বাংলার লোকজ দর্শন ও দার্শনিক মনোমোহন:প্রসঙ্গ বাউল, সর্বধর্ম সমন্বয়বাদ ও সাম্যচেতনা

বাংলার লোকজ দর্শন ও দার্শনিক মনোমোহন

প্রসঙ্গ বাউল, সর্বধর্ম সমন্বয়বাদ ও সাম্যচেতনা

মনির হোসেন

মনোমোহন দত্ত একজন মরমি সাধক, কবি ও ভাবসংগীতকার। মনোমোহন সাধু নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তিনি বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার অন্তর্গত সাতমোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন (জন্ম: পূর্ববঙ্গ, ১০ মাঘ, ১২৮৪ বঙ্গাব্দ, ইংরেজি ১৮৭৭; মৃত্যু: ১২৮৪ বঙ্গাব্দ, ১০ মাঘ, ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দ)। তার পিতা পদ্মনাথ দত্ত ও মাতা হর মৌহিনি। মনোমোহন দত্তের পূর্বপুরুষরা সোনারগাঁ ভট্টগ্রামের জমিদার ও এ অঞ্চলের প্রধান সাঁজওয়াল ছিলেন। সাঁজওয়াল বলতে সে সময় যারা বাদশাদের সৈন্য-সামন্ত জোগান দিত তাদের বোঝায়। পরে ওই বংশের একটা অংশ সাতমোড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করে। তার জীবদ্দশায় ভাবশিষ্য ও ভক্ত ছিলেন আফতাবউদ্দিন খাঁ। আফতাবউদ্দিন খাঁ (১৮৬১-১৯৩৩) এবং তার ছোট দুই ভাই বিখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৬২-১৯৭২) ও আয়েত আলী খাঁ (১৮৮৪-১৯৬৭); তারাও ছিলেন মনোমোহন সাধুর ভাবশিষ্য ও ভক্ত। তারাই মনোমোহন দত্তকে তার বাউলসাধনা ও সর্ব্বধর্ম দর্শনের জন্য মহর্ষি উপাধি প্রদান করেছিলেন। মূলত সুরকার আফতাবউদ্দিন খাঁ-ই তার গুরু মনোমোহন দত্তের দর্শন মলয়া সংগীতের মাধ্যমে প্রথমদিকে সমাজে প্রচার করেছিলেন এবং তিনিই মলয়া সংগীতের গানে সুরারোপ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার স্তর কম হলেও তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। কোরআন, বেদ, বাইবেল, মহাভারত, ইতিহাস, উপনিষদ, ত্রিপিটক, রামায়ণ, প্রাচীন সভ্যতা, সুফিবাদ, বৈষ্ণব, রসতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তার অগাধ ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনি তার লেখাপত্র অল্পবিস্তর নিজ সংগ্রহে রাখলেও তার মৃত্যুর পরবর্তী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধরা আনন্দ আশ্রম আক্রমণ করে তার অনেক লেখা, বই পুড়িয়ে ফেলে। অনেক লেখাই পরে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রচলিত লেখা ও গানগুলো তার শিষ্যরা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। উপবন, খনি, প্রীতিকদম্ব, তপোবন, ময়না বা পাগলের প্রলাপ, লীলারহস্য (আত্মজীবনীমূলক), মলয়া ১ম খণ্ড, মলয়া ২য় খণ্ড, প্রেম পারিজাত, পথিক মহর্ষি মনোমোহন দত্ত রচিত গ্রন্থ।

আফতাবউদ্দিন খাঁ (১৮৬১-১৯৩৩) এবং তার ছোট দুই ভাই বিখ্যাত সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (১৮৬২-১৯৭২) ও আয়েত আলী খাঁ (১৮৮৪-১৯৬৭); তারাও ছিলেন মনোমোহন সাধুর ভাবশিষ্য ও ভক্ত। তারাই মনোমোহন দত্তকে তার বাউলসাধনা ও সর্ব্বধর্ম দর্শনের জন্য মহর্ষি উপাধি প্রদান করেছিলেন।

বাংলার লোকজ দর্শন ও মনোমোহন দত্ত

জগতে জীবের জীবনমাত্রই দুঃখময়, দুঃখময় জীবনে সকলেই সুখের আকাঙ্ক্ষা করে। দুঃখ নিয়ে বাঁচতে চায়–জগতে এমন কোনো প্রাণী পাওয়া যাবে না। সুখের দেখা পাওয়ার জন্যই জগতের এত এত চিন্তার প্রসার। সুপ্রাচীন কাল থেকেই মানুষ এর সন্ধানে উন্মুখ। সুখের আস্বাদন কোথায়! মানুষ এই সন্ধানেই সৃজন করেছে ধর্মের। ভাবল সুখ পাওয়া সম্ভব একমাত্র ধর্মেই। ভোলগা থেকে গঙ্গা, মেসোপটেমিয়া থেকে ইনকা, সিন্ধু সভ্যতা থেকে চৈনিক সভ্যতায় মানুষ একে একে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে। পাওয়া না-পাওয়ার বেদনায় নিজেই নিজের সৃজিত ধর্মে তৈরি করেছে আবার বর্ণপ্রথা। বিভক্ত করেছে সাদা-কালোতে। একদল সুখের জন্য আরেক দলের ওপর চালিয়েছে সংগ্রাম। বেধেছে দ্বন্দ্ব, বিনিময়ে মরেছে মানুষ। এই প্রাত্যহিক ঝড়ঝঞ্ঝা এখনো চলমান। প্রাচীন ভারতে সত্যদ্রষ্টা ঋষিরা ঘোষণা করেছিলেন: ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বন্ধিং’ অর্থাৎ যিনি আছেন তিনি এক, এই একক সত্তায়ই সুখ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তা-ও হয়নি। পক্ষান্তরে আরও ঘটেছে মতান্তর। উদ্ভব ঘটেছে নানাবিধ মতের, দর্শনের। কেউ করেছে সাধন, কেউবা করেছে ভজন। মধ্যযুগে বৈষ্ণব পদাবলিতে উচ্চারিত হয়েছে: ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেলো।’ বস্তুত, উৎপত্তিকাল থেকেই দর্শন বিজ্ঞানকে পথ দেখাতে পারলেও ধর্মকে পারেনি। কারণ, ধর্মের ধর্ম হলো সারাক্ষণ একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে স্থির হয়ে থাকা। আসন ছাড়লেই এর বিলুপ্তি ঘটে। ধর্ম যদি বলে, সাত আসমানের ওপর একটি নীল তিমি আছে, তাহলে ধার্মিকদের পক্ষে ওই নীল তিমিকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু দর্শনে এ স্থিরতা নেই। দর্শন গতিশীল ও প্রবহমান। সমাজও ঠিক তাই। দর্শন যখন স্থির হয়ে পড়ে, তখন তা আকার ধারণ করে ধর্মে ও স্থির সামাজিক প্রবর্তক ব্যক্তিক আদর্শে। কালানুক্রমিক তা হয়ে পড়ে জীর্ণ। লৌকিক চেতনা ও বদ্ধমূল সংস্কার এসে জড়ো হয় ধর্মে। বৃহত্তর অর্থে জগতের জড় ও জীবের আলাদা আলাদা ধর্ম আছে। ‘ধৃ’ ধাতুর সঙ্গে ‘ম’ (মন) প্রত্যয় যোগে ‘ধর্ম’ শব্দটি এসেছে, যার মূল অর্থ হলো ধারণ করা বা ধরে রাখা। আগুনের ধর্ম দগ্ধ করা, জলের ধর্ম নিম্নগামী হওয়া, বাতাসের ধর্ম প্রবাহিত হওয়া, মাটির ধর্ম বস্তুকে ধারণ করা, প্রকৃতির ধর্ম সৌন্দর্য তুলে ধরা। তেমনি মানুষের প্রকৃত ধর্ম মনুষ্যত্ব অর্জন করে মানুষ হওয়া।

তার মৃত্যুর পরবর্তী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এবং পরে সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধরা আনন্দ আশ্রম আক্রমণ করে তার অনেক লেখা, বই পুড়িয়ে ফেলে।

সীমাবদ্ধ আচার-আচরণিক গণ্ডিতে মানুষের ঈশ্বর ভজন, রীতির ঊর্ধ্বে উঠে খোদা লাভের তাড়নায় মানুষের মানুষ ভজন। এই দ্বৈতাদ্বৈত ভাবুকে ভজনদের ভজনালয়ে সমন্বয়বাদী আত্মবিস্মৃত আত্মবিসর্জনই ভারতীয় লোকজ দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের মূলনির্যাস। সময়ে স্রোতে বিভিন্ন অববাহিকায় ভারতীয় সমাজের অন্দরমহলে এসে মিশেছে জৈন, সাংখ্য, চার্বাক, বৌদ্ধ, হিন্দু, বৈষ্ণব, বাউল, সুফি, মুসলমান, খ্রিস্টানসহ প্রকৃতি পূজারি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানাবিধ ধর্মজ চেতনা। কোনো চেতনাই এখানে রাষ্ট্রিক ও সমাজ কাঠামো সর্বসত্তাকে ধারণ করে বিকশিত হয়নি। চর্চা হয়েছে বিভিন্ন জনপদের নিজস্ব আবহাওয়া ও জলবায়ুর ভেতর দিয়ে। ইউরোপে যেখানে এককভাবে সমাজ কাঠামোতে খ্রিস্টান পাদরি ও চার্চশাসিত সমাজব্যবস্থা ছিল। বৈপরীত্যে ভারতবর্ষে এসব ধর্মজ্ঞ, ধর্মজ চেতনা জনসাধারণের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক মননে ও ভাবের জগতে একক কাঠামো উপেক্ষা করে মননে আলাদা বোধের জায়গায় লোকজ বিশ্বাস কালক্রমে পরিবাহিত হয়েছে। ফলপ্রসূত ভারতীয় প্রতিটি জনপদে ধর্মজ চেতনা তার নিজস্ব রীতিনীতিতে রাষ্ট্রিক কাঠামো থেকে স্বতঃস্ফূর্ত স্বতন্ত্র ব্যক্তিক পরিমণ্ডলে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে নিঃসৃত হয়েছে। তেরো শতকে সেমেটিক সভ্যতার আব্রাহামিক ধর্মমতের ইসলাম বাংলায় শাসন কাঠামোতে প্রবেশের পর রাষ্ট্রিক, সামাজিক রীতিনীতি ও সংস্কৃতিতে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব দৃশ্যমান হয়। প্রচলিত ধর্মীয় চিন্তার সঙ্গে অন্যান্য লোকজ চিন্তার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করে ব্রিটিশশাসিত ভারতের শাসন কাঠামোতে।

আঠারো শতকের শেষে বাউল সম্রাট লালনের (১৭৭২-১৮৯২) সমসাময়িক তৎকালীন ভারতের বাংলা প্রদেশে পূর্বাংশে মহর্ষি মনোমোহন দত্ত (১৮৭৭-১৯০৯) একজন বাউল ও মানবতাবাদী লোকজ দার্শনিক। তার দর্শনের মূল কথা বাউলদের মতো বাউলঘরানার মানবতাবাদ হলেও লালনের (১৭৭২-১৮৯০) সমসাময়িক হিসেবে তার বাউল ঘরানার দর্শনচিন্তা কিছুটা স্বতন্ত্র। তিনি সমন্বয়বাদী সর্ব্বধর্মে ‘জয় দয়াময়’ নামে মানুষ ভজনে আহ্বান করে গিয়েছেন।

আরবি বাউলিয়া, সংস্কৃত ব্যাকুল বা বাতুল, ফারসি রাতুল, অপভ্রংশ বাউর শব্দ থেকে বাউল শব্দের উৎপত্তি। এর অর্থ খ্যাপাটে, পাগল বা ভাবুক যা সর্বদা আত্মমগ্ন। জগৎ এবং জগতের বাইরে সীমার মাঝে অসীম ও নিজকে জানার অভিপ্রায়ে খোদা, মাওলা বা মুরশিদ লাভ তাদের মৌল ব্যঞ্জনা। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় গ্রন্থ, বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে পঠন-পাঠনে সমাজে এক বিশেষ শ্রেণিগোষ্ঠী যারা প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে অগ্রাহ্য করে আলাদা স্রষ্টা সাধনায় মগ্ন থাকেন তথা বাউলের অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট জানা যায়। যাদের কথাবার্তা সর্ব্বধর্ম সমন্বয়বাদ, পোশাক-আশাক, আচার-আচরণে সংগত কারণেই আলাদা। সমাজে বসবাস করলেও এরা সমাজ মানেন না। অস্বীকার করেন প্রোথিত সমাজ ব্যবস্থাকে। গুরুবাদী আখড়ায় সাধনসঙ্গিনী নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিনির্ভর জীবন-জীবিকায় তারা গান বাঁধেন ‘দয়া কর পারের মালিক, আমায় পার করিও, এই যে আমার ভাঙা তরিতে তুমি নাটাই লাগাইও (বাউল গান)’। জাত-পাত, ধনী-গরিব, নর-নারী শ্রেণিনির্বিশেষে সর্বপ্রাণ ভালোবাসার মন্ত্রই হলো বাউল দর্শন। মানবতাবাদী, সাম্যবাদে বিশ্বাসী ও অহমিকা বর্জিত এই সাধক সম্প্রদায়ের উদ্ভব বাংলার সাংখ্য-যোগ-বৌদ্ধ সহজিয়া, সুফি ও বৈষ্ণব দর্শনের সমন্বয়ে লোকজ জীবন থেকে উৎসারিত। সকল প্রকার ভাবাবেগে কুসংস্কারমুক্ত ও কূপমণ্ডূকতার ঊর্ধ্বে বাউল দর্শন নিখাদ বস্তুবাদী ও ভাববাদী চিন্তার সমন্বয়নির্ভর।

জাত-পাত, ধনী-গরিব, নর-নারী শ্রেণিনির্বিশেষে সর্বপ্রাণ ভালোবাসার মন্ত্রই হলো বাউল দর্শন। মানবতাবাদী, সাম্যবাদে বিশ্বাসী ও অহমিকা বর্জিত এই সাধক সম্প্রদায়ের উদ্ভব বাংলার সাংখ্য-যোগ-বৌদ্ধ সহজিয়া, সুফি ও বৈষ্ণব দর্শনের সমন্বয়ে লোকজ জীবন থেকে উৎসারিত।

সম্প্রদায়গত বিভেদ তাদের স্পর্শ করে না। মানুষতত্ত্ব তাদের সাধনতত্ত্বের প্রধানতম লক্ষ্য। ঈশ্বর, শাস্ত্র, সামাজিক রীতিনীতি, রাষ্ট্রিক আইন, সীমাবদ্ধ কাঁটাতারের বেড়া, লোক-পারলৌকিক, জন্ম-মৃত্যু, মহাযাত্রার পরবর্তী জীবন উপভোগ তারা দৃঢ়চিত্তে অগ্রাহ্য করেন। আত্মিক এই পরিচয়সূত্র তুলে ধরেন রচিত গানের সুরে সুরে, যার মূলপরিচয় মানুষ ও ঈশ্বরকে একত্রে একক সত্তারূপে আরাধনার মাধ্যমে। মানুষের ভেতরে আবদ্ধ সত্তাকে খোঁজার মধ্য দিয়েই তারা সত্য ঈশ্বরের উপস্থিতি ভজন করেন। সুরের মূর্ছনায় প্রগাঢ়চিত্তে ‘আপন ঘরের খবর নে না (লালনগীতি)’ বলে আহ্বান করেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই (চণ্ডীদাস)’।

ভারতের বৈষ্ণব ও সুফি মতবাদকে সমন্বয় করে বাংলার লোকজ শেকড় থেকে উৎসারিত বাউলদের সম্পর্কে একজন প্রখ্যাত বাউল ও মধ্যযুগ গবেষকের মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি তার গবেষণা গ্রন্থে লিখেছেন:

বাউলরা সুফিবাদ ও বৈষ্ণব দ্বারা খুব প্রভাবিত। তারা রসপিপাসু মন ও সৌন্দর্যের বিস্ময়ভরা চোখে দুনিয়াকে অনুভব করেন। বৃষ্টির পর বিশ্বসংসার যেমন নতুন করে জেগে ওঠে, তেমনি প্রেম সাধকের হৃদয় সত্যজ্ঞানে পূর্ণ হয়ে জীবনের উপলব্ধিকে সহজ ও সার্থক করে। এতে প্রেমের পথই সুফিদের পথ। নীতিবিদ দার্শনিকদের নীরস তত্ত্বজ্ঞান ও দর্শন ব্যাখ্যার জটিলতায় ভরা পথকে তারা সযত্নে এড়িয়ে যান। গভীর নীরবতার মধ্যে নিমগ্ন হয়ে সুফিরা প্রেমের দীক্ষা নেন। আধ্যাত্মিক জীবনে এই নীরবতা একান্ত কাম্য। নীরবতার অতল গভীরে প্রেমের রস নিবিড়তর হতে থাকে। এবং তারই প্রান্তদেশে সুফি শুনতে পান প্রিয়তমের সান্নিধ্য। মৃত-তাপিত পৃথিবীর জন্য বৃষ্টি মধুর প্রাণ সঞ্চারিণী, তেমনি আল্লাহ, প্রেম সাধকচিত্তের ব্যাকুলতাকে দূর করে শান্তির প্রলেপ স্বরূপ-বর্ষা এখানে আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতীক। সুফিবাদের মূলকথা প্রেম আর মরমি সাধকদের হৃদয়ই তার নির্দিষ্ট পথ। বিরহের দহনে আশিকের আনন্দ। মিলনে নয়। শান্তিও তার কাম্য নয়। শান্তি মানেই তো মৃত্যু। মৃত্যু মানে জীবনের শেষ। যতক্ষণ বিরহের জ্বলন ততক্ষণই তো জীবন। সাধকের প্রধান সাধন। প্রত্যাশা ও প্রতীক্ষাকে অন্তহীন করে ধরে রাখে। এতেই আনন্দ। পরম প্রাপ্তি। সাধকের সাধনা যুগে যুগে এভাবেই উচ্চারিত হয়ে চিরায়ত হয়েছে।

বস্তুত পারস্যে জন্ম সুফিবাদ বাংলায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার জল, আবহাওয়া, সংস্কৃতি ও লোকায়ত উদারচিন্তার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। তারা জগৎকে দেখেন সাধকের সাধনভূমিরূপে। প্রেম-রস আস্বাধনই তাদের আধ্যাত্মিক সাধনার মর্মবস্তু। জটিল তত্ত্ব ও সংবিধিবদ্ধ প্রার্থনায় সুফিরা খোদা লাভের বিপথগামী পথ মনে করেন। যে খোদা তার প্রেমের অপার মহিমা ও প্রেমের নিদর্শন হিসেবে দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন, তাকে অর্থাৎ তার দিদার লাভ একমাত্র প্রেমেই সম্ভব। তিনি বৈষম্যবাদী নন। খোদা সাম্যবাদী। তিনি যদি মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায়, সিনাগগে থাকেন তাহলে তিনি গোত্র-গোষ্ঠী সমর্থক; এক কথায় তিনি সাম্প্রদায়িক আর যিনি সাম্প্রদায়িক তিনি সব মানবের জন্য সমান হতে পারেন না। বরং মানুষের ভেতরে মানুষ; আত্মা দিয়ে খোদা নিজেই বিলীন হয়ে আছেন। লুকিয়ে আছেন সর্ব মানুষের ভেতরে। সুফিরা আরও মনে করেন, দেহের বিনাশ হলে আত্মার ধ্বংস হয় না, আর আত্মা মানেই ঈশ্বর। ঈশ্বর মানেই প্রেম। তাই বিরহ-বেদনাময় এই জীবনে খোদার প্রেমে আশিক না হলে মাশুকরূপে তাকে পাওয়াও অসম্ভব। মাশুক লাভেই পরম আনন্দ। বাংলার বৈষ্ণব দর্শন নিয়ে একজন ভারতীয় গবেষকের মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন:

গৌড়ীয় বৈষ্ণব বঙ্গদেশের প্রাণস্বরূপ। এই সর্বজনীন পরম-ধর্ম্মের পুণ্যপ্রবাহে বাংলাদেশের সংস্কৃতির সকল দিক যেভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছে, তার তুলনা জগতের ইতিহাসে স্বল্প। রসস্বরূপ পরব্রহ্ম অসমোর্দ্ধ-চমৎকারিত্বময় আস্বাদ্য বস্তু এবং অসাম্যাতিশয় রস-আস্বাদক ও রসিকেন্দ্র-শিরোমণিও। তিনি আস্বাদন করেন-স্বীয় স্বরূপানন্দ এবং স্বরূপ শক্ত্যানন্দ। ব্রহ্ম তিনি লীলাময়। সৃষ্টিও তাহার এক লীলা; কিন্তু তা হচ্ছে বহিরঙ্গ মায়ার যোগে তার বহিরঙ্গা লীলা। তার অন্তরঙ্গা লীলাও আছে। লীলার জন্য প্রয়োজন-লীলার স্থান বা ধাম এবং লীলা-পরিকর। আর সেই জন্য তার সৃষ্টি। তার স্বরূপ-শক্তিই লীলা-পরিকররূপে অনাদিকাল হতে বিরাজিত এবং সেই স্বরূপ-শক্তিই, অর্থাৎ সন্ধিনী-প্রধানা স্বরূপ-শক্তিই, তার ধামরূপে অনাদিকাল হতে বিরাজিত। তার অনাদিসিদ্ধ পরিকরগণ জীব নহেন, তারা স্বরূপ-শক্তির মূর্ত্ত বিগ্রহ। তার ধামও অপ্রাকৃত, চিন্ময়, নিত্য। বহিরঙ্গা মায়া তাহার ধামকে বা ধামস্থিত কোনো বস্তুকেও স্পর্শ পর্য্যন্ত করতে পারে না। ভগবদ্ধামে মায়িক কিছু নাই। প্রাকৃত ব্রহ্মাণ্ডে যে সমস্ত বস্তু দৃষ্ট হয়, ভগবদ্ধামেও প্রায় তৎসমস্তই আছে; কিন্তু তৎসমস্ত অপ্রাকৃত, চিন্ময়; তারাও লীলার আনুকূল্য করে থাকে। পরমব্রহ্ম এক এবং অদ্বিতীয় হয়েও অনাদিকাল হতে অনন্তরূপে আত্মপ্রকট করে বিরাজিত।

অর্থাৎ বৈষ্ণব দর্শনেও প্রেমের নিবেদনে পরম ব্রহ্ম লাভের বাসনা তীব্রস্বরে উচ্চারিত হয়েছে। ব্রহ্ম মানবের মাঝে জীবাত্মা ও পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন। প্রেমের জন্যই ঈশ্বর জীবাত্মা সৃষ্টি করে লীলা করেন। এই লীলায় তিনি আনন্দসুধা পান। সুতরাং ব্রহ্মকে পাওয়ার জন্য প্রেমই একমাত্র জিনিস। আর তা জীবে প্রেম। জীবের মধ্যেই ব্রহ্ম লুকিয়ে আছেন। প্রেমসান্দ মননে জীবাত্মার দর্শনে পরমাত্মার মিলন; আর তাতেই সমস্ত সৃষ্টির রহস্য ভেদ করে পরম ব্রহ্মের সান্নিধ্য লাভ সম্ভব। বৈষ্ণবদের ব্রহ্ম লাভ আর সুফিদের মাওলা বা খোদা; এই দুই তত্ত্বেই পরমসত্তাকে প্রেমের মাধ্যমে আরাধনায় বিশ্বাসী। তবে উৎপত্তিগত অঞ্চল ও নাম ভজনে বৈসাদৃশ্য হলেও আত্মগত সুরে পরমসত্তা তাদের উভয় সম্প্রদায়ের কাছে এক ও অভিন্ন। এই অভিন্ন সুরই পরে বাউল দর্শন-সাধনতত্ত্বের দার্শনিক কাঠামো সংগঠনে প্রয়োজনীয় উপাদান জুগিয়েছে। মূলত এ দুটি দর্শনের প্রভাবে বাংলার লোকজ ভাব মিশ্রিত হয়ে আলাদা পরিসরে এ দার্শনিক কাঠামো সৃজনে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতবর্ষে সহজিয়া বৈষ্ণব ও পারস্যে সুফিরা উৎপত্তিগতভাবে সংসারবিরাগী, কিন্তু সাধনে সাধনসঙ্গিনী আব্যশকতায় বিশ্বাসী। পূর্ববর্তী সমস্ত ধর্মজ্ঞ ও ধর্মজ চেতনায় যেখানে নর-নারীর মধ্যকায় সামাজিক বিবাহ রীতিনীতি রাখার পক্ষপাতী; সেখানে তারা এর ঘোর বিরোধী। বরং চুক্তি আবদ্ধ প্রথা থেকে বের হয়ে মানসিক মিল-মহব্বতকে নর-নারীর ইচ্ছাগত দেহ সম্ভোগ সৌন্দর্য তাদের প্রাধান্য। বৈষ্ণবরা সাধনসঙ্গিনী নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি জীবিকা নির্বাহে পরমাত্মা ও জীবাত্মায় প্রেমময় ঈশ্বর সন্ধান, সুফিদের খোদাদর্শন– এই দুই মিলিয়ে বাউলদের মানুষের মধ্যে পরমার দিদার লাভ ভিন্ন আঙ্গিকে একক ভজনের সুর নিঃসৃত। নারীকে দেখেন ঈশ্বরের বিমূর্তরূপ হিসেবে। যাকে সাধন করে মূর্ত ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের বাসনা করেন। তারা এ নিয়ে সংগীতে বলেন: ‘নারী হইল আদি বস্তু সৃষ্টি যারে দিয়া, ভেদাভেদ করে যারা তারা করে বিয়া।’ যা বাউল দর্শনেও মৌল কাঠামোরূপে বিস্তৃত। মূলত ‘মধ্যযুগের অন্যান্য সাধক সম্প্রদায়ের মতো বাউল সম্প্রদায়ও প্রত্যক্ষ সমাজ সম্পর্কের বাইরে, অনেক ক্ষেত্রে তার নির্দিষ্ট কোনো শাখা-প্রশাখা না থাকলেও অঞ্চলভেদে বাউলরা মতবাদ প্রচারে ব্যক্তিভেদে বর্ধিত করেছেন। সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত বাউলরা সামন্তীয় সমাজকে অস্বীকার করেন; অবজ্ঞা করেন প্রচলিত সমাজ ও বিশ্বব্যবস্থাকে। অবশ্য এই প্রত্যাখ্যান করার পশ্চাতে তাদের রয়েছে মানুষের দীর্ঘকালের শ্রেণিকাঠামোয় আবর্তিত গভীর দুঃখবোধ, সামাজিক ভেদবিচারে নির্মম উৎপীড়ন।’

নারীকে দেখেন ঈশ্বরের বিমূর্তরূপ হিসেবে। যাকে সাধন করে মূর্ত ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভের বাসনা করেন। তারা এ নিয়ে সংগীতে বলেন: ‘নারী হইল আদি বস্তু সৃষ্টি যারে দিয়া, ভেদাভেদ করে যারা তারা করে বিয়া।’ যা বাউল দর্শনেও মৌল কাঠামোরূপে বিস্তৃত।

বাউলরা সহজিয়া বৈষষ্ণ ও সুফিদের মতো গুরু বা মুরশিদে প্রবলভাবে বিশ্বাসী। এই তিন ধারার দর্শনপাঠে গুরুকে মান্য করা হয় দয়ালদর্শন পাওয়ার জন্য বিবর্ণ পথের উদ্‌ভ্রান্ত পথ থেকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দিকনির্দেশক হিসেবে। গুরু যিনি তিনি আদেশ দেন, নাম জপতে গোপন নির্দেশনা দেন; যার সাধন পদ্ধতিবাদীই বাউল। মানুষের দেহ তাদের কাছে বিশ্বব্রহ্মা– প্রতীকস্বরূপ, ঈশ্বরের প্রতীকী ব্যঞ্জনা। গুরু বা মুরশিদ, মানুষ ভজন, দয়ালের দর্শন–এই তিন তাদের আরাধ্য। বিশ্বাস করেন যে, মনের মানুষ তথা ঈশ্বর প্রত্যেকের নিজের ভেতরে অবস্থান করে; যাকে মুরশিদের সান্নিধ্যে তার নির্দিষ্ট নির্দেশনায় লাভ করা সম্ভব। সে জন্য বাউলরা বলেন: ‘ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার’, আর এতেই মানবজীবন সার্থক।

হিন্দুত্ববাদের জন্মজন্মান্তর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সহজিয়া বৌদ্ধ, তারপর বৈষ্ণব ও সুফিরা যে অমোঘ বাণীর কথা বলে গেছেন তারই সমন্বয়রূপে বাউলরাও আরও বিস্তৃত পরিসরে বলেন: ‘মেদিনীর ভূ-তে সৃষ্টি তাতেই বিলীন– এই মহানন্দ। তাই ‘এমনও সাধের জনম আর পাবো না, বারে বারে আর ফিরে আসা হবে না’; ‘আর কি হবে মানব জীবন, মন যাহা চায় তাহাই কর এই ভবে’ (বাউল গান)। এই ভবের সমস্ত ক্রিয়া তারা সাধনা করেন মানুষের দেহকে নিয়ে। এই স্থুল মানব দেহকে এত অমূল্য সম্পদ হিসেবে বাউলরা ছাড়া আর কেউ মূল্যায়ন করেনি। পূর্ববর্তী সব ধর্মে দেহ বিলীনের পর পরকালের সুখ আস্বাদন উন্মুক্ত। কিন্তু বাউলদের দেহ সাধনাই প্রেম সাধনার নিমিত্তে পরমাত্মার দর্শন। বাউল গানের মধ্যেই এই তত্ত্বসার নিঃসৃত। বহু বাউল গানে এই কথার উল্লেখসহ, বিভিন্ন আভাস ও ইঙ্গিতের সুরে বাউলরা আরও বলেন:

বলব কিসের প্রেমের কথা

           কাম হইল প্রেমের লতা

কাম ছাড়া প্রেম যথা তথা

           নাইরে আগমন

কাম ছাড়া প্রেম পায় না গতি

           তাই ভাবে লালন।

অর্থাৎ মানবদেহই সব তত্ত্ব ও সত্যের ভিত্তি। দেহ সকল সুখ, জ্ঞান ও কর্মের উৎস। মক্কা-মদিনা, গয়া-কাশী, কৈলাস-বৃন্দাবন, জেরুজালেম, পরমাত্মা, জীবাত্মা, লীক-অলীক, পরমসত্তা, দয়াল, খোদা, ঈশ্বর, আল্লাহ মানবের অধিষ্ঠান। তাই তারা বলে ‘নিজেকে জানো’। নিজের ভেতরে, সসীমের মধ্যেই, অসীমের সন্ধান পাওয়া যায়। নিজের আত্মার অস্তিত্বেই খোদার দিদার লাভ হয়। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলও খ্রিস্টপূর্বে know yourself কথা বলেছিলেন। দার্শনিক জিসি দেবও বিশ শতকে এই আত্মাকে জানার নিমিত্তে বস্তুবাদ ও ভাববাদকে একত্রিত করে সমন্বয়বাদ দর্শনের প্রচার করেছেন জীবনব্যাপী। তার আগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাণপুরুষ দার্শনিক রবীন্দ্রনাথও একই সুরে বলেছিলেন: ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি/ বাজাও আপন সুর/ আমার মাঝে তোমার প্রকাশ/তাই এত মধুর।’ বাউলরা এই রূপের আরাধ্যে আনন্দ লাভের বাসনায় দেহের অবস্থানের নামকরণ করেছে জ্যান্তমরা। সুফিরা নাম অঙ্কন করেছেন ফানাফিল্লাহ, বৈষ্ণবরা বলেন মুই-সই মুই-সই। এদের সবার মধ্যে নামকরণে পার্থক্য থাকলেও অবস্থানগত সুর এক ও অভিন্ন। লালন তার গানে আরও বলেছেন: ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি/কমনে আসে যায়/তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি/ দিতাম পাখির পায়। পাখি কমনে আসে যায়।’ এই আসা-যাওয়া অচিন পাখিই সৃষ্টির মধ্যে পরমসত্তার সত্তা। এই সত্তা তথা সৃষ্টি বিনা স্রষ্টাও স্রেফ শূন্য। মূল্যহীন। বাউল গানে আরও বলে: ‘এই মানুষে আছে রে মন/যাদের বল মানুষ রতন/ আপন ঘর না বুঝে বাহির খুঁজ /পড়বি ধাঁধায়।’

অর্থাৎ সমাজে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-সাধু-সন্ত নির্বিশেষে সকল মানুষ হলো একক পরমসত্তার সৃষ্টি; এই জনমত তথা সর্ব্বধর্ম সমন্বয়বাদ জনমত প্রতিষ্ঠা করাই বাউল দর্শনের মূল বক্তব্য। স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি বড়। বিধানের চেয়ে মানুষ বড়। সৃষ্টি না থাকলে স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে। দুদ্দু শাহ, ফকির মজনু শাহ, ভবানী পাঠক, পাগলা কানাই, মঞ্জু শাহ, লালন শাহ, হাসন রাজা, শাহ আবদুল করিম প্রমুখ বাউল বাংলার বিভিন্ন জনপদে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন অঞ্চলে এই বাউল দর্শন অনুসরণ করে ‘মানুষ সকল কিছুর ঊর্ধ্বে’ এই ভাবনাই গেয়ে গেছেন তাদের রচিত গানে গানে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে, লালনের সমসাময়িক বাউল ও মরমি কবি মহর্ষি মনোমোহন দত্ত বাংলার পূর্ববঙ্গে এই মানুষ ভজনেরই সাধনা করে গিয়েছেন। যিনি উনিশ শতকে বৈষ্ণব, সুফি, হিন্দু, মুসলিম, মাইজভান্ডারি, মাজার-ফকিরি, লোকজ আধাত্ম্য ভাব নিয়ে রচনা করেছেন বাউল ঘরানার গান। যা তার নিজস্ব, স্বতন্ত্র আঙ্গিককে সুরে-লয়ে সৃজনে সৃষ্ট মলয়া সংগীত। সমাজে বহুতত্ত্বে বিশ্বাসী ধর্মজ ভাবনাকে একক সুরে তিনি প্রচার করেছেন তার সমন্বয়বাদী সর্ব্বধর্ম। এই দর্শনের মূলতত্ত্ব বাউল দর্শনেরই বিস্তৃত পরিশাখা। তিনি বাংলার পূর্বাংশে পূর্ববর্তী সমস্ত লোকজ, আগত ধর্মজ চেতনাকে নিয়ে প্রচার করেন সমন্বয়বাদী ধর্ম দর্শন। একক সত্তাকে আরাধনায় সৃজন করেন সুর, নামকরণ করেছিলেন মলয়া সংগীতে। মুসলমানের আল্লাহ, হিন্দুর ভগবান, বৌদ্ধদের গৌতম, খ্রিস্টানের যিশু, সুফিবাদের দয়াল এই সব নাম বৈষম্যকে অবলুপ্ত করে ভক্তি, শ্রদ্ধা, সুর-গান ও জীব-জড় প্রেমময় ভজনে নাম জপেছেন জয় দয়াময়। তিনি ধর্ম বিভেদ ঘোচাতে সর্বভাবনাকে সমন্বয় করে জয় দয়াময় জপতত্ত্ব প্রচার করে গিয়েছেন। যা সর্ব্বধর্ম নামকরণে সর্বমানবের জন্য ‘আনন্দ আশ্রম’ নামক উপাসনালয় সৃষ্টির মধ্যে জয় দয়াময় ভজন করেছেন। তার এবং তার অনুসৃত সর্ব্বধর্ম দর্শনে বিশ্বাসী ভক্তরা মানুষ ভজনের মধ্যেই জয় দয়াময়কে বিমূর্ত থেকে মূর্তরূপে সাধনা করেন। আর তাতে তিনি মানুষের জীবনকে চার ভাগে: প্রবদ্ধ, সাধক, সিদ্ধাসিদ্ধ ও সিদ্ধ পর্যায়ে বিভক্ত করেন। এই অনুযোগে তার অনুসারীরা সর্ব্বধর্ম সাধনা করেন সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে একমাত্র মানুষ পরিচয়ে পরিচিত করে তুলতে। তবে সবটাই মানবের ইহজাগতিক মুক্তির পরিলক্ষ্যে।

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে, লালনের সমসাময়িক বাউল ও মরমি কবি মহর্ষি মনোমোহন দত্ত বাংলার পূর্ববঙ্গে এই মানুষ ভজনেরই সাধনা করে গিয়েছেন। যিনি উনিশ শতকে বৈষ্ণব, সুফি, হিন্দু, মুসলিম, মাইজভান্ডারি, মাজার-ফকিরি, লোকজ আধাত্ম্য ভাব নিয়ে রচনা করেছেন বাউল ঘরানার গান।

মনোমোহন দত্ত স্বতন্ত্র ধর্মসাধনা ও মানবতাবাদ

জগতে সবাই সুখ চান। সুখের জন্যই সবার এত কর্মের প্রয়াস। প্রয়াসের ফলে চিত্তবিনোদক একটা বস্তু অনেক সময় পাওয়া যায়; তাকেই সুখ মনে করে মানুষ সংসারী জীবন আস্বাদন করেন। সুখ চাই বলে সুখ-বিরোধী দুঃখ কেউ চাই না; দুঃখ-লাভের জন্য কেউ কোনোরূপ চেষ্টাও করেন না; বরং দুঃখ যাতে না আসতে পারে, তার জন্য চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুঃখ এসে পড়ে এবং এসে পড়ে বলে তা ভোগ করতে হয়; কিন্তু তা ভোগ করা হয় অনিচ্ছার সহিত, দুঃখ যেন বলপূর্বকই নিজেকে ভোগ করে নেয়। দুঃখের হাত থেকে অব্যাহতি এবং নিরস সুখ লাভ সবার কাম্য। কিন্তু কীরূপে তা সম্ভব হতে পারে! মনীষীরা তা নির্ধারণের নিমিত্ত চিন্তা করেছেন হাজার হাজার বছর ধরে। এই চিন্তার ফলেই দর্শন-শাস্ত্রের উদ্ভব। ভারতবর্ষে ভিন্ন ভিন্ন মনীষী ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিন্তা করেছেন। তাদের মধ্যেই পূর্ব বাংলার একজন মনীষী মহর্ষি মনোমোহন দত্ত। যিনি সমস্ত ধর্ম ও ধর্মজ উপাদানগুলো নিয়ে আঠারো শতকে প্রচার করেছেন সমন্বয়বাদী ধর্ম। যার মূল চেতনার পরিসরই ছিল সাম্য ও মানুষে মানুষে মিলন।

নৃবিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানমতে, ‘ধর্ম ব্যক্তির নিজস্ব সাধনা।’ এর গঠন-পাঠন, উদ্ভব ও বিকাশ প্রথমেই ঘটে ব্যক্তি মানুষের ক্ষুধার্ত মননে। ত্রুটি কিংবা বিচ্যুতির প্রশ্নও জাগে মানুষের মধ্যেই। সব মিলিয়ে প্রচার ও প্রকাশের জন্য ব্যক্তি সমাজের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছান। পূর্বেকার ধর্মজ চেতনা ও ব্যক্তির মননে আবির্ভূত নতুন ধর্মীয় প্রণালি তার টিকে থাকার মূল্যে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়ায়। উদ্ভব হয় নতুন ভাবের। প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সমাজের স্থিত সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে এটা তার আদিম প্রবৃত্তির সহজাত জাগ্রত গুণ। ভাব থেকে ভাবনা, আর ভাবকারীকে ভাবুক এই মিলিয়ে ভাবের রাজ্যে গতিময়তা সবসময় মানুষকে একটা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করে। আঠারো শতকে বাংলার বাউলরা এই অন্ত্যজ ভাবনা থেকেই সহজিয়া বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, প্রচলিত সনাতন, ইসলাম, সুফিধর্ম মতকে একত্র করে ফকিরি লাইনে মানুষের স্থূল দেহকে প্রাধান্য দিয়ে লোকজ সংস্কৃতিতে এ মানবতাবাদী বাউল দর্শনের দিকটি প্রবর্তন করেন। অবশ্য বাংলার পাল ও গুপ্ত শাসনামল কাল থেকে লোকজ সংস্কৃতিতে সুপ্রাচীন থেকেই আলাদা একটা প্রাকৃত সমন্বয়বাদী ভাবের স্থিতি ছিল। ‘ইসলামের প্রভাবে প্রভাবান্বিত কিছু লোক বাংলার কোথাও কোথাও সেই প্রাকৃত ধর্মের ভাব ও সাধন সুরের সংস্কৃতির ধারা অক্ষুণ্ন ছিল’ যা বৈষ্ণব, বাউল ও সুফিরা মিলে সেই ভাবের একক খোদার কথা বললেও কোনোরকম নামকরণ করেননি। শুধু দেহতত্ত্ব ও মানুষ ভজনে ‘মনের মানুষ’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু মহর্ষি মনোমোহন দত্ত এই একই ধারার বিশুদ্ধ বাউল সাধনা করলেও সর্বপ্রথম তিনি এ ধারায় ‘মনের মানুষকে’ জয় দয়াময় নামে শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে আত্মাকে সর্ব্বধর্মী ঈশ্বর হিসেবে মূর্তরূপে প্রবর্তন করেন। যা তার সমসাময়িক অন্য বাউলদের থেকে কিছুটা হলেও স্বতন্ত্র ও ব্যতিক্রম। তবে আমিত্ব বলে সর্ব্বধর্মের মনোমোহনের এই দর্শনের লোকজ্ঞান ভারতীয় চার্বাকপন্থি ঘরানার। প্রসঙ্গ হিসেবে একজন ভারতীয় খ্যাতনামা চার্বাক গবেষকের মূল্যবান মন্তব্য নিম্নরূপ:

‘আমি, আমি বা জীবাত্মা’ বলিয়া দেহাতিরিক্ত কোনো পদার্থ নাই। পরলোক বলিয়াও কিছু নাই, পুনর্জন্ম বলিয়াও কিছু নাই। দেহ ভস্মীভূত হইলেই ‘আমার’ সব শেষ। ‘ভস্মীভূতস্য দেহস্থ্য পুনরাগমনং কুতঃ।’ এই দেহই যখন ‘আমি’, তখন দেহ ভস্মীভূত হইয়া গেলে ‘আমিও’ ভস্মীভূত হয়ে গেলাম। ইহার পরে ‘আমি’ আর কোথা হতে কিরূপে আসবো? সুতরাং যত দিন বেঁচে থাকা যায়, যথেচ্ছভাবে ততদিন সুখভোগ করার চেষ্টা করাই সঙ্গত, তাতেই জীবনের সার্থকতা। ‘খাও, পিও, মজা কর’ তাই চার্বাক-নীতি। ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।’ যত দিন বেঁচে থাক, সুখে থাক। সুখ-ভোগের জন্য দেহের শক্তির প্রয়োজন; দেহের শক্তি রক্ষার এবং বৃদ্ধির জন্য ঘৃত পান কর। অর্থ না থাকে, ঋণ করিয়াও ঘৃত সংগ্রহ কর। ঋণ শোধ করতে না পার, ভয় কিসের? পরকাল বলে তো কিছু নাই; মৃত্যুর পরে তোমারও অস্তিত্ব থাকবে না। তখন কে কখন কোথায় তোমার নিকটে ঋণের টাকা চাইবে?’– ইহাই চার্বাক-নীতি; চার্বাক মতে-অঙ্গনা-সঙ্গাদি জনিত সুখই পুরুষার্থ; এই দেহে যে দুঃখাদির অনুভব হয়, তাহাই নরক। রাজাই পরমেশ্বর, তদ্ব্যতীত অন্য কোনো পরমেশ্বর নাই। এই ভোগায়তন স্কুল দেহের নাশই মুক্তি। প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। যাহা প্রত্যক্ষীভূত হয় না, তাহার অস্তিত্ব নাই। পরলোক, পুনর্জন্ম-প্রভৃতি প্রত্যক্ষের বিষয় নহে বলিয়া তাহাদের অস্তিত্বও স্বীকার্য্য নহে। ক্ষিতি (পৃথিবী), অপ (জল), তেজঃ ও বায়ু এই চারিটাই তত্ত্ব; কেননা, এই চারিটা প্রত্যক্ষের বিষয়। আকাশ (ব্যোম) প্রত্যক্ষের বিষয় নহে বলিয়া তত্ত্ব নহে।১০

অর্থাৎ প্রাচীন ভারতে চার্বাক বা লোকায়ত দার্শনিকরা বিশ্বদর্শনসিদ্ধ মনস্কে অনুধ্যান করতে পেরেছিলেন বলেই তারা জাগতিক ধর্মগুলো থেকে নিজেরা আলাদা স্বতন্ত্রভাবে জীবনে জীবের ইচ্ছা ও জৈবিক আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যক্তির সামাজিক চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে জোরালো সমর্থন করেছেন। পৃথিবীর প্রচলিত ধর্মগুলো তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলেও সব ধর্মে একটা সামঞ্জস্য আদান-প্রদানে আমদানি-রপ্তানির বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। গীতা বা সংহিতায় ধর্মের যা ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তাতে স্পষ্ট যে, মানুষের বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার বিষয়ে ধর্ম তার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ‘ধর্ম’ কথাটির সঙ্গে ঈশ্বরতত্ত্ব ও ঈশ্বর সাধনার বিষয়টিকে যুক্ত করে কালে কালে তৈরি হয়েছে হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, কনফুসিয়াস, ইহুদি, পারসিক, ইসলাম ধর্ম প্রভৃতি। মানুষের সঙ্গে অন্যান্য জীবের ধর্ম বিষয়ে পার্থক্য আছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের ধর্মীয় ব্যাপ্তি বা আধ্যাত্মিক মার্গের উদারতা যে প্রভাবিত করতে পারে তাবৎ জীবকুলকেও স্বামী বিবেকানন্দের ভাবনাতেই মেলে তার সন্ধান– ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’।

তবে নৃবিজ্ঞান আলোচনায় মানুষের উৎপত্তি ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জগতের সব ধর্মমতের মধ্যে প্রাচীনতম হলো সনাতন বা হিন্দুধর্ম। হিন্দুধর্মের প্রধান শাস্ত্র হলো বেদ। এ ছাড়া প্রস্থান ত্রয় অর্থাৎ উপনিষদ, শ্রীভগবতগীতা ও বেদান্ত দর্শন হিন্দুধর্মে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হয়। আত্মা ও ব্রহ্মের অভেদতত্ত্ব এবং সৎ-চিৎ-আনন্দের উপলব্ধি হিন্দুধর্মের পরম উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। তীর্থযাত্রা, উপবাস, মূর্তিপূজা ইত্যাদি হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য। বেদান্তে জ্ঞানযোগ (বিচারাত্মক), ভক্তিযোগ (ভাবাত্মক) ও কর্মযোগের (শ্রমাত্মক) কথা বলা হয়। তবে ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরোপলব্ধির উৎকৃষ্ট উপায় হিসেবে রাজযোগকে হিন্দুধর্মে প্রাধান্য দেওয়া হয়। চতুরাশ্রম, চতুবর্ণ হিন্দুধর্মের সামাজিক ভিত্তিস্বরূপ। হিন্দু, জরুথ্রষ্টীয় ও ইহুদি এই তিন ধর্মই প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতে বর্তমান রয়েছে। ইহুদি ধর্ম তৎপ্রসূত খ্রিস্টধর্মকে আত্মসাৎ করা তো দূরের কথা, তা থেকে একসময় নিজেই বিদায় নিয়েছে। ফারসি জাতি এখনো জরুথ্রষ্টীয় ধর্মের সাক্ষীস্বরূপ রয়েছে। অন্যদিকে শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী ভারতবর্ষ জুড়ে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রভাব পড়েছে জাতিতে-জাতিতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে। হিন্দুধর্মের সর্বোৎকৃষ্ট বেদান্ত জ্ঞান থেকে বৌদ্ধতন্ত্রের অজ্ঞেয়বাদ, জৈন ধর্মাশ্রিত নিরীশ্বরবাদ ইত্যাদি সব বিষয়ই হিন্দুধর্মের সম্পদ বলে অনেকে মনে করেন।

তবে ভারতবর্ষে উৎপত্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মগুলো উভয়ই কর্মবাদ এবং আত্মার দেহান্তরবাদ থেকে কোনোটা কোনো অংশেই বিচ্ছিন্ন নয়। ত্রিরত্নে খচিত বৌদ্ধধর্ম। বৌদ্ধধর্মের মূল কথা হলো বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘ। যে বৈদিক এবং উপনিষদ ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভাব ও দর্শনে বৌদ্ধধর্ম একসময় ফলবান হয়েছিল, তা একান্তভাবেই আর্য ধর্মাশ্রিত ও আর্য সাধনারই ফল। গৌতম বুদ্ধের চতুরঙ্গ সত্য ও জন্মান্তরবাদ আর্যঋষিদের বেদান্তবাদেরই উত্তর ফলশ্রুতি বলা যেতে পারে। বৌদ্ধ সাধনায় জীবনের চরম পরিণতিকে বলা হয়েছে নির্বাণ। এই নির্বাণ নেতিবাচক নয়, তা অনির্বচনীয় আনন্দ প্রাপ্তির অপর নাম। বুদ্ধদেব স্বয়ং ছিলেন নিবৃত্তিমার্গী-অজ্ঞেয়বাদী। বেদাশ্রিত হিন্দুধর্মের সঙ্গে তার অনেক ক্ষেত্রে বিরোধ ছিল। বেদের বাহ্য কর্মবাদের পরিবর্তে তিনি স্থান দিয়েছিলেন কর্মবাদের। বৌদ্ধের এই অজ্ঞেয় প্রবণতা বাংলার লোকজ ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

অন্যত্র দূরপ্রাচ্যে তাওবাদ এবং কনফুসিয়াস মতবাদ হলো চীনা দর্শন ও চৈনিক ধর্মের দুটি ধারা। এর প্রথমটির প্রবক্তা হলেন লাও-জু, চ্যাং-জু প্রমুখ মহান ব্যক্তি এবং দ্বিতীয়টির প্রবর্তন করেন স্বয়ং কনফুসিয়াস। কনফুসিয়াস তার ধর্মমতে জোর দিয়েছিলেন সামাজিক দায়বদ্ধতা ও পরোপকার নীতির ওপর, আর লাও-জু ভালোবাসতেন আত্মার প্রশান্তি ও স্বতঃস্ফূর্ততায় মানুষের উপকার করা নীতির ওপর। তাদের ঈশ্বরও ছিল একেবারে অজ্ঞেয়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো যাগযজ্ঞ এ ধর্মমতের কার্যাবলি ছিল না। কিন্তু খ্রিস্ট জন্মের সমসাময়িক কালে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রবেশ করে এবং তা কালের নিয়মে তাওবাদকে প্রভাবিত প্রসূত; স্থানীয় লোকজ ভাবনা সমন্বয় করে চৈনিক সংস্কৃতির আদলে বৌদ্ধধর্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তী সময়ে জাপানে প্রবর্তিত শিন্টো ধর্ম বা শিন তাও ধর্মকেও প্রভাবিত করেছে বৌদ্ধধর্ম ও তাওবাদ যেখানে ‘কামি নো মিচি’ অর্থে দেবতার পথ-কে বোঝানো হতো মানুষের কল্যাণ সাধনের অর্থে। তেমনি ইহুদি (মোজেস প্রবর্তিত) ও খ্রিস্টধর্ম (যিশু প্রবর্তিত), ইসলাম ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী প্যালেস্টাইন, ইসরায়েলেও ঠিক একই পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছে। বাংলায় বাউল, সুফিরা এই সমন্বয় পদ্ধতি অনুসরণ করেই ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, নবী, পয়গম্বর, দেব, দেবী, কৃষ্ণ, কালী, গৌতম বৌদ্ধ, বিষ্ণুকে তারা আলাদা করে অনুধ্যান করেন না। এরা প্রত্যেকেই একই নুরে বিচিত্র ছবি। অর্থাৎ ‘জন্মান্তর কাল অবধি আমরা কিছু ধ্রুব সত্য মুখস্থ করতে শিখেছি, আর তা সারা জীবন আবৃত্তি করি। মনে করি এসব প্রথা ও চর্চিত পুরোনো মাত্রই সত্য ও শুদ্ধ। নতুনমাত্র মিথ্যা ও অশুদ্ধ।’১১ বাংলার বাউল সম্প্রদায় এসব চিরন্তন ও ধ্রুব সত্য মানতে নারাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন: ‘ভারতবর্ষ দুই ভাগে বিভক্ত হিন্দু আর মুসলমান। ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল, আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যেদিকে দ্বার খোলা অন্য পক্ষের সেদিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে?’১২

মরমি কবি মনোমোহন দত্ত এই অমিলকে মিলবন্ধনের ধাঁচে ফেলতে চেয়েছেন। তিনি তার পদ্যে ও মলয়া সংগীতের সুরে বলেন:

যার মন উদাসী হয়েছে             পাগলারে!

হিন্দু মুসলমান কে হয়              চিনিনা তারে।

বুঝতে নারি ছোট বড়              চিন্তে নারি আপন পর, এক তারে

ব্রহ্ম বাঁধিয়া রাখছে,                দেখি বাগদি হাড়ি, চাঁড়াল, মুচী কোনটা শুচি হয় অশুচি

দেখি সকল ভোজের বাজী          রাজী নয় সে ভেদ বিচারে, মালাকার

ব্যাপ্ত বিশ্ব চরাচরে                  যা দেখি সব একের খেলা এক বিনা আর নাই সংসারে

মনোমোহনের মন বাবাজী           ভাঙ্গা তরী, বেহুস মাঝি,

লোচ্চার লোচ্চা, পাজির পাজি,       কেবল বকাবকি করে।১৩

উদ্ধৃত বিশ্লেষণে বলতে পারি: মনোমোহন দত্ত তার সমসাময়িক বাউল, মরমি কবি লালন ফকিরের মতোই মানুষের পরিচয়সূত্রে ধর্মীয় ট্যাগকে অকাট্য চিত্তে অগ্রাহ্য করেন। মানুষের কোনো জাতপাত হয় না। মানুষের একটাই পরিচয়–সে প্রকৃতির আর আট-দশটা প্রাণের মতো একটা প্রাণী; সবশেষে মানুষ। প্রচলিত এসব জাতপাত সব মানুষের শ্রম শোষণকারী সুবিধাবাদী জনগোষ্ঠীর তৈরি। তিনি অন্যত্র আরও লিখেছেন: ‘দূরে ও নিকটে, অন্তরে ও বাহিরে, সাকার ও নিরাকার, আলো ও অন্ধকার এই দ্বৈত সাম্য হইলেই যোগ বা শান্তি আসবে।’১৪ অর্থাৎ মনোমোহন দত্তের এই একক সমন্বয় ধর্মজ চেতনা বাংলার আবহমান কাল ধরে চলে আসা উদারবাদী লোকজ চেতনা থেকেই নিঃসৃত।

আবহমান বাংলার এই লোকজ ধর্মজ চেতনার অন্তঃসারের মর্মকোষখানি অষ্টাদশ শতকে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাখও (১৮০৪-১৮৭২) জার্মানির লোকজ চেতনাকে তার ধর্মীয় তত্ত্ব বিশ্লেষণে তুলে ধরে তার গ্রন্থে লিখেছিলেন:

আমাদের বলেন ধর্ম কী। ধর্ম হলো মানুষের নিজের থেকে নিজের বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটি মাধ্যম। অন্যভাবে, মানুষ যা নয়, তা-ই মূলত ঈশ্বর। মানুষ পাপী। কিন্তু ঈশ্বর পবিত্র। মানুষ জন্ম-মৃত্যুর ছকে বন্দি। ঈশ্বর অমর। মানুষ ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও কামের কাছে নত। ঈশ্বর সকল প্রয়োজন ও বিলাসের ঊর্ধ্বে। মানুষ দুঃখভারাক্রান্ত ও জরাগ্রস্ত। ঈশ্বর চির-আনন্দিত ও সদা-তরুণ, মানুষ নিষ্ঠুর, প্রতারক ও স্বার্থলোভী। ঈশ্বর দয়াবান, সৎ ও নিবেদিত। মানুষের ক্ষমতা প্রকৃতপক্ষে শূন্য। ঈশ্বর এবসুলেট বা পরম। ঈশ্বরের সক্ষমতা অসীম অব্দি ব্যাপ্ত।১৫

উদ্ধৃত আলোচ্য এ বস্তুবাদী দার্শনিক ফয়েরবাখ জার্মানিতে বসে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভাববাদী চেতনাকে যেভাবে বিশ্লেষণ করে গিয়েছেন ঠিক সমসাময়িক বাংলার বাউল দার্শনিক মনোমোহন দত্তও (১৮৭৭-১৯০৯) একই রূপে ঈশ্বর ব্যাখ্যায় ও সান্নিধ্য লাভের জন্য আরাধনা করেছেন। অর্থাৎ মানুষ যেহেতু ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষরূপে ধরতে পারে না, ফলে তার কল্পিত জগতে নিরাকার ঈশ্বরের মূর্ত ছবি অঙ্কন করে ভাবনার জগৎকে প্রসারিত করে। তাহলে মানুষ ঈশ্বরের এমন সত্তা কল্পনা কেন করেন? কারণ, মানুষ ঈশ্বরের এই পরম কনসেপ্টের কাছাকাছি যেতে চায়। মানুষের ধারণা এই পরম সত্তা লাভ করতে পারলেই কথিত সব যন্ত্রণা, অক্ষমতা, অশান্তি থেকে মুক্তি মিলবে; মানুষের এই ধারণা কখনো মিথ্যে প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ পায় না। কারণ, মানুষের পক্ষে কখনোই সেই কল্পিত ঈশ্বর সত্তায় উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। ফলে মানুষ তা নিজে নিজের ওপর আরোপ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। ঈশ্বরের সব গুণাবলি অর্জন করতে পারলে আসলেই দুঃখকে জয় করা সম্ভব কি না! মানুষের ঈশ্বর না হয়ে উঠতে পারার এই আজন্ম ব্যর্থতাই মূলত মানুষের ভেতর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসকে চিরন্তন করে। মানুষ মনে করে: আমি তো ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারি নাই। তাই মানুষ অক্ষম হওয়ার পরও তার বিপরীতে ঈশ্বর সুপিরিয়র বা পরম হতে চায়; এই চাওয়া-পাওয়ার মধ্যেই বাউল, সুফিরা মানুষের মধ্যে অসীমকে পাওয়ার জন্য মানুষ ভজন করেন; যা প্রত্যক্ষ ঈশ্বর ভজনের নামান্তর। মনোমোহন দত্ত আরও বলেন:

এমন একদিন আসিতেছে, যেদিন সাম্যের তত্ত্ব প্রত্যেক সমাজে উপলব্ধি হইবে। প্রাকৃতিক বৈষম্যের স্তর ছাড়িয়া, যেখানে সামাজিক বৈষম্য ইতরবিশেষ অবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছে সেইখানেই সংকোচন ও প্রসারণ শক্তি বলে অভাবের অত্যান্তিকতা আবির্ভূত হইয়া পাপের বৃদ্ধি ও সংগ্রামের সৃষ্টি এবং মানবীয় বৃত্তির সংকোচন ও সমাজের হীনতা আনয়ন করে। জগতের সর্বসাধারণ মানুষ। বিশেষ বিশেষ ধর্ম নেতার নামে দোহাই দিয়া কয়েকটা নীতি অবলম্বন বাহ্যভাবে সমাজ গড়িয়া চলিয়াছে ইহারা পদাতিক সৈন্য।১৬

মনোমোহন তার এই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মলয়া সংগীতে আরও লেখেন:

                                    মানুষের প্রতি নাই প্রীতি ভাব যার

                                    ঈশ্বরের প্রতি প্রেম কিছু নাই তার।

                                    আপনি খুঁজিলে আপনা পাইবে

                                    শাস্ত্র খুঁজে খুঁজে, হইওনা কানা

                                    হৃদয়েতে আছে ভাব স্বীয় ভাবে

                                    আপনা স্বরূপ যাইবেক জানা।১৭

উদ্ধৃত অংশে তিনি বলতে চাচ্ছেন: জীবের মাঝেই ঈশ্বর। শাস্ত্র, কিতাব, গ্রন্থে কোনো ঈশ্বর নেই। শাস্ত্র, বেদবিধি সব মানুষের সৃষ্ট। আপনার মাঝে ঈশ্বর না খুঁজে শাস্ত্রে ঈশ্বর খোঁজা নিতান্ত নিরর্থক। সন্ধানকারীদের তিনি বলেন কানা-বধির। যারা শুনেও শোনে না, বুঝেও বুঝতে চায় না। আত্মার শাসন করতে পারে না, সেই মানুষ আবার মানুষ শাসন করতে যায়। বরং আপনার ভেতরে সন্ধান করলেই মানবের মাঝে মাওলাকে পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ ‘চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিব, ত্বক–এই পঞ্চ-ইন্দ্রিয় যোগে ঈশ্বর মনুষ্যভাবে কার্য করেন। তার মধ্যে বিষয়, বৈরাগ্য, ধর্ম, কর্ম সকলেই বিরাজ করেন।’১৮ মনোমোহন তার রচনায় আরও বলেন:

স্বভাবই ধর্ম, যেমন অগ্নির ধর্মই স্বতঃই গরম, লৌহের ধর্ম কঠিন, বরফের ধর্ম শৈত্য, তেমনই মানবের যে যাহা করিতেছে তাহাই তাহার ধর্ম, ইহাই স্বতঃসিদ্ধ কথা, এ কখনও নষ্ট হইতে পারে না, অব্যাহত গতিতে জীবনের ওপর স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিয়া বেড়ায়–যেমন একজন চোর ধরা পড়িয়া কত যন্ত্রণা ভোগ করিয়াও পুনঃ তাহাই করিতে প্রবৃত্ত হয়, যদি ইহাই তাহার ধর্ম না হইবে তবে সে আবার কখনোই এ কাজে অগ্রসর হইত না। পাপ এবং পুণ্য বলিয়া যে দুইটি কথা আছে তাহাও এই স্বাভাবিক ধর্মের অভ্যন্তরেই বিরাজমান-যে ব্যক্তি অব্যাহত গতিতে আপনার স্বভাবকে স্বাধীন ইচ্ছার বশীভূত করিতে পারিয়াছেন তিনিই পুণ্যের ফল প্রচুর শান্তি, বিকার রহিতভাবে ভোগ করিতেছেন, আর যিনি স্বভাবের স্বাধীনতা রক্ষায় অপারগ তিনিই নানাবিধ পাপজনিত কষ্ট ভোগ করিতেছেন, ক্রমান্বয়ে শান্তি এবং অশান্তিই এ দুয়ের পরিণাম ফল। ইচ্ছার স্বাভাবিক স্বাধীনতা বড় গুরুতর সাধন সাপেক্ষ, যাহার মনের গতি প্রাণের ভাব স্বয়ং ভগবানের ইচ্ছার সহিত মিলিত হইয়াছে যিনিং সোহং এই বীজের প্রকৃত অবস্থা লাভ করিয়াছেন মাত্র, তিনিই এ জগতে স্বাধীনতা লাভ করিয়া প্রকৃত সুখের অধিকারী হয়েছেন।১৯

অর্থাৎ ভয়-লোভ, জাত-পাত-ধর্মের পার্থক্য মোচন করলেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারবে। নির্দিষ্ট জালে ফেলা সংবিধিবদ্ধ সমস্ত ধর্মীয় তত্ত্বই প্রতিটি ধর্মীয় বিশ্বাসপ্রবণ সম্প্রদায়ের নিকট মহৎ। বিশ্বাসীরা তাদের ধর্মকে একমাত্র অর্গানিক সত্য বলে বিশ্বাস করে। মানুষের শেষ পরিণতি হলো মৃত্যু। আর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মানুষের স্রষ্টার সঙ্গে পুনর্মিলন ঘটে। ব্রহ্ম সত্য, চিরন্তন, তিনি সর্বজনীন। তার দয়া, মায়া কোনো গোত্র, সম্প্রদায়ভেদে আলাদা হয় না। দয়া, প্রেম, মানবতাই হলো সেই মিলনের পথে পৌঁছাবার একমাত্র সহজ উপায়। পরের উপকারই ধর্ম, অপরকে এবং ঈশ্বরে ও নিজ আত্মার প্রতি বিশ্বাস, উদারবাদিতাই ধর্ম; পরপীড়ন, পরের ক্ষতি, অপরকে ঘৃণাই অধর্ম ও পাপ। মনোমোহন দত্তের মতে,

‘স্বর্গ ও নরক নামে কোনো নির্দিষ্ট স্থান নেই। মৃত্যুর পর নিজ কার্যানুসারে স্বর্গ বা নরক ভোগ করতে হবে, এরূপ ধারণাও অলীক; কেননা শরীরের সঙ্গেই শুভাশুভাদির উৎপত্তি এবং তার সঙ্গেই বিনাশ। শরীর ধ্বংস হলে শুভ আর অশুভ উভয়েই আধার নষ্ট হয়ে যায়।’২০

সর্বপ্রাণে সত্য ও নিরহংকার অনুভবে মনের ভাব উদয়ের ভেতর দিয়ে মানুষকে ভালোবাসা, মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের দিদার লাভ করা সম্ভব। আর তাতেই মানুষ হয়ে উঠবে প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ। অর্থাৎ জাত-পাত-ধর্মের পার্থক্য মোচন করলেই মানুষ প্রকৃতপক্ষে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে পারবে।

সাম্যবাদ ও মনোমোহন দত্ত

বাংলার লোকজ দর্শন থেকে উৎসারিত বাউল ও বাউল দর্শনের দেহ লীলাতত্ত্ব একাংশে রাখলে বাদবাকি বাহ্যিক ও আচার-আচরণিক সামাজিক অংশে বাংলার লোকজ সাম্যবাদের আভাস পাওয়া যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩) যেমন জার্মান দর্শন, ইংল্যান্ডের অর্থনীতি, ফরাসির সংস্কৃতি মিলিয়ে সাম্যবাদের ধারণা সৃজন করেছেন; তেমনি ঠিক সেই সময়ে ভারতবর্ষের বাউলরা এখানকার সুফি, বৈষ্ণব, ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ দর্শনের মানবতাবাদী নির্যাস নিয়ে সমন্বয় করে বাংলায় সাম্যবাদের বাণী গানের সুরে প্রচার করেছেন। মার্কসের মতোই এখানকার বাউলরা প্রচলিত ধর্ম, শ্রেণিবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতাকে আলোচনা-সমালোচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন। যেখানে মার্কস গঠন করেছেন রাজনৈতিক দল; বিপরীতে ভারতে বাউলরা উদ্ভব করেছেন আলাদা গোত্রের। তবে বাউলরা সামাজিক সাম্যের কথা বললেও মার্কসের মতো বৈশ্বিক ও অর্থনৈতিক সাম্য কাঠামোর কথা বলেননি; তবে তাদের রচিত সুরের মূর্ছনায় প্রগাঢ় চিত্তে একক বৈশ্বিক মানব সমাজ সৃজনেরই উদাত্ত আহ্বান শোনা যায়। লালন লিখেছিলেন: ‘এমন মানব সমাজ গো কবে সৃজন হবে, যেদিন হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান জাতি ভেদ নাহি রবে’ এ গানের সুর জাত-ধর্ম-বর্ণ-সাম্প্রদায়িকতা রোধ করে যা অসাম্প্রদায়িক একক বিশ্বমৈত্রী গঠনের নামান্তর।

প্রকৃতপক্ষে সমাজ কাঠামোতে প্রচলিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আবর্তিত ‘এসব বিশ্বাস ও রীতিনীতি সামাজিকভাবে স্রেফ হাওয়াই বেলুন ওড়ানোর মতো। এর প্রকৃত কোনো সামাজিক মূল্য নেই। এতে বরং দ্বন্দ্ব ও সংঘাত বাড়ে। মানবীয় সমস্যার সমাধান হয় না।’২১ সে জন্য বাউলরা ‘আচার-আচরণে সংযত, সহিষ্ণুতা, দৃঢ়চেতনা অর্জনে সমাজের উপকার ও বিকশিত মনুষ্যত্বসম্পন্ন ইহজাগতিক চিন্তাচেতনায় পরিশীলিত, লোভ ও অহমিকা মুক্ত হয়ে মানুষের কল্যাণ ও জাতপাত বাতিল করে সব মানুষকে শুধু মানুষরূপে ভাবে, যা তাদের সার্বিক এসমস্ত আচরণকে নিজেদের সংস্কৃতি ও বাহ্যিক ধর্ম সৌন্দর্যরূপে’২২ প্রচার করেন। মহর্ষি মনোমোহন দত্তের আনন্দ আশ্রমের একজন শিষ্য আনন্দস্বামী যিনি তার আশ্রমে সাধনা করতেন। তিনি তার গুরু মনোমোহনের মুখনিঃসৃত অনেক কথালাপ লিপিবদ্ধ করেছিলেন, যা মনোমোহন দত্তের সাম্যবাদী চিন্তাচেতনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন:

ভাব অভাব, সুখ দুঃখ, চাঞ্চল্য স্থিরতা, সহিষ্ণুতা অসহিষ্ণুতাদি সকলই ঈশ্বরের ইচ্ছাতে মনুষ্য মনে বিচরণ করিতেছে। মঙ্গলময়ের রাজ্যে লোকের এই প্রকার শোকের ভাব চিরকাল থাকিতে পারে না। এস্থলে ইহা অবশ্য স্বীকার্য্য যে, যে বস্তু কিংবা বিষয় অথবা ব্যক্তির দ্বারা দুঃখের কারণ উপস্থিত হইয়াছে সেই বস্তু কিংবা বিষয় অথবা ব্যক্তির দ্বারাই সেই দুঃখের নিবৃত্তি হইবে। কোনো প্রকারের খেদ মনে থাকিয়া গেলে মানুষের জীবন-মুক্তি হইতে পারে না। জগতের কোনো বিশ্বাসকেই অগ্রাহ্য করা যাইতে পারে না, কেননা তাহা সাময়িক ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়। কেহই সরল বিশ্বাস ভিন্ন, কৈতবযুক্ত হৃদয় লইয়া ধর্মের প্রচার করেন নাই এবং যাঁহারা সেই প্রচারানুযায়ী কার্য্য অবলম্বন করিয়াছেন তাহারাই এক এক সম্প্রদায় বদ্ধ হইয়াছেন। এই সাম্প্রদায়িকতা ধর্মের জীবনের শৈশবাবস্থা, তাহা হইতে মনের বিরাগ পৌঢ়াবস্থা, এবং তাহা সম্যকরূপে পরিত্যাগ সৎ এবং সিদ্ধাবস্থা।২৩

অর্থাৎ সমাজ জীবনে মানুষের পরিচয় অর্ধেক ব্যক্তিক ও বাকি অর্ধেক সামাজিক। ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই সমাজে কোনো মানুষের সামাজিক জীবন পরিচালিত হয়। ব্যক্তি ও সমাজ একে অপরের পরিপূরক। এই সামাজিক পরিপূরকে বাউলরাও সামাজিক সম্পত্তিতে বিশ্বাসী। ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে যা বোঝায় তাতে তারা সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাসী। তাদের সামাজিক বিশ্বাস বেঁচে থাকার নিমিত্তে অসত্য পরিত্যাগ ও জীবনবৃত্তিতে নারী-পুরুষের সমতায়। অন্যত্র মহর্ষি মনোমোহন দত্ত লেখেন:

তুমি কও দেখি মন

তুমি হিন্দু না মুসলমান

আল্লাহ না হরি

মনকে তুই করো ইনসান।২৪

অর্থাৎ এখানকার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, চোর-বাটপার, চোরাকারবারি, নিম্নবিত্ত, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ পূজা, নামাজ, ধর্মীয় আইন-শাসন মানুক আর না-মানুক; তাকে কথায় কথায় কেমন আছেন?– বললে, বলে আলহামদুলিল্লাহ, বলে ভগবানের দয়ায় ভালো আছি। তাদের এ ধরনের কথা বলাতে প্রকৃতপক্ষে আদৌ কোনো সাম্প্রদায়িকতার লেশ নেই। বরং এগুলো তাদের কর্মবাদের জীবনাভূতির পরিভাষা। আর ভাষারও কোনো ধর্ম নেই। সুতরাং এটাই এখানকার হাজার বছর ধরে চলে আসা অসাম্প্রদায়িক সমন্বয় চেতনার মূলদ কেন্দ্রবিন্দু। মনোমোহন এটা মেলাতে গিয়েই তার ভাবনায় আপাদমস্তকে মানুষের মর্যাদায় সাম্যবাদে বিশ্বাসী। মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। বরং সমাজের উৎপাদনের চালিকাশক্তি ও শ্রমের একক ভোগ যারা করে তারাই সমাজে শ্রেণিবৈষম্য তৈরি করে।

ঈশ্বর মানুষকে অর্থ ও বর্ণবৈষম্য গায়ে লিখে দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন না। বরং মানুষের জন্যই মানুষ দরিদ্র, জাতপাতে বিভক্ত হয়। নর-নারীতে তৈরি হয় কুৎসিত বিকৃত দ্বন্দ্ব। পুরুষ নিজেকে দৈহিক শক্তিশালী মনে করে নিপীড়ন করে নারীর ওপর। তাই ‘ধনবৈষম্য এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য দুটোই দূর করা চাই। কেউ শিকার আর কেউ শিকারি হবে–এমন সমাজে মনের, জীবনের মুক্তি ঘটবে না।’২৫ বাউল মহর্ষি মনোমোহন মলয়া সংগীতের সুরে সুরে এসবের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সচেতনভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন।

বাউলরা দুভাগে বিভক্ত: গৃহী বাউল ও গৃহবর্জিত বাউল। কিন্তু মনোমোহন দত্ত ছিলেন এই দুয়ের মিশ্রণ। সংসার, জৈবিক ধর্মকে তিনি অবজ্ঞা করেননি।

বাউলরা দুভাগে বিভক্ত: গৃহী বাউল ও গৃহবর্জিত বাউল। কিন্তু মনোমোহন দত্ত ছিলেন এই দুয়ের মিশ্রণ। সংসার, জৈবিক ধর্মকে তিনি অবজ্ঞা করেননি। বরং সংসারের মধ্যে জৈবিক ধর্মকে পালন করে তিনি এই বদ্ধমূল কাঠামো ভাঙতে চেয়েছেন। তার রচিত আত্মজৈবনিকমূলক গ্রন্থ লীলারহস্য ও মলয়া সংগীত এর মধ্যে এগুলো পাওয়া যায়। তিনি তার শিষ্য আফতাবউদ্দিন খাঁকেও এই দীক্ষা দিয়েছেন। তার সাংসারিক জৈবিক ধর্ম পালনের চিন্তাগত ছিল নর-নারীর একক স্ব-ইচ্ছার স্বাধীনতা। মানে প্রচলিত চুক্তিবদ্ধ বৈবাহিক সমাজ রীতিনীতিতে তার ছিল অনাস্থা। নারীকে তিনি পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে একক আত্মারূপে দেখেছেন। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে কোনোরকম নর-নারীর বৈষম্য তিনি মানেননি। পুরুষ যদি দেহ হয়, নারী তার আত্মা। লোকজ কবি, মরমি সাধক মনোমোহন দত্তের সমসাময়িক (১৮৭৭-১৯০৯) দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন:

মানুষের সৃষ্টিতে নারী পুরাতনী। নরসমাজে নারীশক্তিকে বলা যেতে পারে আদ্যাশক্তি। এই সেই শক্তি যা জীবলোকে প্রাণকে বহন করে, প্রাণকে পোষণ করে। প্রাণসাধনার সেই আদিম বেদনা প্রকৃতি দিয়েছেন নারীর রক্তে, নারীর হৃদয়ে। জীবপালনের সমস্ত প্রবৃত্তিজাল প্রবল করে জড়িত করেছেন নারীর দেহমনের তন্তুতে তত্ত্বতে। এই প্রবৃত্তি স্বভাবতই চিত্তবৃত্তির চেয়ে হৃদয়বৃত্তিতেই স্থান পেয়েছে গভীর ও প্রশস্তভাবে। এই সেই প্রবৃত্তি নারীর মধ্যে যা বন্ধনজাল গাঁথছে নিজেকে ও অন্যকে ধরে রাখবার জন্য– প্রেমে, স্নেহে, ধৈর্যে। মানবসংসারকে গড়ে তোলবার, বেঁধে রাখবার এই আদিম বাঁধুনি। প্রকৃতির সমস্ত সৃষ্টি প্রক্রিয়া গভীর গোপন, তার স্বতঃপ্রবর্তনা দ্বিধাবিহীন। গৃহে নারী যেমনি প্রবেশ করেছে কোথা থেকে অবতীর্ণ হলো গৃহিণী, শিশু যেমনি কোলে এলো মা তখনই প্রস্তুত। পুরুষের রচিত সভ্যতার আদিকাল থেকে এ রকম ভাঙাগড়া চলছে। ইতোমধ্যে, নারীর মধ্যে প্রেয়সী, নারীর মধ্যে জননী প্রকৃতির দৌত্যে স্থিরপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আপন কাজ করে চলেছে। এবং প্রবল আবেগের সংঘর্ষে আপন সংসারের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে অগ্নিকাণ্ড করেও আসছে। সেই প্রলয়াবেগ যেন বিশ্বপ্রকৃতির প্রলয়লীলারই মতো, ঝড়ের মতো, দাবদাহের মতো-আকস্মিক, আত্মঘাতী। নব-নব সভ্যতার ওলটপালটের ভেতর দিয়ে নারীর জীবনের মূল ধারা চলেছে এক প্রশস্ত পথে। প্রকৃতি তাকে যে হৃদয়সম্পদ দিয়েছেন নিত্যকৌতূহলপ্রবণ বুদ্ধির হাতে তাকে নূতন নূতন অধ্যবসায়ে পরখ করতে দেওয়া হয়নি। নারী আসলেই পুরাতনী।২৬

অর্থাৎ প্রাবন্ধিক বলতে চেয়েছেন: নারীই সমাজ সভ্যতার আদি শক্তি। বারবার সমাজ পরিবর্তন হলেও নারীর কোনো মুক্তি হয়নি। যেদিন নারী গৃহে প্রবেশ করল সেদিন থেকে নারী হয়ে উঠল বিভিন্নরূপে সেবাদাসী। পুরুষ নিত্যনতুন ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলেও নারী তা পারেনি। নারীকে আবদ্ধ রেখেই পুরুষ জারি করেছে নিত্য-নতুন আইন, প্রথা। অথচ সমাজের বৃহৎ একটা অংশ তথা নারীকে একবার জিজ্ঞেসা করারও প্রয়োজন মনে করেনি সে এগুলো চায় কি না। ‘কোনো অজ্ঞাত কারণবশত মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানা বিষয়ে উন্নতি করতে লাগল, অপর অংশ (নারী) তার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নত করতে পারল না বলে নারী পুরুষের সহচর না হয়ে’২৭ গৃহপালিত পশুর মতো সম্পত্তিতে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে পড়ল। একমাত্র ‘মৃত্যু কর্তৃক বিচ্ছেদ না ঘটলে সমাজ থেকে নারীর প্রতি নিদারুণ এই শোষণ কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না’২৮ এই ব্যবচ্ছেদ না হওয়ার কারণ ‘এর প্রতিষ্ঠা ও স্থিতির সঙ্গে যোগ আছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকার রাখার প্রশ্ন।’২৯ শুধু পুরুষের আনন্দ ও সন্তান-সন্তানাদির জন্য বীর্যারোহণ বস্তু হিসেবে নারী পরিগণিত হয়েছে এবং অদ্যাবধি হয়ে যাচ্ছে। আদিসাম্যবাদ পরবর্তী সামন্ত যুগে যেমন নারীর মুক্তি ঘটেনি, তেমনি আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজেও নারীর অবস্থান একই রকম। মনোমোহন দত্ত নারীকে সমাজের অর্ধেক দেহ, প্রেমময়ী প্রেয়সী হিসেবে পুরুষের সহচররূপে দেখেন। তিনি তার মলয়া গানে অন্যত্র বলেন:

কল্পনা সহচরী              দিব্য বেশভূষা ধরি

কাব্য অলংকারসহ          নাচেরে হাসিয়া

তুলেরে প্রীতির গান        বাজেরে প্রেমের তান

সংসারে শোকতাপ         অনুতাপ, মনঃস্তাপ

দুশ্চিন্তা শৈবাল আদি        যায়রে ভাসিয়া।৩০

অর্থাৎ তিনি নারীকে সাম্যবাদী সমাজের নারীরূপে প্রেরণা করেন। এই আরাধনায় সবটা শুভ ও কল্যাণ অর্থে। এবং ‘সমাজই মূলত তার সামন্তীয় মূল্যবোধ ও বৈষম্যমূলক আচরণ, রীতিনীতির কলাপে মানুষকে নারী-পুরুষরূপে গড়ে তুলে জেন্ডার সামাজিকীকণের নিরিখে শুভ-অশুভ কল্যাণ নিহিত করার অভিলক্ষ্যে। তাতে করে সামাজিকভাবে নারী হয়ে পড়ে ঘরকুনো। বিচ্ছিন্ন হয় সমাজ থেকে, পরিবার থেকে; একইসঙ্গে পুরুষের সহযাত্রী হতে।’৩১ কিন্তু মরমি কবি মনোমোহন মনে করেন: ‘পৃথিবীতে শুভ যা কিছু আছে তার মূল আধ্যাত্মিক প্রেমযোগ, তাই ঈশ্বরের ইচ্ছাতে স্ত্রী ও পুরুষদিগের হৃদয়ে জানিত ও অজানিতভাবে বিচরণ করছে। নারীকে বাদ দিয়ে চৈতন্য, অচৈতন্য সাধন এবং সমাজের কণ্টকময় অবস্থা’৩২ থেকে উত্তরণ সম্ভব না। তাই নারী-পুরুষের জীবনে মুক্তি লাভ করতে হলে নারীকে পাশে রেখেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। তাতেই মানুষ লাভ করবে পরমানন্দ ও শান্তি। সমাজ থেকে সমস্ত কলুষতা মুছে যাবে; পৃথিবী হবে সর্ব-প্রাণের। হবে মানুষের।

মনির হোসেন: শিক্ষক ও গবেষক, ইংরেজি বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যবসা ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বিইউবিটি)

ই-মেইল: monirhossainhossain2021@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১. মোবারক করীম জওহর: ভারতের সুফি, প্রথম খণ্ড, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৬৪, পৃ. ৭-১৪

২. যতীন্দ্রবিমল চৌধুরী: গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শন, প্রাচ্যবাণী মন্দির, কলকাতা, ১৯৫৭, পৃ. ১৩০-১৩২

৩. সুজিত কুমার মণ্ডল: বাউল দর্শন : কর্ম ও অনুভব, দর্শন বিভাগ, বোলপুর কলেজ, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ২৭-২৮

৪. অরবিন্দ পোদ্দার: মানবধর্ম ও বাংলা কাব্য মধ্যযুগ, দে’জ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ১৮৪

৫. বিশ্বভারতী গ্রন্থবিতান (সম্পা.): রবীন্দ্র রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড, শান্তিনিকেতন, কলকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৮০

৬. উপেন্দ্র ভট্টাচার্য: বাংলার বাউল ও বাউল গান, মডার্ন বুক এজেন্সি, কলকাতা, ১৯৬৭, পৃ. ৮৩

৭. আবদুল ওয়াহাব: বাঙলার বাউল, সুফি সাধনা ও সংগীত, ঘোষ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১৩৬

৮. প্রগতি প্রকাশন (অনূ.): সমাজতন্ত্র ও ধর্ম, মস্কো, ১৯৮৩, পৃ. ৩

৯. নীহাররঞ্জন রায়: বাঙালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৮৮, পৃ. ১৭৫-১৭৬

১০. যতীন্দ্রবিমল চৌধুরী: গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শন, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪

১১. হুমায়ুন আজাদ: সীমাবদ্ধতার সূত্র, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ. ২১

১২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: কালান্তর, পুনর্মুদ্রণ, আজকাল প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০২, পৃ. ১৩৭-১৩৯

১৩. মনোমোহন দত্ত: মলয়া, ২য় খণ্ড, পুনর্মুদ্রণ, জয় প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ৪২

১৪. মনোমোহন দত্ত: খনি, দ্বিতীয় কল্প, আনন্দ আশ্রম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৯৯৩, পৃ. ১৯

১৫. Ludwig Feuerbach: The Essence of Christianity, Germany, 1854, page. 22-27 

১৬. মনোমোহন দত্ত: খনি, দ্বিতীয় কল্প, পূর্বোক্ত, পৃ. ১২-১৮

১৭. মনোমোহন দত্ত: পাথেয়, পুনর্মুদ্রণ, আনন্দ আশ্রম, সাতমোড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৯৭৭, পৃ. ১৮-২৮

১৮. রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস: প্রকৃত তত্ত্ব, সর্ব্বধর্ম মিশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৮৩৩, পৃ. ৩৫

১৯. মনোমোহন দত্ত: তপোবন, পুনর্মুদ্রণ, আনন্দ আশ্রম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০০৬, পৃ. ৭০

২০. রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস: পূর্বোক্ত, পৃ. ৪

২১. আবুল ফজল: সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন, বইঘর, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃ. ৩২৯-৩৩৪

২২. মোতাহের হোসেন চৌধুরী: সংস্কৃতি কথা, নওরোজ কিতাবিস্তান, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৯-১২

২৩. রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস: পূর্বোক্ত, পৃ. ৬-৮

২৪. মনোমোহন দত্ত: মলয়া, ২য় খণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫০

২৫. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পিতার হুকুম, প্রথমা প্রকাশন, ২০০৭, ঢাকা, পৃ. ২৩

২৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: কালান্তর, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৫৭-১৫৮

২৭. আবদুল কাদির (সম্পা.): রোকেয়া রচনাবলী, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৭৭, পৃ. ২৪

২৮. অতুল সুর: ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়, সাহিত্যোলোক, কলকাতা, ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৯৮

২৯. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩

৩০. মনোমোহন দত্ত: তপোবন, পুনর্মুদ্রণ, আনন্দ আশ্রম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ২০০৭, পৃ. ৪৪

৩১. নমিতা খান (সম্পা.): নারী ও সমাজ, সংবাদপত্রের পৃষ্ঠা থেকে, সূচীপত্র, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৭১

৩২. রঞ্জিত কুমার বিশ্বাস: পূর্বোক্ত, পৃ. ৫৪

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •