ন্যূনতম মজুরি ও গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন
শামীম ইমাম
বাংলাদেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নাই। বিভিন্ন খাতওয়ারী যে মজুরি নির্ধারণ করা হয় তার পরিমাণ দারিদ্রসীমার অনেক নীচে এবং সেটাও নিয়মিত পরিশোধ করা হয় না। এসব নিয়ে নানা ছলচাতুরী প্রতারণা চললেও শ্রমিকদের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিব্যবস্থা সংগঠন সবই খুব দুর্বল। তাছাড়া নিয়মিত মজুরি পুনর্বিন্যাসের কথা থাকলেও কখনোই তা হয় না, প্রতিবারই দাবিদাওয়া আন্দোলন সংগ্রাম দরকার হয়। নিপীড়ন জখম এমনকি শ্রমিক খুনের ঘটনাও ঘটে। তারপরও মজুরি এবং অন্যান্য দাবিদাওয়া অপূর্ণই থাকে। এই লেখায় এ নিয়ে পোশাক শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন ও মজুরি পরিস্থিতি আলোচনা করা হয়েছে।
প্রত্যেক মানুষকে বাঁচার জন্য কাজের জন্য খাওয়া, পরা, থাকাসহ মৌলিক চাহিদাসমূহ কম-বেশি পূরণ করতে হয়। দরকার বিনোদন ও বিশ্রাম। প্রয়োজন হয় ন্যূনতম কিছু পণ্য ও সেবার। এগুলো পেতে একজন ব্যক্তির যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তা হিসাব করেই জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হবার কথা। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে খেয়াল রাখার কথা যাতে তা শ্রমিকদের আয় কমপক্ষে দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে রাখতে পারে। পৃথিরীর বেশিরভাগ দেশে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের আইনগত কাঠামো আছে। আমাদের দেশে কোনো জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নেই।
ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার এয়ার ভাইস মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে এ দেশে গঠিত প্রথম মজুরি কমিশন তৎকালীন বাজারদর বিবেচনা করে ৪ সদস্যের একটি শ্রমিক পরিবারের প্রয়োজনীয় খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা (শিক্ষা বাদে) খরচ হিসাব করে, মূল মজুরি ১২৫ টাকাসহ প্রান্তিক ভাতা ৩০ টাকা ধরে সর্বমোট ১৫৫ টাকা ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ করে। তৎকালীন বাজারদরে উক্ত মজুরিতে প্রায় সাড়ে ৬ মণ চাল পাওয়া যেত। যার দাম বর্তমান বাজারদরে ১৫ হাজার ৬০০ টাকা। বাংলাদেশ আমলেও একবার ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা ওই সময়ে মালিকপক্ষ কর্তৃক আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া, সরকারের মালিকহিতৈষী মনোভাব এবং শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার কারণে স্থগিত/বাতিল হয়ে যায়।
শুধু চালের দরের সঙ্গে তুলনা করেই নয়, সমগ্র বাজারদরের সঙ্গে তুলনা করলেও দেখা যাবে স্বাধীনতার পর থেকে এই ৫৩ বছরে টাকার অংকে বাড়লেও শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ক্রমেই কমেছে। এভাবে বিগত ৫৩ বছরে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প-কলকারখানার শ্রমিকরা হাজার হাজার কোটি টাকার মজুরি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনানুযায়ী– শ্রমিকদের ইতোমধ্যে অর্জিত কোনো আইনি অধিকার কর্তন করা যায় না। বাস্তব কারণেই শুধু খাতওয়ারি ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির দাবি নয়, পাশাপাশি ‘জাতীয় ন্যূনতম মজুরি’ নির্ধারণ হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ দাবি।
এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহু শ্রমিকের প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে ৪৩টি শিল্পের জন্য খাতওয়ারি ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পের জন্মলগ্ন থেকেই বাজারদরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মজুরি তথা ন্যায্য মজুরি ও বকেয়া মজুরি-ভাতা পাওয়ার দাবিতে আন্দোলন জারি রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বকেয়া মজুরি-ভাতা পাওয়া, শ্রমিক নির্যাতন ও ছাঁটাই বন্ধ এবং ন্যূনতম মূল মজুরি (বেসিক) ১৬ হাজার ২৫০ টাকা ও মোট মজুরি ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন দেখা দেয়।
দেশের প্রচলিত শ্রম আইনানুযায়ী প্রতি ৫ বছর পরপর ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করার কথা। আবার প্রয়োজনে ৫ বছরের আগেও ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ করার কথা বলা আছে (বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬, ধারা ১৩৯ ও ধারা ১৪০ক)। কিন্তু চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধিসহ জীবনযাপন ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ার পরও মালিক ও সরকারের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে মজুরি পুনর্নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের দাবি প্রচারসহ সভা-সমাবেশ-মিছিলের মধ্য দিয়ে আন্দোলন শুরু করে। ২০২২ সালের শুরু থেকে অবিলম্বে পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা ঘোষণা করা, তার বাস্তবায়নের আগে ৬৫ শতাংশ মহার্ঘভাতা প্রদান করা, গ্রেড চুরি বন্ধে অপারেটরদের ২টি গ্রেড নির্ধারণ করা, সব গ্রেডে একই হারে মজুরি বৃদ্ধি করা, সোয়েটার ও পিস রেটে কর্মরত শ্রমিকদের কাজের আগে মজুরি নির্ধারণ ও ডাল সিজনে পূর্ণ বেসিক দেওয়া, সোয়েটারে ৩ শিফট ও ওভারটাইম নিশ্চিত করা; ইপিজেড-ইপিজেডের বাইরে সবখানে সমান হারে মজুরি বৃদ্ধি ও মূল মজুরির ১০ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেওয়া, বাধ্যতামূলক অংশীদারত্বমূলক প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করা; দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধে চাল, ডাল, তেল, শিশুখাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য রেশন কার্ডের মাধ্যমে বিতরণের লক্ষ্যে স্থায়ীভাবে রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা, শ্রমিকদের জন্য জীবনবিমা, চিকিৎসা, শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিতে সরকার ও মালিকের উদ্যোগ নেওয়া; শ্রমিক ছাঁটাই, মিথ্যা মামলা-হামলা ও নির্যাতন বন্ধ করা এবং শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিক ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দাবিতে শ্রমিকদের বিভিন্ন কর্মসূচী দেখা যায়। পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে ‘ধর্মঘট নিষিদ্ধকরণের অত্যাবশ্যক পরিষেবা বিল, ২০২৩’ বাতিল করার দাবিটি যুক্ত হয়।
ন্যূনতম মজুরি ২৫ হাজার টাকা দাবির ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা
১৯৮৭ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৪২৭ টাকা, ১৯৯৪ সালে ৯৩০ টাকা, ২০০৬ সালে ১৬৬২.৫০ টাকা, ২০১০ সালে ৩ হাজার টাকা, ২০১৩ সালে ৫ হাজার ৩০০ টাকা, ২০১৮ সালে ৮ হাজার টাকা। শ্রমিকদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী প্রকৃত শ্রমিক সংগঠনের অভাব, ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা, দালালি ও সুবিধাভোগী স্বভাব, মালিকদের অনীহা, মজুরি বোর্ড ও সরকারের দায়িত্বহীনতার ফলে যথাসময়ে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট’ হিসাব করে দেখিয়েছে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করলে (যদিও বাস্তবে ১৪/১৬ ঘণ্টা হরহামেশা শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন) একজন পুরুষ শ্রমিকের ৩৩৬৪ কিলোক্যালরি এবং নারী শ্রমিকের ২৪০৬ কিলোক্যালরি তাপ দেহে (যদিও নারীদের মাতৃত্বকালীন অনেক বেশি দরকার হয়) প্রয়োজন হয়। আর নর-নারী নির্বিশেষে গড়ে (৩৩৬৪+২৪০৬/২) ২৮৮৫ কিলোক্যালরি তাপ উৎপাদন সংবলিত খাদ্য প্রয়োজন। এরও কম ২৮০০ কিলোক্যালরি তাপ শক্তি উৎপাদন করতে পারে শরীরে এমন খাদ্য গ্রহণ করার জন্য খাদ্য খরচ পড়বে ১৭৪ টাকা প্রতিদিন। আমাদের বাজারে যে সস্তা নিম্নমানের খাবার পাওয়া যায় তার হিসাবেও প্রতিদিন গড়ে এই টাকা খরচ হবে। এখন আমরা যদি ৫ জনের একটি পরিবারের মাসিক খরচের হিসাব করি, তাহলে লাগে সর্বমোট ৪০ হাজার ৫০০ টাকা।
দৈনিক খাওয়া খরচ
ক্রমিক | খাবারের নাম | পরিমাণ | ক্যালরি | মূল্য (টাকায়) |
১. | চাল | ৫০০ গ্রাম | ১৮০০ | ৩০.০০ |
২. | ডাল/ছোলা | ৬০ গ্রাম | ২০০ | ১৬.০০ |
৩. | সয়াবিন তেল | ৫০ মি.লি. | ৪৫০ | ১০.০০ |
৪. | ডিম | ১টা | ৭০ | ১২.০০ |
৫. | মাছ | ৬০ গ্রাম | ৮০ | ১২.০০ |
৬. | আলু | ১০০ গ্রাম | ১০০ | ৪.০০ |
৭. | শাকসবজি | ১৫০ গ্রাম | ৫০ | ৯.০০ |
৮. | লবণ-মরিচ-হলুদ-মসলা | — | — | ২০.০০ |
৯. | ফল (কলা/আমড়া) | ১টা | ৫০ | ১০.০০ |
১০. | জ্বালানি (লাকড়ি/কেরোসিন/গ্যাস) | — | — | ৩৫.০০ |
১১. | চা | ২ কাপ (দিনে) | — | ১৬.০০ |
সর্বমোট = | ২৮০০ কিলোক্যালরি | ১৭৪.০০ টাকা |
একটি শ্রমিক পরিবারের ন্যূনতম মাসিক খরচ:
মাসিক খরচের খাত | হিসাব | মোট |
১। খাওয়ার খরচ | ১৭৪ টাকা × ৫ জন × ৩০ দিন | ২৬,১০০ টাকা |
২। ঘরভাড়া | ৪,৫০০ টাকা | |
৩। চিকিৎসা পুরো পরিবার (গড়ে) | ২,০০০ টাকা | |
৪। যাতায়াত ভাতা | ৯০০ টাকা | |
৫। শিক্ষা খরচ | ২ জন শিশু প্রত্যেকের ২,০০০ টাকা (গড়ে) | ৪,০০০ টাকা |
৬। জামা কাপড়, বিছানার চাদর/ বালিশ/তেল/সাবান/টুথপেস্ট/জুতা/স্যান্ডেল ইত্যাদি | ২, ০০০ টাকা | |
৭। অতিথি আপ্যায়ন ও বিনোদন | ১,০০০ টাকা | |
সর্বমোট = | ৪০,৫০০ টাকা |
সূত্র: গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন-এর অনুসন্ধানী গবেষণা
গার্মেন্ট শিল্পে পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশের শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম তো বটেই, বরং সারা পৃথিবীতেই সবচেয়ে কম মজুরি পায় বাংলাদেশে। বর্তমানে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি– বাংলাদেশ (সর্বশেষ ঘোষিত- ১২ হাজার ৫০০ টাকা, চীনে ২৪ হাজার ৮৯০ টাকা, ভিয়েতনামে ১৫ হাজার ৯৬০ টাকা, তুরস্কে ২৯ হাজার ১৬৫ টাকা, মালয়েশিয়া ২৫ হাজার ৯৩৫ টাকা, ফিলিপাইন ২৩ হাজার ১৮০ টাকা, ইন্দোনেশিয়া ১৩ হাজার ১১৫ টাকা, কম্বোডিয়ায় ১৮ হাজার ৪৩০ টাকা, ভারত ১৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া ভিয়েতনামের সরকার শ্রমিকদের জন্য খুবই সস্তায় বাসা, পরিবহণ ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-এর ১৩১ নম্বর কনভেনশনে শ্রমিক ও তার পরিবারের প্রয়োজন, জীবনযাত্রার ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। আইএলও-র মতে, বাংলাদেশে শোভন মজুরি হওয়া উচিত ন্যূনতম ২৫২ ডলার = ২৫২ × ১০৯ = ২৭,৪৬৮ টাকা।
এক গবেষণায় (সিপিডি ২০২২) দেখা যায়, ৪ সদস্যের পরিবারের কেবল টিকে থাকার জন্য মাসিক খাবার খরচ হয় ২১ হাজার টাকার বেশি এবং সার্বিক খরচ ৪৭ হাজার ৭৮১ টাকা। গত দুবছরে এই ব্যয় আরও বেড়েছে। আমাদের গবেষণায়ও দেখেছি একটি শ্রমিক পরিবারের বেঁচে থাকার খরচ কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা।
৪ সদস্যের পরিবারের কেবল টিকে থাকার জন্য মাসিক খাবার খরচ হয় ২১ হাজার টাকার বেশি এবং সার্বিক খরচ ৪৭ হাজার ৭৮১ টাকা। গত দুবছরে এই ব্যয় আরও বেড়েছে। আমাদের গবেষণায়ও দেখেছি একটি শ্রমিক পরিবারের বেঁচে থাকার খরচ কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা।
নতুন মজুরি: প্রতারণা অব্যাহত
ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার খর্ব করে রাখাসহ নিয়ত মালিক কর্তৃপক্ষের শ্রম আইন লঙ্ঘন করা, যথসময়ে মজুরি না দেওয়া, মাসের পর মাস মজুরি-ভাতা বকেয়া থাকা, পিসরেট সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান না করা, নানা অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই, মাতৃকালীন ছুটি না দেয়া– উল্টো গর্ভবতী জানতে পারলে ছাঁটাই করে দেওয়া, বিশেষ প্রয়োজনে ছুটি না দেওয়া, ঝুট ব্যবসায়ীরা তাদের নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগ গ্রহণ করে মালিকের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন চালানো, সারা মাস অমানবিক পরিশ্রম করে মানুষের মতো জীবনযাপনের জন্য ন্যূনতম মজুরি না পাওয়াসহ দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের কারণে জমে থাকা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়। এবারও হয়েছে।
মজুরি বোর্ড গঠন ও মজুরি পুনর্নির্ধারণে সরকারের উদাসীনতা এবারও ছিল প্রকট। ইতোমধ্যে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্বিগুণ (কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েকগুণ) বেড়ে যায়। তার ওপর শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছে কারখানার গেটে তালা, কারখানা বন্ধের নোটিশ। আবার অনেকের পাওনা বকেয়া বেতনও দেয়া হয়নি। চলমান সংগ্রামের একপর্যায়ে সরকার ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল আন্দোলনরত ক্রিয়াশীল সব শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা না করে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় মজুরি বোর্ড গঠন করে। বোর্ড গঠনের পর নির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরও বোর্ড নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে। আমরা জানি, মোট মজুরির তুলনায় বেসিক কমিয়ে দেওয়ার অর্থ হলো অঙ্কের মারপ্যাঁচে শ্রমিকদের বঞ্চিত করা। যেখানে মূল মজুরিকে ভিত্তি ধরেই শ্রমিকদের ওভারটাইম, উৎসব বোনাস এবং ছাঁটাইয়ের পর প্রাপ্য, চাকরি অবসানের পাওনাদি, গ্র্যাচুইটি, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বাৎসরিক ছুটির টাকা, ইনক্রিমেন্ট ইত্যাদি নির্ভর করে।
অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের একপর্যায়ে গত ১১ নভেম্বর ২০২৩ গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সর্বমোট ১২ হাজার ৫০০ টাকা (মূল মজুরি ৬৭০০ টাকা + ঘরভাড়া ৩৩৫০ টাকা + চিকিৎসা ভাতা ৭৫০ টাকা + খাদ্য ভাতা ১২৫০ টাকা + যাতায়াত ভাতা ৪৫০ টাকা = মোট ১২,৫০০ টাকা) নির্ধারণ করা হয়, যা যৌক্তিক পরিমাণের অনেক কম। মজুরি নির্ধারণের সময় জীবনযাপনের ব্যয়, জীবনযাপনের মান, মূল্যস্ফীতি, প্রতিবেশী দেশগুলোর শ্রমের মজুরি ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে মালিকদের কথামতো মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। যৌক্তিক কারণেই শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো তখন সরকার ঘোষিত ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরি প্রত্যাখ্যান করে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। চলতে থাকে আন্দোলন-বিক্ষোভ। এই আন্দোলনের সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়- গুলি, টিয়ারশেল, হামলা-মামলা, নির্যাতন নেমে আসে। পুলিশের গুলিতে ও আগুনে পুড়ে গার্মেন্ট শ্রমিক রাসেল হাওলাদার (২৬), ইমরান হাসান (৩০), জালালউদ্দিন (৪২) ও আঞ্জুয়ারা খাতুন (২৪) শহীদ হন। ৪০টি মিথ্যা মামলায় ২০ হাজার শ্রমিকের নামে মামলা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় কয়েকশ শ্রমিককে। উল্লেখ্য এযাবৎ আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে, পুলিশের গুলিতে ও মালিকের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের হামলায় কয়েক হাজার শ্রমিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক। অথচ আজ পর্যন্ত এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো মালিকের সাজা হয়নি।
মালিকদের সামর্থ্য ও প্রাপ্ত সুবিধাদি
তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়। ৭০-এর দশকে গার্মেন্টস শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল মাত্র ৩টি কারখানা দিয়ে। আর বর্তমানে বিজিএমইএ-র হিসাব অনুযায়ী এ সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। লাভ বা মুনাফা অর্জনের পরিমাণ না বাড়লে কী এভাবে ক্রমান্বয়ে ফ্যাক্টরির সংখ্যা বাড়ত? অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে পাওয়া হিসাবে বাংলাদেশের মালিকরা বিশ্বের সবচেয়ে কম মজুরি দিয়ে সবচেয়ে বেশি মুনাফা অর্জন করছেন। দেখা যায়, বিগত দুই যুগে ‘যেখানে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল, চীন ও কম্বোডিয়ায় মুনাফার হার ছিল ন্যূনতম ৩.২ শতাংশ থেকে ৩১.০ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের মালিকদের মুনাফার হার ৪৩.১০ শতাংশ।’
দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশ পোশাক খাত থেকে আসছে। ২০১৮ সালে মজুরি ঘোষণার পরবর্তী ৫ বছরে করোনাকাল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনৈতিক ধাক্কা, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির সংকটে অন্যান্য খাতের অবনতি বা পতন হলেও পোশাক খাতের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। এখানকার মালিকরা ৪০ বছর ধরে বিদেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি আয়, স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণ ও সস্তায় জ্বালানির সুবিধা ভোগ করছে। এই বিশেষ সুবিধার নাম ‘ইনকিউবেটর’ (জন্মের পর নবজাতক শিশুকে দেওয়া বিশেষ সুবিধার নাম ‘ইনকিউবেটর’)। [ভ্যানগার্ড, আগস্ট ২০১০]। বিশ্ব মন্দা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট, শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যবসায় মন্দা চলছে ইত্যাদি অজুহাতে তারা সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা প্যাকেজসহ আর্থিক সুবিধা ভোগ করছে। ‘তিন দশকের বেশি সময় ধরে তৈরি পোশাক খাত বিভিন্ন ধরনের কর সুবিধা পেয়ে আসছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যের কথা বলে মালিকরা এখনো কয়েক হাজার কোটি টাকার করছাড় আদায় করে নিচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অক্টোবর-২৩-এর শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক, বস্ত্র ও আনুষঙ্গিক খাতকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার করছাড় দেওয়া হয়েছে। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পোশাক খাতে করপোরেট করহার সবচেয়ে কম, মাত্র ১২ শতাংশ। ‘পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা’ হলে করপোরেট করহার মাত্র ১০ শতাংশ। তবে রপ্তানিকারককে বছর শেষে এই কর দিতে হয় না। রপ্তানিকালে মোট রপ্তানি মূল্যের (এফওবি মূল্য) ওপর ১ শতাংশ উৎস কর দিলেই তা পরে করপোরেট করের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে যায়। যদিও অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানকে ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়। এনবিআর সূত্র জানায়, ‘পোশাক ও আনুষঙ্গিক খাত থেকে সব মিলিয়ে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার মতো কর আদায় হয়। তবে যত আদায় হয়, তার চেয়ে ১৭৫ শতাংশ বেশি করছাড় দেওয়া হয়।’ [সূত্র: প্রথম আলো ৭ নভেম্বর ২০২৩।] উপরন্তু ডলারের দাম বাড়ায় গত এক বছরে মালিকদের বাড়তি আয় হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা।
২০১৮ সালে মজুরি ঘোষণার পরবর্তী ৫ বছরে করোনাকাল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অর্থনৈতিক ধাক্কা, মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতির সংকটে অন্যান্য খাতের অবনতি বা পতন হলেও পোশাক খাতের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। এখানকার মালিকরা ৪০ বছর ধরে বিদেশে শুল্কমুক্ত রপ্তানি আয়, স্বল্পসুদে ব্যাংক ঋণ ও সস্তায় জ্বালানির সুবিধা ভোগ করছে। এই বিশেষ সুবিধার নাম ‘ইনকিউবেটর’
বর্তমানে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৪৬.৯৯ বিলিয়ন ডলারে (৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার) পৌঁছেছে, যা আগের বছরে ছিল ৪২.৬ বিলিয়ন ডলার (৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলার)। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, ব্রাজিল, মেক্সিকো ও অন্যান্য দেশসহ ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে অপ্রচলিত বা নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। মোট রপ্তানির ১৭.৮২ শতাংশ অপ্রচলিত বাজার থেকে এসেছে। ২০৩০-এর মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানির জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। উল্লিখিত তথ্যাদি শ্রমিকদের ন্যূনতম মোট মজুরি আরও বহুগুণ বৃদ্ধির যৌক্তিকতাই উপস্থিত করে।
উপসংহার
শিল্পের মূল চালিকাশক্তি শ্রমিকরা যাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে, তার জন্য শ্রমিকদের মূল মজুরির ৬৫ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান করা, শ্রমিকদের জন্য পূর্ণ রেশনিং চালু করা (৫ সদস্যের ১টি শ্রমিক পরিবারকে ইউনিট ধরে মাথাপিছু মাসিক ১৫ কেজি চাল, ৫ কেজি ডাল, ৫ লিটার ভোজ্য তেল এবং শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় শিশুখাদ্য সস্তায় রেশনিংয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক কারখানায় অথবা শিল্পাঞ্চলে সরবরাহ করা) আশু কর্তব্য।
যথাযথ শ্রম পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণ, আইনানুযায়ী যথাসময়ে মজুরি দেওয়া, শ্রমিক নির্যাতন-ছাঁটাই বন্ধ করা, সকল শিল্পে অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার বাস্তবায়ন, বর্তমান অগণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও বিধিমালা বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক শ্রম আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আশু জরুরি। ভয়াবহ শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতনের কবল থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করে শিল্প বিকাশের জন্য দায়িত্বশীল শ্রেণিসচেতন ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা– শ্রমিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করার সঙ্গে সঙ্গে জনগণের গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম-আন্দোলন বেগবান করার কোনো বিকল্প নেই।
শামীম ইমাম: সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন বাংলাদেশ। ইমেইল:shamim.uclb@gmail.com