অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ: একটি আলোকোজ্জ্বল পথরেখা

স্মরণ

অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ: একটি আলোকোজ্জ্বল পথরেখা

মকবুল আহমেদ

লেখক, রাজনৈতিক নেতা এবং শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ (১৯১৪-১৯৯৪) বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অনন্য অবস্থান অর্জন করেছেন। ‘ভূমিহীন কৃষকের কড়িহীন লেখক’ হিসেবেই তিনি নিজেকে পরিচিত করতেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তাই ছিলেন। তবে ‘ভূমিহীন কৃষক’ তার আক্ষরিক বর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তা সম্প্রসারিত হয়েছিল সবধরনের নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষে। সমাজের মূল ভারবাহী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুক্তির প্রশ্নটি ছিল লেখক চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর রাজনীতি, লেখালেখি ও চিন্তার বিশেষ গুরুত্ব এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।

কোনো মানুষের জীবন নিজের কাছে কিংবা তার আত্মীয়-পরিজনের কাছে মূল্যহীন নয়। কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবন ও তার সপ্রাণ তৎপরতা দেশের জন্য, স্বজাতির জন্য অমূল্য হয়ে ওঠে। বাঙালি ও বাংলাদেশের জন্য এ মহাপ্রাণদের একজন ছিলেন অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ (জন্ম: ১৯১৪ খ্রি., মৃত্যু: ২৮ মে ১৯৯৪ খ্রি.)। দেশের মানুষের জন্য তার চিন্তা ও তৎপরতা চিরদিনের জন্য থেমে গিয়েছে ১৯৯৪ সালের ২৮ মে তারিখে। চিন্তা থেমে গেছে না বলে বলা যেতে পারে, একজন মানবদরদি আসহাব উদ্দীন আহমদের সপ্রাণ তৎপরতা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তার চিন্তা থেমে গেছে কথাটা বলতে না চাওয়ার পক্ষে যুক্তি হলো: মানুষ, সমাজ জীবন ও জগৎকে ঘিরে তার যে চিন্তা গড়ে উঠেছিল, সেই চিন্তা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার বিপুল রচনাসম্ভারে। রচনাবলিতে (আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত ৩ খণ্ডে প্রকাশিত অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ রচনা সমগ্র) সুগ্রথিত তার চিন্তা বাঙালিকে সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য চিরদিন সক্রিয় থাকবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে, সমাজের প্রয়োজনীয় জরুরি দাবিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য, কিংবা কোনো অসহায় বিপন্ন মানুষের পাশে সকল সামর্থ্য নিয়ে এসে দাঁড়ানোর জন্য আসহাব উদ্দীন আহমদের যে আকুলতা ছিল, বলতে গেলে তার জীবনের সাধনা ছিল, সেই অনন্যসাধারণ তৎপরতা ১৯৯৪ সালের ২৮ মে থেমে যায়।

সমাজের লোকেরা আসহাব উদ্দীন আহমদকে মহাপ্রাণ, মহান ব্যক্তিত্ব, অমূল্য জীবনের অধিকারী প্রভৃতি বলার অর্থ কী? নিতান্ত সাধারণ, সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে তিনি যে জীবন অতিবাহিত করেছেন, শুধু তার জন্য আমরা তাকে অসাধারণ ব্যক্তি বলছি না। প্রকৃতপক্ষে মানুষ একজন থেকে আরেকজনে আলাদা হয় তার চিন্তার বৈশিষ্ট্যের গুণে। সমাজ ও বিশ্বচরাচর সম্পর্কে মানুষের যে বোধ ও চেতনা গড়ে ওঠে, সেই চিন্তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষ সমাজে আচরণ করে। সেই আচরণের মধ্য দিয়ে একজন মানুষের চিন্তার বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। চিন্তার সেই বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা দিয়েই সমাজে একজন ব্যক্তির স্থান নির্ধারিত হয়। সেই চিন্তা ও তৎপরতার জন্যই আমরা কাউকে বলি ভালো বা মন্দ কিংবা অসাধারণ। এই চিন্তার উৎকৃষ্টতার জন্যই অতি সহজ, সাধারণ জীবনযাপন করেও আসহাব উদ্দীন আহমদ হয়ে উঠেছিলেন অনন্যসাধারণ।

যে চিন্তা মানুষকে সমাজে তার স্থান নির্ধারণ করে দেয় এবং লক্ষ-কোটি মানুষের মধ্যে তাকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে, তা পাওয়া যায় কোথায়? মানুষের চিন্তাকে চর্চা করতে হয়, চিন্তা ব্যক্তিকে অর্জন করে নিতে হয়। আমাদের মনে হতে পারে, সমাজের সকল মানুষই তো চিন্তা করে কিংবা চিন্তার চর্চা করে। আসলে সমাজের সকল মানুষ চিন্তা বা চিন্তার চর্চা করে না। সমাজের অধিকাংশ মানুষ জন্ম নিয়ে সমাজের বিদ্যমান বিধি-ব্যবস্থা রপ্ত করে এবং তাতে অভ্যস্ত হয়ে সেই অভ্যাসই পালন করে। সমাজে ও রাষ্ট্রে যে বিধি-ব্যবস্থা মানুষ তৈরি করেছে, কিংবা বিশ্ব প্রকৃতির যে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ মানুষ হাজির করেছে, তার প্রতি সচেতন মনোযোগ এবং তাকে বিবেচনা ও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রয়াস খুব কম লোকই করে থাকে।

মানবজাতির ইতিহাসে মানুষের চিন্তারও একটি ইতিহাস আছে। চিন্তার সেই ইতিহাসে পৃথিবীর জাতিসমূহের মধ্যে একেক জাতি একেক অবস্থানে জায়গা করে নিয়েছে। ইতিহাসের সেই স্থানানুযায়ী জাতিসমূহের মর্যাদা নির্ণীত হচ্ছে। আবার একটি জাতির ভেতরে সকল ব্যক্তির চিন্তার অবস্থানও এক নয়। একই দেশে একই কালে এবং একই জাতির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও মানুষ চিন্তার একেক ধাপে একেকজন অবস্থান করতে পারে। চিন্তার ইতিহাসে অগ্রসর ধাপে যার অবস্থান, সেই অবস্থানে উঠে আসার একটি অভিজ্ঞতা ও তা অর্জনের একটি ইতিহাস থাকে। যার-যার কালে চিন্তার সেই উন্নত অবস্থান অর্জন করে নিতে পারার কৃতিত্বের জন্য কোনো-কোনো ব্যক্তির জীবন অমূল্য হয়ে ওঠে। আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবনের অসাধারণত্ব সেখানে। তার চিন্তা কি এবং তার কালে তা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে পারলেই আমরা তার মহিমামণ্ডিত জীবনের তাৎপর্য সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে পারব।

আসহাব উদ্দীন আহমদ জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালে একটি ঔপনিবেশিক দেশের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর নামক গ্রামে। সেই সমাজে শিক্ষা-দীক্ষায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙালি হিন্দুদের তুলনায় বাঙালি মুসলমানের অবস্থা ছিল অনেক খারাপ। এই খারাপ অবস্থার মধ্য থেকে বাঙালি মুসলমানের মধ্যবিত্ত পরিবারের যেসব সন্তান উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের অধিকাংশের লক্ষ্য ছিল দেশের জনগণের পরাধীনতা নয়, সমাজের মানুষের মানবেতর জীবনযাপনের দৈন্যদশা নয়, দুনিয়ার কোথায় সাবেকি সমাজে রূপান্তরের হাওয়া লেগেছে কিংবা মানবিক বিজ্ঞান-দর্শনের উন্মেষ ঘটেছে– সেদিকেও নয়; শাসক শ্রেণির কৃপায় ঔপনিবেশিক শাসনের কালাকানুনে মদত জুগিয়ে সুযোগ-সুবিধা ও অনায়াসে আরাম-আয়েশ ভোগ করার জায়গাটি দখল করা। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও কূপমণ্ডূক চিন্তা তাদের মগজকে আবৃত করে রেখেছিল। সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য সে সমাজে জন্ম নিয়ে আসহাব উদ্দীন আহমদ দাঁড়ালেন সামন্ততান্ত্রিক শাসন-শোষণ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, প্রচলিত ও সাবেকি চিন্তাচেতনার পক্ষে নিজের মগজকে ডুবিয়ে না রেখে তিনি তার চিন্তাকে সজাগ করলেন এবং সক্রিয় করলেন বিদ্যমান অন্যায় ও অমানবিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে। এখন তা বলা যত সহজ, তখন করা তত সহজ ছিল না।

সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি যে সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য সে সমাজে জন্ম নিয়ে আসহাব উদ্দীন আহমদ দাঁড়ালেন সামন্ততান্ত্রিক শাসন-শোষণ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে।

তিনি সমাজের অসাম্য ও অন্যায্য বিধিবিধানের বিরুদ্ধে তার সচেতন চিন্তা ও সক্রিয় তৎপরতাকে দাঁড় করাতে গিয়ে সমাজের সকল মানুষের কল্যাণকামী, বিশেষ করে নিপীড়িত শ্রেণির স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী মতবাদ মার্কসবাদ বা সমাজতন্ত্রের দর্শনকে জনগণের সামনে হাজির করার রাজনীতিতে যুক্ত হলেন। রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার প্রয়োগে সফলতা-বিফলতা নিয়ে আজকাল যত বিতর্ক হোক না কেন, গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের আদর্শের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বহু অনগ্রসর ও নিপীড়িত জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারলেও, আমাদের এই অঞ্চলে শাসক শ্রেণির দৃষ্টিতে সমাজতন্ত্র ছিল একটি নিষিদ্ধ শব্দ। সমাজতন্ত্র বিষয়টি জনগণের কাছেও ছিল অপরিচিত ও অনেকটা কুয়াশাবৃত। নিজ সমাজের কাছে অপরিচিত কিন্তু শাসক শ্রেণির কাছে ভীতি-জাগানো মানবতাবাদী ও সাম্যবাদী সমাজের মতাদর্শ মার্কসবাদী চিন্তার সঙ্গে আসহাব উদ্দীন আহমদের পরিচয় ঘটা এবং সেই চিন্তাকে নিজের চিন্তার মধ্যে আত্মস্থ করে নেওয়ার ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ। সেই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ঘটতে পারার জন্যই আসহাব উদ্দীন আহমদ হয়ে ওঠেন অন্য দশজন থেকে আলাদা, হয়ে ওঠেন অপরের জন্য অপরিহার্য। এভাবে তিনি হয়ে ওঠেন দেশের জন্য, সমাজের জন্য অমূল্য জীবনের অধিকারী। একজন বিপ্লবীর জীবনের তৎপরতা যখন আর শুধু নিজেকে ঘিরে আবর্তিত হয় না, তখন তার জীবন হয়ে ওঠে সর্বজনের সম্পদে। তখন তিনি আর শুধু পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন বা বন্ধু বলে সামাজিক স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকেন না, তিনি হয়ে ওঠেন একজন ‘কমরেড’। এ জন্য একজন বিপ্লবীর বা কমরেডের জীবন অমূল্য; যা দাম দিয়ে পাওয়া যায় না, যার অভাব অন্য একজন সাধারণ ব্যক্তিকে দিয়ে পূরণ হয় না।

নিজ সমাজের কাছে অপরিচিত কিন্তু শাসক শ্রেণির কাছে ভীতি-জাগানো মানবতাবাদী ও সাম্যবাদী সমাজের মতাদর্শ মার্কসবাদী চিন্তার সঙ্গে আসহাব উদ্দীন আহমদের পরিচয় ঘটা এবং সেই চিন্তাকে নিজের চিন্তার মধ্যে আত্মস্থ করে নেওয়ার ঘটনাটি তাৎপর্যপূর্ণ।

সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষের কর্মতৎপরতার মধ্যে আমরা একজনের অভাব, একজনের কাজ অন্যজনকে দিয়ে মিটিয়ে নিতে পারি। একজন শিক্ষকের, একজন ইঞ্জিনিয়ারের, একজন ডাক্তারের কাজ, একজনের অভাবে অন্য আরেকজনকে দিয়ে করানো যায় সহজে। কিন্তু একজন বিপ্লবীর কাজ সমাজের অন্য যে কোনো পেশার দক্ষ লোক দিয়েও সম্পাদন করানো দুঃসাধ্য। একজন বিপ্লবীর কাজের প্রতিস্থাপন সমাজের অন্য আর কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে হয় না। সমাজে একজন বিপ্লবীর আবির্ভাবও প্রতিনিয়ত ঘটে না। সে জন্য একজন বিপ্লবীর জীবন ও কর্ম নিয়ে দেশ গৌরব বোধ করে।

মার্কসবাদ শুধু সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থা সংবলিত রাষ্ট্র গড়ার মতবাদ ছিল না। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিধিবিধানের কথা বাদ দিলেও মানবেতিহাসে দর্শনের বিকাশের ধারায় মার্কস-এঙ্গেলসের অভূতপূর্ব অবদান ছিল অনস্বীকার্য। সমাজ ও জগৎকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের যে পদ্ধতি দর্শনের বিকাশে মার্কস সংযোজন করেছিলেন, তাতে মানবজাতির চিন্তার কুহেলিকা অপসৃত হয়ে দর্শন দাঁড়াতে পেরেছিল একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ওপর। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্যের যে ব্যাখ্যা মার্কস মানবজাতির সামনে হাজির করেন, সমাজের ভবিষ্যৎ রূপান্তরের জন্য তা হয়ে ওঠে অমোঘ পাথেয়। প্রকৃতি ও সমাজ বিকাশের নিয়মের ব্যাখ্যায় মার্কস যে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন তা এখনো নাকচ হয়ে যায়নি। দর্শনের ইতিহাসে কর্তৃত্বকারী মার্কসের অনন্য সেই চিন্তাকে আসহাব উদ্দীন আহমদ গ্রহণ করেছিলেন। তাতেই তার চিন্তা ও তৎপরতার রূপ নিয়েছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারায়।

যারা আসহাব উদ্দীন আহমদকে ভালোবাসেন, তার জীবনাচরণকে পছন্দ করেন, তা আসলে তার চেহারার আকার-আকৃতির জন্য করেন না, তার জাতি-ধর্ম পরিচয়ের জন্যও না; তারা তা করেন আসহাব উদ্দীন আহমদের অগ্রসর ও বিশিষ্ট চিন্তাচেতনার জন্য। সেই অগ্রসর ও বিশিষ্ট চিন্তাটি হলো কার্ল মার্কসের চিন্তাভাবনার প্রতি তার একনিষ্ঠতা। মার্কসের চিন্তা ও চেতনার প্রতি কারো বিন্দুমাত্র পরিচয় থাক বা না থাক, আসহাব উদ্দীন আহমদের চিন্তার প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ ও ভালোবাসা তা প্রকারান্তরে কার্ল মার্কসের চিন্তার প্রতি আকর্ষণ বৈকি!

একটি পশ্চাৎপদ সমাজের রূপান্তরের জন্য আসহাব উদ্দীন আহমদ তার সমগ্র জীবনকে যেভাবে পরিচালিত করেছিলেন তা আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করে দেখতে পারি। তার জীবনের প্রথম অংশ শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষকতার জীবন, দ্বিতীয় অংশ সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন, তৃতীয় অংশ লেখক জীবন। পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তার জীবনের প্রতিটি পর্বের চালিকাশক্তির উৎস একই অভিন্ন চিন্তাসূত্রে গাঁথা। তা হলো, বিপন্ন ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর আকুলতা। সেই চিন্তা থেকে তিনি সারা জীবনে এক মুহূর্তের জন্য এক চুলও সরে দাঁড়াননি।

বাঙলাদেশ লেখক শিবিরের সম্মেলনে অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ (মাঝখানে)। তাঁর ডানদিকে হাসান আজিজুল হক ও আনু মুহাম্মদ; বাঁদিকে আবদুল মতিন খান ও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ১৯৯৩।

কর্মজীবনের শুরুতে তিনি শিক্ষকতার পেশাকে তার পছন্দের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। জ্ঞানচর্চার কাজকে আসহাব উদ্দীন আহমদ জীবনের সাধনা হিসেবে মানতেন। আমৃত্যু পড়ার প্রতি তার যে প্রবল আগ্রহ তা তার নিজের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখতেন না। জ্ঞানের পরিপূর্ণতায় ও জীবনের অভিজ্ঞতায় চেতনাকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত তিনি অপরকেও পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। জনগণের মধ্যে শিক্ষা ও সচেতনতা প্রসারের লক্ষ্যে ও জ্ঞানতৃষ্ণা মেটানোর প্রয়োজনে সারা জীবন তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও লাইব্রেরি গড়ার কাজে নিবেদিত ছিলেন। নিজের এলাকায় বাঁশখালী কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাইস্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা ও তার উন্নতি সাধনের প্রতি তার যে নিরলস নিষ্ঠা ছিল তা নেহাত উচ্চ আকাঙ্ক্ষাবশত ছিল না, তা শিক্ষার প্রতি তার একাগ্রতা ও জনগণের মধ্যে শিক্ষা সম্প্রসারণের প্রতি তার আন্তরিকতার জন্যই হয়েছিল। আরও বৃহত্তর দায়িত্বের আহ্বানে, বাংলা ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে অধ্যাপনার পেশাকে তিনি পরিত্যাগ করলেও সারা জীবন তিনি নিজের শিক্ষা-দীক্ষা ও অপরের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির কাজ থেকে কখনো নিজেকে নিবৃত্ত রাখেননি।

নিজের এলাকায় বাঁশখালী কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, সাধনপুর পল্লী উন্নয়ন হাইস্কুল, পশ্চিম বাঁশখালী হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা ও তার উন্নতি সাধনের প্রতি তার যে নিরলস নিষ্ঠা ছিল তা নেহাত উচ্চ আকাঙ্ক্ষাবশত ছিল না, তা শিক্ষার প্রতি তার একাগ্রতা ও জনগণের মধ্যে শিক্ষা সম্প্রসারণের প্রতি তার আন্তরিকতার জন্যই হয়েছিল।

তার জীবনের দ্বিতীয় অংশের রাজনৈতিক জীবন বহু আনন্দ-বেদনার, বহু বর্ণময় অভিজ্ঞতার। যে রাজনৈতিক দীক্ষা ও জীবনজয়ের ব্রত নিয়ে আসহাব উদ্দীন আহমদ পথযাত্রা শুরু করেছিলেন তা বহু আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে। তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সার্বিক সফলতা-বিফলতা দেশের তথা তৎকালীন পাকিস্তান রাজনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতির সফলতা-বিফলতার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাকে যে তার এলাকার জনগণ ভালোবাসেন তা আজ প্রশ্নাতীত। সেটা এক ধরনের তার রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতাকে ভালোবাসার শামিল। যেহেতু তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তা ও আদর্শ থেকে কখনো সরে দাঁড়াননি, এবং তার সমগ্র জীবনটা তিনি পরিচালিত করেছিলেন তার রাজনৈতিক জীবনাদর্শের আলোকে। তার চিন্তার বিপর্যয় ঘটানোর মতো দুর্বলতা জীবনের কোনো মুহূর্তে তিনি কখনো দেখাননি। তাকে ভালোবাসার মাধ্যমে সেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অপরাজিত চিন্তার কর্তৃত্বকেই মানুষ ভালোবেসেছে, সম্মান জানিয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান শাসক শ্রেণির মহলে শামিল হওয়ার সিঁড়িতে যে পঙ্কিল ধাপগুলো রয়েছে, তাতে পা ফেলার হীন প্রচেষ্টা এবং লোভনীয় দুর্বলতা তার চিন্তায় কখনো উঁকি দেয়নি। এমনকি পাকিস্তান আমলের অধ্যাপনার চাকরিটাও তিনি স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করার মতো দুঃসাহস দেখাতে পেরেছিলেন নিজেকে জনগণের জন্য আরও অপরিহার্য ও আরও সহজলভ্য করার জন্য। তার রাজনৈতিক চিন্তার ব্যর্থতার প্রশ্নই ওঠে না।

আসহাব উদ্দীন আহমদের জীবনের সবচেয়ে আলোকোজ্জ্বল অংশ লেখালিখির জীবন। তার লেখক-জীবনে আর্থিক অনটনের অবস্থায় পড়ে নিজেকে নিয়েও তিনি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছেন ভূমিহীন কৃষকের সঙ্গে নিজের কড়িহীন লেখক-জীবনের তুলনা দিয়ে। নিজের অর্থনৈতিক দৈন্যদশাকে নিয়ে তিনি সরস রসিকতা করতে জানতেন। আসহাব উদ্দীন আহমদ বাংলা ভাষার একজন ভিন্ন ও বিরল ধারার লেখক। সমাজের বৈরী সম্পর্ক, নিপীড়িত মানুষের বেদনাক্লিষ্ট জীবন-কাহিনি, শাসক শ্রেণির অন্তঃসারশূন্য লক্ষ্য ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, এমন জনবোধ্য ভাষায় চিত্রিত করেছেন কম লেখকই। তার প্রতিটি গ্রন্থের বিষয়বস্তুতে ও গ্রন্থের নামকরণে সমাজের নানা অসংগতি ফুটে উঠেছে। যেমন: বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, ধার, সের এক আনা, জান ও মান, বন্দে ভোটরম (ইংরেজি), হাতের পাঁচ আঙুল, বাঁশ সমাচার, বিপ্লব বনাম প্রতি বিপ্লব, দাড়ি সমাচার, ঘুষ, দাম শাসন দেশ শাসন, ভূমিহীন কৃষক কড়িহীন লেখক, লাথি লাঠি গণতন্ত্র, শিকল ভাঙার গান, নতুন বোতলে পুরোনো মদ, বোকা মিয়ার ইতিকথা, উজান স্রোতের জীবনের ভেলা প্রভৃতি লেখা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বাংলা ভাষায় প্রতিবাদী রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ ও জনবোধ্য ভাষায় সমাজসচেতন ব্যঙ্গ রচনার ধারায় আসহাব উদ্দীন আহমদ একজন সফল ও প্রধান লেখক। তার মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় একুশে পদক প্রাপ্তির কথা বাদ দিলেও এই সফলতা ও কৃতিত্ব তিনি তার জীবৎকালেই পেয়েছেন। সাহিত্য রচনার পেছনেও আসহাব উদ্দীন আহমদকে অনুপ্রাণিত করেছে মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও প্রতিবাদী চেতনাবোধ। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত মানুষের প্রতি মমতাবোধের কথা, মানুষের প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পাদন করে দিতে তার সাহায্য করার দায়িত্ববোধের কথা, তিনি কখনো বিস্মৃত হতেন না। সেই কর্তব্যবোধে উজ্জীবিত হয়ে সাধারণ মানুষের জন্য নিবেদিত থেকেছেন সারা জীবন। নিরলসভাবে খেটেছেন একজন সাধারণ কর্মীর মতো। জীবনের প্রতি ও সাধারণ মানুষের প্রতি তার এই অঙ্গীকার তার সকল লেখায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে।

সমাজের বৈরী সম্পর্ক, নিপীড়িত মানুষের বেদনাক্লিষ্ট জীবন-কাহিনি, শাসক শ্রেণির অন্তঃসারশূন্য লক্ষ্য ও স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা এমন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, এমন জনবোধ্য ভাষায় চিত্রিত করেছেন কম লেখকই। তার প্রতিটি গ্রন্থের বিষয়বস্তুতে ও গ্রন্থের নামকরণে সমাজের নানা অসংগতি ফুটে উঠেছে। যেমন: বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর, ধার, সের এক আনা, জান ও মান, বন্দে ভোটরম (ইংরেজি), হাতের পাঁচ আঙুল, বাঁশ সমাচার, বিপ্লব বনাম প্রতি বিপ্লব, দাড়ি সমাচার, ঘুষ, দাম শাসন দেশ শাসন, ভূমিহীন কৃষক কড়িহীন লেখক, লাথি লাঠি গণতন্ত্র, শিকল ভাঙার গান, নতুন বোতলে পুরোনো মদ, বোকা মিয়ার ইতিকথা, উজান স্রোতের জীবনের ভেলা প্রভৃতি লেখা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমাদের সমাজে অনেক উচ্চশিক্ষিত, বয়স্ক পণ্ডিত ব্যক্তি রয়েছেন; তাদের অনেকে যখন সমাজের অনাচার, ভেদনীতি, পশ্চাৎপদ চিন্তা লালন করেন কিংবা সবকিছু চোখ বুঝে মেনে নিয়ে লক্ষ-কোটি মূক মানুষের স্বার্থ পদদলিত করে মায়াময় সোনার হরিণটি ধরার জন্য গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দেন, সেই সমাজে একজন আসহাব উদ্দীন আহমদ স্রোতের উজানে জীবন-ভেলায় চড়ে জীবনজয়ের গান, মানুষের ভালোবাসা ও আনন্দের গান গাইতে-গাইতে তীরে পৌঁছে গেলেন। রেখে গেলেন আমাদের জন্য একটি আলোকোজ্জ্বল পথরেখা।

মকবুল আহমেদ: অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক। ই-মেইল: moqbul.coast@gmail.com

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •