কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে গণপ্রতিরোধ: ঘটনাপ্রবাহ এবং কারণ অনুসন্ধান

বিশেষ লেখা

সালমান সিদ্দিকী

আজি কারার সারাদেহে মুক্তিক্রন্দন

ধ্বনিছে হা হাস্বরে ছিঁড়িতে বন্ধন
—নজরুল

কোটা সংস্কারের আন্দোলন এখন আর শুধু নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ নেই। বন্দী মানুষ মুক্তির আশায় রাস্তায় নেমে পড়েছে। কে নেই এই মিছিলে? ছাত্র, অভিভাবক, শিক্ষক, কারখানার শ্রমিক, হোটেল বয়, রিকশা চালক সবাই আজ রাস্তায়। ছাত্ররা জানে তারা ভালো নেই। ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীনদের কাছে প্রতিদিনকার পরাজিত জীবন! পড়াশোনা শেষ করলেও চাকরি নেই,ভবিষ্যত নেই। মানুষ জানে, তারা দু’ মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া।  ভোটাধিকার তো আগেই হরণ করা হয়েছে। কথা বলার অধিকার নেই। বিরোধী দল-মতকে দমন করা হচ্ছে। চলছে গুম-খুন, নির্যাতন। সরকার উন্নয়নের বাণী প্রচার করছে কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে উন্নতির বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। মানুষ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, শাসক আওয়ামীলীগ দেশটাকে লুটপাট আর জুলুমের রাজত্বে পরিণত করেছে। মানুষ মুক্তি পিয়াসায় ছটফট করছে! এই প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিষয়টি বোঝার চেষ্টায় এই লেখায় এই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরে এই আন্দোলনের ঐতিহাসিক গণ আন্দোলনে পরিণত হবার কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে।

কোটা সংস্কারের আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ :
 আজ থেকে ৬ বছর আগে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। পুলিশ-ছাত্রলীগের হামলা-নির্যাতন মোকাবেলা করে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলনের এক পর্যায়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিলের ঘোষণা দেন। ঐ বছরের অক্টোবর মাসে সরকার কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

সম্প্রতি এ বছরের ৫ জুন বুধবার হাইকোর্ট কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেয়। অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের ( ৯ম-১৩ তম গ্রেড) পরিপত্র অবৈধ বলে ঘোষণা করে। এরই প্রেক্ষাপটে আবারও সারা দেশ আন্দোলনে ফেটে পড়ে। ৬ জুন বৃহস্পতিবার: আদালতের রায়ের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচীতে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী অংশ নেয়। ৯ জুন রোববার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবারও কোটাব্যবস্থা পুনর্বহালের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে। শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি মানতে ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বেধে দেয়। এই সময়ের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে সর্বাত্মক আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ঢাকায় বিক্ষোভ শেষে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দল অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর স্মারকলিপি দিতে যায়। একই দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও  কর্মসূচি পালন করে। এদিন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করে।

১ জুলাই সোমবার : ৩০ জুনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নেওয়ায় শিক্ষার্থীরা আবারও আন্দোলনে নামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশ থেকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে দাবি মেনে নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি  আহ্বান জানানো হয়। এ দিন আন্দোলনের প্লাটফর্ম   ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র পক্ষ থেকে ৩ দিনের কর্মসূচী ঘোষিত হয়।

২ জুলাই মঙ্গলবার: আন্দোলনকারীরা বেলা পৌনে ৩ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হয়। এখান থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলটি কলাভবনের পাশের হলগুলো প্রদক্ষিন করে নীলক্ষেত, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও বাটা সিগনাল হয়ে শাহবাগে অবস্থান নেয়। শাহবাগ মোড় আন্দোলনকারীরা অবরোধ করে রাখে। এদিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা- আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।

৩ জুলাই বুধবার: এদিন আন্দোলনকারীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে। সারাদেশের আরও ৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ দিন বিক্ষোভ করে এবং সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে রাখে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পুরান ঢাকার তাঁতী বাজার মোড় অবরোধ করে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা- আরিচা মহাসড়ক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়ক এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে।

৪ জুলাই বৃহস্পতিবার: এদিনও শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৭ কলেজ এবং ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করে রাখে। এ দিন সমাবেশ থেকে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়।

৫ জুলাই শুক্রবার: ছুটির দিনেও সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে।

৬ জুলাই শনিবার: আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ এবং অবরোধ অব্যাহত থাকে। এদিন দাবি না মানা পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষা বর্জন এবং সারাদেশের সড়ক-মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই কর্মসূচীর নাম দেয়া হয়বাংলা ব্লকেড

৭ জুলাই রবিবার: রাজধানী ঢাকা ‘বাংলা ব্লকেড’ এ অচল হয়ে যায়।  সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, জেলা শহরে এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বামপন্থী ৭ টি ছাত্র সংগঠনের জোট ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট’ প্রেস কনফারেন্স থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সম্পূর্ণ বাতিলের দাবি জানায়। নারী,আদিবাসী, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবন্ধি নাগরিকদের জন্য কোটা রাখা প্রয়োজন বলে মত দেয়।

৮ জুলাই রবিবার: ঢাকার শাহবাগ, সায়েন্সল্যাব, কারওয়ান বাজার, জিরোপয়েন্ট, মহাখালীসহ ঢাকার অন্তত ১১ টি  স্থানে ‘বাংলা ব্লকেড’ অর্থাৎ অর্থাৎ অবরোধ কর্মসূচী পালিত হয়। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম  ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ৬৫ জনের একটি সমন্বয়ক টিম ঘোষণা করে। এ দিন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যূনতম কোটা রেখে অবিলম্বে সংসদে আইন পাস করা হোক। এই সমস্যার সমাধান আদলতে হবে না। এটা করার দায়িত্ব নির্বাহী বিভাগের।”

৯ জুলাই সোমবার: হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষার্থী আবেদন করেন। পরের দিনও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচীর ঘোষণা দেওয়া হয়।

১০ জুলাই, বুধবার: সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়কে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা (status quo) ঘোষণা করে। আগামি ৭ আগস্ট পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারিত হয়। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এদিন বলেন, “ আমি প্রথম দিনই বলেছিলাম রাস্তায় স্লোগান দিয়ে রায় পরিবর্তন হয় না।”

১১ জুলাই বৃহস্পতিবার: আন্দোলনকারীরা বাধার মুখেই এ দিন বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ কর্মসূচী পালন করে। এদিন বিকেলে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে আন্দোলনকারী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়। এদিন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করছে। এটি সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত ও সম্পূর্ণ বেআইনি।” সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, “শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস করে যাচ্ছে।”

১২ জুলাই শুক্রবার: ছুটির দিনেও আন্দোলনকারীদের অবরোধ কর্মসূচী চলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শাহবাগ অবরোধ করে রাখে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রেলপথ অবরোধ করে রাখে। এ দিন রাতে শাহবাগ থানায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে  ‘পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা এবং মারধর’র অভিযোগে মামলা দায়ের হয়। এতে আসামি করা হয় ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ শিক্ষার্থীদের।

১৩ জুলাই শনিবার: এদিন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এবং জেলাগুলোতে দিনভর জনসংযোগ কর্মসূচী পালিত হয়। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ পরদিন ঢাকায় গণপদযাত্রা এবং রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচী ঘোষণা করে। জেলাগুলোতে গণপদযাত্রা এবং জেলাপ্রশাসকের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। দাবি না মানা পর্যন্ত ক্লাস- পরীক্ষা বর্জন এবং আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

১৪ জুলাই রবিবার: সকাল ১০ টা থেকেই আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণগ্রন্থাগারের সামনে জমায়েত হতে থাকে। মিছিল ক্যাম্পাস প্রদক্ষিন করে শাহবাগ, মৎস্যভবন, সচিবালয় হয়ে জিরো পয়েন্টে গেলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেয়। এখানেই বিক্ষোভ চলতে থাকে। প্রায় আধ ঘন্টা পর আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনের দিকে যেতে থাকে। গুলিস্তান শহীদ মতিউর রহমান পার্কের সামনে পুলিশ পুনরায় ব্যারিকেড দেয়। এখানে আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী গান গাইতে থাকে। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ১২ জনের একটি প্রতিনিধি দল রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। স্মারকলিপি গ্রহন করেন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব। আন্দোলনকারীরা আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংসদ অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের দাবি জানান।

এ দিন গণভবনের এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি ’ বলে কটুক্তি করেন। এ বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে এ দিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যে জমায়েত হতে থাকে। প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের বাধা উপেক্ষা করে মেয়েদের হল থেকে রাতের বেলা হাজারো মেয়ে এ বিক্ষোভে অংশ নেয়। এ যেন বাঁধ ভাঙা জোয়ার, একে রোখে সাধ্য কার!
 আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিতে থাকে
তুমি কে আমি কেরাজাকার রাজাকার
কে বলেছে, কে বলেছেস্বৈরাচার স্বৈরাচার
আন্দোলনকারীরা আরও স্লোগান দিতে থাকে –
‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’

১৫ জুলাই, সোমবার : আন্দোলনকারীরা বেলা ১২ টায় রাজু ভাস্কর্যে জমা হতে থাকে। এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে, বুয়েট, মেডিকেল, নার্সিং কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়। ইডেন কলেজ থেকে মিছিল নিয়ে বের হওয়ার সময় মিছিলে ছাত্রলীগ হামলা চালায়। এতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি শাহিনুর সুমী, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া আক্তার, অর্থ সম্পাদক সানজিদা হক, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের অর্থ সম্পাদক আনাতোলিয়ান স্কাইয়া সহ ৮-১০ জন আহত হয়। সারা শহরের মিছিলগুলো ক্রমেই রাজু ভাস্কর্যে সমবেত হতে থাকে। এ দিন রাজু ভাস্কর্য চত্বর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দিতে থাকে, লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারো বাপের না।

ছাত্রলীগ ৩ টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ দেয়। ঢাকা মহানগর এবং সারাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিয়ে আসা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মধুর ক্যান্টিন এবং মুহসিন হলের মাঠে অবস্থান নেয়। তারা ইট- পাটকেল, লাঠিসোটা, রড, রামদা – চাপাতি এবং আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছিলো।

বেলা ২:৩০ টায় আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে ভিসি চত্বরে গেলে সেখানে ওত পেতে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করে। বিজয় একাত্তর হল, সূর্যসেন হল, মল চত্বর এবং ভিসি চত্বর যেন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আন্দোলনকারীরা ছিল নিরস্ত্র এবং অপ্রস্তুত। এই সুযোগ ছাত্রলীগ নেয়। ছাত্রলীগের হামলায় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এর পর শুরু হয় ছাত্রলীগের বর্বরোচিত আক্রমণ। যাকেই পেয়েছে নির্মমভাবে পিটিয়েছে। ৫-৭ জন মিলে একজনকে পিটিয়েছে। নারী শিক্ষার্থীরাও এদের বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বাসে ৩০-৪০ জন নারী শিক্ষার্থী আত্মরক্ষার জন্য উঠে পড়ে। তাদেরকে টেনে -হিচড়ে নামায়, পেটাতে থাকে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়। এতে অন্তত ৪০০ জন আন্দোলনকারী এবং সাংবাদিক আহত হয়। একের পর এক আহতরক্তাক্ত দেহ ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে ঢুকছিলো। কারও মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। কারও হাত, কারও পা ভেঙে গেছে। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। আহতদের চিৎকার। সাথে থাকা সঙ্গী-সাথীদের সেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা। ডাক্তার-নার্সদের হিমশিম অবস্থা। সময় যত গড়াচ্ছে, আহত দেহের সংখ্যা তত বাড়ছে। ইমারজেন্সি রুমে আর জায়গা নেই। এর মধ্যেই শোনা গেলো বাইরে ছাত্রলীগ হামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশঙ্কা বাস্তব হলো। ছাত্রলীগ ইমার্জেন্সিতে লাঠিসোটা নিয়ে একটু পরপর মোট দফা হামলা চালায়। আহতদের ওপর এবং তাদের সাথে যারা ছিলো তাদের ওপরও হামলা করে। হাসপাতালে ঢুকে হামলা। এ বর্বরতার শেষ কোথায়?
এ দিন ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আন্দোলনকারীদের শেষ দেখে ছাড়বেন বলে জানান। আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “এর জবাব দেওয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত।”

১৬ জুলাই, মঙ্গলবার : এ দিন ছাত্রলীগ-যুবলীগ এবং সরকার সমর্থকরা দিনভর আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। চট্টগ্রামে ৩ জনকে হত্যা করা হয়।
এদিন পুলিশ সরাসরি গুলি করে হত্যা করে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদকে। এতে সারাদেশে অন্তত জন হত্যার শিকার হয়।

ঢাকায় আন্দোলনকারীরা বিকাল ৩ টায় শহীদ মিনারে সমবেত হয়। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি। প্রত্যেকের চোখে-মুখে প্রতিরোধের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। সমাবেশ, স্লোগান চলতে থাকে। সন্ধ্যায় একটি মিছিল দোয়েল চত্বর, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি প্রদক্ষিণ করে ভিসি চত্বরে গিয়ে শেষ হয়। ছাত্রলীগ ৩ টায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করে। ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, আন্দোলনকারীদের বুঝিয়ে দেয়া হবে কত ধানে, কত চাল!

এদিন রাত থেকেই আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে। ইডেন কলেজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাত্রলীগ মুক্ত হয়। গভীর রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ বহিরাগত সন্ত্রাসী এবং পুলিশসহ যৌথভাবে হামলা করে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা একতাবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে।

১৭ জুলাই, বুধবার : নিহতদের স্মরণে সারাদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ, অবরোধ চলতে থাকে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে এটি হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল প্রবেশদ্বারে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি অবস্থান নেয়। রাজু ভাস্কর্যের আশেপাশের পুরো এলাকা সাজোয়া যান এবং পুলিশ-বিজিবি’র অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। শাহবাগসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ছাত্রলীগযুবলীগ অবস্থান নেয়। শিক্ষকদের আয়োজনে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ সকাল ১১ টায় অপরাজেয় বাংলায় অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষকরা ছাত্রদের নিরাপত্তা নিয়ে উপাচার্য মাকসুদ কামালের সাথে দেখা করতে চাইলে– তিনি নেই বলে জানানো হয়।
সকাল থেকেই উপাচার্যের বাসভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিতে থাকে, “হল আমার বাড়ি ঘর, হল আমি ছাড়বো না” আরও স্লোগান
দিতে থাকে, “ব্যর্থ ভিসিকে, পদত্যাগ করতে হবে।”

এ পরিস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা এবং কফিন মিছিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষ করে কফিন মিছিল রাজু ভাস্কর্যের দিকে এগোতে থাকে। মিছিল রোকেয়া হলের সামনে যেতেই পুলিশ – বিজিবি সামনে- পেছন দু’দিক থেকেই টিয়ারশেল এবং সাউন্ডগ্রেনেড মারতে থাকে। ছাত্ররা কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, মল চত্বর এবং এর আশেপাশে অবস্থান নিতে থাকে। টিয়ারশেলে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এরপর শিক্ষার্থীরা মলচত্বর, সূর্যসেন হল, বিজয় একাত্তর হল এবং জসিমউদদীন হলের দিকে অবস্থান নেয়। পুলিশ মারমুখী হয়ে হলগুলোর দিকে আসতে থাকে।

এ দিন সন্ধ্যা ৬ টা ছিল হলত্যাগের সর্বশেষ সময়। অধিকাংশই হল ছেড়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে হল ছেড়ে যাওয়ার ব্যথা ছিল। অনেককেই কাঁদতে দেখেছি। ছাত্রদের ছোট একটা অংশ হলে থেকে যায়। পুলিশ-বিজিবি গোটা হলপাড়া দখলে নেয়। এ দিন সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

সন্ধ্যা ৭ টায় কালো শাড়ি পড়ে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্য ভাষন দেন। তিনি একবারের জন্যও আগের দিন ঘটা নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করলেন না। প্রতারণাপূর্ণ তার এ সাত মিনিটের লিখিত বক্তব্য আন্দোলনকারীদের আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। আন্দোলনকারীরা পরদিন সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচীর ঘোষণা দেয়। এদিন আন্দোলন সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। আওয়ামী মাফিয়াদের সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে অজস্র মানুষের গৌরবগাঁথা রচিত হয়। রাতে আইনমন্ত্রী আলোচনার জন্য আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানান। আন্দোলনকারীরা সাফ জানিয়ে দেয়, ‘রক্তের উপর দিয়ে কোন সংলাপ হবে না।’

১৮  জুলাই বৃহস্পতিবার:  ঢাকাসহ সারাদেশের প্রায় সবগুলো জেলায়কমপ্লিট শাটডাউনকর্মসূচী পালিত হয়। কর্মসূচীতে সাধারণ মানুষের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন  এবং অংশগ্রহণ। স্কুল-কলেজ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ দিন প্রতিরোধের অগ্রভাগে ছিল। লাঠি নিয়ে তারা প্রস্তুত। পুলিশ-বিজিবি প্রস্তুত বন্দুক হাতে। মহাখালী-রামপুরা-বাড্ডা -মালিবাগে ছিল ব্রাক, ইস্ট-ওয়েস্ট এবং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের বিক্ষোভ-প্রতিরোধ। মিরপুরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। মিরপুর, পল্টন, উত্তরা, যাত্রাবাড়ি সর্বত্র প্রতিরোধ। ঢাকার আকাশে উড়তে থাকে র‍্যাব এর হেলিকপ্টার। আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধের মুখে একটি বিল্ডিংয়ে আটকে পড়া ৬০ জন পুলিশকে হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়।

সরকার বিজিবি মোতায়েন করে। বিজিবি সীমান্ত রক্ষা বাদ দিয়ে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। ঢাকা শহরে অসংখ্য পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। গোটা রাজধানী যেন মিছিল, বিক্ষোভ আর প্রতিরোধের শহর। রাত টা থেকে সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এদিন নিহত অন্তত ৭৯ জন, আহত অসংখ্য।

১৯ জুলাই শুক্রবার: দ্বিতীয় দিনের মত সারাদেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচী পালিত হয়। গণমাধ্যমের তথ্য মতে, ঢাকায় অন্তত ৪৪ জন এবং সারাদেশে ৫৬ জন শহীদ হন। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং শাসকদল আওয়ামী বিরোধী এই প্রতিরোধে রাস্তাঘাট সর্বত্র সাধারণ মানুষ নেমে পড়ে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর সমন্বয়করা ৯ দফা দাবি ঘোষণা করে। দাবি না মানা পর্যন্ত শাটডাউন কর্মসূচী পালনের আহ্বান জানানো হয়।

২০ জুলাই, শনিবার: সরকার দেশজুড়ে কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েন করে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, বেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। যাত্রাবাড়ি,শনির আখড়া, উত্তরা, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় হাজার- হাজার ছাত্র-জনতা বিক্ষোভ করতে থাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে সরকারি বাহিনী তুলে নেয়। এ দিন রাতে সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ ৩ জন সমন্বয়ক ৮ দফা দাবি পেশ করে।

২১ জুলাই, রোববার: দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারি চাকরিতে (৯ম২০ তম গ্রেড) কোটা পুনর্বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল করে। রায়ে বলা হয় ৯৩ শতাংশ মেধা এবং শতাংশ কোটায় নিয়োগ হবে। শতাংশ কোটার মধ্যে শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, শতাংশ আদিবাসী এবং শতাংশ প্রতিবন্ধি তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ থাকবে। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে তুলে নিয়ে সরকারি বাহিনী নির্যাতন করে। অসুস্থ অবস্থায় তাকে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা তাদের ৪ দফা দাবি তুলে ধরেন এবং সরকারকে তা মেনে নেওয়ার জন্য ৪৮ ঘন্টা সময় বেঁধে দেন। সমন্বয়করা বলেন, কোটা সংক্রান্ত আদালতের রায়ের মাধ্যমে সরকার ছাত্র হত্যার দায় এড়াতে পারে না। এই দিনে সরকার কমপক্ষে জন ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়েছে। আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার এবং রিফাত রশিদসহ কয়েক জনের সন্ধান দাবি করা হয়।

২২ জুলাই, সোমবার : কোটা সংস্কার সংক্রান্ত আদালতের দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেন। এ দিনেও সরকার সমর্থক এবং সরকারি বাহিনীর হামলা-গুলিতে অন্তত ১৩ জন নিহত হন।

২৩ জুলাই, মঙ্গলবার: কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

২৪ জুলাই, বুধবার : নিখোঁজ অবস্থায় ক’দিন থাকার পর আসিফ ও বাকেরকে চোখ বাধা অবস্থায় ফেলে যাওয়া হয়। এরপর আন্দোলন দমাতে সরকার সমস্ত অপচেষ্টা জারি রাখলেও আন্দোলনকারীদের মনোবল অটুট। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে আন্দোলনকে জারি রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। প্রেসক্লাবে কারফিউ ভেঙে সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরাগানের মিছিলবের করে। গানের মিছিলে অংশ নেয় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। তারা গাইতে থাকে– ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো, বলিদান লেখা আছে অশ্রুজলে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট শহীদদের ছবি নিয়ে বিক্ষোভ করে।
দেয়ালগুলো ভরে উঠতে থাকে ছবি আর প্রতিবাদে।  সেখানে লেখা হয় আবু সাঈদের মায়ের হাহাকার –  হামার বেটাক মারলু কেনে। এরকম অসংখ্য উদ্যোগ সারা দেশে চলতে থাকে।

ওরা  দুপায়ে লে গেল মরণশঙ্কারে
সবারে ডেকে গেল শিকল ঝঙ্কারে

১৬ জুলাই, রংপুর। নিরস্ত্র আবু সাঈদ বুক টান টান করে পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়ায়। পর পর দু’রাউন্ড গুলি। নিথর দেহ রাস্তায় পড়ে যায়। আগের দিন সাঈদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদ শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করে ফেসবুকে লিখেছিলো– “স্যার, এই মুহূর্তে  আপনাকে ভীষণ দরকার। আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিলেন সবাই তো মরে গেছেন। কিন্তু আপনি মরেও অমর। এই প্রজন্মের যারা আছেন, আপনারাও প্রকৃতির নিয়মে মারা যাবেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে আছেন মেরুদণ্ড নিয়ে বাঁচুন। ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জানান, রাস্তায় নামুন। শিক্ষার্থীদের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। প্রকৃত সম্মান শ্রদ্ধা পাবেন। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবেন না। আজন্ম বেঁচে থাকবেন শামসুজ্জোহা হয়ে।”

১৮ জুলাই উত্তরা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন সড়কে সবাই ছোটাছুটি করছে।  সন্ধ্যা প্রায় ৬ টা। এরই মধ্যে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ছুটছিলো পানি আর বিস্কুট হাতে। আর বলছিলো “কারও পানি লাগবে, পানি?” যখন মুগ্ধ পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। গুলিটা ‘লাগছিলো কপালে, মেয়েরা যেখানে টিপ পড়ে। ডান কানের পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে।’ তখনও মুগ্ধ’র হাতে ধরা ছিল পানির বোতল আর বিস্কুটের প্যাকেট। মুগ্ধ তার ফেসবুক বায়োতে লিখেছিলো, “বাবুমশাইরা, জীবনটা বড় চাইলম্বা নয়।মুগ্ধ তার কথা রেখেছে।

ফারহান ফাইয়াজ ছিল ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র। ১৮ জুলাই ধানমন্ডিতে সে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। ফারহান তার ফেসবুক একাউন্টের ইন্ট্রোতে লিখেছিলো, একদিন পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে। শহীদদের তালিকা অনেক লম্বা। ক’জনের নাম লিখবো? ৫ বছরের রিয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া,পোশাক শ্রমিক হোসেন মিয়া, যাত্রাবাড়ি এলাকার দিনমজুর রিংকু,সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়, ১০ শ্রেনির শিক্ষার্থী নাইমা, কলেজ ছাত্র তাঈম। লিখে শেষ করা যাবে না । ২৮ জুলাই এক প্রেস কনফারেন্সে সরকার জানায়, আন্দোলনে ১৪৭ জন মারা যায় যায়। ২৭ জুলাই দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, নিহতের সংখ্যা ২১০। কিন্তু বাস্তব সংখ্যা এরচেয়ে অনেক বেশি। সায়েন্সল্যাবে থাকা একজন আন্দোলনকারী তার অভিজ্ঞতা বলছিল, “১৮ জুলাই ল্যাবএইডের আশেপাশে পুলিশ কমপক্ষে ৮-১০ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করে। কিন্তু মৃতদেহ পুলিশ নিয়ে যায় এবং নিজেদের গাড়িতে তুলে ফেলে। আমরা কিছুই করতে পারিনি।”

অনেক লাশ বেওয়ারিশ অবস্থায় কবর দেয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে দিনের পর দিন পড়ে থেকেছে কত লাশ! কেউ খোঁজ পায়নি। ২৫ জুলাই দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে প্রকাশিত, আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারে একদিনেই ২১ টি বেওয়ারিশ মৃতদেহকে কবর দিয়েছে। মৃতদেহগুলো পুলিশ তাদের দিয়েছে বলে জানা যায়।

সবকিছু মনে রাখা হবে

১৬ জুলাই থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবি। এদের সহযোগিতা করে আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী। এদের যৌথ নারকীয়তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন! এই নারকীয়তার স্বাক্ষী এদেশের মানুষ, রাস্তাঘাট, বিল্ডিং, রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি, আকাশ, বাতাস সব সবকিছু।

পুলিশের হামলা থেকে রক্ষা পেতে একজন কিশোর বয়সী  আন্দোলনকারী বিল্ডিংয়ের কার্নিশ ধরে ঝুলে ছিলো। একজন পুলিশ কাছ থেকে রাউন্ড গুলি করে। অন্য একজন পুলিশ আরও ৩ রাউন্ড গুলি করে। রাস্তায় আহত হয়ে পড়েছিল একজন আন্দোলনকারী। তাকে যখন অন্য একজন উদ্ধার করতে যায় তাকেও কাছ থেকে গুলি করে পুলিশ। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমাম হোসেন তাঈম। সেও বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে অংশ নেয়। তার বাবা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উপপরিদর্শক আয়নাল হোসেন। সারাদিন কোথাও ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে এলেন ঢাকা মেডিকেলে। অবশেষে ছেলের সন্ধান পেলেন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। সেখানে পড়ে ছিলো তাঈমের নিথর দেহ। পুরো শরীর গুলিবিদ্ধ, রক্তাক্ত। তখন তিনি  কাদঁতে কাঁদতে মোবাইলে একজনকে জিজ্ঞেস করেন, “স্যার, আমার ছেলেটা মারা গেছে। বুলেটে ওর বুক ঝাজরা হয়ে গেছে। স্যার,আমার ছেলে আর নেই। একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে, স্যার?

১৯ জুলাই, মোহাম্মদপুরের আন্দোলনে যুক্ত ছিল একজন। আমাকে সে  রাত আনুমানিক ৮ টার দিকে ফোনে জানায়, “ভাই একটা মাইক খুব দরকার। মসজিদে চাইছি দেয়নি। যেমনে পারেন ম্যানেজ করেন। খুব দরকার। সবাইরে একসাথে রাখা দরকার।” সে এরপর বলে, ‘ভাই বিশ্বাস করেন – একটু আগে ছোট্ট একটা পোলারে পুলিশ হাত দিয়ে ধইরা গুলি কইরা মাইরা ফেলছে।”
১৮ তারিখ গোটা সায়েন্সল্যাব এলাকা আন্দোলনকারীদের দখলে। পুলিশ-বিজিবি রাস্তায় সুবিধা করতে না পেরে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে। একজন আন্দোলনকারী তার অভিজ্ঞতা বলছিলো, “বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের নিশানা করে গুলি করে। আমার সামনেই একজনের মাথায় গুলি লেগে বেরিয়ে যায়। মাথার মগজ বেরিয়ে গেছে।” একজন ফেসবুকে তার অভিজ্ঞতা লিখছিলো এভাবে– ঠিক আমার বাসার গেটের সামনে গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে এক লন্ড্রি দোকানী। আবাসিক এলাকার মধ্যে যুদ্ধাবস্থায়ও গুলি করা হয় কিনা জানিনা। শহীদ এই লন্ড্রী দোকানী কোন তালিকায় জায়গা পাবেন? বছরের ছোট্ট রিয়া। দুপুরের ছাদে খেলতে গিয়েছিল মেয়েটি। রাস্তায় মুখোমুখী আন্দোলনকারী এবং পুলিশ-বিজিবি। বাবা ছুটে যান মেয়েকে ছাদ থেকে আনতে। আকাশে হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছিল। গুলি- সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ছিল। মেয়েকে কোলে নিতেই একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হয় রিয়ার মাথায়। মুহুর্তেই বাবার কোলে ঢলে পড়ে নিথর দেহ।

১৯ জুলাই, মিরপুর। ১১ বছরের সামিরের ঘরের জানালা দিয়ে পুলিশের কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া ঢুকছিলো। সে জানালা বন্ধ করতে যায়। এমন সময় পুলিশের ঘাতক বুলেট সামিরের চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়।

২০ জুলাই, চিটাগং রোড। ১২ বছরের হোসেন মিয়া পপকর্ন ফেরি করে বিক্রি করছিলো। কখন একটি গুলি এসে তাকে বিদ্ধ করে সে বুঝতেই পারেনি।

আব্দুল্লাহ আল নোমান নামের একজন সাংবাদিক  ফেসবুকে হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের জরুরি মর্গের সামনে ভোর সাড়ে চারটার দৃশ্য এটি। বিড়ালটির সামনে পিছনে থাকা রুম দুটো তখন তাজা লাশে ভর্তি। শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা লাশগুলো একের পর এক এ দুটো রুমে রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত জায়গা ছিল না আর। এটার সাক্ষী শুধু আমি নই সে রাতের বিড়ালটিও সাক্ষী। বলছি ১৯ জুলাই শুক্রবার দিবাগত রাতের কথা।…রাত যত বাড়ছে লাশের সারিও বাড়ছে।’

  আন্দোলন শুধু ছাত্রদের থাকেনি, ছাত্রজনতার হয়ে উঠেছে

আন্দোলনের শুরুতে ছাত্ররা থাকলেও ধীরে ধীরে এ আন্দোলন গণমানুষের ব্যাপক সমর্থন পায়। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে যেমন ছাত্র আছে; আরও আছে দোকানি, রিকশা চালক, ফেরিওয়ালা, দোকানের কর্মচারী সহ আরও অনেকে। আন্দোলনকারীদের পানি খাইয়েছে ঘরের মা- বোনেরা। অনেকে নিজেদের উদ্যোগে রুটি-কলা, বিস্কুট এনেছে। অনেকে বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার এনেছে।

ছোট দোকানদার তার দোকানের  লজেন্স, মাস্ক, পানি আন্দোলনকারীদের দিয়েছে। আন্দোলনকারীরা ঘেমে গেলে, মায়ের বয়সীরা মাথায় পানি ঢেলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফেরিওয়ালা যিনি ফেরি করে আমড়া-পেয়ারা বিক্রি করেন; যখন পুলিশ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকতে নিষেধ করে তখন সে বলেছে, ‘ছাত্ররা কি আমাগো ভাই-ব্রাদার না। আমি হকার, হকারই আছি। একজনকে টাইনে যদি বাঁচাতে পারি।’

গাইবান্ধার একজন আন্দোলনের সংগঠক তার অভিজ্ঞতা বলছিলেন। ১৭ জুলাইয়ে রেললাইন থেকে ফায়ারসার্ভিস পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার আন্দোলনকারী রাস্তায় ছিলো। এদের অধিকাংশই স্কুল ছাত্র। মা-বাবারা নিজেদের ছেলে-মেয়েকে আন্দোলনে নিয়ে এসেছে। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে নেমেছে। বাবার হাত ধরে মেয়ে, দুজনের হাতে দুটি লাঠি। দু’জনেই আন্দোলনে এসেছে। একজন আন্দোলনকারী বলছিলো– অন্য সময় মাবাবা মিছিলে গেলো বাধা দিত; কিন্তু সময় আমাকে বলেছেলক্ষলক্ষ ছেলেমেয়ে রাস্তায়। আমি কীভাবে শুধু তোমাকে না করি!’ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের সহযোগিতা করেছে, আশ্রয় দিয়েছে। নিজেরা চাল-ডাল সংগ্রহ করে রান্না করে খাইয়েছে।

আন্দোলনের এ পর্যায়ে গণগ্রেফতার চলছে। হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হচ্ছে। ছাত্ররা চরম অনিরাপদ অবস্থান মধ্যে আছে। সরকারি এই দমন- পীড়ন এবং সন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে অনেকে আন্দোলনকারীদের নিজেদের বাড়িতে থাকতে দিচ্ছে। টিউশন বাসা থেকে বলছে– ‘বাবা, তোমার মেসে থাকার দরকার নেই। আমাদের বাসাতেই থাক।’

আহতদের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। আইনজীবীরা বিনা পারিশ্রমিককে আটকদের জন্য লড়ছে। রিকশাচালকরা রিকশা নিয়ে মিছিলে জড়ো হচ্ছে।

আটক সন্তানকে পুলিশ হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মা সন্তানকে সাহস দিয়ে বলছে, ভয় নেই, সাহস রাখ। শিক্ষকরা বলছেন, আমরা ছাত্র হত্যার বিচার চাই। আন্দোলন ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে। আন্দোলন এখন সর্বত্র।

দেশের বাইরেও এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে টি বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বিশাল প্রতিবাদ মিছিল করেছে। বামপন্থী ছাত্র সংগঠন এআইডিএসও তারা বাংলাদেশের ছাত্রদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ এবং আন্দোলনের সমর্থনে সংহতি মিছিল করেছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছে। এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, হাঙ্গেরিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ হয়েছে।

এসব প্রতিবাদে শুধু ছাত্ররা নয়, আরও অনেকেই ছিলো। আরব আমিরাতে বিক্ষোভ করায় সে দেশের সরকার আন্দোলনকারীদের ৩ জনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং ১ জনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী, হাজারো দমন-পীড়ন,অত্যাচার  করে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমানো যায়নি। এ আন্দোলনও দমবে না।

 আমরা এখন নিজদেশে, নিজবাসে অন্তরীণ

১৮ জুলাই রাত থেকেই সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। এটি করে মূলত আন্দোলন দমাতে এবং যে হত্যাযজ্ঞ তারা চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে তা দেশে-বিদেশে আড়াল করতে। কর্পোরেট পুঁজির তাবেদার ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো সব চোখের সামনেবিটিভিহয়ে গেল। সরকার যেভাবে সংবাদ প্রচার করতে বলেছে, তারা সেভাবেই করতে লাগল। একটা কথাই এসময় প্রচলিত হল– single script, different screen. গণমাধ্যম দেখে বোঝার কোন উপায়ই নেই, কী বর্রর হত্যাকান্ড সরকার এখানে চালাচ্ছে!

মাঠের প্রতিরোধ যখন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এল, শুরু হল প্রচারযন্ত্রের মারফত একটানা সরকারি প্রচার। এগুলো  বিএনপি-জামাতের নাশকতা, দেশবিরোধীদের চক্রান্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারের এসব মিথ্যাচারে জনগণের বিন্দুমাত্র আগ্রহ ও আস্থা নেই। আন্দোলন দমনে এটি আওয়ামীগের পুরনো অপকৌশল। বাস্তবে আওয়ামীলীগ এই আন্দোলনে সর্বস্তরের জণগনের অংশগ্রহণ অস্বীকার এবং লড়াইয়ের তেজকে কালিমালিপ্ত করতেই বিএনপি – জামায়াতকে এ আন্দোলনের সাথে জড়ানোর চেষ্টা করছে।

প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেলের একটি স্টেশনের ভাঙা জানালা আর ভাঙা কম্পিউটারের সামনে দাঁড়িয়ে শোক প্রকাশ করলেন। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসসাধন নিয়ে সরকারের হাহাকারের শেষ নেই! অথচ সারাদেশের অসংখ্য মানুষের মৃত্যু নিয়ে তার কোন বিকার নেই। এদের কাছে শত শত মানুষের জীবনের চেয়ে মেট্রোরেলের একটি স্টেশন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

এরই মধ্যে চিকিৎসারত অবস্থায় তিনজন সমন্বয়ককে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ডিবি তুলে নেয়। তাদেরকে ভয় দেখিয়ে, জিম্মি করে বিবৃতি আদায় করে। এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীরা আলাদাভাবে বিবৃতি দেয়। তারা আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার অঙ্গীকার করে। সমন্বয়করা অধিকাংশ সরকারের হাতে আটক। বাইরে যারা তারাও নিজেদের মধ্যে ভালো যোগাযোগ করতে পারছে না। যে কোন মুহূর্তে আটক হওয়ার আশঙ্কা। এসব কিছুকে উপেক্ষা করে তারা বারবার চেষ্টা করতে থাকে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের। এ আন্দোলনকে কিছুতেই নষ্ট হতে হতে দেয়া যাবে না।

আন্দোলনকারীরা ২৮ জুলাই সারাদেশে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সারাদেশের বিভিন্ন দেয়ালে শোভা পেতে তাকে তাদের প্রতিবাদের ভাষা। কোন দেয়ালে লেখা– ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই।’ কোথাও লেখা– ‘সোনার বাঙলা আজ মৃত্যুপুরী কেন?’ কোন দেয়ালে আকাঁ হলো শহীদ আবু সাঈদের ছবি, সেখানে লেখাবুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।

অনেকে দেয়ালে লিখেছেন, ‘এই গণহত্যার প্রতিশোধ চাই।’

সরকার জানে– যে আগুন জ্বলে উঠল, তা সহজে নেভবার নয়। তাই তড়িঘড়ি করে যে কোন উপায়ে আন্দোলন দমন করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যখন আমি এই লেখা লিখছি (৩১ জুলাই), তখনও ছাত্ররা রাস্তায়। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ছাত্ররা নেমেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাবিপ্রবি, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় ছাত্ররা বিক্ষোভ করছে।

সরকারব্লক রেইডকরে গণতল্লাশী গণগ্রেফতার করছে। মধ্য রাতে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট সর্বত্র থেকে আটক করা হচ্ছে। দোকান থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে।  মোবাইল সার্চ করা হচ্ছে, ফেসবুকে পোস্ট কিংবা ছবি দেখে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিরোধী দল-মতের ব্যক্তি কিংবা ছাত্রদের বিরুদ্ধে গণহারে মামলা দেয়া হচ্ছে। ধরে নিয়ে যাওয়ার পরও পুলিশ অস্বীকার করছে। আত্মীয়-স্বজনরা থানায় থানায় ঘুরছে। জানালা দিয়ে গণ আটকের ছবি তোলায় বসুন্ধরা এলাকায় জানালাতে গুলি ছোড়ে পুলিশ।

হাইকোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী গণমাধ্যমে বলছিলেন, একাত্তর সালে আমি যুদ্ধ করেছি। আমার পায়ে যুদ্ধে গুলি লাগে। সে দিনগুলোতে আমি দেখেছি পাকিস্তানিবাহিনী মধ্যরাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজায় ঠক ঠক করতো। ‘মুক্তি’ আছে কিনা জিজ্ঞেস করতো। আর আজ স্বাধীন বাংলাদেশে পুলিশ মধ্য রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জিজ্ঞেস করছে ছাত্র আছে কিনা!

২৯ জুলাই ডেইলি স্টার বাংলা’র রিপোর্ট অনুযায়ী, পর্যন্ত শুধু ঢাকাতেই ২০০ মামলায় লাখ ১৩ লাখের অধিক আসামী। পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১২ হাজারের অধিক ছাত্রজনতাকে আটক করা হয়েছে। ১৭ বছরের কিশোর হাসনাতুল ইসলাম ফাইয়াজ এইচএসসি ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাকে নিম্ন আদালত ৭ দিনের রিমান্ড দিয়েছিল।

আটক-গণগ্রেফতার চলছেই। অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। রিমান্ডে তাদের নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করা হচ্ছে। পুরো দেশটাই যেন বড় এক কারাগার। পুরো দেশের মানুষই যেন রিমান্ডে।

বেকার সংকট: যা কমছে নাদিনকে দিন বাড়ছে:

১৯৭১ সালের পর ছাত্র-জনতার এমন তীব্র প্রতিরোধ এর আগে হয়নি। আন্দোলন দমাতে রাষ্ট্র এত বর্বর হত্যাযজ্ঞ এর আগে চালায়নি। এত কম সময়ে এত মানুষ আহত- নিহত হয়নি।
এই যে আন্দোলন, এর পেছনের কারণ কী? এর পেছনের কারণ হিসেবে রয়েছে বহুবছরের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এবং শোষণমুক্তির তীব্র আকুতি। কী কারণে ছাত্রদের মধ্যে এমন ক্ষোভ তৈরি হলো? এসব বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়–

১.সরকার তথাকথিত উন্নয়ন, সাফল্য এবং প্রবৃদ্ধির অগ্রগতির কথা প্রচার করছিলো। কিন্তু এ উন্নয়নে তরুণদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, বেকার সংকট কাটছে না। মেট্রোরেল, পদ্মাসেতু হচ্ছে কিন্তু দেশের তরুণরা কাজ পাচ্ছে না। পাচ্ছে বিদেশীরা। এ অবস্থায় তরুণরা নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পাচ্ছে না।

২. সরকারি সেক্টরে যথেষ্ট নিয়োগ হচ্ছে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে, সরকারি চাকুরিতে অনুমোদিত পদের প্রায় ২৬ শতাংশ পদ শূন্য।  যা সংখ্যায় প্রায় পাঁচ লাখ। এসব শূন্য পদে নিয়োগ দেয়া হলে বড় অংশের কর্মসংস্থান নিশ্চিত হতো। কিন্তু সরকার তা করছে না। একই সাথে এই বিষয়টিও লক্ষ্যনীয়, সরকার নতুন করে শূন্যপদ সৃষ্টি করছে না।

৩. যতটুকু জব সেক্টর আছে তাও একজন পাবে তা নিশ্চিত নয়। নিয়োগ বাণিজ্য, সরকার দলীয় কোটা, ৫৬ শতাংশ কোটা, স্বজন পোষণ, প্রশ্নফাঁস– এতকিছু ভেদ করে চাকরি পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

৪. জীবনযাত্রার চাপ ভীষণ বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছোঁয়া। শিক্ষার খরচ বাড়ছে। অভিভাবকদের সংকট ছাত্ররা খুব কাছে থেকে দেখেছে। ভোটাধিকার হরণ, সাইবার নিরাপত্তা আইন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দখলদারিত্ব– সব মিলিয়ে আওয়ামী জুলুম ছাত্ররা আর মানতে চায়নি।

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়  আওয়ামীলীগের ইশতেহারে ছিল ‘ঘরে ঘরে চাকরি’ দেয়ার প্রতিশ্রুতি। ১৫ বছর পরের বাস্তবতা হলো, এখন ঘরে ঘরে বেকার। ২০২০ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ( আইএলও) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছিল, আগামী কয়েক বছরে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষকে কাজ ও আয়ের জন্য খুঁজে নিতে হয়েছে স্বল্প আয়ের অনিশ্চিত কাজকর্ম। এদের মধ্যে রিকশা চালিয়ে, বাদাম বিক্রি করে, বাসা- বাড়িতে কাজ করে কেউবা গ্যারেজে কাজ করে কোন মতে জীবন ধারণ করছেন। উচ্চ শিক্ষিতদের একটা বড় অংশ বেকার। সরকারি এবং বেসরকারি উভয় সেক্টরেই চাকুরির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

যত দিন যাচ্ছে বেকার সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।  দেশের সমস্ত মানুষকে শোষণ করে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ছে। দেশের হাজার-হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ব্যাংক লুটপাট চলছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কোন শিল্পায়ন হচ্ছে না। অতীতে গড়ে ওঠা চিনিকল-পাটকলসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দিয়ে ক্রমাগত দেশের অর্থনীতিকে আমদানি নির্ভর করা হচ্ছে। একটা শিল্প গড়ে উঠছে তো কয়েকটা বসে যাচ্ছে। কারখানা গুলোতে কর্মী ছাঁটাই, লে-অফ চলছে। স্থায়ী কর্মী নিয়োগ না করে আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। দেশের এই সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই কর্মসংস্থান নিশ্চিত হচ্ছে না। আর এর জন্য দায়ী, নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতি এবং বাংলাদেশের শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা।

এ ব্যবস্থায় পুঁজিপতিরা কীভাবে মুনাফা করেন? তারা যা করেন– কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে, উন্নত প্রযুক্তি এবং আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। একই সাথে  শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়িয়ে দেন এবং শ্রমিকদের মজুরি কমিয়ে দেন। এর ফলে কী হয়? শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, বাজারে মন্দা দেখা দেয়,  শিল্পায়ন কমে যায়, বেকারত্ব বাড়ে এবং শ্রমিক ছাঁটাই হয়। এভাবেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ক্রমাগত কর্মসংস্থানের সংকটে ভোগে এবং বেকার সমস্যার জন্ম দেয়। তাই  কর্মসংস্থানের প্রশ্নটি সত্যিকার অর্থে দেশের শিল্পায়নের গতির সাথে যুক্ত। কোটা ব্যবস্থা উঠে যাওয়ায় হয়তোবা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী মেধায় চাকরি পাবে। কিন্তু কর্মসংস্থানের সার্বিক সংকটে তা বেকার যুবকদের কতটুকু আশান্বিত করবে? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

রাত্রির গভীর তপস্যা কি আনিবে না দিন

বাংলাদেশের মানুষ শুধু মার খায় না, প্রতিরোধও করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেছিলো, ছাত্রলীগ একটা ফু দিলেই, আন্দোলনকারীরা পাঁচ মিনিটে উড়ে যাবে। হয়েছে উল্টোটা। ১৬ তারিখ রাত থেকেই ছাত্রলীগের নেতারা বিতাড়িত হয়।

ছাত্রলীগ এবং এই সংগঠনের নেতারা এমন কোন অপরাধ নেই যা করত না। হল দখল, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, ধর্ষণসহ সমস্ত অপকর্ম এরা দিনের পর দিন করত। ছাত্রদের সাথে এরা দাসের মত আচরণ করতো। হলগুলো ছিল একেকটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছিল ছাত্রলীগের সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের সহযোগী। সরকার ক্ষমতায়, ছাত্রলীগ বিতাড়িত; এটা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনে ইতিহাসে লড়াইয়ের একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

সরকার ছাত্রলীগযুবলীগ দিয়ে আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার নৈতিকভাবে পরাজিত হয়েছে। আওয়ামীলীগের অবস্থা যে কতটা নাজুক তা স্পষ্টভাবে সামনে এসেছে। আওয়ামীলীগ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ গণধিক্কৃত দল ও সংগঠনে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনের সমর্থন জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এই আন্দোলন ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। জনগণ অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছে। সমস্ত ভয় দূর হয়ে গেছে।

সরকার সাময়িক পিছু হটে কোটা সংক্রান্ত দাবি মেনে নিয়েছে। কিন্তু সরকার এখনো পরাজিত হয়নি, শুধু তাদের মধ্যে পরাজয়ের ভয় ঢুকে গেছে। সে দ্রুতই তার সমস্ত শক্তিকে সংহত করতে তৎপর হবে। আমাদের প্রস্তুতিও বহুগুণ বাড়াতে হবে। মাটির তলায় থাকা গণবিক্ষোভ আজ গণবিস্ফোরণ হিসেবে ফেটে পড়েছে। শত শত ছাত্রকে নির্বিচারে হত্যা করে এই সরকার কোনভাবেই তার মসনদ টিকিয়ে রাখতে পারবে না । এই গণঅভ্যুত্থান  জনগনের সামনে নতুন মুক্তির সংগ্রাম, নতুন বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে। এ লড়াই কেবল শুরু, শেষ নয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তোলা দরকার। সারাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার সমস্ত মানুষকে আহ্বান জানাই, আসুন ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান! নতুন মুক্তির সংগ্রামে অংশ নিন। যে লড়াই শুরু হল তা একমাত্র শেষ হতে পারে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়েই।

সালমান সিদ্দিকী: সভাপতি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। ইমেইল: salmanssf1984@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *