বাংলাদেশের ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’
মিজানুর রহমান নাসিম
অর্পিত সম্পত্তি আইন বাংলাদেশের একটি সামাজিক বাস্তুবিদ্যক সমস্যা। আমাদের দেশে বিশেষ এই বাস্তুবিদ্যক সমস্যার উৎসমূল অনুসন্ধান, সমস্যার বর্ণনা ও তার নৈতিক মূল্যায়ন এই প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংগঠিত যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার শত্রু সম্পত্তি আইন নামে একটি আইন প্রবর্তন করে। যুদ্ধের উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে সৃষ্ট আইনটির মাধ্যমে পাকিস্তান সরকার সুনির্দিষ্টভাবে হিন্দু নাগরিকদের ভূ-সম্পত্তিকেন্দ্রিক নানা বিধিমালা আরোপ করে। এর ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সম্পত্তির অধিকার খর্ব হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরেও বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন নামে এই আইনের ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে। একটি বিস্তৃত গবেষণার অংশ হিসেবে উপস্থাপিত বর্তমান প্রবন্ধে এই আইনের প্রেক্ষাপট ও এর সামাজিক ফলাফল আলোচনা করা হয়েছে।
ভূমিকা
বিগত অর্ধ-শতকেরও বেশি সময় ধরে নানা সময়ে নানা সংশোধনীর মাধ্যমে চলমান এই আইন বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবনে এক চরম বঞ্চনাময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই আইন বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী একটি আইন। দীর্ঘদিন থেকে চলমান এই আইনের কারণে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের ভূ-সম্পত্তি হারিয়েছে, বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে ছিন্নমূলে পরিণত হয়েছে, তাদের পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে গেছে এবং অনেকেই হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে দেশত্যাগ করেছে। অপরদিকে এই আইনের সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থান্বেষী পরজীবী মহলের যারা ক্রমান্বয়ে দেশে অন্যের সম্পত্তি দখলের একটি ভয়ানক অপতৎপরতা বিস্তৃত করে তুলছে। বর্তমানে এই আইন বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর ক্রম-প্রান্তিকায়নে ও নিঃস্বায়নে একটি শক্তিশালী নিয়ামক হিসেবে কাজ করছে।
বৈষম্যমূলক এই আইনটি দীর্ঘদিন থেকে চলমান থাকলেও এ দেশের সমাজবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো বিশ্লেষণধর্মী বা অনুসন্ধানমূলক গবেষণার উদ্যোগ নেন নি। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর এই আইনের প্রভাব সম্পর্কে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব ছিল। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে বিচারপতি কে. এম সোবহানের নেতৃত্বে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ১৯৯৪ সালে এই পরিষদের উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রথম দুইদিন ব্যাপী একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর বিভিন্ন দিক নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যক্ষ রাজিয়া মতিন চৌধুরী, বিচারপতি কে. এম সোবহান ও অধ্যাপক ড. রঙ্গলাল সেন। স্বাধীন বাংলাদেশে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর মূল্যায়নে এটিই ছিলো সবচেয়ে প্রথম সম্মিলিত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। পরবর্তীতে ১৯৯৫-৯৬ সালে এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম (এ.এল.আর.ডি)-এর উদ্যোগে পরিচালিত হয় `Impact of Vested Property Act on Rural Bangladesh: An Exploratory Study’ শীর্ষক গবেষণা। এ গবেষণার ভিত্তিতে ১৯৯৭ সালে এ.এল.আর.ডি `Political Economy of the Vested Property Act in Rural Bangladesh’ (বারকাত ১৯৯৭) শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে। দ্বিতীয় গবেষণা কাজটি হয় `Vested Property Act: Toward a Feasible Solution’ নামে। এই গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় `Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh: Framework for a Realistic Solution’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ। এরই ধারাবাহিকতায় আমি ২০১২ সালে ব্যবহারিক নীতিবিদ্যার আলোকে ‘বাংলাদেশের ভূমি আইন: অর্পিত সম্পত্তি আইনের নৈতিক মূল্যায়ন’ নামে একটি গবেষণা কর্ম সম্পন্ন করি।
পাকিস্তান সরকার প্রণীত শত্রু সম্পত্তি আইন-এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তি আইন বিগত পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের চলমান একটি আইন। এই আইন বর্তমানে বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে চলমান ভূমি অধিকার বিষয়ক একটি পুরোনো ও বহুবিস্তৃত সমস্যা সৃষ্টিকারী ভূমি আইন। নির্দিষ্ট কোন কালপর্বের তথ্য বিশ্লেষণ করে বা কতিপয় মাঠ জরিপকৃত পরিসংখ্যান দিয়ে এই আইনের প্রকৃত চরিত্র-চিত্রণ বা অভিঘাত সম্পর্কে পূর্ণ ধারণালাভ সম্ভব নয়। সেহেতু এই আইন প্রবর্তনের ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, আইনের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, বিবর্তন ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই আইনের উপস্থিতির ফলে সৃষ্ট বাস্তুগত সংকট বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা আবশ্যক। এই আইনের তাত্ত্বিক দিকটির বিস্তৃত পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন এই প্রবন্ধের লক্ষ্য।
শত্রু/অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর মূল্যায়নে আইনের প্রকৃতি, উৎস ও স্বরূপ বিশ্লেষণ একটি মৌলিক দিক। এই আইনের তাত্ত্বিক আলোচনায় গবেষণাকর্মের প্রাথমিক ও প্রধান উৎস হিসেবে এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে শত্রু সম্পত্তি আইন ও অর্পিত সম্পত্তি আইন বিষয়ক বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাদি যেমন পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলের ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি দলিল, পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর উপর সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও পরিসংখ্যানগত তথ্যায়ন। উপমহাদেশের ভূমি আইনের ইতিহাস, আইনের দর্শন, ব্যবহারিক নীতিবিদ্যা, বাস্তুবিদ্যা বিষয়ক নানা গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছি প্রাসঙ্গিকভাবে শত্রু সম্পত্তি আইন ও অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর ঐতিহাসিক ও সামাজিক-দার্শনিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে। পূর্বে সম্পাদিত কিছু মাঠ গবেষণার জরিপের ফলাফল প্রবন্ধের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পরিসংখ্যানগত ও ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রয়োগ করা হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের উৎস হিসেবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সহায়তা নিয়েছি এ বিষয়ে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদন। মাঠ পর্যায়ে অর্পিত সম্পত্তি আইন বিষয়ে গবেষক, আইনজ্ঞ, আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গের সাথে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। বেদখলকৃত কিছু সম্পত্তি যেমন জমি, বাড়ি, উপসানলয় সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করেছি। এসব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর বহু-বিস্তৃত বাস্তুবিদ্যক অভিঘাত ও এর পরিণতির বিষয়টি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধ এই গবেষণার অংশ।
সামাজিক বাস্তুবিদ্যা: একটি ধারণা
সামাজিক বাস্তুবিদ্যা ব্যবহারিক নীতিবিদ্যার একটি শাখা। সামাজিক বাস্তুবিদ্যা শব্দটি মারে বুকচিন (Murray Bookchin) নামক একজন সমাজতত্ত্ববিদ তাঁর লেখায় সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন এবং বাস্তুবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমসাময়িক কালের সামাজিক সমস্যাগুলো বিচার করার প্রয়াস পান। একটি স্বতন্ত্র বিজ্ঞান হিসেবে বাস্তব্যবিদ্যা একশত বছরেরও বেশি পুরোনো। বাস্তব্যবিদ্যা শব্দটি যাঁর নামের সাথে যুক্ত তিনি হলেন ১৯৮০’র দশকের জার্মান জীবিতত্ত্ববিদ আর্নেস্ট হেকেল (Ernst Haeckel)।১ দুটি গ্রিক শব্দ: ‘Oikis’ যার অর্থ ‘household’ অর্থাৎ পরিবার বা বসতি এবং ‘ষড়মড়ং’ যার অর্থ জ্ঞান। সুতরাং বুৎপত্তিগত অর্থে বাস্তব্যবিদ্যা হচ্ছে সেই বিজ্ঞান যা জীবন্ত প্রাণির বসতি বা তার পরিবেশ নিয়ে আলোচনা করে। বাস্তব্যবিদ্যার অন্যতম একটি প্রাচীন শাখা হচ্ছে অর্গানিক মডেল (organic model)। অর্গানিক মডেল অনুসারে, প্রত্যেক স্বতন্ত্র প্রজাতি তাদের পরিবেশের সাথে রেখে চলে, যেমন করে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শরীরের সাথে সম্পর্কিত। একটি অঙ্গ বিকাশের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রূপলাভ করে; তেমনি বাস্তুগুলোও জন্মায়, বিকশিত হয় এবং পূর্ণাঙ্গতা পায়। বাস্তুবিদগণ প্রজাতি, গাছপালা, প্রাণি, জৈব ও অজৈব উপাদান, যেমন মাটি, পুষ্টিকর পদার্থ এবং জলবায়ু- এদের মধ্যকার মিথষ্ক্রিয়াকে দেখেন একটি অধিকতর জটিল এবং পরিবর্তনশীল উপাদান হিসেবে। ১৯৩০ এর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ বাস্তুবিদ আর্থার টান্সলে (Arthur Tansley) এই অর্গানিক মডেলের প্রবর্তন করেন যা বাস্তুবিদ্যায় একটি প্রধান চিন্তাধারা হিসেবে বিবেচিত। ১৯৩৫ সালে তাঁর লেখা একটি নিবন্ধে তিনি বাস্তুবিদ্যা বিষয়ক গবেষণার জন্য ইকোসিস্টেম তত্ত্বের অবতারণা করেন। সেখানে তিনি বলেন:
…এই সকল ইকো-সিস্টেম যাদেরকে আমরা নানা নামে অভিহিত করি, সেগুলো বিভিন্ন রকমের এবং আকৃতির হয়ে থাকে। তারা মহাবিশ্বের অগণিত ভৌতিক প্রণালীকে একটি নির্দিষ্ট রীতিতে পরিচালিত করে, যার মধ্যে বিশাল মহাবিশ্ব থেকে শুরু করে একটি অণু পর্যন্ত একই নিয়মে ক্রিয়া করে।২
বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইকোসিস্টেম বাস্তুবিজ্ঞানের একটি আদর্শ চিন্তাধারায় পরিণত হয়। এঁদের মতে, প্রাকৃতিক বাস্তুপ্রণালী একটি ভারসাম্যের নিয়মকে অনুসরণ করে। যখন এই নিয়মের সুসামঞ্জস্যতা বাধাগ্রস্ত হয়; প্রাকৃতিক উপাদানগুলো এই ভারসাম্যকে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে কাজ শুরু করে। এই মতবাদে আমরা দুটি দিক দেখতে পাই: কম্যুনিটি মডেল এবং এনার্জি মডেল। কম্যুনিটি মডেল অনুসারে, প্রকৃতি হচ্ছে একটি পরিবারের মত যেখানে এর প্রত্যেক সদস্য এর সামগ্রিক কর্মকা-ে অবদান রাখে। কম্যুনিটি মডেলের সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী হলেন ইংরেজ প্রাণিবিদ চার্লস এলটন (Charles Elton) যিনি তাঁর প্রাণিবিদ্যাকে অভিহিত করেছেন “প্রাণিজগতের সমাজবিদ্যা ও অর্থনীতি হিসেবে।”৩ অন্যদিকে এনার্জি মডেল ইকোসিস্টেমের জীব ও জড় উপাদানের মাঝে পার্থক্য করে থাকে। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গীতে, আমরা ইকোসিস্টেমের মধ্য দিয়ে শক্তির প্রবাহকে চিহ্নিত করতে পারি যা খাদ্যচক্রে খাদ্যপ্রবাহের সমান্তরাল। অর্থনৈতিক ও পারিবারিক রূপককে ব্যবহার না করেই আমরা এটি করতে পারি। এভাবে আমরা ইকোসিস্টেমের মূল্যায়নে উপসংহারে বলতে পারি যে, যদি ইকোসিস্টেমকে কোন প্রাণিসত্ত্বা হিসেবে ধরা হয়, তাহলে এর আলোচনায় ন্যূনতমভাবে নৈতিকতার দিকটিকে অবশ্যই স্থান দিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে, ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস্ লাভলক (James Lovelock) এবং মার্কিন জীবতত্ত্ববিদ লিন মারগুলিস (Lynn Margulis)-এর নেতৃত্বে কিছু পর্যবেক্ষক এই পরামর্শ দেন যে, গোটা পৃথিবীটিকেই একটি প্রাণিসত্ত্বা হিসেবে বুঝতে পারা যায়।৪ ইকোসিস্টেমের মধ্যে প্রকৃতির সুসংহতি ও পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার নীতি আমাদেরকে প্রাকৃতিক উপায়েই প্রাকৃতিক নিয়ম রক্ষার নীতি প্রণয়নের পথে পরিচালিত করে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হয়ে চলা প্রকৃতি জগৎ যদি একটি স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বিকাশের নিয়মের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়; সেক্ষেত্রে আমাদেরকে প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে খুবই সাবধানতা অবলম্বন করা উচিৎ।৫
বাস্তুবিদ্যক সমস্যার সমাধানে শুধুমাত্র বিজ্ঞানই যথেষ্ট নয়; অধিকন্তু এ ব্যাপারে একটি নীতিবিদ্যক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা অপরিহার্যতার দাবি রাখে। কারণ, বাস্তুবিষয়ক স্বার্থগুলো সংরক্ষণে প্রায়শই উচ্চ পর্যায়ের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা যুক্ত থাকে। নীতিবিদ্যার আলোকে ইকোসেন্ট্রিক (ecocentric) ব্যাখ্যায় যিনি প্রথম মৌলিক চিন্তার অবতারণা করেছেন, তিনি হলেন এলডো লিওপোল্ড (Aldo Leopold, 1887-1948)। তাঁর মতে, ভূমিকে দেখা উচিৎ একটি জীবন্ত সত্তা হিসেবে যা প্রাণবন্ত বা অস্বাস্থ্যকর হতে পারে, আঘাতপ্রাপ্ত বা মৃত হতে পারে। ভূমি তাই শুধুমাত্র মাটি নয়; বরং মাটি, গাছপালা এবং জীবজন্তুর বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় এটি একটি শক্তির উৎস।৬ লিওপল্ডের লেখা পরিবেশগত নীতিবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রত্যেককে অনুপ্রেরণা যোগায় কেননা তিনি তাঁর বাস্তুবিদ্যক চিন্তাকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক বিবেচনায় মূল্যায়ন করেছেন।
সুতরাং সমসাময়িক পরিবেশবিষয়ক সমস্যাগুলোকে এর গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর মাঝে চিহ্নিত করা যায়। অন্যদিকে ডিপ ইকোলজিও (Deep Ecology) পরিবেশগত সংকটকে মৌলিক দার্শনিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে। তাঁরা মনে করেন, এক্ষেত্রে সমাধান আসতে পারে কেবলমাত্র আমাদের প্রচলিত বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী এবং এই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রয়োগনীতি পরিবর্তন করার মধ্য দিয়ে। তাঁরা পরিবেশের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে ‘কর্তৃত্ববাদী বিশ্বব্যবস্থাকে’ চিহ্নিত করেন।৭ ফলে পরিবেশগত সমস্যার একটি যৌক্তিক সমাধানকল্পে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর মৌলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই শুধুমাত্র একটি উন্নততর বিশ্ববীক্ষা লাভ করা সম্ভব।
মানবপ্রকৃতি প্রকৃতিজগৎ এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সে জন্য বাস্তুবিদ্যক সমস্যাকে মানব সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়েই পাঠ করতে হবে। একটি সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং কাঠামো, এর অর্থনীতি, সম্পত্তির মালিকানা, জাতিসত্তার বৈচিত্র, ধর্মীয় চিন্তা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- প্রভৃতি বাস্তুবিদ্যক সমস্যার সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সুতরাং বুকচিনের সামাজিক বাস্তুবিদ্যক দার্শনিক ব্যাখ্যা বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর মূল্যায়নে স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক বাস্তুবিদ্যার চিন্তাটি বুকচিনের চিন্তার মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম তাত্ত্বিক আকার লাভ করে, যেখানে তিনি পরিবেশগত সমস্যাগুলোকে মানব সমাজের অন্তর্নিহিত সমস্যার আলোকে ব্যাখ্যা করেন। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত The Ecology of Freedom এবং ১৯৯০ সালে প্রকাশিত The Philosophy of Social Ecology গ্রন্থদ্বয়ে বুকচিন সামাজিক বাস্তুবিদ্যার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। সামাজিক বাস্তুবিদেরা সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য সমাজে মানুষের স্তর-বিন্যাস ও উচ্চস্তরের মানুষের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ, প্রভুত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের দুর্দম বাসনা ও মনোভাবকে দায়ী করেন। তাঁরা বিভিন্ন সামাজিক চর্চা ও প্রতিষ্ঠান যেমন বর্ণবাদ, লিঙ্গ বৈষম্য এবং শ্রেণিবৈষম্য অধিকন্তু ব্যক্তিগত মালিকানা, ধনতন্ত্র, আমলাতন্ত্র এমনকি জাতিরাষ্ট্রকেও আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং তাঁরা মানুষকে সকল প্রকার বহির্নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁরা ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা, গোষ্ঠী চেতনা এবং গোষ্ঠী স্বার্থকে অধিক গুরুত্ব দেন।
সামাজিক বাস্তুবিদ্যার উৎস খুঁজে পাওয়া যায় নানা দার্শনিক চিন্তার ঐতিহ্যে। মার্কসীয় সমাজতত্ত্ব, উদারনৈতিক নৈরাজ্যবাদ এবং পাশ্চাত্যের “জৈবসত্তা ঐতিহ্য তত্ত্ব” (Organismic tradition theory) যা দার্শনিক এরিস্টটল ও হেগেলের চিন্তার সাথে সম্পর্কিত। সামাজিক বাস্তুবিদ বুকচিন গভীর উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ করেছেন মানুষের সমাজ জীবনকে। একটি সমাজ, তাঁর দৃষ্টিতে, বহু শ্রেণি ও উপশ্রেণিতে বিভক্ত। এই বিভাজন ক্রমোচ্চ স্তরে বিন্যস্ত। একটি রাষ্ট্রে বহু জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ বাস করে। অর্থাৎ ভাষা, বর্ণ, ধর্ম এবং সাংস্কৃতিক ও নৃ-তাত্ত্বিক দিক থেকে একটি জাতি-রাষ্ট্রের মানুষ নানা শ্রেণি, উপ-শ্রেণি ও স্তরে বিভক্ত। প্রতিটা শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যার দিক থেকে সমান নয়। জনসংখ্যার কারণে কোনো সম্প্রদায় গরিষ্ঠ, আবার কোনো কোনোটি ক্ষুদ্র বা লঘিষ্ঠ।
মারে বুকচিনসহ অন্যান্য সামাজিক বাস্তুবিদরা লক্ষ্য করেছেন যে, একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশে ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাসে বিভক্ত সমাজে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষ রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে নিগৃহীত ও বঞ্চিত হয়। চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে তাঁদের স্থান, অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা অত্যন্ত সীমিত। সমাজের এই নিম্ন, দুর্বল ও সংখ্যালঘু মানুষদের দুর্দশা থেকে তাঁদের মনে উৎসারিত হয় গোষ্ঠী স্বার্থের ভাবনা- যা পরবর্তীকালে জ›ম দেয় সামাজিক বাস্তুবিদ্যার। কম-বেশি প্রায় সকল জাতি-রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থায় সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষ নানাভাবে নিগৃহীত হয়। তাই, বলা যায় যে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের অপব্যবহার ও ক্রমোচ্চ সামাজিক স্তর-বিন্যাস (social hierarchy) ‘সামাজিক বাস্তুবিদ্যা’ নামে জ্ঞানের একটি নতুন শাখার জন্ম দিয়েছে।
সামাজিক বাস্তুবিদদের মতে, মানব সভ্যতার অতিপ্রাচীন কাল থেকেই বঞ্চনা, নিয়ন্ত্রণ, প্রভুত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের মনোভাব নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজে ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাসের সূত্রপাত ঘটে- যা পরিণামে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরও ক্রমশ অবাঞ্ছিত বিপর্যয় ডেকে আনে। এরূপ প্রবণতা ও মনোভাবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে সামাজিক বাস্তুবিদ্যার জনক মারে বুকচিনের দৃষ্টি ও অন্বেষা আরো গভীর, সূক্ষ্ম ও সুদূরপ্রসারী। তিনি বলেন যে, একজন মানুষ তখনই প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করে যখন সে বহিঃনিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকে। তাঁর মতে, প্রকৃতির উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা জাগ্রত হয় সামাজিক স্তরবিন্যাসের উপস্থিতি ও কর্তৃত্বের অভ্যাস থেকে।৮ তিনি বলেন, সমাজে একজন মানুষের উপর অন্যের আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা প্রকৃতি জগতেও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার বাসনাকে জাগিয়ে তোলে।
সামাজিক ক্রমোচ্চ স্তর-বিন্যাসে কর্তৃত্ব সম্পর্কে বুকচিনের নিজস্ব ব্যাখ্যাটি প্রণিধানযোগ্য। তাঁর মতে, একটি ক্রমোচ্চ স্তর-বিন্যাসকৃত সমাজে কর্তৃত্বের ধরনটি বহুবিধ রূপে বিদ্যমান। যেমন, …তরুণদের উপর বয়স্কদের কর্তৃত্ব, নারীর উপর পুরুষের, এক নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের উপর অন্য নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের কর্তৃত্ব, সাধারণ জনগণের উপর আমলাদের কর্তৃত্ব, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর উপর শহরবাসীদের কর্তৃত্ব এবং অধিকতর সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক অর্থে শরীরের উপর মনের কর্তৃত্ব…।৯ সামাজিক স্তরবিন্যাসের এরূপ কাঠামোর উপস্থিতি সমাজে দুর্বলের উপর সবলের আধিপত্য বিস্তারের চর্চাকে সক্রিয় করে তোলে। পাশাপাশি, সামাজিক বাস্তব্যবিদ্যার আলোচনায় মারে বুকচিন নতুন আঙ্গিকে “জৈবসত্তা ঐতিহ্য” (Organismic tradition) তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। বুকচিনের “জৈবসত্তা ঐতিহ্য তত্ত্ব” অনুসারে সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক মূল্যবোধ সচেতন আত্মপ্রত্যয়মূলক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। এই সচেতন আত্মপ্রত্যয়মূলক কর্মকা- তখনই সম্ভব যখন মানুষ সকল প্রকার বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত থাকে। বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ বলতে শুধুমাত্র শারীরিক নিয়ন্ত্রণকেই বোঝায় না। সুতরাং নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাজ হচ্ছে তাই যা সকল প্রকার নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব থেকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে মুক্ত রাখে ।
অর্পিত সম্পত্তি আইন ও সামাজিক বাস্তুবিদ্যা
সামাজিক বাস্তুবিদ্যার উপরোক্ত তাত্ত্বিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে এখন আমরা বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তি আইন-কে মূল্যায়ন করব। এক্ষেত্রে প্রথমেই লক্ষণীয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাসে কাদের কোথায় অবস্থান। ধর্মের দিক থেকে এ দেশের মানুষ প্রধানত চারটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত। সংখ্যার দিক থেকে মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা গরিষ্ঠ, তারপর হিন্দুরা- তারা দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায়ভুক্ত। তা’ছাড়া আছে খ্রিস্টান ও বৌদ্ধরা। আছে আদিবাসী- যারা ভাষা ও সাং¯কৃতিক দিক থেকে অনেক উপ-গোষ্ঠীতে বিভক্ত।
অর্পিত সম্পত্তি আইন দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায় হিন্দুদের স্বার্থসংশ্লি¬ষ্ট। বলা বাহুল্য, উপমহাদেশে সামাজিক ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতে। শত্রু সম্পত্তি আইন ১৯৬৫ সনে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সেই উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার জন্য প্রণীত হয়েছিল। কালক্রমে যা অর্পিত সম্পত্তি আইন, অর্পিত ও অনাবাসী সম্পত্তি আইন ইত্যাদি নানা নামে অদ্যাবধি চলমান আছে। উল্লে¬খ্য জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ বহু শতাব্দী কাল থেকে এদেশে পাশাপাশি বসবাস করে আসছে। পাকিস্তান সরকার ‘বিভক্ত কর এবং শাসন কর’ ইংরেজদের এই নীতিকে অবলম্বন করে হিন্দুদেরকে সোশাল হায়ারার্কির দ্বিতীয় স্তরে স্থান দেয়। সাংবিধানিক যেসব আইন কানুনের মাধ্যমে এই হীন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তন্মধ্যে শত্রু সম্পত্তি আইন-টি অন্যতম যা নাগরিক অধিকার হরণের সর্বাপেক্ষা নগ্ন প্রচেষ্টা।
অর্পিত সম্পত্তি আইন বাংলাদেশের সমাজে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী কর্তৃক সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, নিজ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে সমাজে আধিপত্য বিস্তারের মনস্তত্ত্ব প্রকারান্তরে প্রকৃতিতেও অযাচিত হস্তক্ষেপের বাসনাকে জাগিয়ে তোলে যার ফলাফল ভয়াবহ। তাই সামাজিকভাবে সুবিধাজনক ও শক্তিশালী অবস্থানে থাকা ভূমি দখলকারী গোষ্ঠীর লোলুপ থাবা আজ শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভূ-সম্পদ গ্রাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সামাজিক জীবনকেও বিপন্ন করছে। এই অপসংস্কৃতি সমাজের সকল জনগোষ্ঠীর জীবনকে প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণের এই মনোভাবে প্রকৃতিতেও পড়ছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব; ধ্বংস হচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, বেআইনীভাবে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা বা কারখানা যার ফলে প্রায়শঃ ভূমিধ্বসে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ পাহাড়বাসীরা, প্রকৃতি হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা। পরিবেশ আইনকে উপেক্ষা করে একদিকে চলছে নদী-খাল ভরাট করে দখলী প্রক্রিয়া, অন্যদিকে অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে নদী দখল, খাল ভরাট, নদী-খাল দূষণ, বনভূমি দখল, বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণি হত্যা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকা-ের ফলে আজ বাংলাদেশের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির সম্মুখীন। নদী-খাল দখলমুক্তকরণ, পাহাড় কাটা বন্ধে প্রশাসনিক উদ্যোগসহ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনাও দখলবাজদের অবৈধ কর্মকান্ডগুলো থামাতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে অসম স্তরবিন্যাস, জীবনযাপনের প্রায় সকল ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের নামে আধিপত্য বিস্তার, সর্বোপরি অর্পিত সম্পত্তি আইন সহ নানাপ্রকার নিপীড়নমূলক আইন বহাল রেখে বাংলাদেশে সামাজিক বাস্তুবিদ্যক সমস্যার সমাধান করা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন অসম্ভব।
অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণের এই মনোভাবে প্রকৃতিতেও পড়ছে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব; ধ্বংস হচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে, বেআইনীভাবে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে স্থাপনা বা কারখানা যার ফলে প্রায়শঃ ভূমিধ্বসে প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ পাহাড়বাসীরা, প্রকৃতি হারাচ্ছে তার স্বকীয়তা। পরিবেশ আইনকে উপেক্ষা করে একদিকে চলছে নদী-খাল ভরাট করে দখলী প্রক্রিয়া, অন্যদিকে অপরিশোধিত বিষাক্ত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এভাবে ক্রমান্বয়ে নদী দখল, খাল ভরাট, নদী-খাল দূষণ, বনভূমি দখল, বনভূমি উজাড়, বন্যপ্রাণি হত্যা ইত্যাদি নানাবিধ কর্মকা-ের ফলে আজ বাংলাদেশের সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ চরম হুমকির সম্মুখীন।
বাংলাদেশের ভূমি আইন
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ভূমি আইনের বিবর্তনের রূপটি অর্পিত সম্পত্তি আইন নামক ভূমি আইনটির আলোচনায় গুরুত্ব বহন করে। জানা যায় যে, “খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার সালে সিন্ধু সভ্যতার সাথেই ভারতবর্ষের ভূ-সম্পত্তির ইতিহাসের সূত্রপাত হয়।”১০ প্রতিটি যুগের সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর রূপ এবং ভূমি সম্পর্কিত আইন বা ব্যবস্থাপনার রূপ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সময়ের সাথে সাথে নিত্য নতুন ধারণার প্রবর্তন এবং সমাজের সংকটের সাথে সংগতি রেখে তার আইন-কানুনের পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটে থাকে। বাংলাদেশের মতো একটি স্বল্পায়তনের কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রে ভূমির গুরুত্ব বেড়েই চলছে। বিশাল জনসংখ্যার অনুপাতে ভূমির দু®প্র্রাপ্যতা ভূমি ব্যবস্থাপনার সংকটকে উত্তরোত্তর তীব্রতর করে তুলছে। ফলে এখানে মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে ব্যাপকভাবে যুক্ত বলে ভূমি মালিকানার দিকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। বাংলাদেশের মতো একটি গ্রাম-প্রধান কৃষিভিত্তিক সমাজে ভূমির গুরুত্ব যে কোন মানদ-ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাচীন বাংলায় জনসংখ্যা অনুপাতে জমি ছিল প্রচুর। তখন অনাবাদী জমির পরিমাণই ছিল বেশি। এই অনাবাদী জমিগুলো চাষোপযোগী করে যে দখল করতো, সেই হতো সেই জমির মালিক। দখলীকৃত জমি ছিল তার নিরঙ্কুশ ভোগ-দখলের ক্ষেত্র। কিন্তু জনসংখ্যার বিস্তার, কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার অগ্রগতির ফলে ভূমির ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে যে রাজা পূর্বে ভূমির এবং ভূমি সংলগ্ন প্রজার ধারক, রক্ষক ও পালক এর দায়িত্ব পালন করতেন, পরবর্তীতে তিনিই দাবি করলেন শুধু ভূমিস্বত্বের অধিকারিত্ব। ভারতবর্ষে মৌর্য সম্রাটদের আমল থেকে এ বিবর্তন লক্ষণীয়। ফলে রাজাই হয়ে গেলেন কৃষি উৎপাদন বিকাশের স্তরে রাজ্যের সকল ভূমির মালিক। যদিও সে জমি কর্ষণ ও ভোগের অধিকার ছিল প্রজার। বিনিময়ে রাজাকে কর প্রদান করতে হত। তবে একথা বলাও দরকার, রাজা শুধু কর ভোগই করতেন না, নানাবিধ সামাজিক কর্মকা-েও ব্যয় করতেন।
প্রাক-মুঘল অর্থাৎ সুলতানী আমলে ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় প্রচলিত রীতি নীতিকে প্রথমদিকে অনুসরণ করা হতো। পরবর্তীতে এই ব্যবস্থাপনায় নতুন বিধি প্রণয়ন করা হয়। জানা যায় যে, “ভারতবর্ষে আলাউদ্দিন খিলজী (১২৯৬-১৩১৬) সর্বপ্রথম ভূমি ব্যবস্থাপনায় সংস্কার শুরু করেন।”১১ আলাউদ্দীন খিলজীর আমলে ভূমির উৎপাদন ক্ষমতা যাচাই করে উৎপাদিত ফসলের এক চতুর্থাংশ রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়। খরা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কৃষককে কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও উৎপাদন কার্য পরিচালনার জন্য ঋণ প্রদানেরও ব্যবস্থা করা হয়।
সম্রাট শের শাহের আমলে ভূমি আইনের বেশ কিছু সংস্কার সাধন করা হয়। তাঁর সময় জমিতে চাষীর স্বত্বাধিকার আইনানুগ স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ‘পাট্টা’ ও ‘কবুলিয়াত’ ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। মুঘল শাসনামলে ভূমি আইনে ভূমিতে উত্তরাধিকার স্বত্বের প্রবর্তন করা হয়। তাছাড়া ভূমিতে চাষীদের শ্রমস্বত্ব অধিকার, একই সাথে ভূমি হস্তান্তর ব্যবস্থারও প্রবর্তন করা হয়। দেখা যায়, “শের শাহ ভূমির পরিমাণ ও নিয়মিতভাবে ভূমির ধরণ নির্ণয় ও এর ভিত্তিতে খাজনা সংগ্রহ শুরু করার মধ্য দিয়ে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেন।”১২ তবে কৃষি ক্ষেত্রে সামান্য কিছু পরিবর্তন ঘটলেও সমগ্র মধ্যযুগের ভূমি আইন পুরোনো রীতিনীতির দ্বারাই পরিচালিত হয়েছে। সংস্কার যা হয়েছে তা কৌশলগত, মূলধারার সংস্কার সেখানে ছিল অনুপস্থিত।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতবর্ষ তথা বাংলার ভূমি মালিকানা তথা ভূমি ব্যবস্থাপনায় বড়ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়। ইংরেজ কর্তৃক ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানী ক্ষমতা লাভের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভূমি ব্যবস্থাপনার দর্শন পরিচালিত হয়েছিল একচেটিয়া মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে। ইংরেজরা চেয়েছিল ভারতবর্ষে একটি সুস্থির ও নিশ্চিত রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। এ লক্ষ্যেই ১৭৯০ সালের মধ্যে প্রথমত পাঁচসনা এবং পরে দশসনা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু এসব পদক্ষেপ রাজস্ব আদায়ে আকাক্সিক্ষত ফল প্রদানে ব্যর্থ হলে ১৭৯৩ সালে ব্যাপক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ফলাফল হিসেবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করা হয়। এর দুটি লক্ষ্য ছিল- “একটি হচ্ছে ভূমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা সৃষ্টি করা এবং আরেকটি হচ্ছে ভূমি নিয়ন্ত্রণে একটি ভূ-স্বামী শ্রেণি সৃষ্টি করা।”১৩ এই বন্দোবস্ত একদিকে ভারতবর্ষে কোম্পানির ক্ষমতা সংহতকরণ অন্যদিকে নির্ধারিত মাত্রার একটি সুনিশ্চিত রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত মোতাবেক জমিদাররা আদায়কৃত খাজনার দশভাগের নয় ভাগ নিয়মিতভাবে কোম্পানিকে প্রদান করে কোম্পানির নিকট থেকে জমির মালিকানাস্বত্ব লাভ করে। কিন্তু কোম্পানি রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করার জন্য ‘রাজস্ব বিক্রয় আইন’ নামে এমন এক কঠোর আইনের প্রবর্তন করেন যার ফলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানির বকেয়া পরিশোধে ব্যর্থ জমিদারদের জমিদারি বাতিলের বিধান রাখা হয়। এমনকি মহামারী, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির ফলে যখন রাজস্ব আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তখনও রাজস্ব আদায় শিথিল করা হয়নি। ইংরেজ কর্তৃক প্রবর্তিত রাজস্ব আদায়ের এই হিংস্র নীতি ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিরল।
তবে একই সময়ে ব্রিটেনেও একই ধরনের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। ব্রিটেনের জমিদার-শ্রেণি ভূমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আধুনিকীকরণ ও সচল করে মুনাফা অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকে। ফলে সেখানে একটি সফল কৃষি বিপ্লব সংগঠিত হয় ও কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিবাদী রূপ পরিগ্রহ করে। কিন্তু বাংলায় জমিদার শ্রেণি চেতনাগত পশ্চাৎপদতার ফলে উৎপাদনের উন্নয়নে অংশগ্রহণ না করে শুধুমাত্র খাজনা আদায়ের মধ্যে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখে। ফলে, বাংলাদেশে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরেও বাংলায় কৃষির অচলায়তন অব্যাহত থাকে। তবে রায়ত শ্রেণির উপর খাজনা ভার উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ফলে গোটা উনিশ শতক ব্যাপী ভারতে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের প্রথম অর্ধ শতকের অভিজ্ঞতায় গোটা কৃষি ব্যবস্থারই পুনর্বিন্যাস করার তাগিদ তৈরি হয়। এই তাগিদেরই ধারাবাহিক ফল ১৮৭৯ সালের খাজনা কমিশন এবং ১৮৮৫ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন এবং তৎপরবর্তী বেশ কয়েকটি সংশোধনী। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ. কে.এম ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলায় গঠিত সরকার স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডের নেতৃত্বে ‘ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন’ গঠন করে।১৪ উক্ত ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলা সরকারের আইন সভায় পাশ হয় পূর্ব বাংলা জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫১। এ আইন পাশের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে দেশে এক শ্রেণির রায়ত সৃষ্টি করে তাদেরকে ভূমির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ফলে ভূমিতে কৃষকের ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকৃত হয়। এ ছাড়াও নানা রকম প্রজাপত্তন, উপস্বত্ব প্রথা বাতিল সহ কৃষির সার্বিক উন্নতি সাধন ইত্যাদিও এ আইনের লক্ষ্য হিসেবে থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭২ এবং ১৯৮৪ সালে দুটি ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশ প্রণীত হয়। ১৯৭২ সালে পরিবার প্রতি জমির মালিকানা সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে তা সর্বোচ্চ ৬০ বিঘার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। এছাড়া এ দুটি অধ্যাদেশে ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বন্টন, বর্গাচাষীর অধিকারের স্বীকৃতি, ন্যূনতম কৃষি মজুরী নির্ধারণ, ভূমি সংস্কার বোর্ড গঠন ইত্যাদি নানাবিধ সংস্কার সাধন করা হয়। ১৯৯৪ সালে একটি আইনের মাধ্যমে ‘সিকস্থি’ ও ‘পয়স্থি’ সংক্রান্ত ভূমি আইন সংশোধন করা হয়। কিন্তু ১৯৪৭ উত্তর এই ভূমি আইন ও সংস্কারসমূহে সাধারণ মানুষের ভূ-সম্পত্তিজাত অনেক অধিকার এর বিধান যুক্ত করা হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে মানুষ এ থেকে উপকৃত হয়েছে সামান্যই। যার কারণে ভূমি সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা, বিত্তবানদের জবরদখল, আমলাতান্ত্রিক হয়রানি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।
‘শত্রু সম্পত্তি আইন’এর ঐতিহাসিক পটভূমি ও বিবর্তন
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক দর্শনে সৃষ্ট পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান ভূমিষ্ঠ কালেই জড়িয়ে পড়ে ইতিহাসের জঘন্যতম দাঙ্গায়। দাঙ্গার দাবানল থেকে জীবন রক্ষার্থে বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পরিবার সাত-পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারত তথা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে গমন করে। অনুরূপভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলমানরা পূর্ব বাংলায় আশ্রয় নেয়। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালেও দাঙ্গাকালীন এক পরিস্থিতিতে এই দেশান্তরিত হওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৯৪৮ সালে ঐতিহাসিক দিল্লী চুক্তি এবং ১৯৫১ সালে নেহেরু-লিয়াকত প্যাক্টের মাধ্যমে দেশত্যাগী উদ্বাস্তু মানুষের ভূ-সম্পত্তি রক্ষার্থে সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত হলেও তৎকালীন সরকার প্রণীত বেশ ক’টি আইন ধারাবাহিকভাবেই পূর্ব বাংলার দেশান্তরিত হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ফেলে যাওয়া ভূ-সম্পত্তি বেদখলের পটভূমি সৃষ্টি করেছিল। এরই সূত্র ধরে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালীন সময়ে প্রবর্তিত হয় শত্রু সম্পত্তি আইন। হিন্দু সম্প্রদায়ের রেখে-যাওয়া পরিত্যক্ত সম্পত্তি সমূহকেই ১৯৬৫ সালে আখ্যা দেয়া হয় ‘শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে।
১৯৪৮ সালে প্রণীত পূর্ব পাকিস্তান সম্পত্তি অধিগ্রহণ আইন থেকে শুরু করে ১৯৬৫ সালে শত্রু সম্পত্তি আইন- প্রত্যেকটি আইনই গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের পরিপন্থী আইন। লক্ষণীয় যে, এই আইনগুলোর অধিকাংশই প্রণীত হয়েছে সামরিক ও স্বৈরশাসকদের দ্বারা যাদের মূল দর্শন ছিল সাম্প্রদায়িক। ফলে, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ ১৭ দিনের মাথায় থেমে গেলেও এবং ১৯৬৯ সালে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হলেও শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করা হয়নি। ১৯৬৫ সাল থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাত্র ৬ বছরেই হিন্দু সম্প্রদায়ের মোট বেদখলকৃত ভূ-সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৭৪ শতাংশ।”১৫ এই দ্রুততর সম্পত্তি বেদখলের দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। এটা ছিল তৎকালীন পাকিস্তানী প্রায় ঔপনিবেশিক সরকারের ফ্যাসিবাদী চরিত্রেরই চরম বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল করে অর্পিত ও অনিবাসী সম্পত্তি প্রশাসন আইন নামে আরেকটি আইনের মাধ্যমে এসকল সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার নীতিমালা গ্রহণ করে।
বাংলাদেশের অর্পিত সম্পত্তি আইন ও তার স্বরূপ
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অঙ্গীকার করা হয় পাকিস্তান আমলের গণবিরোধী আইনসমূহ পর্যায়ক্রমে বাতিল করা হবে। কিন্তু আপাতত আইনের অব্যাহত চলমানতার সূত্র ধরে এই আইনসমূহ বাংলাদেশ সরকার অব্যাহত রাখে। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির এক আদেশ জারির মাধ্যমে শত্রু সম্পত্তি সমূহকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ সরকারে ন্যস্ত হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের ১নং অধ্যাদেশটি বাতিল করা হয় ১৯৭৪ সালে প্রণীত “ÒThe Enemy Property (Continuance of Emergency Provisions) Repeal Act,1974”১৬ অর্থাৎ শত্রু সম্পত্তি (জরুরি বিধানাবলীর অব্যাহতকরণ) রহিত আইন, ১৯৭৪ দ্বারা। এই আইনের ৩ নং ধারায় সকল শত্রু সম্পত্তি সরকারে অর্পিত হয়। একই সময়ে প্রণীত হয় The Vested and Non-Resident Property Act, 1974১৭ (অর্পিত ও অনিবাসী সম্পত্তি (প্রশাসন) আইন, ১৯৭৪) নামে আর একটি আইন। এই আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিক, কিংবা বিদেশী নাগরিক যারা পূর্বে বাংলাদেশের নাগরিক ছিলেন তাঁদের বাংলাদেশে স্থিত ভূ-সম্পত্তি সরকার কর্তৃক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, এই আইন হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
১৯৭৬ সালে তৎকালীন সরকার দুটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনকে পুনরায় জীবিত করে তোলে এবং ১৯৭৪ সালের অর্পিত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আইনটি বাতিল করে সরকারকে ঐ সকল সম্পত্তির সরাসরি মালিক বানানো হয়; যা পূর্বে শুধু তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণের দায়িত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এ দুটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার ১৯৫১ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে প্রদত্ত ভূ-সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারকে হরণ করে নতুন নতুন অনেক ভূ-সম্পত্তি সরকারী কাজের নানা ছলছুতোয় অধিগ্রহণ করতে থাকে। পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী এক ভূমিদস্যূ চক্র গড়ে ওঠে। যাদের রুটিন মাফিক কর্ম হয়ে দাঁড়ায় নতুন নতুন অর্পিত সম্পত্তি আবিষ্কার ও দখল।
এ দুটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার ১৯৫১ সালের প্রজাস্বত্ব আইনে প্রদত্ত ভূ-সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারকে হরণ করে নতুন নতুন অনেক ভূ-সম্পত্তি সরকারী কাজের নানা ছলছুতোয় অধিগ্রহণ করতে থাকে। পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী এক ভূমিদস্যূ চক্র গড়ে ওঠে। যাদের রুটিন মাফিক কর্ম হয়ে দাঁড়ায় নতুন নতুন অর্পিত সম্পত্তি আবিষ্কার ও দখল।
ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ একের পর এক ভূ-সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ হতে থাকে এবং ব্যাপকভাবে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ক্রমাগত সামাজিক অর্থনৈতিক জুলুমের প্রতিবাদে দেশব্যাপী নানা সংগঠন সোচ্চার হতে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয় যে, নতুন করে আর কোন সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হবেনা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এটা শুধু প্রতিশ্রুতির মাঝেই ঘুরপাক খায়, আদৌ তার বাস্তবায়ন হয় না।
পরবর্তীতে ২০০১ সালে বাংলাদেশ সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। এই আইনটি ২২ তম জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয় এবং ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনার পরে পাশ হয়। এই আইনে নতুন করে কোন সম্পত্তি অর্পিতকরণ করা যাবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তাছাড়া জনস্বার্থমূলক কাজে অধিগৃহীত কতিপয় সম্পত্তি ব্যতীত বাকী অর্পিত সম্পত্তির একটি তালিকা প্রদান করে ৬ মাসের মধ্যে তা বৈধ মালিকদের কাছে প্রত্যর্পণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ খানিকটা আশার আলো দেখতে পায়। ১৯৬৫ সালে শত্রু সম্পত্তি আইন প্রণয়নের পর ২০০১ সালের এই ১৬ নং আইনটিই একমাত্র আইন যে আইনে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত ব্যক্ত হয়। সামগ্রিক অর্থে, এই প্রত্যর্পণ আইনটি সম্পদ হারানো মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের দাবি ছিল যে, সম্পত্তি প্রত্যপর্ণের এ আইনে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের প্রতিফলন ঘটুক এবং মালিকানাবিহীন অর্পিত সম্পত্তিতে একই সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হোক। অথচ ২০০২ সালের ২৬ নভেম্বর পরবর্তী ক্ষমতাসীন সরকার এই আইনে সংশোধনী এনে প্রত্যর্পণের সময়সীমা অনির্দিষ্ট করে দেয়। ফলে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া পুনরায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের তদানীন্তন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্পিত সম্পত্তি যাচাই বাছাই ও নিষ্পত্তিকরণ অধ্যাদেশ, ২০০৮ নামে একটি অধ্যাদেশ জারি করে। এ অধ্যাদেশে পাকিস্তান আমলে প্রণীত শত্রু সম্পত্তির তালিকা থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত যে সকল সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তা সবই অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে নতুন করে যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে পুনরায় তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এছাড়া এ অধ্যাদেশের মাধ্যমে ২০০১ সালের প্রত্যর্পণ আইনকে রহিতকরণ করে ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু পরিবার সমূহের হারানো সম্পদ ফিরে পাওয়াকে অনিশ্চিত করে দেয়া হয়। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এ অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার পুনরায় ২০০১ সালে প্রণীত অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন সংশোধন করে অর্পিত সম্পত্তি ফেরৎ দানের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে। দীর্ঘ দুই বৎসর নানা চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে অবশেষে ২০১১ সালে আইনটি সংসদে পাস হয়।১৮ যদিও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ের নানা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ২০০১ সালের আইনের আলোকেই অর্পিত সম্পত্তিগুলো প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছিলেন। যাহোক, বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের একটি সভায় এপ্রিল, ২০১২ এর মধ্যেই ফেরৎযোগ্য সম্পত্তির তালিকার গেজেট প্রকাশিত হওয়ার কথা থাকলেও তা বিলম্বিত হয়েছে। অধিকন্তু, ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নানা জটিলতা। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে সহজতর পদ্ধতিতে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত দখলকৃত ভূ-সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদেরকে ফেরৎ দেয়ার দাবি করেছে। এভাবে ১৯৬৫ সাল থেকে নানা রাজনৈতিক পটভূমিতে শত্রু সম্পত্তি আইন নতুন নতুন ডালপালা বিস্তার করে এখনও পর্যন্ত ক্রিয়াশীল রয়েছে।
পকিস্তান আমলে শত্রু সম্পত্তি আইন-এর ফলে শুধু দেশত্যাগকৃত হিন্দু পরিবারের ফেলে যাওয়া সম্পত্তিই নয়; সার্বিকভাবে নানা ছল ছুতোয় হিন্দু মালিকানার ভূ-সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে দখল করা হতে থাকে। কালক্রমে ভূ-সম্পত্তি বেদখলের এই মহোৎসব জন্ম দেয় নানা ভূমিদস্যু চক্রের। অন্যের জমি দখলে কৌশল হিসেবে সৃষ্টি করা হয় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা, ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ, দেশত্যাগে বাধ্য করা ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনা। তাদেরকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে বুঝতে বাধ্য করা হয় যে, এ দেশ তাদের জন্য নিরাপদ নয়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মাত্র ছয় বৎসরেই নজিরবিহীনভাবে হিন্দু জনসংখ্যা নিরুদ্দিষ্ট হয়। এই সময়ে মোট বেদখলকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৭৪,৩৭২ একর যা এ পর্যন্ত মোট বেদখলকৃত ভূ-সম্পত্তির তিন চতুর্থংশ (৭৪%)। যাতে “খানা প্রতি গড়ে ২৭৬ ডেসিমেল জমি হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতছাড়া হয়েছিল।”১৯ সম্পত্তি দখলের এই মহোৎসব থেকে দেবস্থান, ধর্মীয় উপাসনালয় এমনকি শ্মশানঘাট পর্যন্ত বাদ যায় না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অব্যাহতভাবে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর উপস্থিতি পাকিস্তান আমলের হিন্দু সম্পত্তি গ্রাসের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এ আইনের অভিঘাত যে পাকিস্তান আমলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়; বরং আরও বেশী ব্যাপ্ত তা সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন গবেষণা, সেমিনার, সংবাদপত্রের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
সরকারি জনসংখ্যা জরিপের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯০১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়ে চলছে। বিশেষজ্ঞ জনেরা হিন্দু জনসংখ্যার এই নিম্নমুখী প্রবণতাকে অস্বাভাবিক ও কৃত্তিম উপায়ে সৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর প্রবর্তন, নানা সময়ে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেশে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞ গবেষকদের দেয়া তথ্য মতে, ১৯৬৪ থেকে ২০০১ সন পর্যন্ত মোট ৮১ লক্ষ হিন্দু জনসংখ্যা নিরুদ্দিষ্ট হয়েছিল।২০ ভূ-সম্পত্তি হারিয়ে দেশত্যাগের এ ধারা এখনও অব্যাহত আছে।
সরকারি জনসংখ্যা জরিপের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯০১ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ধারাবাহিকভাবে হ্রাস পেয়ে চলছে। বিশেষজ্ঞ জনেরা হিন্দু জনসংখ্যার এই নিম্নমুখী প্রবণতাকে অস্বাভাবিক ও কৃত্তিম উপায়ে সৃষ্ট বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর প্রবর্তন, নানা সময়ে সংগঠিত সাম্প্রদায়িক সংঘাত দেশে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের একটি অন্যতম কারণ।
বিপুল সংখ্যক দেশত্যাগী মানুষের এদেশে রেখে যাওয়া ভূ-সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি আইন-এ একের পর এক অধিগ্রহণ করা হতে থাকে। পরবর্তীতে এটা শুধু দেশত্যাগী মানুষের সম্পত্তি দখলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পাশাপাশি অসংখ্য ভূমিদস্যু চক্র, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, এমনকি ভূমি অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দ্বারা হিন্দু সম্পত্তি দখলের নানামূখী অশুভ তৎপরতায় অব্যাহত থাকে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হয়ে উঠে জোর জবরদস্তি। তা’ছাড়া মামলা মোকদ্দমায় ফেলে আর্থিকভাবে কোণঠাসা করে অনর্পিত সম্পত্তিও বিক্রী করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি এই দখলী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে খোদ হিন্দু সম্প্রদায়েরই কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ যারা উপদ্রুত হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তিগুলো দখলে সক্রিয়। তাছাড়া যে সকল হিন্দু ভারতে চলে গেছে তাঁদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দেখিয়ে লিজ নেয়া হয়েছে। যাঁদের ভূ-সম্পত্তি এভাবে দখল করা হচ্ছে বা লিজ নেয়া হচ্ছে তাঁরা হয়ত দখলদারদেরই নিকটাত্মীয় বা প্রতিবেশী, কিন্তু দখলকারীদের মাঝে এই বিবেচনা অনুপস্থিত। সারা দেশে এইভাবে অসংখ্য সম্পত্তি দখল করা হয়েছে। ফলে এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে, দখলবাজদের কোন জাত-ধর্ম নেই, অন্যের সম্পদ দখলের হীন আকাক্সক্ষাই তাদের কাছে মুখ্য।
মামলা মোকদ্দমায় ফেলে আর্থিকভাবে কোণঠাসা করে অনর্পিত সম্পত্তিও বিক্রী করতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি এই দখলী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হচ্ছে খোদ হিন্দু সম্প্রদায়েরই কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ যারা উপদ্রুত হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তিগুলো দখলে সক্রিয়। তাছাড়া যে সকল হিন্দু ভারতে চলে গেছে তাঁদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দেখিয়ে লিজ নেয়া হয়েছে।
সরকারি হিসাবে দেশে মোট অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ সাড়ে ছয় লক্ষ একর দাবি করা হয়। কিন্তু দেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও গবেষকগণ মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছেন তাতে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। তাদের মতে ১৯৬৫ সাল থেকে ২০০৬ সময়কালে বাংলাদেশে “২৬ লক্ষ একর”২১ হিন্দু সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি আইনের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বেদখল হয়েছে। আর এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১২ লক্ষ পরিবার তথা ৬০ লক্ষ হিন্দু জনগোষ্ঠী। এই বিশাল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তির বাজার মূল্য (২০০৭ সালের হিসাবে) দাঁড়ায় ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা “বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) শতকরা ৬৭ ভাগের সমপরিমাণ।”২২ হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসা এই প্রলয়ংকরী বিপর্যয়ের ৫৩% ঘটেছে ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ কালপর্বে। বাকি ৪৭% ঘটেছে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে।
বিপুল পরিমাণ ভূ-সম্পত্তি হারিয়ে অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোও প্রতিনিয়ত ঘটে চলছে। দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ হিন্দু সম্পত্তি দখলে যে সহিংসতা ও নির্যাতনের পথ বেছে নিয়েছে তাতে নানাবিধ মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রের সচিত্র প্রতিবেদনে এরূপ অসংখ্য ঘটনার বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়।
শেষ কথা
ক্ষমতার দাপট এবং নানামুখী অপতৎপরতার ফলে বছরের পর বছর ধরে দেশের একটি দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ অর্পিত সম্পত্তি আইনের চোরাবালি ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের কেউ একজন ভারতে গেলেই অন্যদের নামেও লিখা হচ্ছে ‘হাল সাং ভারত’। সাতপুরুষ ধরে এদেশে বাস করলেও তার সম্পত্তি হঠাৎ করেই হয়ে যাচ্ছে অর্পিত সম্পত্তি তালিকাভুক্ত। অন্যের সম্পত্তি দখলের সংস্কৃতি এখন এতটাই নগ্নরূপে প্রকাশিত হচ্ছে যে সরকারী খাস জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, নিম্নবিত্ত ও সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভূ-সম্পত্তি একের পর এক বেদখল হয়ে যাচ্ছে। ফলে সরকারি হিসেবে যদিও দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ একর অর্পিত সম্পত্তি রয়েছে এর মধ্যে সরকারের দখলে আছে প্রায় দু’লক্ষ একর। বাকি সাড়ে চার লক্ষ একরই সরকারের বেদখলে। যদিও বেসরকারী গবেষণায় প্রমাণিত যে, দেশে অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ২৬ লক্ষ একর।
শত্রু সম্পত্তি ও অর্পিত সম্পত্তি বিষয়ক সমস্যার সমাধান খুবই জটিল। দীর্ঘদিন ধরে সমাজে ক্রিয়াশীল এই কালো আইন সমাজ জীবনে ইতিমধ্যে অপূরণীয় ক্ষতির সৃষ্টি করেছে। বর্তমান বাংলাদেশে ভূমির সংকট খুবই প্রকট। মাথাপিছু জমির পরিমাণ দিন দিনই হ্রাস পাচ্ছে। ফলে এ দিক থেকে অর্পিত সম্পত্তি আইন বিষয়ক সমাধান প্রক্রিয়াটি একটি জটিলতর প্রক্রিয়া। ফলে সমাধানটি হতে হবে সুচিন্তিত। এ লক্ষ্যে দেশের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের প্রস্তাবিত সুপারিশমালার ভিত্তিতে একটি সমাধান রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। অর্পিত সম্পত্তি আইনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব বিষয়ে গবেষকবৃন্দ, অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকদের দেয়া এই সমাধান রূপরেখাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিগত প্রায় চার দশক ধরে অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর বহুমাত্রিক অভিঘাতে হিন্দু জনগোষ্ঠীর জীবনে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তা চূড়ান্ত অর্থে এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এবং সামাজিক বাস্তুগত সংকট সৃষ্টি করে চলছে। সরকার অর্পিত সম্পত্তি আইন-এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক হলে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের মতামতের ভিত্তিতে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। কার্যকর ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এই আইন বাতিল ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিবর্গের ভূ-সম্পত্তি সমূহ ফেরৎ দেয়ার বিকল্প নেই।
ড. মিজানুর রহমান নাসিম: প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও সম্পাদক মননরেখা। ইমেইল: mizanrah68@gmail.com
তথ্যসূত্র:
১) Des Jardins, Environmental Ethics, 3rd edition, (Montréal, Canada: Wodsworth, 2005), p.168.
২) Arthur Tansley, ‘The Use and Abuse of Vegetational Concepts and Terms’, quoted in Frank Golley, A History of the Ecosystem Concept in Ecology, (New Heaven, Conn : Yale University Press, 1993), p.8.
৩) Des Jardins, ibid, p.172.
৪) For details, James Lovelock, Gaia: A New Look at Life on Earth, (Oxford, England: Oxford University Press, 1979).
৫) Des Jardins, ibid, p.168.
৬) Aldo Leopold, ‘The Land Ethic’, A Sand County Almanac, (New York: Ballantine, 1970), p.253.
৭) Des Jardins, ibid, p.214
৮) Des Jardins, ibid, p.244.
৯) Murray Bookchin, The Ecology of Freedom, (Palo Alto, Calif : Cesire Books, 1982), p.4
১০) ইরফান হাবিব, ভারতবর্ষের ইতিহাস প্রসঙ্গে, মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে, ভাষান্তর- কাবেরী বসু, (কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সী, ২০০৯), পৃ. ৫৭।
১১) মো: আব্দুল কাদের মিয়া, ভূমি জরিপ ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, ৪র্থ সংস্করণ, (ঢাকা: এ. কে. প্রকাশনী, ১৯৯৩), পৃ. ৩।
১২) T. Hussain, Land Rights in Bangladesh, Problems of Management, (Dhaka: UPL, 1st pub.1995), p. 14.
১৩) সিরাজুল ইসলাম, ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও কৃষি অর্থনীতি’, বাংলাদেশের ইতিহাস (সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত), ২য় খ-, (ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি, প্রথম বাংলা সংস্করণ, ডিসেম্বর, ১৯৯২),পৃ. ২২৫-২২৬।
১৪) T. Hussain, ibid, p. 18.
১৫) আবুল বারকাত ও অন্যান্য, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বঞ্চনা, অর্পিত সম্পত্তির মাাঝে বসবাস, (ঢাকা: পাঠক সমাবেশ, ১ম বাংলা সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৯), পৃ. ৭১।
১৬) The Enemy Property (Continuance of Emergency Provisions), Repeal Act, 1974, Act no. xlv of 1974, Ministry of Law and Parliamentary Affairs (Law Division), Government of The People’s Republic of Bangladesh, (Dhaka: Bangladesh Parliament, 1st July, 1974).
১৭) The Vested and Non-Resident Property Act, 1974,Act no. xlvi of 1974, Ministry of Law and Parliamentary Affairs (Law Division), Government of The People’s Republic of Bangladesh, (Dhaka : Bangladesh Parliament, 1st July, 1974).
১৮) The Vested Property Return Amendment Act 2011.The act has passed in the parliament in 28 November 2011.
১৯) আবুল বারকাত ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।
২০) ঐ, পৃ. ৫৭।
২১) আবুল বারকাত ও অন্যান্য,প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭।
২২) ঐ, পৃ. ৬৭।