বিবৃতি
পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যাযজ্ঞের ন্যায়বিচার ও সেনাশাসন অবসানের দাবি
মুক্ত গবেষক এলায়েন্স
জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশে এক গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে এসেছে, যা কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ রেজিমে অনুপস্থিত ছিল। গণতন্ত্র মানেই দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য তাদের মৌলিক ও নাগরিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। একটা গণতান্ত্রিক দেশে তার সমাজ ও রাজনৈতিক পটভূমিতে লিঙ্গ, জাতি, শ্রেণি ও ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিক অংশগ্রহণ করবে, এটাই কাম্য। অথচ, গভীর বেদনার সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি যে গণতন্ত্রের এই স্বপ্ন খুব দ্রুত আমাদের বাস্তবতা থেকে অপসৃত হচ্ছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামে মামুন নামে স্থানীয় এক বাঙালি যুবকের মৃত্যু স্থানীয় জনপদে অস্থিতিশীল অবস্থা জাগিয়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মাঝে শুরু হওয়া মতানৈক্যটি একটি সাম্প্রদায়িক নৃশংসতায় রূপ নিয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি, যার মাঝে ছিল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় অগ্নিসংযোগ, রাষ্ট্রীয় মদতপুষ্ট আক্রমণ ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর চালানো হত্যাকাণ্ড, যার মাঝে ছিল দুজন কলেজ শিক্ষার্থী। অথচ খাগড়াছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বরাতে জানা যায়, মৃত ব্যক্তির স্ত্রী তিনজনের নাম উল্লেখ করে (আরও অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনসহ) একটি হত্যা মামলা করেছেন, যে তিনজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার বদলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উল্টো লিপ্ত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার কাজে। এ ছাড়া আমরা দেখেছি, অনলাইনে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বড় আকারের মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচারের ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে, যা তাদের স্টিগমাটাইজেশনকে জোরদার করছে। এই বর্বরতা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টির সব প্রত্যাশাকে গুঁড়িয়ে দেয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমি ও জীবনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া দমনমূলক সেনা মোতায়েনকেই আরও জোরদার করে।
ঐতিহাসিকভাবেই, বাংলাদেশের আদিবাসীরা একটি ধারাবাহিক ও কাঠামোগত নিপীড়নের শিকার, যা তাদেরকে মৌলিক সব সাংবিধানিক ও মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই বিভিন্ন ক্ষমতাধর সরকার সমস্যাযুক্ত ভূমি আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে আদিবাসী জনতাকে গৃহহারা করে আসছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আদিবাসীদের পরিচয় এবং প্রতিনিধিত্বের দাবি অস্বীকার করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এই পরিস্থিতির আরও অবনমন ঘটেছে যখন ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলের বাইরে থেকে বাঙালিদের গণহারে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাঠাতে শুরু করে এবং সেখানে, শুধু সীমান্তে নয়; বরং গোটা পাহাড়জুড়ে সেনাশাসন কায়েম করে। আন্তর্জাতিক আদিবাসী সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপ (আইডব্লিউজিআইএ)-এর মতে, ২০১৪ সালের হিসাব অনুযায়ীই ৩৫ থেকে ৪০ হাজার সেনা (বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন এবং বাংলাদেশ আনসার বাদে) পার্বত্য চট্টগ্রামে মোতায়েন ছিল, যা সেনাবাহিনীর মোট সদস্যসংখ্যার একটি বড় অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশনের মতে, প্রতি ছয়জন আদিবাসীর জন্য সেখানে একজন করে সেনা মোতায়েন করা আছে। রাষ্ট্র আমাদেরকে ‘আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি ফিরিয়ে আনতে এই সেনা মোতায়েন’, এই বয়ান দিয়ে এলেও, এসব ক্রিয়াকলাপ আদিবাসী জনগণকে লম্বা সময়ের জন্য নিপীড়নের পাত্রে পরিণত করে, তাদেরকে ভুলভাবে চিহ্নিত করা হয় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘বহিরাগত’ হিসেবে। আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ১৯৯৭ বাস্তবায়নও কখনো সম্পূর্ণ করে নাই, উল্টো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মতন অপমানসূচক শব্দবন্ধ ব্যবহার করার মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অপমানের পাল্লাই ভারী করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দাবি এই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের চলমান সংকটকে অস্বীকার করে পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা বা তাদেরকে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হবে না। এ ক্ষেত্রে নাগরিক স্পেস থেকে সেনাশাসনের অবসান অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সেনাশাসন পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত একটি ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ পরিণত করে এবং আদিবাসী জনগণের নাগরিক জীবনে সেই যুদ্ধের রেশ টেনে নিয়ে আসে। আমরা তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাশাসনের অবসান এবং দমনমূলক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দ্বারা সেখানে চলমান রক্তপাতের ইতি টানার দাবি জানাচ্ছি। এ ছাড়া বাংলাদেশের আইনে কোনো ক্রিয়াকলাপ যদি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে তা দেশের অন্যান্য স্থানের মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে সুরাহা করা হবে–এটাই আমাদের কাম্য, এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডগুলোর ন্যায়বিচার আমরা দাবি করছি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জনগণের একটি অংশকে ক্রমাগত বিপদের মুখে ঠেলে দেবে, এটা আমাদের প্রত্যাশা নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ক্রমাগত ‘বহিরাগত’বা ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে অপমান করতে থাকলে তা এক বর্বরোচিত জাতিগত হত্যাযজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় অপরাধের দিকেই আমাদের ঠেলে দেবে।
-২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪