জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে বাংলাদেশের মানুষের খোলা চিঠি

দখলদার গণহত্যাকারী ইসরাইলের বহিষ্কার দাবি করে

জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে বাংলাদেশের মানুষের খোলা চিঠি

২৫ মার্চ বাংলাদেশের জনগণের ওপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যা শুরুর দিন। এবছরে এই দিনে এই সময়ের আরেকটি গণহত্যার বিরুদ্ধে ঢাকায় সমাবেশ হয়। ফিলিস্তিন সংহতি কমিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত এই সমাবেশ শেষে জাতিসংঘের প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মহাসচিবের কাছে ইসরাইলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়ে এক খোলা চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠি এখানে প্রকাশিত হলো।

মার্চ ২৫, ২০২৪

ঢাকা, বাংলাদেশ

প্রেরক:

ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি বাংলাদেশ

ঢাকা

প্রতি:

সম্মানিত জনাব অ্যান্টোনিও গুতেরেস

মহাসচিব, জাতিসংঘ

নিউইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

দৃষ্টি আকর্ষণ: Ms. Gwyn Lewis, UN Resident Coordinator & Mr. Stefan Liller, UNDP Resident Representative

বিষয়: জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক সকল প্রস্তাবাবলি, আন্তর্জাতিক আইনসমূহ, মানবাধিকারের মূলনীতিসমূহ এবং আন্তর্জাতিক আদালত প্রদত্ত নির্দেশনাসমূহ বিরামহীনভাবে লঙ্ঘন করার দায়ে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলকে জাতিসংঘ এবং এর সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করার আহ্বান।

সম্মানিত জনাব মহাসচিব,

‘ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি বাংলাদেশ’-এর আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন।

আপনার সদয় অবগতির জন্য আমাদের পরিচয় জানাতে চাই: ‘ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি বাংলাদেশ’ রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ এবং নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও পেশাজীবীদের একটি মঞ্চ। আমরা বর্তমানে ফিলিস্তিনে ইসরায়েল পরিচালিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞসহ ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে পরিচালিত অন্যান্য অপরাধের প্রতিবাদে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সংগত অধিকারের পক্ষে সক্রিয় রয়েছি। তারই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলকে জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করার সুনির্দিষ্ট দাবি বাস্তবায়নের অনুরোধ করতে আপনাকে এই পত্রটি পাঠাচ্ছি।

বাংলাদেশের জনগণ ৫৩ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা একটি নৃশংস ও ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়েছিল। সেই গণহত্যার দুঃখজনক ও নির্মম স্মৃতিকে স্মরণ করার সময় আমরা পৃথিবীর সকল গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ ও অধিকাংশ দেশের সঙ্গে অত্যন্ত হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি, বিশ্বের সকল স্বীকৃত সভ্য নিয়মকানুন ও রীতিকে পদদলিত করে এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনের গাজায় প্রায় ২৫ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুর বিরুদ্ধে প্রায় ছয় মাস ধরে বিরামহীনভাবে দানবিক গণহত্যা পরিচালিত করে চলেছে দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েল।

গত ৭ অক্টোবর থেকে পরিচালিত ইসরায়েলের সামরিক অভিযানসহ নজিরবিহীন মানবতাবিরোধী, দানবিক ও নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের নিম্নলিখিত কর্মকাণ্ডে আমরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ:

– ইসরায়েল ছয় মাসের চলমান সামরিক অভিযানে ৩২ হাজার ১৪২ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ১৩ হাজার শিশু এবং নিখোঁজ ৭ হাজার মানুষ। আর আহত হয়েছেন ৭৪ হাজার ৪১২ জন (২৩ মার্চ পর্যন্ত পরিসংখ্যান)। দৈনিক গড়ে নিহতের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন। এই সময়ে অধিকৃত পশ্চিমতীরে ১১৬ জন শিশুসহ নিহত হয়েছেন আরও ৪৪২ জন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬৬৫ জন। এখনও অব্যাহত হত্যাযজ্ঞের হিসাবে প্রতিদিন আরও শত শত মানুষ যোগ হচ্ছে।

ইসরায়েল ছয় মাসের চলমান সামরিক অভিযানে ৩২ হাজার ১৪২ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ১৩ হাজার শিশু এবং নিখোঁজ ৭ হাজার মানুষ।

– মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিবের দেওয়া ভাষ্যানুযায়ী গাজায় ২৫ হাজার নারী ও শিশু গণহত্যার শিকার হয়েছেন।

– গড়ে প্রতিদিন ৬৩ জন করে মোট ৯ হাজার নারী হত্যার শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে প্রতিদিন ৩৭ জন করে মাতাকে হত্যা করা হয়েছে।

– গাজায় ১০ লাখ শিশু ট্রমায় আক্রান্ত; এদের ৭০ শতাংশ ট্রমা-পরবর্তী অসুস্থতায় (পিটিএসডি) ভুগছে। পিতা-মাতা-অভিভাবক হারানো ১৭ হাজার শিশুকে দেখাশোনার মতো কেউ জীবিত নেই।

– নির্বিচার বোমাবর্ষণে গাজার ৬০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি ও বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে; যা থেকে সৃষ্ট কংক্রিটের আবর্জনার পরিমাণ ২৩,০০০,০০০ মেট্রিক টন। পরিকল্পিতভাবে সৃষ্ট এই ধ্বংসযজ্ঞ বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয়হীন করেছে অজানা সময়ের জন্য।

– পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সম্ভাব্য আশ্রয়কেন্দ্র, জাতিসংঘের অবকাঠামো, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সিংহভাগ হাসপাতাল ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, সরকারি দফতর, মসজিদ ও গির্জা; লাইব্রেরি নাট্যশালা, সাংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে শুরু করে মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ।

– ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ ও আক্রমণ নানামুখী: তারা নির্বিচারে হত্যা করছে শত শত সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি-খেলোয়াড়-শিক্ষক-গবেষক-শিক্ষার্থী-ত্রাণকর্মী; জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মী, জাতিসংঘের উদ্বাস্তু ও ত্রাণ সংস্থার দফতর ও ভান্ডার এবং একাধিক বিদেশি নাগরিককে। ইসরায়েল ফিলিস্তিনের কমপক্ষে তিনটি প্রজন্মকে পরিকল্পিতভাবে নিঃশেষ করে দিচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার অধিকার ও সম্ভাবনা, ইতিহাস-সংস্কৃতি-জীবনজীবিকার উপায়, খাদ্য-পানীয়, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার সুযোগ ধ্বংস করার মাধ্যমে।

– গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি ইসরায়েলের বহুমুখী আক্রমণ ও প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে বিশেষভাবে জাতিসংঘ; তার বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং এগুলোতে কর্মরত কর্মচারী ও কর্মকর্তারা। জাতিসংঘ ও তার সহযোগী সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনে গণহত্যা ও জাতিগত বিনাশ/উচ্ছেদের (এথনিক ক্লিনজিং) পথে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা বিবেচনা করে ইসরায়েল বিশেষ প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে। মিথ্যা অভিযোগ ও প্রচারণার ভিত্তিতে ত্রাণ সংস্থার তহবিল বন্ধ করার পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়েছে।

– গণহত্যার প্রতিবাদকারী যে কোনো দেশ, সংস্থা/সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের প্রতি তারা একই প্রতিহিংসা জাহির ও বাস্তবায়ন করে চলেছে। ব্যক্তিগতভাবে জাতিসংঘের মহাসচিব এবং জাতিসংঘ তাদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু; জাতিসংঘকে ঘোষণা করা হচ্ছে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ ও ‘সন্ত্রাসবাদের সহায়তাকারী’ হিসেবে।

– আমরা গভীর হতাশা ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করছি যে ইসরায়েল তার সকল অপরাধ নিরাপদে ও বিনা বাধায় চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপী ইউনিয়নভুক্ত কিছু দেশ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের প্রত্যক্ষ নৈতিক, কূটনৈতিক, আর্থিক ও সামরিক সহায়তার মদতে।

– ইসরায়েলের বহুমুখী যুদ্ধকৌশলের অন্যতম নির্মমতা এখন আমরা তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি গাজায়; বিশেষত রাফাহ শহরে আটকে পড়া ১৫ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির ক্ষেত্রে। উপায়হীন বিরাটসংখ্যক উদ্বাস্তুকে ইসরায়েল তার জাতিগত বিনাশ/উচ্ছেদের (এথনিক ক্লিনজিং) অংশ হিসেবে বিশ্ব জনমতকে অগ্রাহ্য করে সেখানে বড় আকারে সামরিক হামলা চালানোর ঘোষণা দিচ্ছে। অন্যদিকে ত্রাণসামগ্রী ঢুকতে দেয়া ও বিতরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে ইসরায়েল গাজার ২৫ লাখ মানুষকে অনাহার ও অপুষ্টিতে হত্যা করার জন্য দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে। ত্রাণ সংগ্রহ করতে সমবেত ক্ষুধার্ত মানুষকে সুপরিকল্পিতভাবে নিয়মিত হত্যা করছে একের পর এক ঘটনায়। জাতিসংঘের ত্রাণ সাহায্য সংস্থার ওপর হামলা, তাদের কর্মী হত্যা, ভিসা প্রদান বন্ধসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে অব্যাহতভাবে।

– সারা বিশ্ব সুস্পষ্টভাবে জানে ইসরায়েল ১৯৪৮ সালে তার প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘ গৃহীত সকল সিদ্ধান্ত ও প্রস্তাবাবলিকে অবলীলায় অগ্রাহ্য করে এসেছে। আমরা এটাও জানি, ২০১৫ থেকে ২০২২ সালে গৃহীত ১৪০টি প্রস্তাবের একটিও ইসরায়েল মেনে চলেনি। জাতিসংঘকে অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি ইসরায়েল জেনেভা কনভেনশন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল মৌলিক নীতিকে অমান্য করে এসেছে ৭৫ বছর ধরে।

২০১৫ থেকে ২০২২ সালে গৃহীত ১৪০টি প্রস্তাবের একটিও ইসরায়েল মেনে চলেনি। জাতিসংঘকে অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি ইসরায়েল জেনেভা কনভেনশন ও মানবাধিকার সংক্রান্ত সকল মৌলিক নীতিকে অমান্য করে এসেছে ৭৫ বছর ধরে।

– অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালত প্রদত্ত নির্দেশনাগুলোকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে গণহত্যা বহাল রেখেছে ইসরায়েল।

– আমরা তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে বলতে চাই, বৈশ্বিক সকল আইন ও নীতিকে অগ্রাহ্য করে দখলদার ও বর্ণবৈষম্যবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রমাণ করেছে সে সভ্য দুনিয়ার সদস্য নয়।

এ অবস্থায় আমরা মনে করি, ক্রমাগতভাবে জাতিসংঘের সনদ এবং সিদ্ধান্তসমূহ অমান্যকারী দেশ হিসেবে ইসরায়েলের জাতিসংঘসহ এর সকল প্রতিষ্ঠানের সদস্যপদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার ও সুযোগ নেই। তাই অবিলম্বে ইসরায়েলকে জাতিসংঘ চার্টারের সদস্যপদ সংক্রান্ত ধারা-৬ অনুসারে জাতিসংঘ ও তার সকল প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমরা আপনার মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদ, সাধারণ পরিষদ এবং সদস্যরাষ্ট্রগুলোর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আশা করি আপনি এ বিষয়ে আমাদের আহ্বান ও দাবিটি সকল সদস্যরাষ্ট্রের নজরে আনার ব্যবস্থা নেওয়াসহ অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

এ বিষয়ে আপনার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণকে আমরা অগ্রিম ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।

আপনার একান্ত,

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এবং আহ্বায়ক

ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি বাংলাদেশ

অনুলিপি:

–       UN Resident Coordinator, & UNDP Resident Representative

–       মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

–       বাংলাদেশে জাতিসংঘের অন্যান্য দপ্তরের প্রধানরা

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •