সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

গত ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশে আরেকটি ‘ঐতিহাসিক’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই নির্বাচনে কোনো কার্যকর বিরোধী দল ছিল না। সরকারি দলের মনোনয়ন, সমর্থন ও সম্মতিতে সকল প্রার্থী অংশগ্রহণ করেছে। সারাদেশে তাই যেই জয়লাভ করেছে তারা সবাই সরকারেরই লোক। এই নির্বাচন ছিল ২০১৪ মডেলের সম্প্রসারিত রূপ। এটি কীভাবে এই পরিণতিতে পৌঁছালো তা বোঝার জন্য নির্বাচনের বেশ আগে থেকে বিভিন্ন ঘটনা ও তৎপরতার খবারখবর এবং নির্বাচনের ঘটনাবলীর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো এই সংখ্যায়।

বিভিন্ন মেয়াদে এই সরকার জ্বালানী ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে যা যা করেছে তাতে শুধু এই খাতে নৈরাজ্যই সৃষ্টি হয়নি, দেশের বর্তমান জটিল আর্থিক সংকটেরও অন্যতম উৎস এই খাতই। বারবার গ্যাস বিদ্যুতের দামবৃদ্ধিও এরই ফলাফল। এখন আবার নতুন মহাপরিকল্পনার নামে এই সর্বনাশা অপতৎপরতা কীভাবে অব্যাহত রাখা হচ্ছে এই সংখ্যায় সেটাই অনুসন্ধান করা হয়েছে।  

এই সংখ্যার আরেকটি লেখায় রপ্তানিমুখী উন্নয়ন আর সম্পদের কেন্দ্রীভবনকে প্রশ্ন করে সমাজে মধ্যবিত্তসহ বিভিন্ন আয়গোষ্ঠীর ভোগ চাহিদা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা তথ্য ও তত্ত্ব তুলে ধরে লেখাটিতে শ্রমজীবী মানুষের আয় বা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি সমগ্র অর্থনীতির বিকাশের জন্যই কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেটাই বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গত ৭ই অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনী জনগণের ওপর নতুন আগ্রাসন ও গণহত্যা শুরু করেছে ইসরাইল, যা এখনও অব্যাহত আছে। গাজাসহ ফিলিস্তিনী মানুষের ওপর ইসরাইলী বর্বরতার প্রতিবাদে বিশ্বের বহু দেশের মত বাংলাদেশেও প্রতিবাদ বিক্ষোভ সভা সমাবেশ হচ্ছে। গত ২৯শে ডিসেম্বর ঢাকায় ফিলিস্তিনে আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধের দাবিতে সম্মিলিত বড় সমাবেশ ও দীর্ঘ মিছিল হয়। এই সংখ্যায় সমাবেশের ঘোষণা প্রকাশ করা হলো। সেইসাথে একটি লেখায় ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক পরীক্ষা করা হয়েছে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনী জনগণের বন্ধু হিসেবে ভূমিকা পালন করলেও মোদী সরকারের সময় থেকে তারা যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ দখল ও নৃশংস গণহত্যার পরও ভারতের এই অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। এই সংখ্যায় এই সম্পর্কের অতীত বর্তমান বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

গত বছর থেকে সরকার স্কুল পর্যায়ে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করার পর তা নিয়ে নানামুখী বিতর্ক চলছে। সরকার এনিয়ে কোনো আলোচনা বিতর্ক ভিন্নমত উৎসাহিত না করে নানা দমনপীড়ন ও প্রচারণার আশ্রয় নিয়েছে। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে। এই শিক্ষাক্রমের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সরকার ফিনল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশের কথা বলছে। এ বিষয়টি স্পষ্ট করতে এই সংখ্যায় ফিনল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডের শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা তুলনামূলক চিত্র উপস্থিত করা হয়েছে। 

জন্মের পর মানুষই সবচাইতে দুর্বল নাজুক ও নির্ভরশীল থাকে। মা-ই তার অস্তিত্বের প্রধান অবলম্বন হলেও মুনাফার দাপটের নতুন নতুন উৎপাত এই শিশুদের মা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যত হয়। মায়ের পেটে বেড়ে ওঠার ধারাবাহিকতায় জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলেও বাণিজ্যের থাবা, সমাজের বৈষম্য, অসঙ্গতি, অমনোযোগ ইত্যাদি কারণে এই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সম্পর্কও নানা বাধা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পতিত হয়। এই সংখ্যায় একজন শিশু বিশেষজ্ঞ এই বিষয়টিই তলিয়ে দেখেছেন।      

১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ নামে একটি বৈষম্যমূলক আইন প্রবর্তন করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেও বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন নামে এই আইনের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। এই সংখ্যায় এই আইনের প্রেক্ষাপট ও এর সামাজিক ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।

এই সংখ্যায় ধারাবাহিক লেখা ‘আমাদের অস্তিত্ব সুন্দরবন’- দ্বিতীয় পর্বে সুন্দরবনের মৎস্য ও জলজ সম্পদ, প্রাণী সম্পদ এবং বন্যপ্রাণী বিলুপ্তিসহ বিপদের কারণসমূহ তুলে ধরা হয়েছে। ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর ও তারপর’ তৃতীয় পর্বে আলোচনা করা হয়েছে ১৯৭৩-৭৪ এর রাষ্ট্রনীতি, দুর্ভিক্ষ এবং মৌলিক অধিকার বিপর্যয়ের কিছু দিক। সেইসাথে তাজউদ্দীনের বিদায়- ভুট্টো, কিসিঞ্জারের আগমন কথা এবং শিল্প সাহিত্য জগতের কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান’ এর একাদশ কিস্তিতে বাংলাদেশের সামরিক শাসকরা দেশি-বিদেশি অনুত্পাদনশীল লুম্পেন পুঁজির বিকাশকে কীভাবে ত্বরান্বিত করেছে তার পর্যালোচনা হাজির করা হয়েছে। তারিক আলীর ‘মৌলবাদের সংঘর্ষ: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা’ অনুবাদের পঞ্চম পর্বে ওয়াহাবিবাদের ইতিহাস, সৌদ রাজবংশের সাথে তার যুক্ততা এবং সৌদী আরবে যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানির প্রবেশ কাহিনী আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়া কাবেরী গায়েনের শিক্ষা বিষয়ক লেখা ও সাইফুল ইসলামের সাক্ষাৎকারের বাকি অংশ থাকছে এই সংখ্যায়। থাকছে চলচ্চিত্র আলোচনা- ‘দক্ষিণ এশিয়ার সিনেমার সংসার যাত্রা’। এবারে সত্যজিৎ রায়ের ‘পুরুষ’ নির্মাণ এবং দক্ষিণ এশিয়ার সিনেমার ‘পুরুষ চরিত্রের’ বিবর্তন আলোচনা করা হয়েছে। দেশের পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে পাহাড়ে খুন, ‍শিক্ষাক্রম নিয়ে মতপ্রকাশে বাধা এবং নির্বাচন নিয়ে কয়েকটি বিবৃতিও এই সংখ্যায় প্রকাশ করা হলো।

সর্বজনকথা তার প্রকাশের দশম বছরে পা দিয়েছে। এই উপলক্ষে বছরব্যাপী সেমিনার, ওয়ার্কশপ, তরুণদের গবেষণা, নির্বাচিত লেখা নিয়ে বই প্রকাশ, দেশজুড়ে লেখক-পাঠক সমাবেশ, সর্বজন মেলাসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আমরা সকল লেখক পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের শুভেচ্ছা জানাই এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ কামনা করি।  

আনু মুহাম্মদ

২৫শে জানুয়ারি ২০২৪    

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •