রিকশা কেন চলে? কারা চালায়? কারা চড়ে?
মওদুদ রহমান
রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চালনা এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশার ওপর এক কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ভরশীল। পরিবহণ হিসেবে এদের ওপরই নির্ভরশীল বড় ছোট শহরগুলোর বেশিরভাগ মানুষ। অথচ তাদের কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, সুবিধা-অসুবিধা দেখা ও উন্নয়নের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নাই, বরং বিপরীতে রাষ্ট্র পরিচালিত হামলা, হুমকি, চাঁদাবাজীই প্রধান। সরেজমিনে অটোরিকশা এবং ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের জীবন জীবিকা অনুসন্ধান এবং এযাবত প্রকাশিত গবেষণা পত্রগুলো পর্যালোচনার ভিত্তিতে এই জরুরী বিষয়ে নীচের লেখা তৈরি করা হয়েছে ।
সন্তানের লেখাপড়ায় বেশি বেশি উৎসাহ দিতে মা-বাবাদের বলা একটা বহুলপ্রচলিত কথা হচ্ছে: ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়ায় চড়ে সে।’ বিপরীতে পড়াশোনায় অমনোযোগিতার পরিণাম বোঝাতে অনেক মা-বাবা সন্তানকে শাসনে ধমকের সুরে বলেন: ‘ভালোমতো না পড়লে, রিকশা চালিয়ে খেতে হবে।’ অর্থাৎ লেখাপড়া শিখে কেউ রিকশাচালক হতে চায় না, এমনকি রিকশার বদলে গাড়িতে চড়তে পারার মধ্যেও সামাজিক মনস্তত্ত্বে আয়েশি জীবনের বাহাদুরি প্রকাশের চল চালু আছে। আবার একই সমাজে চিকিৎসক পিতার স্বপ্ন থাকে সন্তানকে চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার, প্রকৌশলী দম্পতির চেষ্টা থাকে সন্তানকে প্রকৌশলী হিসেবে তৈরি করার; কিন্তু কোনো রিকশাচালক পিতার কি স্বপ্ন থাকে ভবিষ্যতে সন্তানকে রিকশাচালক হিসেবে দেখার! অথচ রিকশাচালনা পেশা তো অন্য আট-দশটা পেশার মতোই বৈধ। একজন রিকশাচালক পিতা তো অপর একজন চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী পিতার মতোই উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার চালান, সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করেন। তাহলে এই পেশায় কী এমন আছে, যাতে করে এই পেশায় জড়িতজনদের সমাজে নীচু চোখে দেখা হয়? কী কারণে এই পেশাজীবীরা পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী আর সড়কে পুলিশি চাঁদাবাজির শিকার হয়? কী কারণে হঠাৎ কোনো ঘোষণায় সড়কে এ পেশাজীবীদের বিচরণ কখনো নিষিদ্ধ, কখনো সীমিত করে দেওয়া হয়? আর মোটাদাগে এ প্রশ্নটা তো করাই যায়: অর্থনৈতিক সামর্থ্য বিচারে সামাজিক কাঠামোয় নীচু শ্রেণিতে অবস্থান করার পীড়া, অসহনীয় গঞ্জনা আর জীবন ধারণের অনিশ্চয়তার নিশ্চিত ভয় থাকার পরও হাজারো যন্ত্রণা সহ্য করে কী কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ রিকশা চালনাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে?
তাহলে এই পেশায় কী এমন আছে, যাতে করে এই পেশায় জড়িতজনদের সমাজে নীচু চোখে দেখা হয়? কী কারণে এই পেশাজীবীরা পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী আর সড়কে পুলিশি চাঁদাবাজির শিকার হয়? কী কারণে হঠাৎ কোনো ঘোষণায় সড়কে এ পেশাজীবীদের বিচরণ কখনো নিষিদ্ধ, কখনো সীমিত করে দেওয়া হয়?
এ লেখায় উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর আলোকেই আলাপ সাজানোর চেষ্টা থাকবে। এই আলাপে নিশ্চিতভাবেই সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে না; বরং প্রশ্নের ভিড় আরও বাড়তে পারে। কারণ, প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা যে পেশার ওপর নির্ভরশীল সেই রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চালনা পেশার কর্মপরিবেশ, নিরাপত্তা, সুবিধা-অসুবিধা নিরূপণ ও উন্নয়নের জন্য যে বহুমুখী আয়োজন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বিশাল শূন্যতা রয়েছে তা পূরণের ধৃষ্টতা নয়; বরং উপলব্ধির তাগিদই মামুলি এই লেখার প্রেরণা।
চাকায় বাঁধা জীবন
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে, জীবিকা হচ্ছে মূলত সামর্থ্য, সম্পদ, এবং কার্যাবলির সমন্বয়; যা জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় [১]। আরেকটু বিস্তৃত করে বলতে চাইলে আন্তর্জাতিকভাবে বহুলপ্রচলিত সংজ্ঞা ধার করে বলা যায় যে, একটি সুষ্ঠু জীবিকা হচ্ছে তাই যা, শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে কিংবা কাটিয়ে ওঠার উপায় হিসেবে কাজ করে, যার মাধ্যমে সামর্থ্য ও সম্পদ বজায় থাকে কিংবা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টেকসই জীবিকা অর্জনের সুযোগ তৈরি করে এবং মোটা দাগে যা অপরের জীবিকা অর্জন প্রক্রিয়ায় সুবিধাদি যুক্ত করে [২]। অর্থাৎ রিকশা (পায়ে টানা সাইকেল রিকশা), অটোরিকশা (ছোট চাকার ২, ৫ কিংবা ৮ জন যাত্রীবহন ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারিচালিত থ্রি-হইলার, ইজিবাইক) এবং ব্যাটারিচালিত সাইকেল রিকশা চালনা পেশায় জড়িতজনদের পেশাকে জীবিকা বলা যাবে যদি এ পেশায় উপার্জিত অর্থ দিয়ে শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক পরিশ্রম কাটিয়ে ওঠা যায়। যদি এ পেশার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সামাজিক আর অর্থনৈতিক অবস্থানের উন্নতি ঘটে, এবং যদি এ পেশার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ চালকের পরিবারের সদস্যদের মৌলিক চাহিদা পূরণে পরিপূর্ণভাবে সক্ষম হয়। অর্থাৎ ঢাকা শহরে থাকা প্রায় ২ লাখের মতো অটোরিকশাসহ যে ১২ লাখ রিকশা রয়েছে, এ ছাড়াও সারা দেশে যে ৪০ লাখ ইজিবাইক ও অটোরিকশা রয়েছে (সরকারি, বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছেই এ-সংক্রান্ত কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই), সেসব চালকের আয়-উপার্জন ন্যূনতমভাবে সুস্থ শরীরে পরিবার-পরিজন নিয়ে বসবাস করার মতোই হওয়া উচিত [৩]। অথচ জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে যে রিকশা চালানোর ফলে ঠান্ডা, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা, ডায়রিয়ার মতো রোগে ঢাকার ৯৪ শতাংশ রিকশাচালকই অসুস্থ থাকেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ চালক আবার জন্ডিসে আক্রান্ত। কারণ, তাদের জন্য রাস্তাঘাটে সুপেয় পানির কোনো জোগান নেই, টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই [৪]।
জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে যে রিকশা চালানোর ফলে ঠান্ডা, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা, ডায়রিয়ার মতো রোগে ঢাকার ৯৪ শতাংশ রিকশাচালকই অসুস্থ থাকেন। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ চালক আবার জন্ডিসে আক্রান্ত। কারণ, তাদের জন্য রাস্তাঘাটে সুপেয় পানির কোনো জোগান নেই, টয়লেটের কোনো ব্যবস্থা নেই ।
গবেষণা থেকে আমরা এ-ও জানতে পারি যে, পায়ে টানা রিকশা চালিয়ে সংসারের মাত্র শতকরা ৬৮ ভাগ খরচের জোগাড় হয়, বাকি খরচের জোড়াতালি আসে প্রধানত গার্মেন্টস শ্রমিক স্ত্রী, কিংবা বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেওয়া স্ত্রীর আয়ের টাকা থেকে। আর শহরে নানা কাজে শিশু শ্রমিক হিসেবে যেসব ছেলে-মেয়ে নিয়োজিত আছে তাদের অধিকাংশই রিকশাচালক বাবার সন্তান [৫]। ভাবার কোনোই কারণ নেই যে, রিকশাচালকেরা কাজে ফাঁকি দেন, কিংবা নিয়মিত রিকশা না চালানোর ফলে হয়তো সংসারের পুরো টাকাটা রিকশা চালিয়ে আয় করতে পারেন না। বরং একই গবেষণা আমাদের এ-ও জানাচ্ছে যে, ৬২ শতাংশ চালকই উপার্জনের তাগিদে সপ্তাহে ৭ দিনই গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে বের হন, আর ২৮ শতাংশ চালক সপ্তাহে এক দিন ছুটি নেন। গড়পড়তায় প্রতিদিন ৯ ঘণ্টা রিকশা টানার পরও যদি কারো মনে হয় যে, সংসারে স্ত্রী-সন্তান, পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের খরচ জোগানোর ব্যর্থতা ‘ফাঁকিবাজ’ রিকশাওয়ালাদেরই; তবে তারা রাস্তায় নেমে সামান্য সময়ের জন্য রিকশা চালানোর চেষ্টা করে দেখতে পারেন [৬]।
ঢাকা শহরের ৬৭.৭ শতাংশ রিকশাচালকই পরিবার-পরিজনহীন অবস্থায় থাকেন মূলত পরিবারসহ শহরে থাকার খরচ বাঁচাতে। নিজেরা গ্যারেজে ঘুমিয়ে, হোটেলে খেয়ে যতটা সম্ভব টাকা আপনজনদের কাছে পাঠানো যায় সেই চেষ্টা করেন [৫]। তারা গড়ে প্রতি পাঁচ মাসে একবার বাড়ি যান। কারণ, কাজ থেকে অবসর নেওয়ার ফুরসত আর গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাড়ি যাওয়ার মুরোদ তাদের হয়ে ওঠে না [৬]। তারা খাবার খান সস্তা হোটেলে, বাজারে গিয়ে খোঁজেন কম দামের সবজি। দুধ, ডিম, মাংস খাওয়ার সাধ থাকলেও সাধ্য তাদের কুলোয় না। পচন-ধরা নরম মাছেই তাদের পাতের বিলাস আটকে থাকে [৭]। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, রোগে ভুগে, বাসি-পচা-নিম্নমানের খাবার খেয়ে, গ্যারেজে ঘুমিয়ে তারা নিজেদের ক্ষয় করতে করতে বেঁচে থাকেন, বাঁচিয়ে রাখেন পরিবারের সদস্যদের। অথচ ক্ষমতার গদিতে বসে যারা হুটহাট রিকশামুক্ত ভিআইপি সড়কের ঘোষণা দেন, রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক নিষিদ্ধের ছক কাটেন, তাদের জানানো দরকার যে, ঢাকায় রিকশা চালাতে আসা ব্যক্তিদের প্রতি চারজনের একজন কৃষিকাজ ছেড়ে এ পেশায় যুক্ত হয়েছেন [৮]। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকরা কী কারণে মাঠ থেকে পথে নামেন, কী কারণে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসেন সেই প্রশ্নটা জোর গলায় করা দরকার।
ঢাকা শহরের ৬৭.৭ শতাংশ রিকশাচালকই পরিবার-পরিজনহীন অবস্থায় থাকেন মূলত পরিবারসহ শহরে থাকার খরচ বাঁচাতে। নিজেরা গ্যারেজে ঘুমিয়ে, হোটেলে খেয়ে যতটা সম্ভব টাকা আপনজনদের কাছে পাঠানো যায় সেই চেষ্টা করেন।
প্রতিটি রিকশা গড়পড়তায় ১.৬ জন মানুষের জীবিকা অর্জনের অবলম্বন (অধিকাংশ রিকশা দুই শিফটে দুজন চালক চালান বিবেচনায়) [৮], এই হিসাবে কেবল ঢাকা শহরেই প্রায় ২০ লাখ মানুষ রিকশা চালনা পেশায় যুক্ত। কাজেই নীতিনির্ধারকরা যখন রিকশা চলাচলের পথ সংকুচিত করে দেওয়ার নীতিতে অটল থাকেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা কিংবা ইজিবাইক বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রিকশাচালকদের জীবনে সামান্য আরামের পথে কাঁটা পুঁতে দেন তখন আদতে তারা এই ২০ লাখ মানুষ এবং এদের ওপর নির্ভরশীল ১ কোটি মানুষের (প্রতি পরিবারে ৫ জন সদস্যসংখ্যা বিবেচনায়) পেটে লাথি দেওয়ার আয়োজনই পূর্ণ করেন। মর্যাদাপূর্ণ বিকল্প কোনো জীবিকার সন্ধান না দিয়ে কোনো সভ্য দেশের সরকার রাষ্ট্রের নাগরিকের সঙ্গে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করতে পারে না। অথচ বাংলাদেশে এমনটাই হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে
এক জরিপে দেখা যায় যে, ঢাকায় যানবাহন সেবা প্রদানের দিক থেকে রিকশাচালকরা প্রথম স্থানে রয়েছেন। অন্য যানবাহনের অভাবে হোক, কিংবা তুলনামূলক সস্তা বাহন হিসেবে সহজপ্রাপ্তির কারণে হোক, ঢাকাবাসীর ব্যক্তিগত যাতায়াতে রিকশা ব্যবহৃত হয় সর্বোচ্চ, যা কিনা যাতায়াতে ব্যবহৃত মোট বাহন ব্যবহারের ৩৫ শতাংশ, এরপর ধারাবাহিক তালিকায় রয়েছে বাস এবং ব্যক্তিগত গাড়ি, যা কিনা যথাক্রমে ২১ শতাংশ এবং ১০.৫ শতাংশ। যানজটের কারণে দেখিয়ে যারা রিকশাওয়ালাদের বলির পাঁঠা বানাতে চান, সড়কে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক বন্ধ করে দেওয়ার ধুয়া তোলেন তাদের জানা দরকার যে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় মাথাপিছু সড়কের দৈর্ঘ্যের পরিমাণ ১ ফুটেরও কম (০.২১৩ মিটার), যেখানে উন্নত শহরের কথা বাদ দিয়ে অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের উদাহরণ টানলেও দেখা যায় যে সেখানে মাথাপিছু সড়কের এই দৈর্ঘ্যের পরিমাণ ১৫ ফুট থেকে দেড় ফুট (৪.৫ মিটার থেকে ০.৫ মিটার) [৮]। অথচ যানজটের কারণ হিসেবে রিকশাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যাতে মনে হয়, ঢাকা শহরকে সিঙ্গাপুর কিংবা দুবাই বানানো যাচ্ছে না কেবল এই রিকশাওয়ালাদের জন্যই!
ঢাকাবাসীর ব্যক্তিগত যাতায়াতে রিকশা ব্যবহৃত হয় সর্বোচ্চ, যা কিনা যাতায়াতে ব্যবহৃত মোট বাহন ব্যবহারের ৩৫ শতাংশ, এরপর ধারাবাহিক তালিকায় রয়েছে বাস এবং ব্যক্তিগত গাড়ি, যা কিনা যথাক্রমে ২১ শতাংশ এবং ১০.৫ শতাংশ।
ঢাকার অনেক সড়কই রিকশাচালকদের জন্য চলাচল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন, গাবতলী থেকে রাসেল স্কয়ার পর্যন্ত মিরপুর রোড কিংবা রাসেল স্কয়ার থেকে এফডিসি পর্যন্ত পান্থপথ রোডে তো রিকশা চলাচল সেই ২০০২ সাল থেকে বন্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে: এই সড়কে কি চলাচলের গতি বেড়েছে? গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০ কিলোমিটার দূরত্বের ঢাকা নিউমার্কেটে আসতে কেউ কি ২ ঘণ্টার কম সময়ে পৌঁছানোর আশা করতে পারেন? বিশ্বব্যাংকের ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ১০ বছরে ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি প্রতি ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ কিলোমিটার, যা কিনা হাঁটার গতি থেকে সামান্য বেশি [৯]। সেই গতি আরও কমে ২০২২ সালে হয়েছে ঘণ্টায় ৪.৮ কিলোমিটার, যা কিনা আমাদের হাঁটার গতির প্রায় সমান। সিপিডির আরেক জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে প্রতি দুই ঘণ্টায় ৪৬ মিনিট জ্যামে আটকে থাকতে হয় [১০]। পৃথিবীর ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০টি শহরে যাতায়াতের গতি পর্যালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে ঢাকা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধীরগতির শহর [১১]। ঢাকাকে পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে ধীরগতির শহরে পরিণত করার দায় কি তবে রিকশাচালকদের? অথচ জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকার শ্রাদ্ধ করে যানজট নিরসনের নামে তৈরি করা ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেস, আর ভিআইপি সড়কগুলোতে তো রিকশার প্রবেশাধিকার নেই। নাকি ক্ষমতার কাঠামোতে এই বিশাল সংখ্যক পেশাজীবীর কোনো ভাগ নেই দেখে এই দুর্বলের ওপর সবল রাষ্ট্রের দেওয়া সব অপবাদ, অবিচার জায়েজ হয়ে যায়?
‘উন্নয়নের’ সমস্যা আর সমস্যার বাণিজ্য
ঢাকায় প্রধান (প্রাইমারি), অপ্রধান (সেকেন্ডারি), সংযোগকারী (কানেকটিং), স্থানীয় এবং চিপাগলি মিলিয়ে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ২৮৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে অর্ধেক সড়কেই বাস এবং ব্যক্তিগত গাড়ির মতো যান্ত্রিক বাহন চালানোর উপায় নেই। কাজেই অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, কী কারণে রিকশার মতো বাহনই যোগাযোগের ক্ষেত্রে মানুষের প্রধান পছন্দ এবং কী কারণে ঢাকার শতকরা ৬০ ভাগ বাসিন্দা রিকশায় চলাচল করে। অথচ এ রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক কোনোটারই লাইসেন্স বা অনুমোদন দেওয়া হয় না। ঢাকা সিটি করপোরেশন শেষ ১৯৮৬ সালে রিকশার লাইসেন্স দিয়েছিল। তখন পর্যন্ত লাইসেন্সকৃত ৭৯ হাজার ৫৫৪টি রিকশার সংখ্যা তিন যুগ পর এসেও অপরিবর্তিত রয়েছে [৬, ৮]। বিপরীতে ঢাকায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করে আর প্রতিদিন যোগ হচ্ছে প্রায় ৪০টি নতুন ব্যক্তিগত গাড়ি [১২]।
অথচ আমরা আগেই দেখেছি যে, কেবল ঢাকাতেই ২ লাখের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ প্রায় ১২ লাখ রিকশা রয়েছে। এই যে বিপুল সংখ্যক রিকশাকে বৈধতার আওতার বাইরে রেখে দেওয়া হয়েছে, তাতে লাখ লাখ রিকশাচালকের মাথার ওপর অনিশ্চয়তার খড়গ থাকলেও লাভ হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী (আরও নির্দিষ্টভাবে বললে আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের এলাকাভিত্তিক নেতা-কর্মী) ও পুলিশবাহিনীর ঘুষখোর সদস্যদের। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ঢাকায় যে অন্তত ২ লাখের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে সেই প্রতিটি রিকশা মাসে গড়ে দেড় হাজার টাকা টোকেন বাণিজ্যের শিকার হয়। এই হিসাবে মাসে অবৈধভাবে আদায় করা হয় ৩০ কোটি টাকা। রিকশাপ্রতি রেকার বিল গুনতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। আবার কোনো রিকশা ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া হলে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করে রাস্তায় নামাতে হয়। বেশিরভাগ রিকশাচালক গলিতে থাকলেও পুলিশের সদস্যরা সেখানে প্রায় প্রতিদিন হানা দেন। অবৈধ যান চলাচলের কথা বলে রিকশা ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানোর ভয় দেখান। এরপর প্রতি রিকশা বাবদ ৫০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। এ ছাড়া অনেক জায়গায় স্থানীয় নেতাদের কাছ থেকে ‘কার্ড’ নিতে হয়। সেই কার্ডের জন্য মাসে আড়াই হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ টাকা ক্ষমতার ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভাগাভাগি হয়। এই হিসাবে শুধু কার্ড ম্যানেজ করে রাস্তায় একটি অটোরিকশা চালাতে হলে বছরে ঘুষ গুনতে হয় ২৬ হাজার ৪০০ টাকা। এরপর রাস্তায় নামলে কোনো কারণে আবার পুলিশ ধরলে সেখানে জরিমানার নামেও গুনতে হয় টাকা [৩]।
ঢাকায় যে অন্তত ২ লাখের মতো ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে সেই প্রতিটি রিকশা মাসে গড়ে দেড় হাজার টাকা টোকেন বাণিজ্যের শিকার হয়। এই হিসাবে মাসে অবৈধভাবে আদায় করা হয় ৩০ কোটি টাকা। রিকশাপ্রতি রেকার বিল গুনতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। আবার কোনো রিকশা ডাম্পিং স্টেশনে নেওয়া হলে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করে রাস্তায় নামাতে হয়।
যে রিকশা না থাকলে ঢাকা শহরের অর্ধেক রাস্তায় চলাচল করাটাই মুশকিল হয়ে যেত, সেই হাড়ভাঙা খাটুনির রিকশা চালানো যখন সময়ে সময়ে বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা আসে তখন তাদের পক্ষে খুব বেশি মানুষকে উচ্চকিত হতে দেখা যায় না, অথচ তাদের সামান্য পরিমাণ রোজগারে ভাগ বসানো মাছির অভাব হয় না। মনে রাখা দরকার, রিকশাচালকরাও এই পেশার অমানুষিক কষ্টের জাল থেকে মুক্তি চায়, যেমনটা মুক্তি চায় এ দেশে কোনোরকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়ে কুলি, মজুর, বেকারি শ্রমিক, ইটভাটার শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মতো পেশায় জড়িত মানুষরা। কাজেই যারা অমানবিক তকমা দিয়ে রিকশা টানা পেশাকে বন্ধ করার যুক্তি টানেন তারা যদি এদের ওপর হওয়া নিয়মিত চাঁদাবাজির অত্যাচার বন্ধ করার উদ্যোগ নিতেন, রাস্তার পাশে বিভিন্ন পয়েন্টে রিকশা, ইজিবাইক চালকদের জন্য পার্কিংসহ বিশ্রামাগারের ভাবনা ভাবতেন, যে চালাবে তার মালিকানা নিশ্চিত করতে রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চালকদের জন্য যদি জামানতবিহীন সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করার জন্য আওয়াজ তুলতেন, তাদের জন্য নিরাপদ আবাসন, সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যকর খাবার আর মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দাবিটা তুলতেন, ডিজাইনকে আধুনিক করে চালক ও যাত্রীর জন্য এই বাহনগুলোকে আরও নিরাপদ ও আরামদায়ক করার আয়োজন করতেন, ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের দিকে মনোযোগী হতেন; তাহলেই এই পেশাটা অনেকটাই মানবিক হয়ে উঠত। যারা রিকশা চালান তারা উপায়ান্তর না পেয়ে পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই চালান। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, অন্য কোনো মর্যাদাপূর্ণ পেশার সন্ধান না দিয়ে অমানবিকতার অজুহাতে রিকশা বন্ধ করে দেওয়ার আয়োজন একটা চরম জুলুম ছাড়া আর কিছু নয়।
রিকশা কোনোভাবেই যানজটের কারণ নয়, যানজটের কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শহরে পর্যাপ্ত রাস্তা না থাকা, যানজটের কারণ হচ্ছে প্রধানত ঢাকাকে নাগরিক জীবনের আয়-উপার্জন, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির একমাত্র তীর্থস্থান হিসেবে গড়ে তুলে কোটি মানুষের ভারে অকেজো করে ফেলা, যানজটের কারণ হচ্ছে সীমিত বাজেটের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে সুলভ গণপরিবহণের ব্যবস্থা না করে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল ক্রমাগত বৃদ্ধি করা, আর সামর্থ্যবানদের সুবিধা দিতে একের পর এক ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল নির্মাণ করা, যানজটের কারণ হচ্ছে ভিআইপি মুভমেন্ট, যানজটের কারণ হচ্ছে বিকট সব হর্ন বাজিয়ে ট্রাফিক আইন না মেনে সবাইকে পেছনে ফেলে সরকারি অফিসের সাহেবসুবোদের ইচ্ছামাফিক চলাচলের মানসিকতা। কাজেই যারা যানজটের দোহাই দিয়ে রিকশাকে সড়ক থেকে উঠিয়ে দিতে চান তাদের উচিত হবে যানজটের প্রকৃত কারণগুলোর অনুসন্ধান করে সেগুলোর প্রতিকারে ব্যবস্থা নেওয়া। রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক চালকদের বিচ্ছিন্নতা আর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার জোরে যাচ্ছেতাই করে ফেলার দাদাগিরি আদতে কোনো কাজে আসবে না।
আমরা আগেই দেখেছি যে, ঢাকা শহরের অর্ধেক সড়ক এতই সরু যে, রিকশা ছাড়া বাস এবং ব্যক্তিগত গাড়ির মতো যান্ত্রিক বাহন চালানোর উপায় নেই। ভিআইপি সড়কে যেমন করে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি জ্যাম কমিয়ে রিকশা, অটোরিকশা চলাচলের সুবিধা করে দিতে কি সরু অলিগলি, রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা যায় না? কী কারণে যাবে না? ব্যক্তিগত গাড়িওয়ালাদের ক্ষমতার জোর বেশি বলে? আর রিকশাচালকদের সঙ্গে যা খুশি তাই করা যাবে, তাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই বলে?
ভিআইপি সড়কে যেমন করে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি জ্যাম কমিয়ে রিকশা, অটোরিকশা চলাচলের সুবিধা করে দিতে কি সরু অলিগলি, রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করা যায় না?
রিকশায় বিদ্যুৎ আর অর্থনীতির ভাঙা মাজা
একটি রিকশা টানতে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৪ কিলোজুল শক্তি খরচ হয়, যা কিনা অলিম্পিকে অংশ নেয়া অ্যাথলেটের ঘামঝরানো পরিশ্রমের সমান [১৩, ১৪]। অর্থাৎ দুধ, ডিম, কলা, মাখন, রুটি খাওয়া উসাইন বোল্ট কিংবা মাইকেল ফেলেপস অলিম্পিকের খেলায় যে কষ্ট করেন; রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, গ্যারেজে ঘুমিয়ে, পচা-বাসি খেয়ে রিকশা টানার কাজ করা যে কোনো আহাদ আলী কিংবা রহিম মিয়াও একই কষ্ট করেন। এই জীবনে একটুখানি স্বাচ্ছন্দ্য আসতে পারে যদি এই রিকশা টানার কাজটা মানবচালিত না হয়ে মোটরচালিত হয়। উল্লিখিত তথ্যানুসারে বাংলাদেশে থাকা প্রায় ৫০ লাখ রিকশা, অটোরিকশা, ইজিবাইক, টমটমের সব যদি বিদ্যুতে চলা শুরু করে আর ব্যাটারিচালিত হয়, তাহলে দৈনিক বিদ্যুৎ লাগবে প্রায় ৫০ হাজার মেগাওয়াট-আওয়ার (প্রতিটি রিকশায় ৪ থেকে ৫টি প্রতিটি ১২ ভোল্টের ১২০ থেকে ১৫০ অ্যাম্পিয়ার-আওয়ার ক্ষমতার ব্যাটারি আছে বিবেচনায় প্রতিটি রিকশা প্রতিদিন চার্জ দিতে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে ১০ ইউনিট করে)। আর এই পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরিতে প্রয়োজন হবে ২ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র (৮০ শতাংশ ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর বিবেচনায়)। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে, ৪ মে ২০২৪ পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট আর দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের ক্ষমতা ২৭ হাজার ১৬২ মেগাওয়াট।
একটি রিকশা টানতে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৪ কিলোজুল শক্তি খরচ হয়, যা কিনা অলিম্পিকে অংশ নেয়া অ্যাথলেটের ঘামঝরানো পরিশ্রমের সমান।
অর্থাৎ ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক চালকরা যদি বিদ্যুৎ গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়, তাহলে অতিরিক্ত কোনো ব্যয় না করেই অলস বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিছু পরিমাণ সচল করেই এ বাড়তি চাহিদা মেটানো যায়। এতে যেমন প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের একটা আপাত সহজ উপায় তৈরি হবে, মোটর যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প একটা ভিত্তি পাবে, টমটম ও ইজিবাইক আমদানির পরিবর্তে নির্মাণ ও মেরামত শিল্প গড়ে উঠবে; তেমনি কোনোরকম হিসাব ছাড়াই কেবল বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ ব্যবসার লাভের জোগান দিতে ব্যাঙের ছাতার মতো যে অসংখ্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, যেগুলোকে অলস বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হয়েছে সেই অলস বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে কিছুমাত্রায় হলেও কাজে লাগানো যাবে [১৫]।
ব্যাটারিচালিত রিকশা আর ইজিবাইক চালকরা যদি বিদ্যুৎ গ্রাহক হিসেবে যুক্ত হয়, তাহলে অতিরিক্ত কোনো ব্যয় না করেই অলস বসে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কিছু পরিমাণ সচল করেই এ বাড়তি চাহিদা মেটানো যায়। এতে যেমন প্রায় ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের একটা আপাত সহজ উপায় তৈরি হবে, মোটর যন্ত্রাংশ তৈরি শিল্প একটা ভিত্তি পাবে, টমটম ও ইজিবাইক আমদানির পরিবর্তে নির্মাণ ও মেরামত শিল্প গড়ে উঠবে।
খেয়াল রাখা দরকার যে, ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে যাত্রী প্রতি কিলোমিটারে বিদ্যুতের খরচ ০.২০ টাকা (পরিপূর্ণভাবে চার্জ হতে ১০ ইউনিট বিদ্যুৎ লাগে, প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের খরচ ১০ টাকা, প্রতি যাত্রায় ৮ জন যাত্রী থাকে আর পরিপূর্ণ চার্জে ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার যেতে পারে বিবেচনায়), বিপরীতে পেট্রোলচালিত থ্রি-হুইলার প্রতি যাত্রী প্রতি কিলোমিটারে জ্বালানি খরচ ০.৮৩ টাকা (প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ১২৫ টাকা, প্রতি লিটার পেট্রোলে ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার যায় আর প্রতি যাত্রায় ৫ জন যাত্রী থাকে বিবেচনায়)। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ মাত্রা হিসেবেও বিদ্যুচ্চালিত ইজিবাইকের তুলনায় পেট্রোলচালিত থ্রি-হুইলারের নিঃসরণ প্রায় দ্বিগুণ [১৬]। অথচ সরকার বর্তমানে দেশে চলা মাত্র কয়েকশ বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কয়েকটি জায়গায় চার্জিং স্টেশন স্থাপন করেছে, ২০২২ সালে করেছে বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য নীতিমালা, চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে গড়ে তোলা হচ্ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরির বৃহৎ কারখানা [১৭]।
প্রশ্ন তোলা দরকার, কী কারণে কিছু বড়লোকের বিলাসী টেসলা, অডি, পোরশে আর মার্সিডিজের জন্য চার্জিং স্টেশন করার বেলায় সরকারি দৌড়ঝাঁপের কমতি হয় না, কিন্তু কয়েক কোটি গরিব মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য জীবন আর জীবিকার আশ্রয় হতে পারে যে মাধ্যমটি সেটিকে এগিয়ে নিতে কেন এতটা উদাসীনতা? আমরা কি কেবল জাপান, কোরিয়া, চীন আর ভারতীয় বাজারের ক্রেতা হতেই নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকব? বিদেশি প্রেসক্রিপশনে কি আমাদের অর্থনীতির ভাঙা মাজা জোড়া লাগবে?
প্রশ্ন তোলা দরকার, কী কারণে কিছু বড়লোকের বিলাসী টেসলা, অডি, পোরশে আর মার্সিডিজের জন্য চার্জিং স্টেশন করার বেলায় সরকারি দৌড়ঝাঁপের কমতি হয় না, কিন্তু কয়েক কোটি গরিব মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য জীবন আর জীবিকার আশ্রয় হতে পারে যে মাধ্যমটি সেটিকে এগিয়ে নিতে কেন এতটা উদাসীনতা?
নগরের আগুনে কি শুধু রিকশাই পুড়বে?
ব্যক্তিগত গাড়ির গতি, চলার সময় সামনে, পেছনে এবং দুই পাশে আশপাশের বাহন থেকে নিরাপদ দূরত্ব রাখার হিসাব আর পার্কিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গা বিবেচনায় রিকশার তুলনায় ব্যক্তিগত গাড়ি সড়কে দ্বিগুণ জায়গা দখল করে এবং গড়পড়তায় ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়া যাত্রী রিকশায় চড়া যাত্রীর তুলনায় সড়কে ৪৫ শতাংশ বেশি জায়গা দখল করে [১৪]। আবার বড় সড়কে যেমন ধীরগতির বাহন বাধা সৃষ্টি করে ঠিক তেমনি সরু সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি রিকশা, ইজিবাইকের মতো বাহনগুলোর জন্য অসুবিধা তৈরি করে। একটি দীর্ঘ এবং বিস্তৃত গবেষণা সম্পন্ন করে রব গালাঘের ওনার রচিত বই Rickshaws of Bangladesh-এ এক পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, পুরান ঢাকায় ১৯ ফুট চওড়া একমুখী চলাচলের এক রাস্তায় এক ঘণ্টায় ৩ হাজার ৫০০টি রিকশা একটি নিদিষ্ট স্থান অতিক্রম করতে পারে, ঠিক একই অবস্থা বজায় রেখে ২০ ফুট চওড়া একমুখী রাস্তায় এক ঘণ্টায় ১ হাজার ৩০০টি গাড়ি চলতে পারে। প্রতিটি রিকশায় ১.২ জন আর প্রতিটি ব্যক্তিগত গাড়িতে ২.২ জন যাত্রী বিবেচনায় এক ঘণ্টায় গাড়ির তুলনায় রিকশায় ১ হাজার ৩৪০ জন যাত্রী বেশি চলাচল করতে পারে [১৪]।
আবার সেই সঙ্গে এ-ও খেয়াল রাখা দরকার যে, একই রিকশা সাধারণত দুই শিফটে চালানো হয় এবং প্রতি শিফট ৭ ঘণ্টা সেবা প্রদানের সময় হিসাবে ধরলে একটি রিকশা দিনে ১৪ ঘণ্টা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাত্রী পরিবহণে ব্যস্ত থাকে। প্রতি ঘণ্টায় ২ জন যাত্রীসেবা পায় বিবেচনায় একটি রিকশা দিনে কমপক্ষে ২৮ জন যাত্রীকে সেবা প্রদান করে। কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়ি সাধারণত পরিবারের সদস্যদের অফিস, স্কুল, কলেজ, বাজারে যাতায়াতের জন্যই ব্যবহৃত হয়। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, নাগরিক সেবা প্রদানে ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় রিকশা বহুগুণ বেশি অবদান রাখছে। কিন্তু এরপরও সকল হুমকি-ধমকি, যানজট লাগানোর অপবাদ, বিদ্যুৎ চুরির কলঙ্ক সবকিছুই রিকশাওয়ালাদের কপালেই জোটে।
ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৭৯ লাখ রিকশা ট্রিপ (রিকশা দিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত) হয়, যা বাহন দিয়ে মোট যাতায়াতের ৩৮ শতাংশ [১৮]। প্রতি ট্রিপের ভাড়া যদি গড়ে ৩০ টাকা হয়, তাহলে কেবল ঢাকাতেই রিকশাচালকরা প্রতিদিন প্রায় ২৪ কোটি টাকা মূল্যের নাগরিক সেবা দেন, আর এই আয় দিয়ে চলে প্রায় কোটি মানুষের জীবন-সংসার। এই টাকা সুইস ব্যাংকে পাচার হয় না, এই টাকা দিয়ে রিকশা চালকরা কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ে সেকেন্ড হোম করেন না। বরং এই টাকা খরচ হয় রাস্তার পাশের সস্তা হোটেলে, এই টাকা খরচ হয় মুদি দোকানে রিকশাচালকদের সংসারের সদাই কিনতে, এই টাকা খরচ হয় সন্তানের লেখাপড়ায় আর মেয়ের বিয়েতে কিংবা অসুস্থ মা-বাবার চিকিৎসায়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীন ব্যবস্থায় রিকশা চালনা পেশা একটা সামাজিক সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করছে। ভূমিহীন কৃষক দুই ফসলের মাঝের সময়টায় শহরে চলে আসেন রিকশা চালিয়ে সংসারটাকে বাঁচিয়ে রাখতে, ছোট কিংবা মাঝারি কৃষক রিকশা চালাতে আসেন ফলনের ক্ষতি পোষাতে কিংবা পরের ফসল লাগানোর বীজ, সার, সেচের খরচ জোগাতে, কলেজ পড়ুয়া সন্তান দুই পরীক্ষার মাঝের সময়টায় চলে আসে শহরে রিকশা চালিয়ে পরের বছরের ভর্তি ফি-র টাকাটা জমিয়ে রাখতে।
যারা কথায় কথায় রিকশাকে অবৈধ ঘোষণা করে দেন, ব্যাটারি খুলে নিয়ে যান, বুলডোজারে রিকশা গুঁড়িয়ে দেন তারা কি হিসাব করে দেখেছেন যে, দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে রিকশা চালনা পেশার অবদান কত? তারা কি হিসাব করে দেখেছেন যে, বাবা রিকশা চালানোর সুযোগ না পেলে কত লাখ শিশু স্কুল ছেড়ে শ্রমিকের খাতায় নাম লেখাবে? কত লাখ কৃষক পরের ফসলটা বোনার টাকা জোগাড় করতে পারবে না? রিকশাচালক স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে কত লাখ কিষানির দুধেল গাইটা আর নয়তো হাঁস-মুরগিটা কেনা হবে না? আপনারা নগরে আগুন লাগাবেন, আপনাদের দেবালয় সেই আগুনে টিকবে তো?
যারা কথায় কথায় রিকশাকে অবৈধ ঘোষণা করে দেন, ব্যাটারি খুলে নিয়ে যান, বুলডোজারে রিকশা গুঁড়িয়ে দেন তারা কি হিসাব করে দেখেছেন যে, দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে রিকশা চালনা পেশার অবদান কত? তারা কি হিসাব করে দেখেছেন যে, বাবা রিকশা চালানোর সুযোগ না পেলে কত লাখ শিশু স্কুল ছেড়ে শ্রমিকের খাতায় নাম লেখাবে? কত লাখ কৃষক পরের ফসলটা বোনার টাকা জোগাড় করতে পারবে না? রিকশাচালক স্বামীর পাঠানো টাকা জমিয়ে কত লাখ কিষানির দুধেল গাইটা আর নয়তো হাঁস-মুরগিটা কেনা হবে না?
সরেজমিন: টমটম লাইসেন্সের রমরমা বাণিজ্য
এই লেখা তৈরির সময়কালে এবং এর আগের প্রায় এক মাস লেখক কক্সবাজার সদর, বাজারঘাটা, বার্মিজ মার্কেট, খুরুশকুল, আলীর জাহাল, টার্মিনাল এবং কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় সরেজমিন অটোরিকশা (স্থানীয়ভাবে টমটম নামে পরিচিত) এবং ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, রিকশা গ্যারেজে গিয়েছেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধা বোঝার চেষ্টা করেছেন। রিকশাচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে, কক্সবাজার শহরে প্রায় ৫ হাজার টমটম রয়েছে যেগুলোর প্রতিটির যাত্রীধারণ ক্ষমতা ৮ জন (ড্রাইভারের দুই পাশে দুজন যাত্রী হিসেবে ধরে), এবং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ক্ষেত্রে লোকাল যাত্রী হিসেবে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা। কক্সবাজার শহরের রাস্তায় পায়ে টানা রিকশা নেই বললেই চলে, ব্যাটারিচালিত রিকশাও (দুজন যাত্রী বহন ক্ষমতাসম্পন্ন) খুব কম। অধিকাংশ টমটমই ভাড়ায় চালিত। গাড়ি কতটা নতুন সেই হিসাব বিবেচনায় ড্রাইভারদের জন্য প্রতিদিনের গাড়ির ভাড়া (দিনপ্রতি টমটম মালিককে প্রদেয় ভাড়া) নির্ধারিত হয় যা দিনপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, এর বাইরে রয়েছে দিনপ্রতি ২০০ টাকা ইলেকট্রিক চার্জের খরচ আর ১৭০ থেকে ১৯০ টাকা পৌরসভার লাইসেন্স বাবদ খরচ। এ ছাড়াও রয়েছে মাসিক ভিত্তিতে শ্রমিক সংগঠনের জন্য চাঁদা আর দিনপ্রতি ২০ টাকা টোকেন চার্জ (পৌরসভার নাম করে ওঠানো চাঁদা)। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় যে, বার্ষিক ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ৩০০ টাকা, গণপরিবহণ চালানোর অনুমতিপত্র ফি ৫০০ টাকা, বার্ষিক মোটর ক্যাব রুট পারমিট ফি ৩৫০ টাকা, বার্ষিক ফিটনেস ফি ৮০০ টাকা [১৯]।
টমটমের ফিটনেস, রুট পারমিট, লাইসেন্স ইত্যাদি যদি অন্যান্য গণপরিবহণের মতো নিয়মমাফিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারিত এবং আদায় করা হতো তাহলে সাকুল্যে প্রতিটি টমটম ড্রাইভারের খরচ হতো বছরে ১ হাজার ৯৫০ টাকা। অথচ কক্সবাজারে প্রতিটি টমটম চালক প্রতি মাসে এই খাতে খরচ করছেন ৫ হাজার ১০০ টাকা আর বছরে খরচ করছেন ৬১ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রতিটি টমটম থেকে পৌরসভা লাইসেন্স ফি-র নামে বাড়তি আদায় করা হচ্ছে ৫৬ হাজার ১০০ টাকা।
অর্থাৎ টমটমের ফিটনেস, রুট পারমিট, লাইসেন্স ইত্যাদি যদি অন্যান্য গণপরিবহণের মতো নিয়মমাফিক যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারিত এবং আদায় করা হতো তাহলে সাকুল্যে প্রতিটি টমটম ড্রাইভারের খরচ হতো বছরে ১ হাজার ৯৫০ টাকা। অথচ কক্সবাজারে প্রতিটি টমটম চালক প্রতি মাসে এই খাতে খরচ করছেন ৫ হাজার ১০০ টাকা আর বছরে খরচ করছেন ৬১ হাজার ২০০ টাকা। অর্থাৎ বছরে প্রতিটি টমটম থেকে পৌরসভা লাইসেন্স ফি-র নামে বাড়তি আদায় করা হচ্ছে ৫৬ হাজার ১০০ টাকা। যদি ধরে নিই যে কক্সবাজারে থাকা ৫ হাজার টমটমের মধ্যে ৪ হাজার টমটম নিয়মিতভাবে রাস্তায় নামছে, তাহলে সম্মিলিতভাবে প্রতিবছর কেবল কক্সবাজারেই টমটম চালকদের কাছ থেকে লাইসেন্স ফি-র নামে আদায় করা হচ্ছে ২২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা! এই লাইসেন্সগুলোর মালিক কারা? এই টাকা যাচ্ছে কোথায়? কথা বলে জানা যায় যে, কক্সবাজারে টমটমের নতুন লাইসেন্স গত কয়েক বছর ধরে দেওয়া হচ্ছে না। আগেই নেওয়া লাইসেন্সগুলোর মালিকরা এখন এগুলো ভাড়ায় খাটাচ্ছেন আর চালকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করছেন। কোনো ড্রাইভার যদি টমটমের লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে চায় তবে মালিকানা হাতবদলে খরচ পড়বে ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা এবং এই রেট বছর বছর বাড়ছেই। ধরে নেওয়ার কারণ নেই যে, লাইসেন্স নিয়ে যে রমরমা দৈনিক বাণিজ্য চলছে সে ব্যাপারে পৌরসভা কিংবা পুলিশ কর্তৃপক্ষের কিছুই জানা নেই। বরং অন্যায্যভাবে আদায় করা এই ২২ কোটি টাকার বাঁটোয়ারা ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েই সবকিছু ম্যানেজ করে রাখা হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। আর দিনপ্রতি ২০০ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিয়েও টমটম চালকদের কপালে জুটছে বিদ্যুৎ চুরির তকমা! মাসে মাসে ৫ হাজার টাকা লাইসেন্স ফি দিয়েও তারা পাচ্ছেন না কোনো সেবা, পাচ্ছেন না প্রতিদিন টমটম নিয়ে পথে নামার নিশ্চয়তা।
(বছরখানেক আগে কক্সবাজারের টমটম চালকদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ৫০০ টাকা করে নিয়ে এই কার্ড দেওয়া হয়, যা প্রতিটি টমটমের ভেতরে ঝুলিয়ে রাখতে বলা হয় এবং এখনো অধিকাংশ টমটমে এই কার্ডটি ঝোলানো অবস্থায় দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে পর্যটকদের অধিকতর নিরাপত্তা ও সুবিধা প্রদানেই এই কার্ডটির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: যেই টমটমের ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না, যেই টমটমের লাইসেন্সের বৈধতা দেওয়া হয় না, যেই টমটম চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই; সেই টমটমে এ রকম একটা কার্ড ঝোলালেই পর্যটকরা নিরাপদ হয়ে যাবেন? এটা কি আদৌ পর্যটকদের সুবিধার জন্য দেওয়া হয়েছে, নাকি এর মাধ্যমেও কার্ড বাণিজ্য চলেছে? ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার স্বার্থে ছবির কার্ডের কিছু অংশ ঢেকে দেওয়া হলো।)
(প্রতিটি টমটমে বাধ্যতামূলকভাবে ঝোলানো কার্ডের কিউআর কোড স্ক্যান করলে ড্রাইভারের নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ফোন নম্বর, জন্মতারিখ জানা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে: এই তথ্যগুলো খোলা বইয়ের পাতার মতো পাবলিক করে দেওয়ার সঙ্গে পর্যটকদের নিরাপত্তার যোগসূত্র কোথায়? এই তথ্যগুলো পাবলিক করে দেওয়ার অধিকার কি কাউকে দেওয়া হয়েছে? টমটম ড্রাইভারের কি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে না, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে না? এখন এই পাবলিক করে দেওয়া তথ্যগুলো কোনো অপরাধী চক্র ব্যবহার করে যে টমটম ড্রাইভারদের সঙ্গে জালিয়াতি করবে না, এই নিশ্চয়তা কে দেবে?)
পরিশিষ্ট
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় রিকশা ও রিকশাচিত্র স্থান পাওয়ার ঘোষণার পর পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রিকশা নিয়ে আবেগে ভেসে যাওয়ার মাতম ছিল চোখে পড়ার মতো। এমনকি এ উপলক্ষ্যে বাংলা একাডেমি আয়োজন করে ‘আনন্দ সম্মিলনের’, যেখানে এ অর্জনকে রিকশা পেশা এবং রিকশাচিত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত সবার প্রতি উৎসর্গ করা হয় [২০]। অথচ রিকশাচালকদের বঞ্চিত জীবনের দুর্দশা লাঘবে কোথাও কোনো আলাপ নেই, প্রশাসনের মর্জিমাফিক রিকশা, অটোরিকশার চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণার বিরুদ্ধে সম্মিলিত কোনো প্রতিবাদ নেই, কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা কাটিয়ে তোলার কোনো আয়োজন নেই। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে পথে যাদের সস্তা শ্রমের বাহনে চড়ে আমরা নানান জায়গায় যাই; তাদের জীবন, সংসার আর টিকে থাকার নিরন্তর লড়াইয়ের প্রতি এতটা উন্নাসিকতা কি আমাদের পারস্পরিক সামাজিক সম্পর্কের ছিঁড়তে থাকা বুননের প্রতিচ্ছবি কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কেবল নিজ নিজ স্বার্থের খোপে বন্দি হয়ে, চলতে থাকা চারপাশের অনাচারের আগুনের আঁচ থেকে বেঁচে থাকাটাই যদি জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে, তাহলে সেই স্বার্থপরতার পাপ যে আমাদের কখনোই স্পর্শ করবে না, সেটা হতে পারে না।
মওদুদ রহমান: প্রকৌশলী, লেখক। ইমেইল: mowdudur@gmail.com
তথ্যসূত্র:
[১] Livelihoods services (2024). https://www.ilo.org/resource/livelihoods-services.
[২] Tao, T.C.H. and G. Wall (2009) ‘A Livelihood Approach to Sustainability’, Asia Pacific Journal of Tourism Research 14(2): 137-152.
[৩] সমকাল, ১৫ অক্টোবর, ২০২২, মাসে ৩০ কোটি টাকার বাণিজ্য অবৈধ রিকশায়
[৪] BBC News বাংলা (2019) ঢাকায় ৩০ শতাংশ রিকশাচালকই জন্ডিসে আক্রান্ত, বিলসের গবেষণা. https://www.bbc.com/bengali/news-48781895
[৫] Hasan, A.H.R. (2019) ‘Internal Migration and Employment in Bangladesh: An economic evaluation of Rickshaw Pulling in Dhaka City,’ in Springer eBooks, pp. 339–359. https://doi.org/10.1007/978-981-13-1537-4_12.
[৬] Karim, Md.R., Ph.D. and Salam, K.A. (2019) Organising the Informal Economy Workers: A study of rickshaw pullers in Dhaka City. BANGLADESH INSTITUTE OF LABOUR STUDIES-BILS. https://www.bilsbd.org/wp-content/uploads/2019/06/A-Study-of-Rickshaw-Pullers-in-Dhaka-City.pdf.
[৭] Tamanna, M. (2012) Rickshaw cycle Drivers in Dhaka : Assessing working conditions and livelihoods. https://thesis.eur.nl/pub/13171.
[৮] Mahmud, S. M. S., & Hoque, M. S. (2012). Management of Rickshaw in Dhaka City for Ensuing Desirable Mobility and Sustainability: The Problems and Options, ResearchGate.
[৯] Dhaka Tribune, 19 July, 2017, WB: Dhaka’s average traffic speed 7kmph, https://www.dhakatribune.com/bangladesh/dhaka/32349/wb-dhaka%E2%80%99s-average-traffic-speed-7kmph
[১০] Saadat, S.Y. et al. (2023) Reducing pollution for greening cities, CPD’S GREEN CITIES INITIATIVE. https://cpd.org.bd/resources/2023/09/Presentation-on-Reducing-Pollution-for-Greening-Cities.pdf.
[১১] Akbar, P., Couture, V., Duranton, G., & Storeygard, A. (2023). The Fast, the Slow, and the Congested: Urban Transportation in Rich and Poor Countries. https://doi.org/10.3386/w31642
[১২] বণিক বার্তা ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন নামছে নতুন ৪০টি ব্যক্তিগত গাড়ি. ঢাকার রাস্তায় প্রতিদিন নামছে নতুন ৪০টি ব্যক্তিগত গাড়ি.
[১৩] Siddique, A. R. M., & Kaiser, M. S. (2016). Financial and Performance Analyses of Microcontroller Based Solar-Powered Autorickshaw for a Developing Country. Journal of Engineering, 2016, 1–8. https://doi.org/10.1155/2016/5246435
[১৪] Gallagher, R. (1992). The Rickshaws of Bangladesh.
[১৫] বণিক বার্তা, ৪ মে, ২০২৪, বিদ্যুতে ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ক্যাপাসিটি চার্জ.
[১৬] Md. Zulkefa Rian and A. N. M. Mizanur Rahman, December, 2014, Study on Power
Consumption and Social Aspects of Battery Operated Auto-rickshaw. International
Conference on Mechanical, Industrial and Energy Engineering 2014.
[১৭] কালের কণ্ঠ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, দেশে বাড়ছে বৈদ্যুতিক গাড়ি বসছে চার্জিং স্টেশন. https://www.kalerkantho.com/feature/profit-loss/2024/02/25/1366547
[১৮] Jayanthakumaran, K., Verma, R., Wan, G., & Wilson, E. (2019). Internal Migration, Urbanization and Poverty in Asia: Dynamics and Interrelationships. In Springer eBooks. https://doi.org/10.1007/978-981-13-1537-4
[১৯] বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত, ডিসেম্বর ২৭, ২০২২, ১৯৬১৫-১৯৬১৯ < https://brta.gov.bd/site/page/720dc6b9-df0f-4877-a64f-100ea43d8576/- >
[২০] প্রথম আলো, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩, রিকশা ও রিকশাচিত্রের ইউনেসকোর স্বীকৃতি লাভে বাংলা একাডেমিতে ‘আনন্দ সম্মিলন’