মায়ের দুধ, দুধের বাজার
বনানী চক্রবর্তী
মানুষের জন্ম অন্য সকল প্রাণের জন্মের মতোই এক জটিল কিন্তু অপরিহার্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ঘটে তবে জন্মের পর মানুষই সবচাইতে দুর্বল নাজুক ও নির্ভরশীল থাকে। মা-ই তার অস্তিত্বের প্রধান অবলম্বন। আবার একমাত্র মানুষের জগতেই মুনাফার দাপটের নতুন নতুন উৎপাত এই শিশুদের মা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে উদ্যত হয়। মায়ের পেটে বেড়ে ওঠার ধারাবাহিকতায় জন্মের পরবর্তী পর্বে মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য অত্যাবশ্যকীয় হলেও বাণিজ্যের থাবা, সমাজের বৈষম্য, অসঙ্গতি, অমনোযোগ ইত্যাদি কারণে এই স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সম্পর্কও নানা বাধা ও বিভ্রান্তির মধ্যে পতিত হয়। এই লেখায় এই বিষয়টিই তলিয়ে দেখা হয়েছে।
শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক কনফারেন্স। মায়ের দুধ খাওয়ানোর গুরুত্ব বিষয়ে আলোচনা চলছে। পর্দায় একটি ভিডিও দেখানো হচ্ছে। কোনো এক হাসপাতালের ডেলিভারি রুম। একজন মায়ের ডেলিভারি হচ্ছে। মায়ের সঙ্গে ডাক্তার ও নার্স। নবজাতকের কান্না শোনা গেল। একজন নার্স তার ভেজা শরীর মুছে দিয়ে মায়ের পেটের ওপর উপুড় করে শুইয়ে দিল। তারপর অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা। সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটি তার পা দিয়ে মায়ের পেটে ছোট ছোট ধাক্কা দিয়ে উপরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে খুব ধীরে। হাত মুখে দিচ্ছে। লক্ষ করা গেল সে আসলে মায়ের স্তনের দিকে এগোচ্ছে। সবার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কী হবে এরপর। কোনো সাহায্য ছাড়াই গুটি গুটি হাত পায়ের ওপর করে শিশুটি পৌঁছে গেল মায়ের বুকে। দু-একবার জিব দিয়ে মায়ের স্তন ছুঁতে পারল। তারপর যা ঘটল তাতে সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ল অজস্র হাততালিতে। শিশুটি ততক্ষণে মায়ের স্তনের বোঁটা শক্ত করে মুখে ধরতে পেরেছে আর সাফল্যের সঙ্গে তৃপ্তিতে খেতে শুরু করেছে। ধারণা করা যায়, সেদিন উপস্থিত বেশিরভাগ চিকিৎসক এ ঘটনা বাস্তবে দেখেননি। সবাই আবেগাপ্লুত। মানুষের বাচ্চাও এরকম করে?
ঘটনাটি বছর পনেরো আগের। প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে দেখা। বুকের দুধ খাওয়া যে একটি প্রাকৃতিক ঘটনা এটা বোঝানোর জন্য এই ভিডিও দেখানো হয়। একই ধরনের ভিডিও ক’দিন আগে যখন প্রশিক্ষক হিসেবে আবার দেখা হলো; আবেগের জায়গায় প্রশ্ন এলো: কখন থেকে মানব শিশুরা আর এরকম করে না, নাকি করার সুযোগই পায় না? কী কী কারণে আর করছে না? বুকের দুধ খাওয়ানো কি শুধু মায়েরই ব্যক্তিগত কোনো কাজ? শুধু মাকে বা পরিবারকে বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ে জানানো বা শেখানোই যথেষ্ট? চিকিৎসকের ভূমিকা কতটুকু? কাজেই এবার আরও জানা আর জানানোর পালা।
গাছপালা, পাখি, পোকামাকড়, কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল আর দেখা-অদেখা আরও অসংখ্য প্রাণীর চারপাশে এই ‘আমরা’। কেউ ডিম থেকে শিশু আর কেউ সরাসরি শিশু জন্ম দিয়ে প্রজাতি এগিয়ে নেয়। পরিবেশ আর আবহাওয়াভেদে বিচিত্র উপায়ে প্রজাতি তার নবজাতকের রক্ষণাবেক্ষণ করে। কোটি বছর ধরে বিবর্তনের ধারায় প্রাণ কণা থেকে পর্যায়ক্রমে মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবির্ভাব যাদের শিশু প্রাণীরা জন্মের পর একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মা প্রাণীর শরীর নিঃসৃত রস বা দুধ খেয়ে বড় হয়। খাদ্য মোটামুটি নিশ্চিত থাকায় বৈরী পরিবেশেও টিকে থাকাটা বেশ সুবিধাজনক হয়। প্রমাণ পাওয়া যায় স্তন্যপায়ীর অস্তিত্বেরও কোটি বছর আগে থেকেই এদেরই আদিপ্রজন্ম ডিম বা শিশু প্রাণীর সুরক্ষা ও পুষ্টি নিশ্চিত করার জন্য ত্বকের গ্রন্থি থেকে একধরনের রস নিঃসরণ করত। এই গ্রন্থিগুলোই বিবর্তনের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে স্তনে পরিণত হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত জানা যায়। দেখা যায় মায়ের দুধের উপাদানগুলো প্রতিটি প্রজাতির প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগলের ক্ষেত্রে আমরা দেখি জন্মেই তারা মায়ের দুধ খুঁজে নেয় ঠিকমতো চোখ ফোটার আগেই। কারো কোনো সাহায্য লাগে না। এটা তার সহজাত প্রবৃত্তি। প্রথম দিকে মায়ের দুধের সঙ্গে গর্ভরস বা amniotic fluid-এর গন্ধে মিল থাকে–যে গন্ধটা শিশুর চেনা। তাই গন্ধ শুঁকে সে গন্তব্য পেয়ে যায়। জন্মে মাত্রই পেয়ে যায় তা নয়। খুঁজে নেওয়ার জন্য সময় লাগে। কারণ, কেউ সাহায্য করার নেই। যে আগে খুঁজে পায় তার দখল আগে। মানুষের বাচ্চাও এটাই করার কথা এবং সুযোগ পেলে এখনো করে যা ভিডিওতে দেখা গেছে। কিন্তু এই ‘প্রাকৃতিক আমরা’ থেকে যত বিচ্ছিন্নতা এলো, অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে যত দূরত্ব বাড়তে থাকল ততই মানুষের বাচ্চার সহজাত প্রবৃত্তি বাধা পেতে থাকল। যত বেশি লাভ-লোকসান, মান-সম্মানের হিসাব মানুষ বুঝতে থাকল ততই সে প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যেতে থাকল। যদিও বিষয়টা এতটা সরল সমীকরণ নয়। মাঝখানে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ আছে।
কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগলের ক্ষেত্রে আমরা দেখি জন্মেই তারা মায়ের দুধ খুঁজে নেয় ঠিকমতো চোখ ফোটার আগেই। কারো কোনো সাহায্য লাগে না। এটা তার সহজাত প্রবৃত্তি। প্রথম দিকে মায়ের দুধের সঙ্গে গর্ভরস বা amniotic fluid-এর গন্ধে মিল থাকে–যে গন্ধটা শিশুর চেনা। তাই গন্ধ শুঁকে সে গন্তব্য পেয়ে যায়। জন্মে মাত্রই পেয়ে যায় তা নয়। খুঁজে নেওয়ার জন্য সময় লাগে। কারণ, কেউ সাহায্য করার নেই। যে আগে খুঁজে পায় তার দখল আগে। মানুষের বাচ্চাও এটাই করার কথা এবং সুযোগ পেলে এখনো করে যা ভিডিওতে দেখা গেছে।
মানুষের সাধারণত একটি শিশু হওয়ার কারণে মায়ের দুধের জন্য প্রতিযোগিতা কম হওয়ার কথা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে শিশুর জন্ম আর মায়ের স্তন খুঁজে নেওয়া, এই সময়টা অন্য প্রাণীর মতো নয়। প্রথমত, মানব শিশু সদ্যোজাত অন্য স্তন্যপায়ীর মতো সচল থাকে না। তার কিছুটা সাহায্যের প্রয়োজন হয়। দ্বিতীয়ত, এই মধ্যবর্তী সময়টিতে ঢুকে পড়েছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হওয়া মনস্তত্ত্ব, সংস্কার, পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা। এর রেশ ধরেই চলছে শিশুর খাওয়া-দাওয়া, বড় হওয়া। বহু উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে এ অবস্থায় পৌঁছেছে মানুষ। এরই মধ্যে একদল বুঝতে শুরু করেছে যে আমরা দূরে সরে গেছি। তাই গত শতক থেকে আবারও শিশুর প্রাকৃতিক অধিকার তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জোর চেষ্টা শুরু হয়েছে।
শিশুর জন্ম একটি বিশেষ ঘটনা। তবে বিষয়টি এখন প্রাকৃতিক ঘটনার চেয়েও পারিবারিক, সামাজিক ঘটনা। মা গর্ভে ধারণ করলেও সামাজিক ধারণামতো সে বাবার পরিবারের সম্পত্তি, মায়ের পরিবারের আবদার। মা কিছুটা গৌণ হয়ে পড়েন। তাই জন্মের পর মায়ের চেয়েও পরিবারে অন্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে তার যোগাযোগ বেশি হয়। ধর্মীয়, সামাজিক রীতি পালন, মিষ্টিমুখ, ছেলে-মেয়েবিষয়ক মতামত, কার মতো দেখতে, বড় হলে কী হবে–এসব আলাপ-আলোচনা শেষ হতেই ঘণ্টাখানেক চলে যায় প্রায়ই। প্রচারণার ফলে শালদুধ খাওয়ানোর বিপক্ষে কুসংস্কার আগের চেয়ে অনেক কম হলেও বড় হলে মিষ্টিকথা, মিষ্টি ব্যবহারের আশায় মিছরি পানি, মধু খাওয়ানোর প্রচলন কম নয়। জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টা শিশু সজাগ থাকে, তারপর সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই এই সময়টা মায়ের দুধ দেওয়ার, মায়ের শরীরের সংস্পর্শে আসার, উত্তাপ, গন্ধ, স্পর্শ চেনার অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে নতুন যোগাযোগ তৈরি হওয়ার সুবর্ণ সময়। শালদুধ পুষ্টি এবং প্রতিষেধকে পরিপূর্ণ। একে শিশুর প্রথম টিকাও বলা হয়। পরিমাণে কম হলেও শিশুর প্রাথমিক প্রয়োজন এতেই মিটে যায় এবং প্রাকৃতিক সুরক্ষার সূচনা হয়। তাই প্রথম ঘণ্টায় মায়ের বুকের দুধ দেওয়ার ওপর খুব জোর দেওয়া হয়।
জন্মের পর প্রথম এক ঘণ্টা শিশু সজাগ থাকে, তারপর সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাই এই সময়টা মায়ের দুধ দেওয়ার, মায়ের শরীরের সংস্পর্শে আসার, উত্তাপ, গন্ধ, স্পর্শ চেনার অর্থাৎ মায়ের সঙ্গে নতুন যোগাযোগ তৈরি হওয়ার সুবর্ণ সময়। শালদুধ পুষ্টি এবং প্রতিষেধকে পরিপূর্ণ। একে শিশুর প্রথম টিকাও বলা হয়।
করোনাকালের পরের হিসাবমতো বাংলাদেশে অর্ধেকেরও কম শিশু জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মায়ের দুধ খেতে পারে। সারা বিশ্বের গড় হিসাব দেখতে গেলে এরকম ছবিই পাওয়া যাবে। হাসপাতালে ডেলিভারি শতকরা ৫০ ভাগের কম। আবার হাসপাতালে ডেলিভারি হলেও বেশিরভাগ জায়গায়ই প্রশিক্ষণ না থাকা, জনবল না থাকার কারণে জন্মের পরপরই শিশু আত্মীয়স্বজনের দায়িত্বে চলে যায়, প্রথম ঘণ্টা কেটে যায়। তা ছাড়া স্বাভাবিক প্রসবের পর শিশুটির পরিবারের সঙ্গেই থাকার কথা। তারা তাদের মতো ব্যবস্থা নেন। নতুন একটা অবস্থায় উদ্বিগ্নতা, অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে মায়ের মানসিক অবস্থা থাকে খুব নাজুক। মা-শিশুর পারস্পরিক প্রয়োজন প্রায়ই উপেক্ষিত হতে দেখা যায়। যেসব জায়গায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসক আছেন সেসব ক্ষেত্রে বুকের দুধ শুরু করানো কখনো-বা চিকিৎসকের সঙ্গে অপ্রস্তুত পরিবারের যুদ্ধের মতো হয়ে যায়। কারণ, মায়ের দুধ পর্যাপ্ত পরিমাণে আসতে প্রথম দু-তিন দিন সময় নেয় আর অস্থিরতা তৈরি হয়, যদিও এই সময় শিশু দিনে দু-একবার প্রস্রাব করলেই তেমন কোনো জটিলতার আশঙ্কা থাকে না। তথ্য হিসেবে অনেকেই এই দেরি হওয়ার বিষয়টি জানেন, কিন্তু জানা আর বাস্তবে মেনে চলা হয়ে ওঠে না। অন্যদিকে হাসপাতালেও উপহার হাতে নিভৃত আনাগোনা শিশুখাদ্য কোম্পানির। কাজেই প্রশান্তিদায়ক সহজলভ্য মুশকিল আসান হিসেবে হাজির হয় কৌটার দুধ।
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ শিশুর সব প্রয়োজন মেটায়, এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খায় ৫৫ শতাংশ শিশু। যদিও বাস্তবে শহর, গ্রাম, পেশা, অর্থনৈতিক বা শিক্ষাগত অবস্থাভেদে এই হিসাব এক নয়। বেশিরভাগ মা কোনো ধরনের মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই মা হয়ে পড়েন, কম বয়সে বা উপযুক্ত বয়সে। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে ১৮ বছরের আগে ৪৭.২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় যারা নিজেরাই শিশু, যতই মাতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া হোক। জীববিজ্ঞানের হিসাবমতো তারা মা হয়। কিন্তু আজকের মানুষ শুধু জীব নয়। প্রকৃতির কার্যকারণ বুঝতে থাকা অনুসন্ধিত্সু জীব, প্রাকৃতিক বিবর্তনের পাশাপাশি যার ওপর সামাজিক বিবর্তনের প্রভাবও পড়ে। আবার প্রকৃতিতেও মা বাচ্চাকে দুধ দিতে না চাওয়ায় শিশুমৃত্যু বিরল ঘটনা নয়। কাজেই শুধু হরমোন নিঃসৃত হলেই মাতৃত্ব, দুধ খাওয়ানো স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হবে তেমন নয়। বর্তমান সময়ে জানা হয়েছে যে, মায়েরও প্রস্তুতি প্রয়োজন। সেই প্রস্তুতি নেওয়ার মতো প্রস্তুতিও আমাদের মায়েদের থাকে না। শিশুমায়ের শিশু পালনের মানসিক প্রস্তুতি থাকার কথা নয়। আবার শিশু বা পরিণত বয়স্ক যা-ই হোক, যে কোনো একটা বিষয়ে আলোচনা উপদেশ পেয়ে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষার ন্যূনতম ভিত্তিও প্রয়োজন। তাহলে হাতে রইল গরুর দুধ, কৌটার দুধ।
ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ শিশুর সব প্রয়োজন মেটায়, এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন নেই। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খায় ৫৫ শতাংশ শিশু। যদিও বাস্তবে শহর, গ্রাম, পেশা, অর্থনৈতিক বা শিক্ষাগত অবস্থাভেদে এই হিসাব এক নয়।
এ ছাড়াও অনেক ধরনের চিন্তার আনাগোনা হতে পারে মায়ের মনে। নতুন পরিস্থিতিতে ভয়, হতাশা, শরীরের গঠন নষ্ট হওয়ার বা সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার সমাজসৃষ্ট উদ্বেগ, স্বামীর মনোযোগ হারানোর আশঙ্কা, দাম্পত্য অস্থিরতা, চাকরি বা পড়াশোনার ক্ষতি; এরকম। বলা যায় যে, মায়ের মানসিক অবস্থা অবহেলিত থাকে পুরোপুরিই–অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা যাই-ই হোক। গর্ভকালীন সময়ও বুকের দুধ খাওয়ানো বিষয়ে আলাপ-আলোচনা অল্প সংখ্যক মা পেয়ে থাকেন। যারা পান পুরো বিষয়টা বুঝে কাজে লাগানোর মতো মানসিক পরিপূর্ণতা আর স্থিতিশীল পরিবেশ অনেকেরই নেই। পর্যাপ্ত পুষ্টির ঘাটতি, বিশ্রামের অভাব–এগুলো তো আছেই। কাজেই শারীরিক-মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন কারণে মা যদি দুধ খাওয়াতে না পারেন বা খাওয়াতে না চান তাতেও পরিবারের চাপ সৃষ্টির শিকার হতে হয়। পরিবেশের অস্থিরতা শিশুকে প্রভাবিত করে। আবার এরকম ঘটনাও কম নয় যে বুকের দুধ পর্যাপ্ত থাকার পরও মা-বাবা বা পরিবার সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না। আবার সচ্ছলতা যাদের আছে তারা যত্নের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বা শিশুর ওজন বাড়ানোর জন্য দামি কিছু খাওয়াতে চান। এসব ফাঁক-ফোকর দিয়ে নিশ্চিন্তে ঢুকে পড়ে কোম্পানির কৌটা।
শিশু জন্মদানের পরপরই বেশিরভাগ মা দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কোনোরকম ছাড় পান না। কারণ, শিশু জন্মের পর পরিবারে বাবাসহ আর কারো জীবনযাত্রায় কোনো ধরনের পরিবর্তন বরদাশত হয় না। শিশুর যত্নসহ গৃহস্থালি বা বাইরের কাজ যা-ই হোক। এ কাজে মাকে সহায়তা করা, তার পুষ্টি বিশ্রামের দিকে নজর দেওয়ার চিন্তা এখন পর্যন্ত তেমন গড়ে ওঠেনি ঘরে-বাইরে কোথাও। শিশু পালনের ঐতিহাসিক ফাঁদে নারীরা এখনো আবদ্ধ। মানব সমাজের একটি সদস্যকে নিজের শরীরে লালন করে পরবর্তী সময়ে এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যেন তারই একার। গৃহস্থালি কাজ, অন্য অনেক কাজের মতোই–অলিখিতভাবে একান্তই তার। এখানে কোনো সাপ্তাহিক বা মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। এই পর্যায়ে সবকিছু সামাল দিয়ে শিশুকে দেওয়ার সময় এবং শারীরিক-মানসিক শক্তিতে ঘাটতি পড়ে অনেকের। তারা বিকল্প খোঁজেন। প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধব, সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে আবারও এসে পড়ে কৌটার দুধ।
মানব সমাজের একটি সদস্যকে নিজের শরীরে লালন করে পরবর্তী সময়ে এগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব যেন তারই একার। গৃহস্থালি কাজ, অন্য অনেক কাজের মতোই–অলিখিতভাবে একান্তই তার। এখানে কোনো সাপ্তাহিক বা মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। এই পর্যায়ে সবকিছু সামাল দিয়ে শিশুকে দেওয়ার সময় এবং শারীরিক-মানসিক শক্তিতে ঘাটতি পড়ে অনেকের।
বড় অংশ কর্মজীবী নারীরা বুকের দুধ চালিয়ে নিতে পারেন না, সে যে ধরনের পেশায় থাকেন না কেন। সারা বিশ্বে প্রায় ৬৪৯ মিলিয়ন কর্মজীবী নারী পর্যাপ্ত মাতৃকালীন ছুটি পান না। বাংলাদেশে, শ্রমজনশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। মাতৃত্বকালীন ছুটির নিয়ম সবধরনের প্রতিষ্ঠানে এক নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে জানামতে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি। আবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক কী নিয়মে চলে বোধগম্য নয়। প্রতিষ্ঠান বা চাকরির ধরন অনুযায়ী ছুটি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। আইন অনুযায়ী শ্রমিক নারীর মাতৃত্বকালীন ছুটি দুই মাস শিশু জন্মের আগে এবং দুই মাস শিশু জন্মের পর (যদিও পর্যাপ্ত নয়)। কলকারখানায় সেই ৪ মাসও বিভিন্ন শর্তযুক্ত হয়ে আরও কমে যায় বলে মায়েদের মুখে শোনা যায়। অথচ WHO-র সুপারিশমতো শ্রমজীবী, পেশাজীবী বা অপেশাজীবী সব মায়ের শিশুই জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়ার কথা। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সুবিধামতো ছুটিতে যাওয়ার সময় নির্ধারণ করে। ফলে জন্মের মাসখানেকের মধ্যেই কাজে যোগদান করতে হয় অনেকের। কাজে যোগদানের আগে থেকে তারা মানসিক চাপে ভুগতে থাকেন, যা দুধ নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। কেউ কেউ আগেই অভ্যেস করতে চান বিকল্প খাবার। প্রচারণার ফলে অনেক মা-ই বুকের দুধ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন। গবেষণায় দেখা গেছে, মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়কাল বাড়লে মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর হার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়।
এরপর কাজের ধরন, সময় বা রুটিনে কোনো শিথিলতার প্রশ্ন তো আসেই না, তার ওপর দুধ খাওয়ানোর বা দুধ সংরক্ষণ বা সহায়তা এসবের ব্যবস্থা স্বপ্নমাত্র। বাচ্চা হওয়া নিয়ে কটূক্তিও কম নয়। প্রথমত: নারী, দ্বিতীয়ত: চাকরি করে, তৃতীয়ত: শিশু জন্ম দিয়েছে। যেন অসম্ভব ব্যক্তিগত একটি কাজের জন্য সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। ভাবখানা হলো: এত আবদার কীসের, দরজা খোলা, নতুন লোকের অভাব নেই। ধরন আলাদা হতে পারে, তবে শ্রমিক নারী বা অন্যান্য পেশাজীবী নারীর অভিজ্ঞতা প্রায়ই কাছাকাছি। ডে-কেয়ারের ধারণা এখন পর্যন্ত প্রস্তাবনা পর্যায়ে আছে, কাগজে-কলমে পোক্ত হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চুক্তি, অনুদানজাতীয় বিশেষ পরিদর্শনের সময় ডে-কেয়ারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে তার হদিস মেলে না। কারণ, কর্মীদের জন্য ডে-কেয়ার চালানোর খরচ হলো বাজে খরচ। এই পর্যায়ে মায়ের হাতে দুটো উপায়। চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা বুকের দুধ খাওয়ানো বাদ দেওয়া। কেউ বলেন, ‘একজনের চাকরিতে তো পরিবার চলে না’, কেউ বলেন ‘গরিব মানুষ, কী আর করব’। আবারও সচ্ছল-অসচ্ছল সবার জন্য ত্রাণকর্তা কৌটার দুধ। কাজেই মড়ার ওপর খাঁড়ার মতো খরচটা চলে যায় শিশুর পরিবারের ঘাড়ে আর পুষ্টি পায় দুধ কোম্পানি। এর সঙ্গে যুক্ত হয় তালমিছরি, চিনি, সুজি, জ্বালানি খরচ। মাঝে পড়ে অপুষ্টিতে ভোগে অসচ্ছল পরিবারের বুকের দুধবঞ্চিত শিশু। কারণ, পাতলা করে দুধ খাইয়ে খরচকে কিছুটা সহনীয় করার চেষ্টা করা হয়। কমিয়ে আনা খরচ বহুগুণে বেরিয়ে যায় ওষুধ আর হাসপাতালের বিল দিতে গিয়ে। অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমজীবী যারা বাসাবাড়ি, হোটেলে কাজ করেন তারাও এই দুষ্টচক্র থেকে রেহাই পান না।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে চুক্তি, অনুদানজাতীয় বিশেষ পরিদর্শনের সময় ডে-কেয়ারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেলেও পরবর্তী সময়ে তার হদিস মেলে না। কারণ, কর্মীদের জন্য ডে-কেয়ার চালানোর খরচ হলো বাজে খরচ। এই পর্যায়ে মায়ের হাতে দুটো উপায়। চাকরি ছেড়ে দেওয়া বা বুকের দুধ খাওয়ানো বাদ দেওয়া।
একটু লক্ষ করলে শিশুকে কেন্দ্র করে পরিবারে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও দেখা যায়। শিশু যদি শুধুই মায়ের দুধ খায় বা বেশিরভাগ সময় মায়ের সঙ্গে কাটায় তাতে দুটো অসুবিধা দেখা দেয়। মাকে সাংসারিক কাজে কম পাওয়া যাওয়ার সম্ভাবনা, আর শিশুর যত্নে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ নারীদের ভূমিকা কমে যাওয়া। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে গুরুত্ব পাওয়ার একমাত্র রাজ্যে তারা নিজেদের গুরুত্বহীন মনে করেন। একটা অঘোষিত অস্পষ্ট ক্ষমতার লড়াই চলতে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে হালকা মনে হলেও এগুলো মায়ের ওপর গুরুতর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা বুকের দুধ নিঃসরণ কমিয়ে দিতে পারে। মান রাখতে, মন রাখতে এই সুযোগে হাজির হয় কৌটার দুধ।
জন্ম নেওয়ার পর থেকে বাইরের জগতের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে শিশুর সময় লাগে। শুরু হয় মায়ের গর্ভের পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। তারপর মায়ের শরীরের গন্ধ সান্নিধ্য পাওয়ার বদলে বহু অপরিচিত গন্ধ শব্দ তাকে বিভ্রান্ত করে। অবস্থাভেদে প্রথম দুই থেকে চার সপ্তাহ সময়ে অতিরিক্ত কান্না, রাতে না ঘুমানো, শরীর মোচড়ানো–এগুলো তার অভিযোজন চেষ্টার অংশ। মূলত কান্নাই শিশুর ভাষা। ছোট-বড় সবধরনের অসুবিধা সে কান্না দিয়েই জানান দেয়। কিন্তু শিশুর কান্নাকাটির কারণ হিসেবে একটি সাধারণ সিদ্ধান্ত হলো দুধ পাচ্ছে না। তবে শিশু যদি মায়ের দুধ খেয়ে ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৬ বার প্রস্রাব করে, সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত বলা যায় দুধ না পাওয়াটা কান্নার কারণ হওয়ার আশঙ্কা কম। বরং কান্নার কারণ খোঁজা দরকার। জটিল অবস্থা থেকে শুরু করে কখনো-বা শুধু আরাম না হওয়াটাও কান্নার কারণ হতে পারে। এরপর আসে ঘনঘন পায়খানা বা চার-পাঁচ দিন পায়খানা না করা, অল্প পেট ফাঁপা। এগুলো বুকের দুধ খাওয়া শিশুর সাধারণ উপসর্গ যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। শিশুর বিভিন্ন আচরণ সম্পর্কে ধারণা না থাকার ফলে পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এগুলোর জন্য মায়ের খাবার, মায়ের দুধকে দায়ী করেন। এতে মায়ের আত্মবিশ্বাস আহত হয়। এরপরও আছে মায়ের জ্বর হলে দুধ খাওয়ানো যাবে না, সিজার হলে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে দুধ শুকিয়ে যায়, ডায়াবেটিস থাকলে দুধ কমে যায় বা খাওয়ানো ঠিক নয়, স্তনের বোঁটা ছোট হলে দুধ হয় না অথবা শিশুর খেতে অসুবিধে হয়, অনেকক্ষণ কাজে থাকার পর বাড়ি ফিরে দুধ খাওয়ানো ঠিক নয়, কারণ দুধ নষ্ট হয়ে যায়–এরকম অনেক বিভ্রান্তিমূলক ধারণা। দৈনন্দিন জীবনের অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তা, চারপাশের অজস্র বিভ্রান্তির কারণে এসব উদ্বিগ্নতা বাড়ে। মা-বাবা পরিবারের এই ভয়-আশঙ্কাকে পুঁজি করে ডায়রিয়া কমানোর, পেটে ব্যথা কমানোর, ভালো ঘুম হওয়ার আশ্বাস নিয়ে আবারও মঞ্চে প্রবেশ কৌটার। যদিও সমস্যার সমাধান হয় না। কারণ, এ জন্য প্রয়োজন চিকিৎসকের পরামর্শ। সেই পরামর্শ মেনে চলতে গেলে প্রয়োজন স্বস্তি।
ছয় মাস বয়স হওয়ার পর মায়ের দুধ শিশুকে পরিপূর্ণ পুষ্টি দেয় না, বিশেষ করে প্রোটিন আয়রনের চাহিদা বাড়ে। এই সময় তাকে বাড়তি খাবার দিতে হয়, ঘরে তৈরি খাবারের সঙ্গে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করতে হয়। পাশাপাশি দুবছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শিশুখাদ্য কোম্পানি যুগ যুগ ধরে মনোজগতের দখল নিয়ে নিয়েছে। ছয় মাস পার হতে-না-হতেই পরিবারে অস্থিরতা শুরু হয় শিশুর বাড়তি খাবার বিষয়ে। এখন পর্যন্ত গরুর দুধের জনপ্রিয়তাকে পুরোপুরি ছাপিয়ে যেতে না পারলেও শহর এলাকার বাইরেও মায়েদের মুখে মুখে ফর্মুলার নম্বর। তারা জানতে চান ৬ মাস হয়ে গেছে এখন ২ নম্বর দুধ দেবেন কি না, বা এক বছর হয়ে গেছে এখন ৩ নম্বর দুধ দেবেন কি না। কেউ জন্মের পর থেকেই ১ নম্বর ফর্মুলা খাওয়াচ্ছেন কেউবা বাড়তি খাবার বলতে পারিবারিক খাবারের চেয়েও কৌটার দুধকে উপযুক্ত মনে করছেন। কারো কারো বেলায় চাকরিতে যাওয়ার সময় শিশুকে বাড়ি রেখে যাওয়ার ক্ষেত্রে তৈরি খাবার বোতলে খাওয়ানো সহজ। তার ওপর আছে বিভিন্ন ‘স্বাদ-গন্ধের’ ‘বিভিন্ন ফলযুক্ত’ সেরেলাক, ‘লম্বা হওয়ার, শক্তিশালী মজবুত’ হওয়ার হরলিক্স আরও কত কী! এ ছাড়াও এসব খাবারের সঙ্গে শিশুকে খাওয়ানোর মগ, বাটি, চামচ–এসব তো রয়েছেই।
দুবছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ চালিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু শিশুখাদ্য কোম্পানি যুগ যুগ ধরে মনোজগতের দখল নিয়ে নিয়েছে। ছয় মাস পার হতে-না-হতেই পরিবারে অস্থিরতা শুরু হয় শিশুর বাড়তি খাবার বিষয়ে।
খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছর আগে থেকেই বুকের দুধের গুরুত্ব বিষয়ে আলাপ-আলোচনা যেমন পাওয়া যায় তেমনি দুধমা দিয়ে মায়ের প্রতিস্থাপন, আর শিশুখাদ্য হিসেবে মায়ের দুধের পরিবর্তে প্রাণীর দুধের ব্যবহারও দেখা যায়। দুধমা বা wet nurse-এর প্রচলন মিশরে শুরু হয় মূলত কুড়িয়ে পাওয়া বা মা-মরা শিশুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অভিজাত সমাজেই এর শুরু। সাধারণত দাসদের মধ্যে থেকেই দুধমা রাখা হতো আর বেঁচে যাওয়া শিশুদের দাস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরবর্তী সময়ে এই দুধমায়ের ব্যবহার মিশর, ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় অভিজাত পরিবারে প্রচলিত হয়ে যায়। দুধমায়ের সম্মান-প্রতিপত্তি দুই-ই বেড়ে যায়। ফলে দুধমা একটি আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। উপমহাদেশেও অভিজাত সমাজে দুধমায়ের প্রচলন ছিল। একসময় এই চর্চার বিরুদ্ধতা শুরু হয়। কারণ, ধারণা করা হচ্ছিল যেহেতু দুধমা পরিবারের বাইরের সাধারণত অর্থনৈতিক নিম্ন শ্রেলি থেকে নির্বাচন করা হয়, তাতে তারা শিশুর ওপর শারীরিক বা মানসিক কুপ্রভাব বিস্তার করতে পারে। প্রাকৃতিক মায়ের সঙ্গে শারীরিক-মানসিক বিচ্ছিন্নতাকেও শিশুর জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করা হচ্ছিল।
অন্যদিকে শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে আসা, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়–এসব কারণে সংসার চালানোর জন্য মেয়েদেরও কাজে ঢুকতে হলো। ফলে অভিজাত সমাজে ধীরে ধীরে কমতে থাকলেও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে প্রচলন শুরু হলো দুধমায়ের। কৃষক পরিবারের মেয়েরা নিজের বাচ্চাকে খাওয়ানোর পাশাপাশি অর্থের বিনিময়ে কারখানায় কাজ করা মায়েদের শিশুকে দুধ খাওয়াতেন। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, পরিচ্ছন্নতার অভাবের কারণে শিশুমৃত্যুর হার বেড়ে চলছিল। চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা বারবার বুকের দুধের ওপর, বিশেষ করে প্রাকৃতিক মায়ের দুধের ওপর জোর দিয়ে যাচ্ছিলেন। কারণ, তারা মায়ের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগের বিষয়টিও ভাবছিলেন, যা শিশুর বৃদ্ধি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ।
শিশু মমির সঙ্গে থাকা পাত্রে প্রাণীর দুধের অস্তিত্ব থেকে ধারণা করা যায় শিশুখাদ্য হিসেবে অন্য প্রাণীর দুধের ব্যবহার। প্রাপ্যতাভেদে গরু-ছাগল-উট প্রভৃতি প্রাণীর দুধ ব্যবহার হতো। প্রাণীর দুধের সঙ্গে বিভিন্ন শর্করাজাতীয় উপাদান ব্যবহার করে শিশুখাদ্য তৈরি এবং তার বাজারজাতকরণ শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ থেকে। পাশাপাশি দুধ খাওয়ানোর পাত্রও বাজারে আসতে থাকে। একই সঙ্গে বুকের দুধের পক্ষে প্রচারণা, গবেষণাও চলতে থাকে। একপর্যায়ে প্রাণীর ও মানুষের দুধের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়। এই পর্যায়ে প্রমাণ করা গেল যে, মানুষের দুধে জৈবরাসায়নিক উপাদানের অনুপাত মানব শিশুর শরীরবৃত্তীয় অবস্থার উপযোগী। এতে বুকের দুধের উপযোগিতা বোঝা গেল ঠিকই, কিন্তু শিশুখাদ্য ব্যবসায়ী তার লাভের চাবিকাঠি পেয়ে গেল। বুকের দুধের অনুপাতকে আদর্শ ধরে প্রাণীর দুধে বিভিন্ন উপাদানের যোগ-বিয়োগ করে প্রক্রিয়াজাত করা হলো। বিশ শতকের শুরুতে বাজারে চলে এলো মায়ের দুধের বিকল্প। বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেল। এমনকি চিকিৎসকরাও বিভ্রান্ত হলেন। তারপর তার অগ্রযাত্রা চলছে ফুলেফেঁপে; নিত্যনতুন সাজে। উচ্চবিত্ত মহলে শুরু হলেও দ্রুত দখল করে নিল সব অভিভাবকের মনস্তত্ত্ব আর দুনিয়ার বাজার। সমসাময়িক বিশ্বে তখন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা। সব মিলিয়ে শিশুর প্রাকৃতিক অধিকার বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ল।
মায়ের দুধের বিকল্প মায়ের দুধকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করতে পারেনি এখন পর্যন্ত। কারণ, মায়ের দুধ শুধুই একটি খাদ্য নয়, এটি একটি জীবন্ত খাদ্য (living food, bioactive food)। এতে মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি, সাইটোকাইন, ল্যাকটোফেরিনের পাশাপাশি জৈব সক্রিয় উপাদান যেমন: স্টেম সেল, microbiota, শ্বেতকণিকাও থাকে। মায়ের শরীরে যে জীবাণুগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বুকের দুধের মাধ্যমে, শিশু সেগুলো পেয়ে যায়।
কিন্তু মায়ের দুধের বিকল্প মায়ের দুধকে সম্পূর্ণ প্রতিস্থাপন করতে পারেনি এখন পর্যন্ত। কারণ, মায়ের দুধ শুধুই একটি খাদ্য নয়, এটি একটি জীবন্ত খাদ্য (living food, bioactive food)। এতে মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি, সাইটোকাইন, ল্যাকটোফেরিনের পাশাপাশি জৈব সক্রিয় উপাদান যেমন: স্টেম সেল, microbiota, শ্বেতকণিকাও থাকে। মায়ের শরীরে যে জীবাণুগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় বুকের দুধের মাধ্যমে, শিশু সেগুলো পেয়ে যায়। পাশাপাশি যদি সে একই মায়ের সংস্পর্শে থাকে, তাহলে সেই জীবাণুগুলোর সঙ্গে তার শরীরের সরাসরি যোগাযোগ হয়। অর্থাৎ শরীর তাদের চিনতে পারে। ফলে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা মজবুত হয়। আবার মায়ের শরীরের উত্তাপ তার তাপমাত্রা ঠিক রাখে। তাই প্রথম ঘণ্টায় শিশুর সঙ্গে মায়ের শারীরিক যোগাযোগকে (skin to skin contact) খুব গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। মায়ের স্পর্শ, শব্দ, মায়ের চোখে চোখ রাখা, যোগাযোগ তার বিকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সংস্পর্শে থাকলে মায়ের দুধ নিঃসরণও বাড়ে। আসলে শিশু যখন মায়ের দুধ খায় তখন শিশু এবং মায়ের মধ্যে একটি মনোজৈবনিক মিথস্ক্রিয়া চলে। মা-শিশু দুজনেই এর সুফল পায়। শিশু যখন মায়ের বুকে মুখ রাখে সেখানকার স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে খবর চলে যায় আর কিছু হরমোনের প্রভাবে দুধ নিঃসরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাই শিশু মায়ের বুকে মুখ না লাগালে, মায়ের সংস্পর্শে না থাকলে এ ঘটনা শুরু হয় না বা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। আবার মায়ের মানসিক চাপ মস্তিষ্কের কাজে বাধা হিসেবে দাঁড়ায়। মায়ের দুধের উপাদানগুলোর গুণগত পরিমাণগত মান সময়ের সঙ্গে, শিশুর বয়সের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। যতটুকু সময় ধরে সে খায় প্রথম অংশে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। তার তৃষ্ণা মেটে। এবং পরের অংশে প্রোটিন ফ্যাট থাকে তাতে তার ক্ষুধা মেটে, সে বৃদ্ধি পায়। ফলে শিশুর অতি ওজনের ঝুঁকি কমে যায়। কৌটার দুধে এই ভারসাম্য সম্ভব নয়। অন্যদিকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে মায়ের স্তন বা জরায়ু ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যায়। এ সময় কিছু হরমোন নিঃসরণের কারণে প্রাকৃতিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণও হয়।
যতটুকু সময় ধরে সে খায় প্রথম অংশে পানির পরিমাণ বেশি থাকে। তার তৃষ্ণা মেটে। এবং পরের অংশে প্রোটিন ফ্যাট থাকে তাতে তার ক্ষুধা মেটে, সে বৃদ্ধি পায়। ফলে শিশুর অতি ওজনের ঝুঁকি কমে যায়। কৌটার দুধে এই ভারসাম্য সম্ভব নয়। অন্যদিকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে মায়ের স্তন বা জরায়ু ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমে যায়। এ সময় কিছু হরমোন নিঃসরণের কারণে প্রাকৃতিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণও হয়।
মায়ের দুধের বিকল্প ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে শিশুমৃত্যু, অপুষ্টি মারাত্মক আকার নেওয়ায় একপর্যায়ে শিশু স্বাস্থ্য সংরক্ষণের পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৮১ সালে Breast milk substitute (BMS) বা বুকের দুধের বিকল্প বাজারজাতকরণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি (WHA) international code of marketing of breast milk substitute code (The code) নামে কিছু নীতিমালা প্রকাশ করে, যাতে সারা বিশ্বের সরকার, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর্মী এবং খাদ্য কোম্পানির দায়-দায়িত্ব বিষয়ে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে, যা ১৯৯০ সালে সংশোধন করে বাজারজাত করার আগে সব শিশুখাদ্য ব্র্যান্ডের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। বুকের দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে শিশুর নিরাপদ এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করা, প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান সাপেক্ষে অত্যাবশ্যকীয় বা জরুরি ক্ষেত্রে বুকের দুধের বিকল্প ব্যবহার এবং সুনির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে বিপণনের জন্য ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নতুন বিস্তারিত আইন পাস হয়। বিশ্বের ৩২টি দেশে এই নীতিমালা অমান্য করলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, ৪১টি দেশ কিছু কিছু ব্যবস্থা নিয়ে থাকে আর ৫০টি দেশে নীতিমালা গ্রহণ করা হলেও অমান্য হওয়ার ঘটনা নিয়মিত এবং নির্বিঘ্নে হয়ে যাচ্ছে।
UNICEF এবং WHO-র যৌথ উদ্যোগে ১৯৯১ চালু হয় BFHI (Baby friendly hospital initiative)। Bangladesh breast feeding foundation (BBF)-এর তথ্যানুযায়ী, এ দেশে ৪৯.৫ শতাংশ হাসপাতাল BFHI-এর নীতি মেনে চলে। এসব হাসপাতালের উদ্দেশ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ, গর্ভকালীন থেকে মায়েদের কাউন্সেলিং, জন্মের প্রথম ঘণ্টায় মায়ের দুধ খাওয়াতে ও পরবর্তী সময়ে চালিয়ে যেতে সাহায্য করা এবং BMS code-এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এদিকে ২০১৭ সালে WHO-র হিসাবে দেখা যায় যে, বিশ্বে আনুমানিক ১০ শতাংশ শিশু BFHI-এর আওতাধীন হাসপাতালে জন্ম নেয়।
ল্যানসেট-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে বুকের দুধ না খাওয়ানোর ফলে অসুস্থতাজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি ৩৪১.৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে কৌটার দুধসহ শিশুখাদ্য কোম্পানির বার্ষিক আয় গত চার দশকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। যেখান থেকে তারা আবার বছরে ৩ বিলিয়ন খরচ করে প্রচারণা বিজ্ঞাপনে। কোম্পানিগুলোর মালিকানা রয়েছে উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে, যদিও তাদের লাভের বড় অংশ জোগান দেয় নিম্ন আর মধ্যম আয়ের দেশের জনগণ। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক বোঝাও তৈরি করে এসব দেশের জনগণের মধ্যে। এসব কোম্পানির সঙ্গে একযোগে ব্যবসা করে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ডেইরি কোম্পানি। বিখ্যাত কৌটার দুধ কোম্পানিগুলোর একটা জনহিতকর চেহারা আছে। Nestle nutrition institute বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুষ্টি গবেষণা কেন্দ্র। নিয়মিত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম আয়োজনের পাশাপাশি তারা পুষ্টিবিষয়ক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় অনুদান দেয়। প্রতিবছর বেশ কিছু গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তারা। গবেষণাগুলো মূলত ফুড fortification বা খাদ্যে খনিজ, ভিটামিন যোগ করে মানোন্নয়ন, স্বাদ-গন্ধ যুক্ত করা। বিশ্বের খাদ্যমান নির্ধারক বা খাদ্য নীতিনির্ধারক সভাগুলোয় নাগরিক সমাজ, নারী ও শিশু অধিকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শিশুখাদ্য কোম্পানির পরোক্ষ প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন দেশের উচ্চমহলেও তাদের সরাসরি যোগাযোগ।
সারা বিশ্বে বুকের দুধ না খাওয়ানোর ফলে অসুস্থতাজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতি ৩৪১.৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে কৌটার দুধসহ শিশুখাদ্য কোম্পানির বার্ষিক আয় গত চার দশকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৫৫ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। যেখান থেকে তারা আবার বছরে ৩ বিলিয়ন খরচ করে প্রচারণা বিজ্ঞাপনে।
মা বা পরিবার শিশুর খাদ্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের জানা বোঝার ওপর ভিত্তি করে। কোনো একটা বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত কী রকম হবে সেটা নির্ভর করে সে কতটুকু জানে আর জানার উৎস কী। প্রাথমিকভাবে জানা শুরু হয় পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে। এরপর আসে রেডিও-টেলিভিশন বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে শিশুখাদ্য বিষয়ে সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন প্রচারণা থেকে। বিভিন্ন এনজিও, স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছেও পেয়ে থাকেন অনিয়মিতভাবে। বর্তমানে ইন্টারনেট তথ্যের জন্য একটি বহুলব্যবহৃত উৎস, যা আবার বাজারের বিজ্ঞাপনের দ্রুত প্রচারমাধ্যম। শিশুখাদ্য কোম্পানির নিয়মিত পদচারণা সমাজের সব স্তরেই, এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদের ভেতরেও। গ্রামের মুদি দোকান, ফার্মেসি থেকে শুরু করে শহরের ঝলমলে ফার্মেসি আর ওয়ানস্টপ শপও শিশুর খাদ্য বিষয়ে সিদ্ধান্তে ভূমিকা রাখে। কারণ, চোখের সামনে সাজিয়ে রাখা সুন্দর প্যাকেটগুলো টাকার বিনিময়ে হাতে পাওয়া যায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যের চেয়ে আকর্ষণীয় আর সহজ সমাধান মনে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসলেই নিরুপায়ের ভরসা।
সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করার জায়গায়ই চিকিৎসকের বা স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা। সরকারি প্রকল্প বা বিভিন্ন এনজিও এ ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সব চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ অত্যাবশ্যকীয় হওয়ার কথা হলেও কার্যক্ষেত্রে অপ্রতুল। বিশেষ করে শিশু রোগের চিকিৎসকরা যেহেতু শিশুদের সংস্পর্শে বেশি আসেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি অনেকটা নিয়মিত কাজ, অল্প সময়ের জন্য হলেও। মূলত চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করার সময় সবার বুকের দুধবিষয়ক প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন, যা বর্তমানে চেষ্টা করা হচ্ছে। গর্ভকালীন চেকআপের সময় থেকেই মাকে এ বিষয়ে জানানো জরুরি। কিন্তু অল্প সংখ্যক হাসপাতাল নিয়মিত এই কাজ করতে পারে। প্রশিক্ষিত অনেকেই আছেন। অপ্রতুল জনবল নিয়ে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন প্রশিক্ষণ দেওয়াও হচ্ছে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না এটি এমন একটি বিষয়, যেখানে জানানো অর্থ শুধুই কিছু তথ্য দেওয়া নয়। মায়ের শারীরিক অবস্থা, মায়ের ও পরিবারের মনস্তত্ত্ব, ধারণক্ষমতা, আর্থসামাজিক অবস্থা অনেক কিছু বিবেচনা করে পর্যায়ক্রমে তথ্য দেওয়াই উদ্দেশ্য। যাতে তারা এই তথ্য কাজে লাগাতে পারেন। আর এ জন্য দলীয়ভাবে, কখনো-বা একেকজন মাকে আলাদা করে নিয়ে কাজ করা দরকার হয়। ততটুকু সময় আসলেই চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীদের হাতে আছে কি না ভাবা দরকার। তার ওপর শুধু মাকে জানানোই শেষ কথা নয়। বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের জানানোও জরুরি। কারণ, এ জন্য সবার সাহায্য সহমর্মিতা দরকার। শিশুটি পরিবারেরই একজন সদস্য। তার প্রতি সবার দায়িত্ব আছে, শুধু মায়ের নয়। এই যোগাযোগ প্রায়ই বাদ পড়ে যায়।
অভিভাবকদের মধ্যে একটা বড় অংশ সংগত কারণেই বিষয়গুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। আসলে সেরকম মানবিক সামাজিক অবস্থায় তারা বাস করেন না, যাতে সহজেই বুঝে নেবেন। কিছু অভিভাবক বোঝেন বা বুঝতে চেষ্টা করেন। কিন্তু সেভাবে শিশুর যত্ন করতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর সঙ্গে অন্যান্য বহু বিষয় যুক্ত থাকে, যা আপাতসহজ বিষয়টাকে অসম্ভব করে তোলে। আর্থসামাজিক বাধা, চাকরি ক্ষেত্রে সুযোগের অভাব, অন্যদিকে সহজলভ্য বিকল্প থাকার কারণে স্বাস্থ্যকর্মী যে তথ্যজ্ঞান সীমিত সুযোগে দিয়ে থাকেন বা দিতে চেষ্টা করেন, তার বাস্তব প্রয়োগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা যায় না। সাজিয়ে-গুছিয়ে আবার নর্দমায় ফেলে দেওয়ার একটা উপমা চলে আসে। তাতে সময় ও সম্পদ দুই-ই নষ্ট। অনেক তথ্যজ্ঞান দিয়ে সমৃদ্ধ করার পর যদি পরিবেশের প্রভাবক রয়েই যায় বা তুলনামূলক বেড়ে চলে, তাহলে আচরণের পরিবর্তন ধীর গতি হবে সন্দেহ নেই। কাজেই নিশ্চিত করা প্রয়োজন যে মা এবং পরিবার শুধু নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই তথ্য পাচ্ছে, অন্য কোথাও বিভ্রান্ত হচ্ছে না। পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে সহযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত না করে মা ছয় মাস শুধু বুকের দুধ খাওয়াবেন এটা একটা অসম্ভব আশা। আবার এত ধরনের দুধের কোম্পানি চালু রেখে, পাড়ার দোকানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া কৌটার দুধ সহজলভ্য রেখে যদি ভাবা হয় এত টাকা খরচ করে, এত শেখানোর পরও কেন বুকের দুধ খাওয়ানো হচ্ছে না, তাহলে সেটা হাস্যকর। যেসব অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তার হাত ধরে শিশুখাদ্য ঢুকে পড়ে সেগুলো বন্ধ না করে সচেতনতা বৃদ্ধি বরং আরও কিছু মানসিক চাপ বৃদ্ধি করতে পারে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৬ শতাংশ হলো ০ থেকে ৩৬ মাস বয়সী শিশু। জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শতভাগ পুষ্টি সে মায়ের দুধ থেকে পাওয়ার কথা। পরবর্তী সময়ে দুই বছর বয়স পর্যন্ত পায় প্রয়োজনীয় পুষ্টির ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। কাজেই মায়ের দুধ জাতীয় এবং বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। নরওয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন নরওয়েজিয়ান মা শিশু জন্মের প্রথম বছরে আনুমানিক ২২৫ লিটার, পরের বছর আরও ৮১ লিটার দুধ শিশুকে খাওয়ান। সেই হিসাবে ২০১৮-১৯ সালে এক বছরে ১০.১ মিলিয়ন লিটার মায়ের দুধ উৎপন্ন হয়েছে এবং যদি শতকরা ৯৫ ভাগ মা সুপারিশমতো দুধ খাওয়াতে পারতেন, তাহলে আরও ৪০ শতাংশ উৎপাদন বেড়ে যেত। নিশ্চিত, নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক এই শিশুখাদ্য অর্থনৈতিক মূল্যমানের দিক থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য এবং অবমূল্যায়িত। এই পুষ্টি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন শুধু মায়ের স্বাভাবিক পুষ্টি জোগান, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম। আর প্রয়োজন কর্মজীবী মায়ের কর্মঘণ্টা কমানো এবং কাজের পাশাপাশি দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। অবশ্যই পূর্ণ বেতনে, কারণ সে নিজেই শিশুর খাদ্য উৎপাদন করছে, তার নিজের খাদ্য সংস্থান জরুরি। এ ক্ষেত্রে আলাদা করে টাকা দিয়ে গরুর দুধ, কৌটার দুধ কিনতে হচ্ছে না। জ্বালানি ও চিকিৎসা খরচ কমে যাচ্ছে। দুধের প্যাকেট, টিন এসব বর্জ্যজনিত পরিবেশ দূষণ কমে যাচ্ছে।
নিশ্চিত, নিরাপদ এবং প্রাকৃতিক এই শিশুখাদ্য অর্থনৈতিক মূল্যমানের দিক থেকে পুরোপুরি অদৃশ্য এবং অবমূল্যায়িত। এই পুষ্টি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন শুধু মায়ের স্বাভাবিক পুষ্টি জোগান, প্রয়োজনীয় বিশ্রাম। আর প্রয়োজন কর্মজীবী মায়ের কর্মঘণ্টা কমানো এবং কাজের পাশাপাশি দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা। অবশ্যই পূর্ণ বেতনে, কারণ সে নিজেই শিশুর খাদ্য উৎপাদন করছে, তার নিজের খাদ্য সংস্থান জরুরি।
শিশুর দু-একটা বিরল রোগের ক্ষেত্রে এবং মায়ের কিছু জটিল রোগের চিকিৎসা চলাকালীন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো সম্পূর্ণ বন্ধ রাখতে হয়। মায়ের অল্প কিছু সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে অথবা মা যদি কোনো গুরুতর অসুস্থতার কারণে একেবারেই দুধ খাওয়ানোর পর্যায়ে না থাকেন, তখন চিকিৎসকের পরামর্শমতো সাময়িক মায়ের দুধ খাওয়ানো বন্ধ রেখে অন্য ব্যবস্থা নিতে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ অসুস্থতা গণ্য নয়। আবার মায়ের কিছু সংক্রামক রোগের বেলায় সরাসরি দুধ খাওয়ানো না গেলেও দুধ চেপে নিয়ে বাটি চামচে খাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। অবস্থার উন্নতি হলে আবার আগের মতোই দুধ খাওয়ানো যায়। আজকের সময়ে এসে গুটিকয় বিশেষ ব্যতিক্রমের বেলায় শিশুর খাদ্যাভাব কাম্য নয়। তাই কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে শিশুখাদ্যের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। শিশু যদি ভবিষ্যৎ নাগরিক হয়, তাহলে সিদ্ধান্তের প্রশ্নে পরিষ্কার থাকতে হবে। সুস্থ নাগরিক নাকি লাভের হিসাব–রাষ্ট্র কাকে অগ্রাধিকার দেবে?
বনানী চক্রবর্তী: শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। ই-মেইল: cbanani24@gmail.com
তথ্যসূত্র:
১. https://www.thelancet.com/infographics-do/2023-lancet-series-breastfeeding
২. https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(22)01932-8/fulltext
৩. https://dhsprogram.com/pubs/pdf/PR148/PR148.pdf