দ্যান মি? আই হ্যাভ ট্রান্সমিটেড দ্য ডিরেক্টিভস অব বঙ্গবন্ধু ফ্রম চিটাগাং রেডিও স্টেশন।’ (চৌধুরী, উদ্ধৃতি মহিউদ্দীন, ২০১৪)

রাষ্ট্রপতি সায়েমের সামনে মিজানুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলের উদ্দেশ্যে উত্তেজিত হয়ে জিয়া বলেছিলেন, ‘হু ইজ আ বেটার আওয়ামী লীগার দ্যান মি? আই হ্যাভ ট্রান্সমিটেড দ্য ডিরেক্টিভস অব বঙ্গবন্ধু ফ্রম চিটাগাং রেডিও স্টেশন।’

জেনারেল জিয়ার সময়ে সরকারি কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী জানাচ্ছেন যে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জিয়া বসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এ বিষয়ে ‘তাঁরা (আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যরা) জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে রাজি হবেন কি না, তা নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম। সেটা তাঁকে জানালে তিনি বলেন, ‘তাঁদের তো আমার প্রতি বিরূপ হওয়ার কারন নেই। তাঁরা কি জানেন না, খন্দকার মোশতাক বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি সরিয়ে ফেলেছিলেন, আমি বঙ্গভবনে আবার বঙ্গবন্ধুর ছবি টানিয়েছি।’ শেখ মুজিব সম্পর্কে জিয়ার মনোভাব বলতে গিয়ে জিয়াউদ্দীন আরও জানান, ‘..আমি তাঁকে একবারের জন্যও বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করতে শুনিনি। তিনি বাকশালের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোনো সমালোচনা করেননি।’ (চৌধুরী, ২০২৪) আমার মনে আছে ১৯৭৬ সালের ২৬শে মার্চ দৈনিক বাংলায় জিয়াউর রহমান ‘একটি জাতির জন্ম’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন। সেখানে তিনি শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবেই সম্বোধন করেছিলেন।

যাইহোক ১৯৭৬ সালের ২৮শে জুলাই তৎকালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের নামে ‘রাজনৈতিক দল বিধি বা প্রবিধান’ জারি করা হয়। এতে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য বিভিন্ন তথ্যসহ আবেদনের আহবান জানানো হয়। বলা হয়- উদ্দেশ্য, আদর্শ, তহবিল, কর্মসূচি, কাঠামোসহ বিস্তারিত তথ্য জমা দিলে সরকার বিবেচনা করবে নিবন্ধনের অনুমতি দেয়া হবে কিনা। একইসাথে বৈধতা পেতে সকল দলের অঙ্গ সংগঠনের নামও জমা দিতে হবে। এই ঘোষণার পর বিভিন্ন দল গঠন ও পুনর্গঠন ত্বরান্বিত হয়। ধর্মভিত্তিক দল গঠনের বাধা সরে যাওয়ায় এসব দল ও গোষ্ঠীগুলোও তৎপর হয়ে উঠে। খোন্দকার মোশতাক আহমদ ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক লীগ’, জামায়াতসহ ইসলামপন্থীরা ‘ইসলামিক ডেমেক্রেটিক লীগ’, জেনারেল ওসমানী ‘জাতীয় জনতা পার্টি’, মোহাম্মদ তোয়াহা ‘সাম্যবাদী দল’ নামে নতুন নতুন দল গঠন করেন। এর পাশাপাশি মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), কাজী জাফর নেতৃত্বাধীন ‘ইউনাইটেড পিপলস পার্টি’ (ইউপিপি), সবুর খানের নেতৃত্বে ‘মুসলিম লীগ’ নিবন্ধন লাভ করে। এছাড়া ছিল আওয়ামী লীগ, আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় লীগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই), এএসএম সোলায়মান নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি।

মনে আছে সেসময় মোহাম্মদ তোয়াহা-র একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল বিচিত্রায়। সেখানে তাঁর একটি উক্তি শিরোনাম করা হয়েছিল- ‘গলা কাটা রাজনীতি করে ভুল করেছি।’ পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি করতেন, সেই ভুল সংশোধন করতে গিয়ে তিনি জিয়াউর রহমানকে ‘দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া’ হিসেবে ঘোষণা করেন এবং আওয়ামী লীগ, মণি সিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (মোজাফফর) নিষিদ্ধ করার দাবি জানান।

১৯৭৫ এর মহাবিপর্যয়ের পর এই সময়ে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হতে থাকে, কিন্তু কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা নেতৃত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। ‘সিপাহী বিপ্লব’ এর বিপর্যয় এবং তারপর কর্ণেল তাহেরের ফাঁসি, বহু নেতাকর্মী আটক, দন্ডিত, পলাতক থাকা, দেশত্যাগ এবং আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে জাসদের সংকট সমাধান অযোগ্য পর্যায়ে চলে যায়। গণবাহিনীর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে থাকে এবং ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সভায় বিপ্লবী পার্টি গঠন প্রক্রিয়ার বিলুপ্তি ঘোষণা করে গণসংগঠনের পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হয়। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতও নানা মাত্রায় বাড়তে থাকে। এর একটি ফলাফল হিসেবে ১৯৮০ সালের ৭ই নভেম্বর জাসদ ভেঙে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) জন্মলাভ করে। এর আহবায়কের দায়িত্ব নেন খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া। তাঁর সাথে আরও ছিলেন আফম মাহবুবুল হক, মবিনুল হায়দার চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না, আখতারুজ্জামান প্রমুখ। পরের বছরগুলোতে জাসদ ও বাসদ দুটোই আরও বেশি কয়টি ভাঙনের শিকার হয়।

সিরাজ সিকদার রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডের শিকার হবার পর পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টিও মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হয়। ক্রমে দ্বিধাবিভক্ত ও বহুধাবিভক্ত হতে থাকে। গোপন আরও কয়টি পার্টি নিজেদের বিপর্যয় থেকে বের হবার চেষ্টায় নতুনভাবে পার্টি গঠন প্রক্রিয়া শুরু করে। এখানে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ ছিল বদরুদ্দীন উমর ও সইফ-উদ-দাহারের নেতৃত্বাধীন ধারাটির। আবদুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৭১ সাল থেকে বেশ কয়বার ভাঙনের সম্মুখীন হয়। ১৯৭৭ সালে এই পার্টি নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে পুনর্গঠিত হয়। মোহাম্মদ তোয়াহা এই দল থেকেই বের হয়ে সাম্যবাদী দল গঠন করেন। জিয়া দল গঠনের উদ্যোগ নেবার পরে বিভিন্ন বাম দল থেকে দলত্যাগী নেতাকর্মীরা সেই দলে যোগ দেন। জিয়ার দল ছিল আসলে বাকশাল বিরোধী মঞ্চ, ডানপন্থী ও বামপন্থীদের সমাবেশ।

বাকশালে একীভূত হবার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিও বিপর্যয় এবং গ্রহণযোগ্যতার সংকটে পতিত হয়। তারা পরে আবার দল পুনর্গঠন করে এবং অতীতের ভুল সংশোধন করতে গিয়ে জিয়ার কর্মসূচির প্রতি সহযোগতিামূলক ভূমিকা গ্রহণ করে। জিয়া আমলে এই দলটি কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।

১৯৭৭ সালের ৩০শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন এবং ৩০শে মে গণভোটের সিদ্ধান্ত জানান। জিয়াউর রহমানের প্রতি সমর্থনসূচক এই ‘হ্যাঁ-না’ গণভোটে সরকারি হিসাবে প্রায় ৮৮ শতাংশ ভোটার ভোট দেন এবং প্রায় ৯৯শতাংশ হ্যাঁ ভোট পড়ে। জিয়ার ঘনিষ্ঠ সরকারি আমলা জানাচ্ছেন, ‘কিন্তু এ ভোট নিয়ে মানুষের মধ্যে তখন কোনো আগ্রহ ছিল না। ফলে ভোটকেন্দ্রে মানুষের ভিড় দেখা যায়নি।’ (চৌধুরী,২০২৪)

এই সময়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথাবার্তা শুরু হয়। এবিষয়ে প্রথম লেখা দেখি হলিডে সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খানের। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ শিরোনামে তাঁর এ লেখাটি বিচিত্রাতে ছাপা হয়। সম্ভবত এই লেখাটিই জিয়াইর রহমানের জন্য পথ নির্দেশক ছিল। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জিয়া এর ভিত্তিতে রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের ঘোষণা দেন। এরপর প্রথমে ‘জাতীয়তাবাদী গণতন্ত্রী দল’ (জাগদল) গঠন, এরপর ভাসানী ন্যাপ (মশিউর), ইউপিপি (কাজী জাফর), জাগমুই ও লেবার পার্টি নিয়ে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট’ গঠিত হয়। এর চেয়ারম্যান হিসেবে জেনারেল জিয়া ১৯৭৮ সালের ৩রা জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। যথারীতি জিয়া বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করেন। জেনারেল ওসমানী ছিলেন তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী, তিন ভাগের একভাগেরও কম ভোট পেয়েছিলেন তিনি।

১৯৭৮ সালের ১লা মে থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা উন্মুক্ত করা হয়, এর আগে রাজনৈতিক দলবিধি বাতিল করা হয়। এর মধ্যে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মণি সিংহ), বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক লীগ (খোন্দকার মোশতাক), এবং জাসদ (আউয়াল) নিষিদ্ধ করা হয়, কিছুদিন পরে আবার সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এর কারণ স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। বিএনপি ১৯০টি আসনে জয়লাভ করে, আওয়ামী লীগ পায় ৩৯টি আসন এবং সবুর খানের মুসলিম লীগ ১২টি আসনে জয়লাভ করে তৃতীয় স্থান লাভ করে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের পক্ষে সক্রিয় ব্যক্তি শাহ আজিজুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচিত এই সংসদ শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করে। জাতীয় সংসদে পঞ্চম সংশোধনী আনা হয় ১৯৭৯ সালের ৬ই এপ্রিল, এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল ব্যবস্থা বাতিল হয়ে সাংবিধানিকভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনপ্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডকে বৈধতা দানসহ সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংযোজন করা হয়। সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান উত্থাপিত বিলটি ২৪১-০ ভোটে পাস হয়।

খালকাটার দুই প্রকল্প এবং গ্রাম সরকার
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ওঠার পর থেকে জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক ক্ষমতা সংহত করার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু কর্মসূচি হাতে নেন, যেগুলোর কোনো কোনোটি প্রয়োজনীয়তার কারণেই জনপ্রিয় হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল খাল কাটায় স্বেচ্ছাশ্রম কর্মসূচি। পত্রপত্রিকায় ব্যাপক প্রচার হচ্ছিল এর দুটো বড় কর্মসূচি নিয়ে, একটি হলো যশোরের ‘উলশী যদুনাথপুর সংযোগ প্রকল্প’, অন্যটি ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র খনন প্রকল্প’। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করার চেষ্টা চলতে থাকে, অনেকের অংশগ্রহণও দেখা যায়। রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) বিশেষত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এই কর্মসূচিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে তাতে অংশগ্রহণ করে।

আমার নিজের এসব প্রকল্প নিয়ে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়, স্বাধীনভাবে অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করি। শাহাদৎ ভাইএর সাথে কথা বলি। তিনি বিচিত্রা থেকে এর উদ্যোগে সম্মত হন। তখন পর্যন্ত জামালপুরে নানাবাড়ী ছাড়া আর কোথাও একা যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। অন্যদের সাথেও একবার এর কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে গিয়েছিলাম, আয়োজকদের সাথে। সেবার মাইক্রোবাসে ফেরার পথে কুমিল্লা গ্রাম উন্নয়ন একাডেমীতে যাই, তার সাফল্যের প্রতীক হিসেবে প্রচারিত ‘দিদার সমবায় সমিতি’র কাজ দেখতে বুঝতে উদ্যোক্তাদের সাথে অনেক সময় নিয়ে কথা বলি। কীভাবে এই সমিতি গরীব কৃষকদের সমিতি তৈরি করে, সঞ্চয় ও ঋণ ব্যবস্থার মডেল তৈরি করে, বিনিয়োগের খাতগুলো কীভাবে কাজ করে সেসব বিস্তারিত জানলাম। আইয়ুব আমল থেকে আখতার হামিদ খানের লেগে থাকা আন্তরিক চেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটেছে। এ নিয়ে পরে লিখেছিলাম। বস্তুত কুমিল্লা একাডেমী, দিদার সমিতি এগুলো সবই পরে বিকশিত এনজিও মডেলের পূর্বসূরী।

যাইহোক, স্বেচ্ছাশ্রম কর্মসূচি দেখতে বুঝতে যশোর ময়মনসিংহ যাওয়া আমার প্রথম একা অজানা পথে যাওয়া। ১৯৭৭ সালের ৫ই মে রওনা হলাম। যশোর খুলনার পথে সরাসরি বাস তখন শুধু যাত্রিক ও সোহাগ পরিবহণ, সরাসরি মানে মাঝখানে লঞ্চে পার হয়ে ওপারে তাদের আরেক বাসে উঠা। সেসময় ঢাকা আরিচা সড়ক ছিল এক লেনের খুবই দুর্বল ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা। এই রাস্তায় আরিচা গিয়ে লঞ্চে পার হয়ে ওপার থেকে আবার বাস ধরে যশোর যাওয়াই ছিল সবচাইতে ভালো উপায়। এই পথেই গেলাম।

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দুটো বড় বহুল প্রচারিত স্বেচ্ছাশ্রম প্রকল্প নিয়ে কাজ করলাম। মাসের প্রথম সপ্তাহে যশোরে উলশী যদুনাথপুর স্বেচ্ছাশ্রম প্রকল্প নিয়ে কাজ। প্রথমে গেলাম এই প্রকল্পের মাঠ পর্যায়ের পরিচালকদের খোঁজে। মূল দায়িত্ব যশোর জেলা প্রশাসকের। দেখা করলাম তাঁর সাথে- ভদ্রলোক গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরা, চোখে সানগ্লাস। খালকাটার স্থানে গেঞ্জি, (জিনস)প্যান্ট এবং সানগ্লাস বেশ নিয়ে মাটিতে বসা জিয়াউর রহমানের ছবি ততদিনে বহুল প্রচারিত ও তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। খালকাটা কর্মসূচিতে জিয়ার প্রধান সহযোগী হিসেবে যশোরের ডিসি সাহেবের বেশ পরিচিতি ছিল তখন। এই ভদ্রলোকই আবার পরে আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রী হয়েছেন, ব্যাংক খুলে বড় আকারের জালিয়াতি লুন্ঠনের মাধ্যমে তার বারোটা বাজানোর দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই ভদ্রলোকের নাম মহিউদ্দীন খান আলমগীর।

খালকাটা কর্মসূচিতে জিয়ার প্রধান সহযোগী হিসেবে যশোরের ডিসি সাহেবের বেশ পরিচিতি ছিল তখন। এই ভদ্রলোকই আবার পরে আওয়ামী লীগের এমপি মন্ত্রী হয়েছেন, ব্যাংক খুলে বড় আকারের জালিয়াতি লুন্ঠনের মাধ্যমে তার বারোটা বাজানোর দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। এই ভদ্রলোকের নাম মহিউদ্দীন খান আলমগীর।

ডিসি সাহেব আদর যত্ন করে আমাকে নিয়ে গেলেন খালকাটা কর্মসূচির এলাকায়, সেখানে তখন বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। আমি প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য নিয়ে পরে এলাকার মানুষের সাথে নানা পর্যায়ে আলাপ আলোচনা করলাম। নাম স্বেচ্ছাশ্রম হলেও জমির ক্ষতিপূরণসহ নানা আর্থিক প্রণোদনা ছিল। কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি আর তা নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগও শুনেছি। কয়েকদিন ধরে প্রকল্প এলাকার মানুষ এবং শহরের সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, শিক্ষকদের সাথে কথা হলো। অনেক কিছু জানলাম যা সরকারি বয়ানের সাথে মেলে না। বহুরকম তথ্য, মতামত, আশা-হতাশা-ক্ষোভের কথা নিয়ে রওনা হলাম ময়মনসিংহ।

ট্রেনে যশোর থেকে ময়মনসিংহ, সেও ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা। ময়মনসিংহে চলছিল ‘ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্প’। এই প্রকল্পের পাশেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সেকারণেই সম্ভবত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব পড়েছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উপর। জেলা প্রশাসন ছিল তার সহযোগী। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা কাজ করছিলেন তাদের মধ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা খুবই সক্রিয় ছিলেন। বেশ কয়েকজন শিক্ষক বিস্তারিত তথ্য পেতে খুবই সহায়তা করেছেন। তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী সর্বমোট কাজে স্বেচ্ছাশ্রমে যে পরিমাণ অংশগ্রহণ ধরা হয়েছে তার অনুপাত হলো ৪০ দশমিক ৬৮, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচির মাধ্যমে কাজের অনুপাত ৫৯:৩২। স্বেচ্ছাশ্রমে যারা কাজ করেছেন সেসব প্রতিষ্ঠান ও জনগোষ্ঠীর নামের তালিকা পেলাম নি¤œরূপ: কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়: ২৪ দল, জেলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ৩৯৯, প্রাথমিক শিক্ষক: ৩৫, ইউনিয়ন পরিষদ: ২১, শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ৪৪, পাটকল: ১, অতিথি দল: ২১, সশস্ত্র বাহিনী: ৫, পৌর এলাকা: ২৪, জিলা পরিষদ: ১, সরকারি অফিস: ৪৮, নারী: ৪, শিশু কিশোর সংগঠন: ২৪ দল।

দুই প্রকল্পের তথ্য উপাত্ত সাক্ষাৎকার জরীপ দলিলপত্র পর্যবেক্ষণের বোঝা নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম। কয়েকদিন একটানা কাজ করে এর উপর বেশ দীর্ঘ লেখা লিখে জমা দিলাম বিচিত্রায়। সেসময় বিচিত্রার প্রধান সম্পাদক শামসুর রাহমান। সাধারণত সম্পাদক শাহাদৎ ভাইই সব লেখা বাছাই ও সম্পাদনার শেষ ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু স্বেচ্ছাশ্রম বিষয়ে লেখাটা চলে গেল প্রধান সম্পাদক শামসুর রাহমানের টেবিলে। আসলে আমার মনে না থাকলেও তাদের তো মনে থাকতেই হবে যে, এটা জিয়া সরকারের পরিচয় প্রকল্প, কাজেই সাবধান! বেশ কিছুদিন ওটার খবর নাই, পড়ে থাকলো কোথাও কার কাছে জানিনা। পরে লেখাটা ফেরত এলো পাতায় পাতায় লালে লাল হয়ে। এরপর আরও কিছুদিন গেল, পরে ওর মধ্যে থেকে লেখাটা কোনোভাবে উদ্ধার করে ছাপা হলো। তথ্য উপাত্ত কিংবা কিছু অনিয়ম বা সীমাবদ্ধতা গেল কিন্তু আমার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ অনেকটাই বাদ গেল।

স্বেচ্ছাশ্রম ছাড়াও জিয়ার আরেকটি কর্মসূচি নিয়ে তখন ব্যাপক আলাপ আলোচনা হয়। সেটি হল ‘গ্রাম সরকার’, যাকে বিরাট এক যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে প্রচার করা হয়। ভূমি সংস্কার নিয়ে জিয়া প্রথম দিকে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এমনকি এরকমও বলেছিলেন যে, বাংলাদেশের কৃষি সংস্কারের জন্য জমির ‘আইল’ তুলে দিতে হবে। কারণ দেশে যত আইল আছে তার মোট আয়তন বগুড়া জেলার সমান। একথায় আমি বেশ কৌতুহলী হয়েছিলাম যে সরকার কি বড় কোনো সংস্কারের দিকে যাচ্ছে? না, এরপর আর এ নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় নি। গ্রাম সরকার নিয়ে হৈচৈ শুরু হবার পর এর প্রকৃত চেহারা বুঝতে এবং তা নিয়ে লিখতে আমি কয়েকটি গ্রামে যাই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কালিহাতিতে, সদর থানার কাছেই ‘মডেল গ্রাম সরকার’। ১৯৭৮ সালের ২৬শে জুলাই থেকে সেখানে অনুসন্ধান করি। ‘বাংলাদেশের গ্রাম ও গ্রামীণ প্রশাসন’ শিরোনামে এক দীর্ঘ লেখায় সরকারি মডেল হিসেবে এর পর্যালোচনা করে লিখেছিলাম (মুহাম্মদ, ১৯৮৫)। বহুল প্রচারিত মডেল গ্রাম সরকারে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী পদ তৈরি করে কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। এই তথাকথিত প্রধানমন্ত্রী সহ মন্ত্রীরা সবাই ছিলেন গ্রামের ক্ষমতা কাঠামোরই অংশ, শুধু পদ পদবীর ভারী নাম দেয়া হয়েছিল! এসব বাগাড়ম্বর বেশিদিন টেকেনি।

পদধ্বনি ও মাহমুদ স্যারের বাসা
১৯৭৯ সালের দিকে সাপ্তাহিক পদধ্বনি পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয় আমাদের রাজনৈতিক মুখপত্র হিসেবে। এর সম্পাদক হিসেবে যিনি ডিক্লারেশন নিয়েছিলেন তিনি পত্রিকা বের করতে পারছিলেন না। তাঁর নাম ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে আমরা পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেই। প্রকাশনা ব্যয়সহ মূল উদ্যোক্তার ভূমিকায় ছিলেন কর্ণেল (অব) কাজী নূরুজ্জামান। আর নিয়মিত লেখা, সম্পাদনা আর নীতি নির্ধারণী কাজে যুক্ত ছিলেন বদরুদ্দীন উমর, শাহরিয়ার কবির, ফিরোজ আহসানসহ আরও কয়েকজন, আমিও এই দলে ছিলাম। নিয়মিত লিখতাম, সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য হিসেবে সক্রিয় ছিলাম। সম্পাদনার প্রধান কাজ শাহরিয়ার কবিরই করতেন। বেশ কয়েক সপ্তাহ প্রকাশের পর ডিক্লারেশনের সম্পাদক পত্রিকা ফেরত চাইলেন, ফলে এটা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ১৯৮০ সালের দিকে নতুনভাবে আরেকটি পত্রিকার উদ্যোগ নিলাম। কর্ণেল (অব) কাজী নূরুজ্জামানের নামে ডিক্লারেশন পাওয়া গেল, নাম হলো নয়া পদধ্বনি। সম্পাদনা পরিষদ আগের মতোই থাকল্ োএবং ব্যাপক উৎসাহ ও পরিশ্রম দিয়ে এটা চললো প্রায় ছয় মাস। প্রতি সপ্তাহে এরকম একটা পত্রিকা প্রকাশ সহজ ব্যাপার ছিল না।

১৯৭৮ থেকে বেশ কয় বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ড. আবু মাহমুদের বাসা ছিল আমার প্রিয় গন্তব্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপক ছিলেন ৬০ দশকে। তাঁর ভূমিকার কারণে আইউব-মোনেমের সন্ত্রাসী ছাত্র বাহিনী এনএসএফ তার ওপর হামলা করেছিল। বিদেশে ছিলেন বহুদিন। তাঁর বাসায় দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি আলোচনা হতো। আরও অনেকে আসতেন। মাহমুদ স্যার ছিলেন অসম্ভব প্রাণবন্ত দিলখোলা মানুষ। আড্ডায় আনন্দ এবং শিক্ষা দুটোই হতো। আমি প্রায়ই বিচিত্রা অফিসে বা অন্যত্র কাজ শেষ করে স্যারের বাসায় আসতাম এবং এখানে আড্ডা সেরে নীলক্ষেতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠে ক্যাম্পাসে হলে ফিরতাম। মাহমুদ স্যার তখন মার্কসীয় বিশ্ববীক্ষা সহ বেশ কয়েকটি বই লেখার কাজ করছিলেন। ‘পদধ্বনি’ ও ‘নয়া পদধ্বনি’র জন্য তাঁর কাছ থেকে বেশ কয়েকটি লেখা নিয়েছি। কয়েকটি তিনি বলেছেন আমি লিখেছি।

স্যারের বাসায় নিয়মিত আড্ডা হতে হতেই বিশ্ব পরিস্থিতি, সাম্রাজ্যবাদের পাশাপাশি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের কাঙ্খিত উন্নয়ন মডেল নিয়ে যৌথ লেখা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলো। প্রথমে বেশ কয়েকদিন আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি কাঠামো পরিষ্কার হলো। প্রাথমিক খসড়া লেখার দায়িত্ব পড়লো আমার উপর। আনন্দের সঙ্গেই আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। খসড়া তৈরি করে পেশ করলাম আড্ডায়। মাহমুদ স্যার সহ সকলের মতামত নিয়ে লেখাটা আরও পরিমার্জিত ও শক্তিশালী করলাম। এর প্রকাশে আগ্রহ দেখালে সাপ্তাহিক বিচিত্রাতেই আটজনের যৌথ লেখা হিসেবে এটি প্রকাশিত হলো। আমি ছাড়াও এই লেখায় যাদের নাম ছিলো বলে মনে করতে পারছি তারা হলেন: আবু মাহমুদ, আহমেদ কামাল, মাহবুবউল্লাহ, স্বপন আদনান, আতিউর রহমান, হোসেন জিল্লুর রহমান এবং সাঈদ-উর রহমান।

এই সময়ে আমি ‘বাংলাদেশের গ্রাম ও গ্রামীণ প্রশাসন’ নিয়ে বিস্তৃত কাজে হাত দেই। এই কাজের জন্য গ্রাম থেকে ইউনিয়ন, থানা, জেলা প্রশাসন পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, ক্ষমতার জাল, কেন্দ্র পর্যন্ত তার যোগসূত্র, শ্রেণীবিন্যাস, সমাজ ও অর্থনীতি, দ্বন্দ্ব সংঘাত শালিস বিচার, সমাজ ও পরিবারে নারী পুরুষ সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে বেশ সময় নিয়ে অনুসন্ধান করে লিখেছি।

পতিতালয়
১৯৭৭ সালের মার্চ মাসের একদিন। সেদিন সকালে গেছি বিচিত্রা অফিসে। গিয়ে দেখি কয়েকজন ডাক্তার সেখানে। আমাকে দেখে শাহাদৎ ভাই বললেন, ‘একটা মেডিক্যাল টিম যাচ্ছে কান্দুপট্টি গবেষণার কাজে। তুমি সাথে যাইতে পার যদি দেখতে বা লিখতে চাও।’ অভাবনীয়ই বলতে হবে। কান্দুপট্টি মানে পুরনো ঢাকার বড় একটা পতিতালয়। দেখলাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চর্ম ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শামসুল আজমের নেতৃত্বে একটি দল যাচ্ছে সেখানে, দলে আরও ছিলেন ডা. সুলতানা, ডা. আরিফসহ নয়জন ডাক্তার, দুজন নার্স ও একজন পিয়ন। সাথে ছিল পুলিশের দল। গাড়ীতে ঠাসাঠাসি করে রওনা হলাম। পুরনো ঢাকার কান্দুপট্টি বাইরে থেকে ভাঙাচোরা একটি ভবন, আগেও দেখেছি। এবারে ভেতরে গিয়ে দেখলাম এক ভয়ংকর জগত। খুবই নোংরা, ছোট ছোট খুপড়ি ঘর। যে জীবন আর পরিবেশ তাতে সুস্থ থাকার কোনো উপায় নাই। দুপুর হয়নি তখনও, মেয়েরা সেসময় অলস বসে আছে, গল্প করছে, ঝগড়া করছে। পুলিশ দেখে কেউ কেউ লুকাতে চাইল।

আমাদের সাথের ডাক্তার দলের কাজ ছিল ওখানকার মেয়েদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পাশাপাশি ওসুধপত্র দেয়া ও জরীপ করা। আমি আমার মত সব দেখছিলাম, কথা বলছিলাম, আমার সাথে ছিলেন শামসুল ইসলাম আল মাজী। তিনি ছবি তুলছিলেন। কিশোরী, তরুণী থেকে মধ্যবয়সী এবং সেই সাথে দালাল, মাসী, ভেতরে যুবক দোকানদার কর্মচারী বহুজনের সাথে কথা বললাম। কেউ কেউ কড়া ভাষায় অভিযোগ করলেন আমাদের মত মানুষ এবং সমাজের বিরুদ্ধে, কেউ নিজের দু:খের কথা বললেন, কেউ হবু খদ্দের ভেবে বলে রাখলেন, কেউ হাসি ঠাট্টা করলেন, কেউ মুক্তির পথ দেখাতে বললেন, কেউ ভন্ড লোকজনদের গালিগালাজ করলেন, কেউ হতাশা ব্যক্ত করলেন, কেউ কথাই বললেন না। মেডিক্যাল টিমের জরীপ, আর আমার কথা অভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ নিয়ে পরে ডা. আরিফসহ বড় লেখা লিখলাম ‘ঢাকার পতিতালয়’। এটা পরে আমার বই সত্তর দশকে তে সংকলিত হয়েছিল। (মুহাম্মদ, ২০২৩) ঔপন্যাসিক রিজিয়া রহমান আমার সাথে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন, তাঁর রক্তের অক্ষর উপন্যাস এই বিষয় নিয়েই লেখা।

নানাভাবে প্রতারিত হয়ে, বিপদে পড়ে, বিক্রি হয়ে যে মেয়েরা এখানে গিয়ে আটকে যায় তাদের উপরই সমাজ দায় চাপায়। আর এদের অমানবিক জীবনের বিনিময়ে টাকা বানায় আড়ালে থাকা লোকজন। আরও বেশি অর্থের সন্ধান পেলে এরা এই মেয়েদের ছুড়ে ফেলে দেয়। সেরকমই হয়েছে কান্দুপট্টিতেও, এর মালিকেরাই পরে ধর্মের নাম করে মেয়েদের তাড়িয়ে সেখানে মার্কেট বানিয়েছে। সেই মেয়েরা আরও কত বিপদে পড়েছে কে জানে!

নানাভাবে প্রতারিত হয়ে, বিপদে পড়ে, বিক্রি হয়ে যে মেয়েরা এখানে গিয়ে আটকে যায় তাদের উপরই সমাজ দায় চাপায়। আর এদের অমানবিক জীবনের বিনিময়ে টাকা বানায় আড়ালে থাকা লোকজন। আরও বেশি অর্থের সন্ধান পেলে এরা এই মেয়েদের ছুড়ে ফেলে দেয়। সেরকমই হয়েছে কান্দুপট্টিতেও, এর মালিকেরাই পরে ধর্মের নাম করে মেয়েদের তাড়িয়ে সেখানে মার্কেট বানিয়েছে। সেই মেয়েরা আরও কত বিপদে পড়েছে কে জানে!

ক্যাম্পাসে নাট্য প্রতিযোগিতা
১৯৭৭ সালের মার্চ মাস জুড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দারুণ আনন্দময় উত্তেজনা ছিল। অধ্যাপক কলিমুল্লাহ এবং সেলিম আল দীনের পরিকল্পনায় আন্তহল নাট্য প্রতিযোগিতার আহবান জানানো হয়েছিল। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল সাড়া পাওয়া কঠিন হবে। পেলেও একটি দুটি পুরনো নাটক নিয়ে দুর্বল প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু উল্টো পাওয়া গেল অভূতপূর্ব সাড়া। সবাই অবাক হয়ে দেখলো ছাত্র এবং ছাত্রীদের হলে হলে নতুন নতুন নাটকের দল তৈরি হচ্ছে, নতুন নাট্যকার, পরিচালক, অভিনয় শিল্পীর আবির্ভাব ঘটছে। ক্যাম্পাসে তখন আর কোনো তৎপরতা ছিল না, স্থানে স্থানে নাটক নিয়ে কথা, রিহার্সাল, উত্তেজনা, ঝগড়া, রাত জাগা দেখছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন কোনো মিলনায়তন ছিলো না। আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নবীনবরণ ইত্যাদি সবই হতো আমাদের সেসময়ের বিভাগের সামনে অস্থায়ীভাবে নির্মিত এক মঞ্চে, সামনে খোলা জায়গা। ওখানেই আমরা সেইসময়ের জনপ্রিয় ব্যান্ডশিল্পী আজম খান, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজদের গানের অনুষ্ঠান দেখেছি। দেখেছি ঢাকা থিয়েটার, আরণ্যকের নাটক।

সেই ছোট অস্থায়ী মঞ্চেই হলো সপ্তাহব্যাপী নাট্য প্রতিযোগিতা। বিচারক ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, আতাউর রহমান, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ, মমতাজ উদ্দীন আহমদ। প্রতিযোগিতায় নতুন নাটকগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাটক অভিনয় ও পরিচালনা সব শাখায় পুরস্কৃত হয় হুমায়ুন ফরীদি লিখিত, পরিচালিত ও অভিনীত নাটক ‘আত্মস্থ আগুন ও হিরন্ময়ীদের বৃত্তান্ত’। আমার মুগ্ধ হবার অনুভূতিও মনে আছে। আমি এই নাটকসহ পুরো প্রতিযোগিতা নিয়ে লিখেছিলাম। এছাড়া অন্য নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- ‘অরক্ষিত প্রহরা’, ‘আরেক তন্দ্রা’, ‘টুনি সংবাদ’। এই প্রতিযোগিতা ফরীদির জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। ওর জীবনে প্রধান স্বপ্ন ছিল সার্বক্ষনিক অভিনয়ে জীবন পার করা। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অনেক পথ খুলে যায় এই প্রতিযোগিতায় ফরীদির সাফল্যের মধ্য দিয়ে। আগ্রহ নিয়ে ঢাকা থিয়েটার গ্রহণ করে ওকে, যেখানে পরের বহুবছর বহু নাটকে ফরীদির ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল অন্যতম প্রধান শক্তি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ডেকে নেয় ওকে যেখানে বেশ কয়েকটি নাটক অসম্ভব জনপ্রিয় হয়েছিল ওর অসাধারণ অভিনয়ের জন্য। অভিনয় ছিল ওর পাগল নেশা, বলতো ‘আমি আর কিছুই পারি না’। আরও বলতো, ‘আমি সমাজতন্ত্র চাই কেন জানো? চাই এজন্য যে, এটাই একমাত্র ব্যবস্থা যেখানে শুধু অভিনয় করেই বেঁচে থাকা যাবে। টাকার জন্য ছুটতে হবে না কোথাও।’ আমার ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার পর টিকে থাকার জন্য ছুটাছুটি ওর জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছিল আর সেটাই কালক্রমে ফরীদির জীবনমন খেয়ে ফেলেছিল।

নাট্য প্রতিযোগিতার সময় হুমায়ূন ফরীদি

রংপুরে দুর্ভিক্ষ
১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর অক্টোবরে উত্তরবঙ্গে বিশেষত রংপুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের কথা জানার পর থেকেই পরিকল্পনা করছিলাম সরাসরি গিয়ে দেখবো বুঝবো এবং লিখবো। অবশেষে ২৭শে অক্টোবর রংপুর যাই।

রংপুরেও এটাই ছিল আমার প্রথম সফর। ঢাকা থেকে বাসে গেলাম। এই রাস্তাতে ফেরী পার হয়ে আবার অন্য বাসে উঠতে হয়। আরিচা গিয়ে নগরবাড়ী পর্যন্ত ফেরী, প্রায় ৪ ঘন্টা ফেরীতে। ওপাশে গিয়ে আবার একই পরিবহণের আরেকটি বাসে রংপুর। পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যায়। কথামত রংপুর শহরে এক তরুণ সাংবাদিকের বাসায় উঠলাম। ওর মা-র আদর যত্নের কথা এখনও মনে আছে।

পরদিন সকালে উঠেই রওনা হলাম উত্তরবঙ্গের দুর্ভিক্ষের সবচাইতে বড় কেন্দ্র কুড়িগ্রামে। রংপুর থেকে কুড়িগ্রাম যাওয়া খুব সহজ নয়। দূরত্ব ২৫/৩০ মাইল হলেও সড়ক ও যানবাহনের কারণে সময় লাগে ৩/৪ ঘন্টা। বাসস্ট্যান্ডে গেলাম, কুড়িগ্রাম যাবার জন্য একটা ভাঙাচোরা জীপ দাঁড়ানো। আর কিছু নাই। জানলাম এটাতেই যেতে হবে, কিছুক্ষণের মধ্যে ছাড়বে। ব্রিটিশ আমলের কোনো জীপ মনে হয়, পেছনটা বাড়িয়ে সেখানে বেঞ্চ পাতা হয়েছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে ভরে গেল, কিন্তু চালকের মন ভরলো না। তাতে হবে না, ওর মধ্যেই মাথা গুজে, ডানে বায়ে পেছনে ঝুলে আরও মানুষ উঠতে হবে। উঠলো, ৩০ জনের মত তো হবেই। এভাবে ছোট জায়গায় মানুষের একটা বড় সমাবেশ নিয়ে রওনা হলো কোনো এক কালে জীপ নামে পরিচিত এই যান। কিছুক্ষণের মধ্যে বুঝলাম এই গাড়ীতে কোনো ব্রেক নাই, হর্ণও নাই-কোনোরকমে চলতে পারে শুধু। যখন থামার দরকার হয় তখন সহকারী ছেলেটা দুই/তিনটি লাঠি নিয়ে জীপের আগে দৌড়াতে থাকে, গতি ওরকমই, পরপর দুতিনটা লাঠি চাকার নীচে ফেললে একটু একটু করে থেমে যায়। তখন মানুষ উঠানামা করে। আবার যখন সামনে কিছু পড়ে, হর্ণ দেবার দরকার হয় তখন ড্রাইভার সাহেব হৈ হৈ করতে থাকেন, সাথে সাথে পুরো গাড়ীর মানুষ চিৎকারে যোগ দেয়। কাজ হয়। কারণ এসব প্রযুক্তি সবারই জানা।

যাইহোক, দুপুর নাগাদ যখন পৌঁছলাম তখন স্কুলের ভেতরে বাইরে হুলস্থুল। স্কুলে এখন লঙ্গরখানা, সেখানে খাবার বিতরণের চেষ্টা হচ্ছে। প্রচুর অনাহারী মানুষ, খাবারের তুলনায় তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের অনেকের সাথে কথা বললাম, দেখলাম। এলাকার মানুষদের সাথেও কথা হলো। পরে রংপুরে ফিরে জেলা প্রশাসক, পৌরসভার মেয়র, সংসদ সদস্য, সাংবাদিক, রাজনীতিকসহ অনেকের সাথে কথা হলো। পাট তামাক চাষ এই এলাকায় অন্যতম প্রধান ফসল। এসব এলাকাতে গিয়ে সংকট বোঝার চেষ্টা করলাম। নীলফামারীও গেলাম। সবকিছু দেখেশুনে এবং তথ্য বিশ্লেষণ করে আমার সিদ্ধান্ত ছিল,

‘বর্তমানে রংপুরে শতকরা ৫ জন স্বাভাবিক ক্রয়ক্ষমতার অধিকারী। শতকরা ১০ জন নিয়মিত আটা বা ভাত খেতে পারছে। শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ জনের এর জন্য ক্রয়ক্ষমতা নাই। পাট ও তামাকের নিম্নমূল্য, অগ্রিম ফসল, জমি, গরু-লাঙল বিক্রি, ফসল নষ্ট হওয়া এবং জমির মালিক কর্তৃক জমি পতিত রাখায় আধিয়ারদের বেকারত্ব, কম দিনমজুরী এবং কৃষি ভিন্ন অন্য কর্মস্থল না থাকায় কর্মজীবী মানুষের প্রকৃত আয় দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।….’

বেশ কয়েকদিন কাজ করে ঈদের আগেরদিন রাতে বাসায় ফিরলাম। ঈদের ছুটির সময়ই লিখে ঈদের পরপর লেখা শেষ করে জমা দিলাম। লেখার শিরোনাম ছিল- ‘দুর্ভিক্ষ: ডেটলাইন রংপুর’। (মুহাম্মদ, ২০২৩)

আখচাষী
১৯৭৯ সালের নভেম্বর মাসে সংবাদপত্রের একটি ছোট্ট খবরে আমার চোখ আটকে যায়। এক আখচাষী পরিবার নিজের ছোট্ট ঘরের আঙিনায় গুড় বানাচ্ছিল। সেই অপরাধে তাদের উপর পুলিশী হামলা হয়। গুলিতে একজন তরুণ আখচাষী নিহত হন। এই ঘটনা ঘটে ২৫শে নভেম্বর রাজশাহী শহর থেকে ৩০ মাইল দূরের গ্রামে। এই ঘটনা আমার জন্য অবিশ্বাস্য ছিল। একটি গরীব কৃষক পরিবারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিশাল আয়োজন করে ঝাপিয়ে পড়ে, খুন চুরি ডাকাতি দখল লুন্ঠন কিছুর জন্য নয়, বরং তার ফলন থেকে প্রয়োজনীয় একটি দ্রব্য গুড় উৎপাদনের জন্য। এবিষয়ে আরও অনুসন্ধানের আগ্রহ বাড়লো। এরপর লম্বা সময় নিয়ে রাজশাহী নাটোর আখচাষীদের এলাকায় গেলাম, তাদের সাথে বিস্তারিত কথা বলরাম, চিনিকল পরিদর্শন করে তথ্য উপাত্ত নিলাম। কৃষক থেকে ভোক্তা, আর রাষ্ট্রযন্ত্রের ভূমিকা সব পর্যালোচনা করে লিখলাম ‘আখ কাহিনী’। (ঐ)

ডায়েরীর কয়েকটি পাতা

৮.৩.৭৮
অনেকগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলে গঠিত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্টের প্রতিনিধি সভা ছিল আজ। লেখক শিবিরের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

১২.৪.৭৮
চারিদিকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট-অসন্তোষ। তবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। এসব প্রতিষ্ঠানে কিছুসংখ্যক ছাত্র বা কোনো দলের ডাকেই ধর্মঘট হয়, কারণ সম্পর্কে কারও মনে প্রশ্ন নেই। আবার ধর্মঘট উঠে গেলে তা কী কারণে উঠে গেল তা নিয়েও প্রশ্ন নেই। সে চেতনা অনেকখানি ভোঁতা।

১৪.৪.৭৮
শ্রমিক এবং শ্রমিক সংগঠন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মোহাম্মদ তোয়াহা, আলাউদ্দীন আহমেদ, শাহ আবদুল হালিমের সঙ্গে আলাপ হলো আজকে। শাহ আবদুল হালিম প্রসঙ্গে কথা বলা অবান্তর- ভালোই আছেন ভদ্রলোক! মোহাম্মদ তোয়াহা, আলাউদ্দীন আহমেদ নিজেদের তত্ত্ব নিয়ে খুব সন্তুষ্ট। তাদের মত অনেকেই ব্যক্তি গালাগালিতে উৎসাহী।..অবাক হলাম যখন তোয়াহা সাহেব বললেন যে, শ্রমিকদের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা নাই!… শুনেছি চট্টগ্রামে পার্টি কংগ্রেস হচ্ছিলো, জিয়া দেখা করতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন শুনে তিনি কংগ্রেসের মাঝখানে চলে এসেছেন। জিয়াকে তারা ‘দেশপ্রেমিক বুর্জোয়া’ বলে অভিহিত করে তার সাথে ঐক্যের যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন।

২১.৪.৭৮
আদমজী জুট মিলে গিয়েছিলাম গতকাল সকালে, ফিরেছি রাত ১১ টায়। শ্রমিকদের অনেক সমস্যা আছে। তবে খেলার মাঠ, স্কুল, ডাক্তার ইত্যাদি আছে দেখলাম।

৭.৬.৭৮
গ্রামে খাদ্যসহ জিনিষপত্রের দাম-
ধান (মণ): ৭০ টাকা, চাল (মণ): ১২০ টাকা, দুধ (সের): ৫ টাকা, সরিষার তেল (সের): ৩০ টাকা, কেরোসিন তেল (গ্যালন): ১০ টাকা, মুরগীর ডিম (হালি): ২ টাকা, ডাল (সের): ৬ টাকা, শাড়ী (প্রতিটি সর্বনি¤œ): ৪০ টাকা, লুঙ্গী (প্রতিটি সর্বনিম্ন): ১০ টাকা, মজুরি (দৈনিক): ৫ টাকা, শুকনা মরিচ (সের): ২০ টাকা, পিঁয়াজ (সের): ১০ টাকা।

৫.১.৭৯
শহরে এখন আবার মিছিল। শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও। বিভিন্ন পেশার মানুষের ধর্মঘট, বিক্ষোভ চলছে, বাড়ছে। ১৯৭৮ ধর্মঘটের বছর হিসাবেই গেছে। এবছর শুরু হয়েছে মিছিল দিয়ে। কিন্তু এই বিক্ষোভ, এই অসন্তোষ আবার কারা ব্যবহার করবে?

নির্বাচন সামনে। রাজাকার-বদরদের দল এখন বেশ শক্তিশালী। আওয়ামী লীগ (মিজান), জাসদ, ইউপিপিও আজ নির্বাচনে যাবার কথা ঘোষণা করেছে। মালেক গ্রুপও যাবে শেষ পর্যন্ত। উপরিকাঠামোর রাজনীতি আবার জমছে। কিন্তু অসন্তুষ্ট, বিক্ষুব্ধ, নিরন্ন মানুষের কী হবে? তাদের রাজনীতি কই?

৮.১.৭৯
নমপেনের পতন হয়েছে। সিহানুক জাতিসংঘে, খিউ সাম্পানসহ অন্য নেতারা চীনে। কম্বোডিয়া কদিন আগে মুক্ত হয়ে এখন আবার ভিন্নরঙের সাম্রাজ্যবাদের শিকার। ভিয়েতনাম সোভিয়েতের ক্রীড়নক হয়ে সকল বিপ্লবী সংগ্রামের ঐতিহ্য ভুলে কম্বোডিয়াকে দখল করলো। চীন নতুন সংশোধনবাদী চক্রের নেতৃত্বে এ ঘটনার জন্যে পুরো দায়িত্ব নিতে বাধ্য। চীনের ভূমিকা কম্বোডিয়াকে নিরাপত্তাহীন করেছে, চীনের ভূমিকা ভিয়েতনামে মস্কোপন্থী ব্লককে শক্তিশালী করেছে।

কম্বোডিয়ার এ অবস্থা সারা বিশ্বে সর্বহারা বিপ্লবের বর্তমান সংকটকে একেবারে সুস্পষ্ট করে তুলেছে। দরিদ্র দেশগুলোর দরিদ্রতম মানুষগুলো বিভ্রান্ত দিশেহারা এখন। চীন এখন মার্কিনের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশে নব্য পুঁজিবাদ পুন:প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত। বিশ্বজোড়া এই সংকট, বিক্ষিপ্ত এবং বিশৃঙ্খল অবস্থার প্রতিফলন বাংলাদেশেও। দিকচিহ্ন কুয়াশাচ্ছন্ন, বন্ধু শত্রু আবছা। বন্ধু যারা তারাই শত্রুর ভূমিকায়।

৯.১.৭৯
সেই দৃশ্য আমাকে লিখে রাখতেই হবে। তিনতলা থেকে দেখেছি, কিছুই করার সুযোগ পাইনি। একটি মেয়ে, বেশ্যা, পালিয়ে এসেছিল- দালাল এবং মাসী জোর করে তাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে-লোকজন জমেছে। বেশ্যা জেনে সবাই পিছিয়েছে- কারও কারও দাঁত বেরিয়েছে। জোর করে মেয়েটিকে নিয়ে গুন্ডা লোকটি রিকশায় উঠলো-গলায় হাত পেঁচানো- পুলিশের সামনে দিয়েই ওরা আবার অসহায় বিদ্রোহী মেয়েটিকে জোর করে নরকে নিয়ে গেল। মেয়েটার পালাবার অধিকার নেই, লাইসেন্সের জোরে সব সভ্য মানুষের সামনে দিয়ে, সভ্য আইনের সম্মুখ দিয়ে ওরা মেয়েটিকে ধরে নিয়ে গেল!

২৩.২.৭৯
ক্যাম্পাসে গ্রন্থাগার উদ্বোধন হলো আজ। কদিন এনিয়ে অনেক ব্যস্ততা গেল আমার এবং বন্ধুদের।

১৩.৩.৭৯
দীর্ঘ দুমাসের প্রস্তুতিতে, কাজে দশ দিন ধরে লিখে আজ শেষ করলাম ‘গবেষণা ও গবেষক’।

২১.৩.৭৯
কাল বিকালেই এই খবরটা ঢাকা হয়ে জাহাঙ্গীরনগরে পৌঁছেছে।..সর্বদলীয় ভিত্তিতে প্রতিবাদ সভা, মিছিল গতরাত থেকে চলছে, আজও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আলবদর ভিসির অপসারণের দাবিতে অনশন করছিল ছাত্ররা। বহুদিন থেকেই গন্ডগোল চলছে, শিক্ষকরাও আছেন ছাত্রদের সাথে। কাল সেখানে ছাত্র শিক্ষকদের উপর লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। আজ ঢাকাতে এর প্রতিবাদ মিছিলের উপরও গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।…আশ্চর্য্য, ১৯৭৯ সালে এসেও রাজাকার বদরদের অপসারণের দাবিতে রক্ত দিতে হয়। নির্বাচনের পরই সরকারের ফ্যাসিস্ট চরিত্র প্রকাশিত হবে যা দেশের আমলা-সামরিক চক্র ও সা¤্রাজ্যবাদের জন্য প্রয়োজন তা আগেই অনুমান করা যেত। এ ঘটনা তারই সূচনা।..

১.৪.৭৯
শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী!

১৮.৪.৭৯
জাকসু (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ) নির্বাচন বেশ জমেছে। এখানে মুজিববাদী ছাত্রলীগ আর জাসদ ছাত্রলীগই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। এছাড়া আছে প্রধান গ্রুপ এবং বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ঐক্যজোট। ইসলামী ছাত্র শিবির, বিএনপি ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নও আছে।

৩০.৪.৭৯
পরশু জাকসু নির্বাচন হয়েছে। এবং মুজিববাদী ছাত্রলীগ প্রায় সবগুলো আসনে জিতেছে।

৬.৬.৭৯
বহুদিন ধরে শুধুই খরা। চিরদুর্ভিক্ষের যে ব্যবস্থা তাতে এগুলো শুধু উলঙ্গ করে দেয় সবকিছু।

২১.৬.৭৯
অর্থনীতি সংসদ নির্বাচনে জিতলাম। বিভাগীয় নির্বাচন হলেও পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সংগঠনই এ নিয়ে সক্রিয় ছিল।

৩.১০.৭৯
গ্রামে দুইদিন। পুরো গ্রামে শুধু চারটি পরিবারে খাবার আছে।

১৭.১০.৭৯
দুদিন ধরে লিখে শেষ করলাম ‘বাংলাদেশে মেয়েদের জীবন’। তবে এটি নিয়ে কাজ চলছিল গত একমাসেরও বেশি। আশেপাশের গ্রামে ও ক্যাম্পাসে মেয়েদের কেসস্টাডিসহ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে বিশেষ সহযোগিতা করেছে সানজিদা ও বানু। কৃতজ্ঞতা রইল।

৩০.১১.৭৯
সারাবিশ্ব জুড়ে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী বিক্ষোভ, ইরান পরিস্থিতির সূত্র ধরে। ভাল লাগছে। আরও ভাল লাগছে যখন দেখছি যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশ থেকে নিজেদের লোকজন প্রত্যাহার করছে।

১৫.১২.৭৯
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে। এগুলোর সারকথা নিম্নরূপ- (১) স্বাস্থ্যখাতে বার্ষিক মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ১২ পয়সা যা তুলনীয় যে কোনো দেশের তুলনায় কম। যেমন বার্ষিক মাথাপিছু আয়-মঙ্গোলিয়া: ৩৩ টাকা, থাইল্যান্ড: ২ টাকা, ভারত: ৭০ পয়সা, শ্রীলঙ্কা: ৪৫ পয়সা, ইন্দোনেশিয়া: ৪০ পয়সা। (২) বাংলাদেশে শহরগুলোতে প্রতি ১০ হাজার লোকের জন্য মাত্র ১ জন এবং গ্রামগুলোতে প্রতি ৪৫ হাজার জনসংখ্যার জন্য ১ জন ডাক্তার। (৩) দেশের সরকারি হাসপাতালের মোট বেড সংখ্যা মাত্র ১৩ হাজার ৬শ ১০টি। ৫ হাজার ৬শ ৪৪ জনের জন্য মাত্র ১টি বেড।

স্বাস্থ্যখাতে বার্ষিক মাথাপিছু সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ মাত্র ১২ পয়সা যা তুলনীয় যে কোনো দেশের তুলনায় কম। যেমন বার্ষিক মাথাপিছু আয়-মঙ্গোলিয়া: ৩৩ টাকা, থাইল্যান্ড: ২ টাকা, ভারত: ৭০ পয়সা, শ্রীলঙ্কা: ৪৫ পয়সা, ইন্দোনেশিয়া: ৪০ পয়সা।

১৮.১.৮০
রংপুরে শীতে ৪১ জনের মৃত্যু। (ইত্তেফাক)

৯.২.৮০
হরতাল ছিল আজ দশদল এবং গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের। হয়েছে। যথারীতি বিএনপির গুন্ডাবাহিনী এবং পুলিশের গুন্ডামী। দুজন নিহত হয়েছেন। বিকালে ফ্রন্টের সভায় আওয়ামী লীগ হামলা করে নিজের ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। প্রতিরোধও হয়েছে। জনগণ দেখেছে কিন্তু অংশগ্রহণ করেনি কিছুতেই। তাদের অবস্থান দর্শকের মতো।

আখচাষীদের উপর লেখা শেষ হলো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মেজর জলিলের সঙ্গে আলাপ হলো পি জি হাসপাতালে।

২৭.২.৮০
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কদিন থেকেই কাজ করছি। জাফরুল্লাহ ভাইএর পর আজ আফসান, বাদল, আলম, শাহাদত ভাইদের সঙ্গে সারাদিনই মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেকার সেন্টিমেন্ট এখনও প্রাণবন্ত। মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে নানা দৃষ্টিভঙ্গী, এনিয়ে নানামুখী চক্রান্ত, বিভিন্ন সংগঠন ও চেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চরিত্র এবং এর পেছনের বিভিন্ন দর্শন বুঝবার চেষ্টা করছি এখন।

৭.৩.৮০
গত সোমবার (৩রা মার্চ) ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে গেছি খুলনার ডুমুরিয়ায় বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের দ্বিতীয় জাতীয় সম্মেলনে। ফিরেছি আজ। এই কদিন হাজার হাজার কৃষকের মধ্যে থেকেছি, তাদের সাংগঠনিক ও চেতনাগত অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করেছি- প্রত্যক্ষ করেছি অনেক অজানা দিক। শোবার এবং খাবারের ব্যবস্থা ছিল সবার জন্য এক। খুব সাধারণ। কিন্তু যার মধ্যে ছিল সমষ্টিগত চরিত্র। ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে কিংবা স্কুলে বিছানো চাটাইতে ৫০ থেকে ২০০ কৃষক কর্মী সাংস্কৃতিক কর্মীর মধ্যে থেকেছি, বালিশ ছাড়া, শীতের কাপড় ছাড়া। ঘুম হয়েছে ৩ থেকে ৪ ঘন্টা। কাল হয়ইনি। তবুও ভালো লেগেছে। কারণ গরীব কৃষক, ক্ষেতমজুর, বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের দুর্ভোগ দেখেছি অনেক- এবার দেখলাম মুষ্টিবদ্ধ সহ¯্র শোষিত মানুষের বিপ্লবী কর্মের দৃঢ় চেতনা। এই কদিন দ্রুত চলে গেছে। পরিচিত হয়েছি অনেক অচেনা বিপ্লবী কর্মীর সঙ্গে।..স্থানীয় সংগঠনের দুর্বলতা সত্ত্বেও নেতৃবৃন্দ এবং বাইরের শাখাসমূহের কর্মীবৃন্দের অক্লান্ত পরিশ্রমে সম্মেলন সফল হয়েছে।..

১১.৩.৮০
সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ডের সভা ছিল আজ। উমর ভাই, জামান ভাই, শাহরিয়ার ভাই, ফিরোজ ভাই এবং আমি ছিলাম।..নয়া পদধ্বনি আদৌ প্রকাশিত হবে কিনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল আর্থিক সংকটের কারণে। আজ সভায় তার সমাধান হয়েছে।

১৪.৩.৮০
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গত কয়দিনে আরও অনেকের সাথে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে ছিলেন- কর্ণেল জামান, লে কর্ণেল দিদারুল আলম, মেজর জলিল (পিজি হাসপাতাল), ক্যাপ্টেন শাহাব (বীরোত্তম), ক্যাপ্টেন সাত্তার, শেখ মুজিব আমলের মন্ত্রী শামসুল হক, মতিভাই, আলম, নাসিরুদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ। শাহাদৎ ভাই তো বটেই। এছাড়া গিয়েছিলাম যুদ্ধাহত বিশ্রামাগারে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলতে

গত ১০ তারিখে কর্ণেল দিদার, শাহাদৎ ভাই, বাদল ভাইসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস তো নয়ই অন্য বাসও পাচ্ছিলাম না। গাবতলী যেতে যেতে রাত ১১টা পার হয়ে গেল। একটা বাস যাচ্ছিল, উঠলাম কিন্তু ১২ টার দিকে আমিনবাজার গিয়ে বাস থেমে গেল। যাত্রী নাই যাবে না। ওখানে নেমে কী করি? কোথায় রাত পার করবো? আশে পাশে কোনো দোকান বা বাসস্ট্যান্ড কিছু নাই। চোখে পড়লো একটু দূরে একটা মসজিদ। মসজিদ অনেকসময় রাতে বন্ধ থাকে। তবুও গেলাম। না, খোলাই আছে। হাতমুখ ধুয়ে ভেতরে গিয়ে শুয়ে থাকতে কোনো বাধা নাই। সারারাত ওখানেই থাকলাম, মশার উৎপাতে ঘুমানো কঠিন ছিল। ফজরের নামাজের পরে চারিদিক ফর্সা হবার পরে বের হয়ে প্রথম বাস পেলাম নবীনগর যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে ঢুকে সেই সকালে দেখি কয়েকটা বাস ঘিরে অনেক ছেলেমেয়ে, হৈ চৈ খুশী খুশী সবাই। দেখি ভূগোল বিভাগ থেকে মঞ্জু, বানু, সানজিদারা শিক্ষা সফরে যাচ্ছে।

ওখানে নেমে কী করি? কোথায় রাত পার করবো? আশে পাশে কোনো দোকান বা বাসস্ট্যান্ড কিছু নাই। চোখে পড়লো একটু দূরে একটা মসজিদ। মসজিদ অনেকসময় রাতে বন্ধ থাকে। তবুও গেলাম। না, খোলাই আছে। হাতমুখ ধুয়ে ভেতরে গিয়ে শুয়ে থাকতে কোনো বাধা নাই। সারারাত ওখানেই থাকলাম, মশার উৎপাতে ঘুমানো কঠিন ছিল।

২৬.৩.৮০
স্বাধীনতা দিবসে গিয়েছিলাম নয়ারহাটের পাশে কাকরানে, সেখানে কুমার পাড়া, বিস্তৃত মৃৎশিল্পের কাজ। বাস, নৌকা, হাঁটা সব মিলিয়ে আমরা দলে বলে গেলাম- রেজা, দীপু, দুলাল, মাহফুজ, সানজিদা, বানু, রেনু, জ্যোতি, অরিন্দম, নার্গিস, ফেরদৌসী, মতিন। অনেক হাঁটলাম, মাটির কাজ দেখলাম, এখান থেকে খুব কম দামে যায় শহরে, সেখানে আরও বেশি দামে বিক্রি হয়। এই শিল্পীদের প্রাপ্তি খুব কম , কিন্তু ঝুঁকি অনিশ্চয়তা অনেক। যেতে আসতে হাঁটতে হাঁটতে একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম-গ্রামের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবারই চেহারা বিরূপ। মনে হয় বিদেশিদের তারা যেভাবে কৌতুহলে ভিন্ন জগতের মানুষ হিসেবে দেখে- আমাদেরও সেভাবেই দেখেছে। শিশুদের মুখে এই ছড়া শুনে শুনে সেটাই মনে হলো- ‘ধলা বিলাই- ধইর‌্যা কিলাই’!

৭.৪.৮০
নয়া পদধ্বনির উপদেষ্টা কমিটির সভা ছিল আজ। মুশকিল হয়েছে, কোনো প্রেস ঝুঁকি নিতে রাজী হচ্ছে না।

১৫.৪.৮০
ময়মনসিংহ জেলখানায় অনেকটা শূন্য সম্ভাবনা নিয়েই গিয়েছিলাম সেখানে আটক সিরাজুল আলম খানের সাথে দেখা করতে। কিন্তু দেখা করা গেল। আমাকে একটা ঘরে বসানোর কিছুক্ষণ পর এলেন সিরাজুল আলম খান এবং কর্ণেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন। ওঁদের সঙ্গে দীর্ঘ চারঘন্টা আলাপ হলো। কাগজ কলম নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ও সম্ভাবনার কথা বললেন সিরাজুল আলম খান। এই প্রথম জাসদের একজনের সঙ্গে আলাপ হলো যিনি জানেন বোঝেন। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, দূরদর্শী কিন্তু নেপথ্য চারণায় অধিক আগ্রহী তিনি। ভাল লেগেছে কথা বলে, ডগমেটিজম নাই। বর্তমান জাসদ নেতৃত্ব সম্পর্কে অসন্তুষ্ট মনে হলো। এবং তিনি জাসদ বিলং করেন না বলে জানালেন।

(এর কদিন পরই ১লা মে সিরাজুল আলম খান মুক্তি পান।)

আমাকে একটা ঘরে বসানোর কিছুক্ষণ পর এলেন সিরাজুল আলম খান এবং কর্ণেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন। ওঁদের সঙ্গে দীর্ঘ চারঘন্টা আলাপ হলো। কাগজ কলম নিয়ে অনেক পরিকল্পনা ও সম্ভাবনার কথা বললেন সিরাজুল আলম খান।

২৬.৪.৮০
বিকালে মাহমুদ স্যারের বাসায় ছিল মুক্ত আলোচনা চক্র। মামুনুর রশীদ, গৌতম মুনশীরা সংগঠিত করেছেন। সিনিয়রদের মধ্যে ওবায়দুল্লাহ খান, ফজলে লোহানীও ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ।

১৫ থেকে ২৬ মে
ভারতে বিভাগের সফর। ফরীদি, মফিজ, মইন, আকবর, রাণী, স্মৃতি, সেলিনাসহ আমরা ১৫ জন। ভারতের বাধার কারণে নেপাল যাওয়া হয়নি। ফারাক্কা বাঁধের উপর দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাওয়া নিষিদ্ধ। আমাদের পরিচয় গোপন করে রিজার্ভ বাস সেই বাঁধের উপর দিয়ে নিয়ে গেল দার্জিলিং। পথে বিশ্বভারতী-শান্তিনিকেতনে একদিন। রাতদুপুরে পার হলাম ফারাক্কা। আলোতে ঝকঝক করছে। বাস থেকে দেখলাম বিরাট আয়োজন যা আমাদের জন্য সর্বনাশ আনছে। পরপর দুইরাত একদিন বাসজার্ণির পর দার্জিলিং।

৮.৬.৮০
জাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল গতকাল। জাসদ, মুজিববাদী ছাত্রলীগ, বিএনপি, ইসলামী ছাত্রশিবির, ছাত্র ইউনিয়ন ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী।..নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে।
জুন-জুলাই মাসে অসুস্থ- ঘরে এবং হাসপাতালে ।

১৯.৭.৮০
কদিন থেকেই মনটা খারাপ- বিচিত্রার জন্য। প্রেসিডেন্টের হুমকিতে বিচিত্রার চরিত্র মনে হয় বদলাতে চলেছে।

২০.৮.৮০
গত পরশু গিয়েছিলাম ভৈরবে। প্রশিকার চারু ভাইএর এলাকায় ভূমিহীনদের সম্মেলন দেখতে এবং সেইসঙ্গে প্রকৃত অবস্থা বুঝতে।
জায়গাটা ভৈরব থেকেও ১৫ মাইল দূরে। প্রত্যন্ত এলাকার ৬২টি গ্রামে এই ভূমিহীন সমিতি। এখানে যুক্ত প্রশিকার ২৬ জন কর্মী। যেদিন গেছি সেদিনই কিছু আলোচনা হয়েছে; পরদিন অরুয়াইল থেকে ১২ মাইল নৌকায় গিয়ে নূরপুরে সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে ভূমিহীনরা যেসব কথাবার্তা বলেছেন তা আমার কাছে বিস্ময়কর ছিল। রাত ২টা ৩টা পর্যন্ত ১০/১২জন কর্মীর সঙ্গে সমগ্র বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।

এখানকার যে বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য সেগুলো হলো:
ক. গ্রামের কলেজ কিংবা ডিগ্রী পাস বেকার, সৎ ছেলেরা এর কর্মী। একইসঙ্গে জীবিকা ও ভূমিহীনদের সহায়তা করবার জন্য তারা এতে যোগ দিয়েছে।
খ. ভূমিহীন যারা সমিতিতে সংগঠিত হয়েছে তারা প্রশিকা নির্দেশিত অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ক্রমশ শ্রেণী সচেতন হয়ে উঠছে এবং নিজেদের অজান্তেই রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা করছে। প্রশিকার মূল উদ্দেশ্য থেকে তারা অনেক অগ্রসর হয়ে আছে।
গ. এই মুহূর্তে প্রশিকা থেকে সরে গিয়ে কিংবা সিডার মূলনীতি বাদ দিয়ে যদি রাজনৈতিক সঠিক চিন্তাধারার নেতৃত্ব এর মধ্যে উপস্থিত হয় তবে সামগ্রিক আন্দোলন দ্রুত কার্যকর বিকাশ লাভ করবে। আর তা যদি না হয় তবে শীগগিরই এ নিয়ে সংকট সৃষ্টি হবে।

১.৯.৮০
গত একটি সপ্তাহ খুব খারাপ সময় যাচ্ছে আমার। চারদিক থেকে হতাশা গ্রাস করছে।… বিচিত্রা প্রায় পঙ্গু। সরকার, বিএনপি এবং স্বয়ং জিয়ার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে বিচিত্রার চেহারা ফ্যাকাশে। আমরা সবাই পরাজিত, অপমানিত বোধ নিয়ে দায়সারা গোছের কাজ করছি।..এখন ক্রমেই শাহাদৎ ভাই যেন আরও কুঁকড়ে যাচ্ছেন, বিষণœ হয়ে পড়ছেন- নিজের পরাজয়ে নিভে যাচ্ছেন- দাঁড়াবার শক্তি নেই। কত কি লেখার ছিল লিখতে পারছি না। এতবড় বন্যা যাচ্ছে কিছুই করার নেই। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা নিয়ে লিখেও ফেলে রেখেছি।

ড. মাহমুদ হঠাৎ করে, এতদিনের কথাবার্তার বিপরীতে গিয়ে, সংবাদে লিখেছেন মুজিব আমলের নীতিই সঠিক ছিল। আমি তাঁর সঙ্গে সরাসরি তর্কে গেলাম, ভিত্তিহীন যুক্তি আর বিশ্বাসের কোন ব্যাখ্যা দিতে না পেরে ক্ষেপে গেলেন। সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম উমর ভাইএর কাছ থেকে। তিনি গ্যাস রপ্তানির পক্ষে একটা লেখা লিখেছিলেন নয়া পদধ্বনির জন্য। সম্পাদকীয় বোর্ডে শাহরিয়ার ভাই, জামান ভাই আর আমি প্রচুর যুক্তি দিলাম এর বিরুদ্ধে। কিন্তু তিনি সবকিছু অগ্রাহ্য করলেন, তার লেখা ছাপতেই হবে। আমরা দল পাকাচ্ছি ইত্যাদি কথাও শুনতে হলো।

৯.৯.৮০
নয়া পদধ্বনি নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের সাথে জটিলতা আরও বেড়েছে। উমর ভাই গত তিনটি সম্পাদকীয় বোর্ডের সভায় আসেননি। গত দুই সংখ্যায় লেখেননি। কারণ হচ্ছে তাঁর লেখার বিরোধী লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

১৯.৯.৮০
জাসদ ভেঙেছে। নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য প্রতিবাদ। প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে নেতৃত্বের নানা ব্যবস্থা। অধিকাংশ তরুণ বেরিয়ে এসেছেন বিদ্রোহ করে।

১.১০.৮০
জাসদের ভাঙনে দুটি ধারা: এক ধারায় শ্রেণী সহাবস্থান এবং বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রতি অনীহা। অন্য ধারায় শ্রেণী সংগ্রাম এবং বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আকাঙ্খা। বিদ্রোহী গ্রুপ দ্বিতীয়টির পক্ষে। পার্টি প্রক্রিয়া, শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কে ভাঙলো জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)।

৯.১০.৮০
পরশু গিয়েছিলাম কুমিল্লায়, প্রশিকার কর্মী সম্মেলনে আহুত হয়ে। মাহমুদ স্যারও ছিলেন। দুদিনের অবিরাম আলোচনা থেকে বুঝলাম কর্মীরা নেতৃত্ব থেকে অনেক স্পষ্ট, দ্বিধাহীন, অগ্রসর। তারা আর প্রশিকার সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে রাজী নন। একটা শ্রেণী সংগঠনের কাজ এগিয়ে নেবার জন্য তারা উদগ্রীব। এরা প্রত্যেকেই আগে কোন না কোন বাম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১০.১০.৮০
ফজল মাহমুদ স্মৃতি পুরস্কার। এবারে পেল: হুমায়ুন ফরীদি (নাটক), শেখ মুহম্মদ মনজুরুল হক (চিত্রকলা) এবং আবদুল মান্নান সরকার (কথাসাহিত্য)।

৩০.১০.৮০
পটুয়াখালীতে খুব ভালো কৃষক জমায়েত হয়েছে। প্রায় ১০ হাজার জমায়েত ছিল। ভূমিহীনদের জমির অধিকার ছিল মূল প্রশ্ন।

৩.১১.৮০
নয়া পদধ্বনির অর্থনৈতিক এবং নীতিগত সংকট প্রশ্ন আলোচনার জন্য জামান ভাই আজ সম্পাদকীয় বোর্ডের সবাইকে চায়ের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মতৈক্য হয়নি।… চলবে পত্রিকা। তবে এই সাংগঠনিক কাঠামো রাখা সম্ভব হবে না, যা ইতিমধ্যেই কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলেছে।

২৯.১২.৮০
‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির’ এবং ‘মৌলিক অধিকার ও আইন সংরক্ষণ কমিটি’র যৌথ সভা। ‘উপদ্রুত এলাকা বিল’ এর বিরুদ্ধে করণীয় নিয়ে আলোচনা। …যাদের দিকে তাকিয়ে বিধ্বস্ত আন্দোলনের মধ্যেও আশার আলো দেখি, জীবনের সবকিছু ঢেলে নিজেদের স্বপ্নকে তিলে তিলে বাস্তবে নির্মাণ করবার জন্য কাজ করি তাদের মধ্যে যখন ক্ষুদ্র ব্যক্তি অহমিকা, পরমত অসহিষ্ণুতা, সমষ্টির মতের প্রতি অবজ্ঞাসূচক কার্যকলাপ দেখি তখন চারদিক অন্ধকার মনে হয়।

(চলবে)

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, লেখক ও সম্পাদক- সর্বজনকথা। ইমেইল: sarbojonkotha@gmail.com 

সূত্রনির্দেশ
মুহাম্মদ, ১৯৮৫। আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি। ২য় বর্ধিত সংস্করণ, ২০০০। মীরা প্রকাশন, ঢাকা।
মুহাম্মদ, ১৯৮৮। আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশের উন্নয়ন সংকট এবং এনজিও মডেল, প্রচিন্তা প্রকাশনী, ঢাকা। ২য় সংস্করণ ২০০০, ৩য় সংস্করণ ২০২১।
মুহাম্মদ, ২০২৩। আনু মুহাম্মদ: রচনাবলী ১ম খন্ড, বাঙ্গালা প্রকাশনী, ঢাকা।
চৌধুরী, উদ্ধৃতি মহিউদ্দিন, ২০১৪। মিজানুর রহমান চৌধুরী: রাজনীতির তিনকাল, হাফেজ মাহমুদা ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ২০০১। উদ্ধৃতি মহিউদ্দিন আহমদ: জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি, প্রথমা।
চৌধুরী ২০২৪। জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী, সাক্ষাৎকার প্রথম আলো, ৩০শে মে। প্রকাশিত গ্রন্থ: দুই জেনারেলের হত্যাকান্ড, প্রথমা, ২০২৪

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •