‘দখলদার এবং অধিকৃতদের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না’

‘দখলদার এবং অধিকৃতদের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না’

ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত হুসাম জোমলতের সাক্ষাৎকার

গত ৯ অক্টোবর ২০২৩ লন্ডনে বিবিসি নিউজ যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত হুসাম জোমলতের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এটি তার অনুবাদ। সর্বজনকথার জন্য সাক্ষাৎকারটির ট্রান্সক্রিপ্ট এবং অনুবাদ করেছেন কল্লোল মোস্তফা। মূল সাক্ষাৎকারটি দেখা যাবে এখান থেকে: https://twitter.com/hzomlot/status/1711387200804315348

বিবিসি: আমি আপনাকে শনিবার সকালে নিয়ে যেতে চাই যখন আপনি প্রথম শুনলেন হামাস কী করেছে। আপনার তখন কী মনে হলো?

হুসাম জোমলত (যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত): আফসোস হলো, এত বছর ধরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সতর্কবার্তায় কর্ণপাত করেনি। আফসোস হলো, কয়েক দশক ধরে পরিস্থিতি বিষিয়ে তোলা হলো। আফসোস যে, এখন রক্তপাত হওয়ার পর বিবিসি এবং সারা বিশ্ব এ বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। আমি কেবল আশা করতে পারি, কিন্তু আমরা এই মুহূর্তটা আগে পাইনি।

বিবিসি: আপনি আফসোস করার মতো অনেক ঘটনার কথাই বললেন। ইসরায়েলে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি নিয়ে কি আপনার কোনো আফসোস নেই?

হুসাম জোমলত: প্রতিটি প্রাণহানির ঘটনা অবশ্যই আফসোসের এবং দুঃখজনক। কিন্তু প্রশ্ন হলো: আমরা কীভাবে এগুলো বন্ধ করব? কীভাবে আমরা বিকল্প অনুসন্ধান করব? কীভাবে আমরা অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেব? কীভাবে শতবর্ষ ধরে নিপীড়িত ফিলিস্তিনের জনগণকে অন্যসব জাতির মতোই সমান চোখে দেখব? আপনি যে বিপর্যয়ের কথা বর্ণনা করেছেন কীভাবে সেই বিপর্যয়ে পতিত হওয়া আমরা থামাতে পারি?

মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং দখলদারিত্ব ও বন্দিত্বের অবসান ঘটানোর ইচ্ছাশক্তিকে খাটো করে দেখবেন না। এ ঘটনা শুধু হামাসের বিষয় নয়। এ ঘটনা গত ৪৮ ঘণ্টারও বিষয় নয়।

এ ঘটনা একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে। ঘটনার সূত্রপাত ঠিক এখানে, লুইস, এই শহরেই। এই ব্রিটেনই কিন্তু আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ না করে আমাদের অধিকার ছেড়ে দিয়েছিল এবং তারপর আমাদের প্রতি পুরো আন্তর্জাতিক পশ্চিমা বিশ্বের আচরণ শুধুই হতাশাজনক।

ভিন্ন পথ বেছে নেওয়ার উপযুক্ত সময় এখনই। কারণ, আর কোনো বিকল্প নেই। জাতিসংঘে আমাদের রাষ্ট্রদূত যেমন বলেছেন, ন্যায়বিচার, প্রতিহিংসা নয় এবং শান্তি, যুদ্ধ নয়।

আর আমরা, ফিলিস্তিনের জাতীয় আন্দোলন, পিএলও, আমরা ৩০ বছর আগে সেই বিকল্প পথ দিয়েছি। আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। আমরা আলাপ-আলোচনা ও অহিংসা পন্থার কথা বলেছিলাম। আমরা আন্তর্জাতিক আইন ও সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলার অঙ্গীকার করেছিলাম। ইসরায়েলের শুধু একটি কাজ করার কথা ছিল: দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এবং ঔপনিবেশিক বসতি বিস্তার বন্ধ করা। কিন্তু একবারের জন্যও তারা তা করেনি। পরবর্তী সব সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জবাবদিহি ও গ্যারান্টি দেওয়ার কথা ছিল। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা করেনি। তাই আমরা আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি, লুইস, এবং প্রশ্ন হলো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো: সামনের দিনগুলোতে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যে ইসরায়েলি গণহত্যা ঘটতে চলেছে, সেটা আমরা কীভাবে বন্ধ করব এবং কীভাবে আমরা…

আমরা, ফিলিস্তিনের জাতীয় আন্দোলন, পিএলও, আমরা ৩০ বছর আগে সেই বিকল্প পথ দিয়েছি। আমরা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিলাম। আমরা আলাপ-আলোচনা ও অহিংসা পন্থার কথা বলেছিলাম। আমরা আন্তর্জাতিক আইন ও সিদ্ধান্তগুলো মেনে চলার অঙ্গীকার করেছিলাম। ইসরায়েলের শুধু একটি কাজ করার কথা ছিল: দখলদারিত্বের অবসান ঘটানো এবং ঔপনিবেশিক বসতি বিস্তার বন্ধ করা। কিন্তু একবারের জন্যও তারা তা করেনি।

বিবিসি: দুঃখিত, আপনার কথার মধ্যে নাক গলাতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কথা বললেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই এবং আমরা সেখানে ফিরে আসব। কিন্তু গত ৪৮ ঘণ্টার বিষয়েও আমাদের কথা বলতে হবে। শনিবার সকালে হামাস যা করেছে আপনি কি তা সমর্থন করেন?

হুসাম জোমলত: এটি সঠিক প্রশ্ন নয়, লুইস, সত্যিই সঠিক প্রশ্ন নয়।

বিবিসি: এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

হুসাম জোমলত: না, এটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নয়, কারণ…

বিবিসি: আপনি তাদের (হামাস) পদক্ষেপকে সমর্থন করেন কি না, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

হুসাম জোমলোত: না না না না না না। এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। হামাস একটি গোষ্ঠী, একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। আর আপনি কথা বলছেন সমগ্র ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধির সঙ্গে। আমাদের অবস্থান সবাই জানে এবং তা খুবই পরিষ্কার।

বিবিসি: কী সেই অবস্থান? আপনি কি হামাসের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন?

হুসাম জোমলত: আপনি তুলনা করতে পারেন না, আপনি তুলনা করতে পারেন না। প্রশ্নটা সমর্থন করা বা না-করার নয়। আমি এখানে আমার জনগণ, ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতে এসেছি, তারা কী অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে (তা বলতে এসেছি)। আমি এখানে কাউকে নিন্দা করতে আসিনি। আর যদি কাউকে নিন্দা করতেই হয়, তাহলে নিন্দা করতে হবে ইসরায়েলকে, যাদের আপনারা মধ্যপ্রাচ্যের ‘একমাত্র গণতন্ত্র’ বলছেন। যে দেশটি বেসামরিক নাগরিকদের টার্গেট করছে, আপনি তো এইমাত্র এ বিষয়ে রিপোর্ট করেছেন। আর এই ঘটনা যে কেবল এই শেষ ৪৮ ঘণ্টাতেই ঘটেছে তা তো নয়।

বিবিসি: হামাস ফিলিস্তিনিদের (উপস্থাপক এখানে সম্ভবত ‘ইসরায়েলি’ বলতে গিয়ে ভুলে ‘ফিলিস্তিনি’ বলে ফেলেছেন- অনুবাদক) টার্গেট করছে, কিন্তু আপনি তাদের নিন্দা করবেন না?

হুসাম জোমলোত: আপনাকে একটা কথা বলি। হামাস কিন্তু ফিলিস্তিনি সরকার নয়, ঠিক আছে? ইসরায়েলি সরকার তার সংগঠিত সেনাবাহিনীকে হুকুম দিচ্ছে। তাই দয়া করে এখানে কোনো তুলনা টানবেন না।

তুলনা করার কোনো সুযোগই এখানে নেই। দখলদার এবং অধিকৃতদের মধ্যে কোনো তুলনা চলে না। তা আপনার শ্রোতা এবং দর্শকদের বাস্তব পরিস্থিতি বোঝার জন্য সহায়ক হবে না।

ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এর একটিই সামরিক মতবাদ রয়েছে। দেশটি যখন যুদ্ধ করে, বেসামরিক লোকদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, বেসামরিক মানুষদের হত্যা করে।

১৯৪৮ সাল থেকেই চলছে। পুরাতন রেকর্ড দেখেন। গাজায় বারবার এই ঘটনা ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। সুতরাং এই আলাপচারিতা কোনো দোষারোপের খেলা নয়, ভুক্তভোগীকে উল্টো দোষারোপ করার কোনো কারবারে আমি নেই।

আসল কথা হলো: আমরা কীভাবে এই মারাত্মক দুষ্টচক্রকে থামাতে পারি?

বিবিসি: আপনি এইমাত্র বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য ইসরায়েলের নিন্দা করেছেন, কিন্তু বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার জন্য হামাসকে নিন্দা করবেন না?

হুসাম জোমলত: লুইস, আপনি কতবার ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন? শতবার। শতবার। ইসরায়েল কতবার যুদ্ধাপরাধ করেছে সরাসরি আপনাদের ক্যামেরার সামনেই? আপনি কি কখনো তাদেরকে তাদের কার্যক্রমের নিন্দা জানানোর প্রশ্ন দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করেছেন? করেছেন কখনো? কখনোই করেননি। না, না, এই প্রশ্নের উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। আপনার দেওয়ার দরকার নেই। আপনি জানেন, আমি কেন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করি? কারণ, আমি এই প্রশ্নের ভিত্তিটাকেই প্রত্যাখ্যান করি।

লুইস, আপনি কতবার ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন? শতবার। শতবার। ইসরায়েল কতবার যুদ্ধাপরাধ করেছে সরাসরি আপনাদের ক্যামেরার সামনেই? আপনি কি কখনো তাদেরকে তাদের কার্যক্রমের নিন্দা জানানোর প্রশ্ন দিয়ে সাক্ষাৎকার শুরু করেছেন? করেছেন কখনো? কখনোই করেননি।

কারণ, এর মূলে রয়েছে পুরো বিষয়টির ভুল উপস্থাপন। কারণ, ফিলিস্তিনিরা সবসময় নিজেদের নিন্দা করবে বলে আশা করা হয়। আরে বোঝার চেষ্টা করেন। এটি একটি রাজনৈতিক সংঘাত। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত।

তাই এখান থেকে শুরু করাটা ভুল। সঠিক সূচনাবিন্দু হতে পারে রুট কজ বা মূল কারণের অনুসন্ধান। বিবিসি এবং মূলধারার মিডিয়া ৭৫ বছর ধরে যা করছে সেই চরম অন্ধকার টানেল থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা।

যখনই কোনো ইসরায়েলি নিহত হয়, আপনি আমাদের এখানে ডেকে নিয়ে আসেন। আপনি কি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন যখন পশ্চিম তীরে অনেক ফিলিস্তিনি নিহত হয়, গত কয়েক মাসে যা ছিল ২০০-রও বেশি? জেরুজালেম এবং অন্য কোথাও ইসরায়েল যখন উসকানিমূলক আচরণ করে তখন কি আপনি আমাকে আমন্ত্রণ জানান? কারণ, ইসরায়েলিরা যা দেখেছে, যেটাকে আমরা গত ৪৮ ঘণ্টার করুণ ঘটনা বলে অভিহিত করতে শুরু করেছি, ফিলিস্তিনিরা ৫০ বছর ধরে তা প্রতিদিনই দেখছে। আপনি গাজার পরিস্থিতি জানেন। আপনি একটু আগেই তার বর্ণনা দিয়েছেন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত কারাগার। এখানে ১৬ বছর ধরে ২০ লাখ মানুষ ইসরায়েলের হাতে বন্দি হয়ে আছে।

তাই আমি এই কথাটা বলছি, লুইস, সম্ভবত সময় এসেছে মিথ্যা ও বিপজ্জনক এই কাঠামোটিকে পরিত্যাগ করার এবং মাঝে মাঝে হলেও মানুষকে কুৎসিত সত্যটি জানার সুযোগ দেওয়া।

বিবিসি: তাহলে আপনার চোখে এর সমাধান কী?

হুসাম জোমলত: আন্তর্জাতিক আইন। ব্যস। এর মানে কী? এর মানে হলো আন্তর্জাতিক আইনের সমান প্রয়োগ, যেমনটা আপনারা ইউক্রেনের ক্ষেত্রে করছেন।

আপনি কি ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে নিজ দেশের যোদ্ধাদের আচরণের নিন্দা জানাতে বলবেন?  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার পর লিগ অব নেশনসের মাধ্যমে যে নিয়মগুলো তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলোকে সম্পূর্ণরূপে এবং সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে ইসরায়েলের ক্ষেত্রে এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। ৭৫ বছর ধরে এই ব্যতিক্রম করা হয়েছে। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যেন কেউই আইনের ঊর্ধ্বে না থাকে। ব্রিটেন তো আইনের শাসনের জন্য বিখ্যাত, লুইস।

আমি মনে করি এটাই সমাধান। ইসরায়েল একটি দখলদার শক্তি। দেশটির দখলে থাকা জনগণের সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব কিন্তু তারই। আর তারা যদি সামনের দিনগুলোতে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে, তাহলে অবশ্যই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থার কাছে দেশটিকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে।

বিবিসি: হুসাম জোমলত, প্রোগ্রামে আসার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •