আমাদের অস্তিত্ব সুন্দরবন-১
ইতিহাস, নদী, লতাগুল্ম ও বৃক্ষরাজি
রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়
“বঙ্গদেশের দক্ষিণ সীমায় অবস্থিত সমুদ্র কুলবর্তী জঙ্গলাকীর্ণ ভূ-ভাগকে সুন্দরবন বলে। নিম্নবঙ্গে যেখানে গঙ্গা বহু শাখা বিস্তার করিয়া, সাগরে আত্মবিসর্জন করিয়াছেন, প্রাচীন সমতটের দক্ষিণাংশে অবস্থিত সেই লবণাক্ত পললময় অসংখ্য বৃক্ষ-গুল্ম সমাচ্ছাদিত শ্বাপদ-সঙ্কুল চরভাগ সুন্দরবন বলিয়া পরিকীর্ত্তিত হয়। ইহা পশ্চিমে ভাগিরথীর মোহনা হইতে পূর্বে মেঘনা মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত। কেহ কেহ মেঘনার মোহনারও পূর্বে অর্থাৎ নোয়াখালী চট্টগ্রাম প্রভৃতি জেলায় এবং হাতিয়া, সন্দীপ প্রভৃতি দ্বিপের দক্ষিণভাগে অবস্থিত বনভাগকেও সুন্দরবনের অন্তর্গত মনে করেন। প্রকৃত পক্ষে গঙ্গা ও মেঘনার অন্তর্বতী ভূ-ভাগই সুন্দরবন। ইহা বর্তমান কালে চব্বিশ পরগনা, খুলনা এবং বাখরগঞ্জ এই তিনটি জেলার অন্তর্গত এবং এই তিনটি জেলার যে অংশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের স্বত্বাধীন, তাহার দক্ষিণভাগে অবস্থিত।”
— সতীশ চন্দ্র মিত্র
ভূমিকা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার বহুমুখী উন্নয়নের ফলে মানুষ বর্তমানে অসীম শক্তির অধিকারী হয়েছে। তাই প্রকৃতিকে মানুষ যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারছে। মানব জাতি এমন এক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সভ্যতা সৃষ্টি করেছে যা প্রকৃতির উপর অতিমাত্রায় চাপ সৃষ্টি করেছে। বিঘ্নিত হয়েছে প্রতিবেশগত বিধিব্যবস্থা। প্রাকৃতিক যেসব সমীকরণ নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে বিশ্বজগত বিকশিত হচ্ছিল তাকে জোর করে মানুষ নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ওইসব নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার ফলে বিশ্ব প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। প্রতিবেশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন-বনানী, তার সৃষ্ট নানান বৃক্ষরাজি, লতা-গুল্ম, কীট পতঙ্গ, বনরাজির জলাভূমি এবং তার মধ্যে জাত মৎস্যকুল, অন্যান্য জলজপ্রাণী সবকিছুর প্রতি মানুষের স্বেচ্ছাচারী আচরণ প্রকৃতির লক্ষ-কোটি বছরের নিয়মবিধিকে পাল্টে দিয়েছে। এই সব অপরিণামদর্শী ক্রিয়াকর্মের পরোক্ষ ফল হিসেবে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশের মহাসংকট। ভাঙন চলছে বর্তমান জীবমন্ডলে। মানবজাতি এর ভয়াবহ কুফল ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হল প্রতিবেশ-পরিবেশগত এই সংকট সমাধানের মূল চাবিকাঠি কোথায়? এক পক্ষ বলছেন এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন। আবার কেউ কেউ বলছেন দূষণের মাত্রা রোধ করে এ সমস্যার মীমাংসা করা যাবে।
বিষয়টিকে শুধু বস্তুগতভাবে মীমাংসা করা যাবে না, আংশিক দিক দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করলেও কাজ হবে না। এ বিষয়ের মীমাংসার ক্ষেত্রে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ স্থির করতে হবে। কী সেই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি? সে দৃষ্টিভঙ্গি হল, এই গ্রহের অধিবাসী সকল প্রাণী-জীবকুল বিশেষ করে মানবজাতির জীবনধারা ও কর্মকাণ্ডের সামাজিক পুনর্গঠন এবং মানব সমাজের যুথবদ্ধতা, পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং মানুষ ও অন্যান্য জীব ও প্রাণীকুলের সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনপদ্ধতি এবং প্রকৃতির প্রতি যথাযথ আচরণ। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সংকট মীমাংসার পদ্ধতি গ্রহণ করলে মানব সমাজের ক্ষুদ্রাংশ কর্তৃক বৃহদাংশের শোষণ রহিত হবে এবং প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃতির সাথে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ এক সুখকর সমাজব্যবস্থা। এই দার্শনিক-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে জগতকে গড়ে তোলার কর্মসূচী গ্রহণ ছাড়া ভিন্ন কোন উপায় নাই।
এখন দেখা যাক বর্তমানে যে সংকটে আমরা পড়েছি এর কারণগুলি কী কী? একথা সত্য যে মানবজাতির সভ্যতার উষালগ্নে তার যে বিকাশ (মানবজাতি – সমাজ ও প্রকৃতির) তা ছিল প্রকৃতির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সদ্ভাবযুক্ত, সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং প্রতিবেশবান্ধব। সে ক্ষেত্রে বলা যায় মানবজাতির প্রাথমিক যেসব সামাজিক, বৈষয়িক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল তা সবই প্রকৃতি তাদের শিখিয়েছিল, এমনকি প্রকৃতি তাদের পথ দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ বিকশিত মানবসমাজ তার বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উন্নতির মধ্য দিয়ে প্রকৃতিকে শুধু নিয়ন্ত্রণই নয় বরং তাকে রূপান্তর করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। সাধারণভাবে বলা যায় মানবজাতি তার সীমা লঙ্ঘন করছে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে। প্রকৃতির দ্রব্য সামগ্রীর যথেচ্ছ ব্যবহার এবং সেসব কিছুকে ইচ্ছামত রূপান্তর এক ভয়ংকর পরিণতির দিকে নিতে চলেছে এই পৃথিবী নামক গ্রহটিকে। আর এসব কিছু করছে মানবজাতির কতিপয় অংশ। অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে সীমাহীন সম্পদ ও ক্ষমতা লাভের জন্য, আরো অধিক মুনাফা লাভের জন্য, আরো বেশি উৎপাদনের জন্য আরো বেশি শোষণ করার জন্য ওই কতিপয় মানুষ প্রকৃতি বিরোধী সকল কুকর্ম করছে। বিশ্বজনীন সুপরামর্শ, বিজ্ঞজনের মতামত, আপামর মানুষের বিদ্রোহ-বিক্ষোভ কোন কিছুই তাদের এই দুষ্কর্ম থেকে বিরত করতে পারছে না।
আজ মানবজাতির ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বুঝতে হবে এবম্বিধ কর্মকাণ্ড ক্রমাগত চালিয়ে গেলে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলে জীবমন্ডলের শুধু মানবজাতির আলাদাভাবে ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে সমগ্র জীবকুলের। ধ্বংস হবে মানবসমাজ। এই পৃথিবীতে আজ মানুষের সার্বিক কর্মকাণ্ড যেসব নেতিবাচক ফল প্রসব করছে তাতে প্রকৃতি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, এই মানবসমাজ বাস্তবিকপক্ষে প্রকৃতিরই সামাজিক রূপ। এখানে সীমাহীন হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রকৃতির সাথে মানবজাতি, জীবমন্ডল, প্রতিবেশ, সমাজব্যবস্থা এবং এর সকল নেতিবাচক ক্রিয়াকর্ম যেভাবে মানবজাতিকে ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে নিয়ে চলেছে ঠিক তেমনি বাংলাদেশের শাসক-শোষক শ্রেণীর অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের ফলে আমাদের অস্তিত্বের চিহ্ন ফলক সুন্দরবনের মহাক্ষতি সাধন করে চলেছে। একে একে এসব বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
দুই
সুন্দরবনের ইতিহাস
প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রের অপূর্ব সমাহারে সমৃদ্ধ সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। সুন্দরবনে সুন্দরীগাছ নামে একপ্রকার গাছের নামানুসারে এই বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। এই গাছের কাঠের রং লাল বর্ণ; তাই সুন্দর এবং সেই কারণে এই বনের নাম সুন্দরবন। অন্য এক পক্ষ বলেন, এটি সমুদ্রের বন। সমুদ্রকে সাধারণ মানুষ সমুন্দুর বলে থাকে। তাই এটা সমুন্দুরবন; তার অপভ্রংশ সুন্দরবন। বরিশালের ইতিহাস লেখক ব্রিটিশ পণ্ডিত মি. বিভারিজ অনুমান করেন যে, বাখেরগঞ্জ জেলার সুগন্ধা নদীর নামের থেকে সুন্দরবন নাম এসেছে। এককালে বাখেরগঞ্জে সুগন্ধা নামে একটি প্রবল নদী প্রবাহিত ছিল। এই নদীতীরে সনাতন ধর্মের একটি পিঠস্থান আছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশ্বাস সতী পার্বতী তাঁর পিতার মুখে পতিনিন্দা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। তখন তাঁর স্বামী শিব সতীকে স্কন্ধে করে নৃত্য করতে থাকলে সতী পার্বতীর দেহ ছিন্নভিন্ন হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে তাঁর দেহখণ্ড পড়ে এবং সেই স্থানগুলোকে পিঠস্থান বলে। এই ওই স্থানগুলি হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র তীর্থস্থান বলে বিবেচিত। সতীদেহের নাক এই সুগন্ধা নদী তীরে পড়েছিল। সেই থেকে নদীর নাম সুগন্ধা এবং সুগন্ধা নদীতীরের বনভাগ সুগন্ধার বন বা সুন্দরবন বলে পরিচিতি পায়। অন্য এক পক্ষ বলতে চান যে, পূর্বে বাখেরগঞ্জ জেলা চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের বনভাগকে চন্দ্রদ্বীপবন বলত। ওই চন্দ্রদ্বীপবন থেকে এর নাম সুন্দরবন হয়েছে। আবার এক পক্ষ চন্দ্রভন্ড নামে এক বন্যজাতির নামের সাথে সুন্দরবনের নামের সাদৃশ্য অনুমান করেছেন। এই জাতির কথা বাখেরগঞ্জে ইদিলপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে উল্লেখ রয়েছে।
যত আলোচনা এবং মতামত থাকুক না কেন সুন্দরী গাছ, সিন্দুর কাঠ বা সুন্দরী কাঠ যেহেতু সারা জঙ্গল জুড়ে ছড়িয়ে আছে, তাই সুন্দরী গাছের থেকেই সুন্দরবনের নামের উৎপত্তি বলে আমরা ধরে নিতে পারি। এই সুন্দরী গাছ অজস্র পরিমাণে উৎপন্ন হয় সুন্দরবনে। এটি সুন্দরবনের প্রধান, স্থায়ী, সর্বব্যাপী বিস্তৃত এবং অতিপ্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কাঠও বটে। এই গাছগুলিতে অধিক ডালপালা হয় না, কাঠ অত্যন্ত শক্ত ও ভারী, অনেক লম্বা হয়, যাবতীয় সরঞ্জামাদি, নৌকা, লঞ্চসহ বহুবিধ কাজ করা হয়। সে কারণে সুন্দরী কাঠকে সুন্দরবনের রাজা বলা যেতে পারে। সুতরাং এর নামানুসারেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে একথা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়া চলে।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল বলা হয়। এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ বন। এই স্থানে দিনে ৪ বার জোয়ারভাটার টান হয়। সমুদ্রের লোনা জলরাশি ২ বার ভিতরে ঢুকে অঞ্চল ভাসিয়ে দেয়, আবার ২ বার সব জল টেনে নিয়ে ভূখণ্ড শুকিয়ে ফেলে। সমুদ্রের লবণ জলের প্রতিদিন এই আসা-যাওয়ার মধ্যে জন্ম নেয়, টিকে থাকে এবং বিকশিত হয় যে বন তাকে বলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা ম্যানগ্রোভ বন। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অপার সৌন্দর্যমন্ডিত, অগাধ জীববৈচিত্র্যে সম্ভারে পরিপূর্ণ হাজারো প্রজাতির প্রাণীকুল ও বৃক্ষরাজি সুশোভিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবনের রয়েছে এক সুপ্রাচীন ইতিহাস।
সুন্দরবনের সন্নিকটবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল একদা ভাটি প্রদেশ নামে পরিচিত ছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশের সকল নদীগুলোই দক্ষিণগামী। কারণ এর অধিকাংশ নদী উত্তরের হিমালয় থেকে জন্ম নিয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। একসময়ে এই ভাটির দেশে ১২ জন রাজার প্রাধান্য ছিল বলে পুরো বাংলাদেশটাকেই ‘বারভাটি বাঙ্গালা’ নামে ডাকা হত।
এটি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ বন। এই স্থানে দিনে ৪ বার জোয়ারভাটার টান হয়। সমুদ্রের লোনা জলরাশি ২ বার ভিতরে ঢুকে অঞ্চল ভাসিয়ে দেয়, আবার ২ বার সব জল টেনে নিয়ে ভূখণ্ড শুকিয়ে ফেলে। সমুদ্রের লবণ জলের প্রতিদিন এই আসা-যাওয়ার মধ্যে জন্ম নেয়, টিকে থাকে এবং বিকশিত হয় যে বন তাকে বলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা ম্যানগ্রোভ বন। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট অপার সৌন্দর্যমন্ডিত, অগাধ জীববৈচিত্র্যে সম্ভারে পরিপূর্ণ হাজারো প্রজাতির প্রাণীকুল ও বৃক্ষরাজি সুশোভিত পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবনের রয়েছে এক সুপ্রাচীন ইতিহাস।
স্রোতস্বিনী গঙ্গা বহু শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে যেখানে সমুদ্রে পতিত হয়েছে সেই স্থানের বেলাভূমির উপরিভাগ জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে ক্রমান্বয়ে সুন্দরবনের সৃষ্টি হয়েছে। পুরাকালে গঙ্গা যেখানে সমুদ্রে পতিত হয়েছিল সেই স্থান থেকে বর্তমানের গঙ্গাসঙ্গম শত শত কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গঙ্গা হিমালয় হতে অধিক পরিমাণে গৈরিক মাটি বহন করে সাগরে আনে। এই গিরিমাটি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোর ভগ্ন এবং ক্ষয়িত মাটির সংমিশ্রণে পলিমাটির সৃষ্টি হয়। প্রথমে এই পলিমাটির দ্বারা বেলাতটের সৃষ্টি হয় এবং প্রথমে দ্বিপাকারে এবং পরে তা জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে বনাঞ্চলে পরিণত হয়। গঙ্গাবাহিত পলিমাটি এবং সুস্বাদু ও সুমিষ্ট জলরাশির সাথে সমুদ্রের লবণ জলের সংমিশ্রণে এক বিশেষ ধরনের জল উৎপন্ন হয়। ওই পলিমাটি এবং ওই বিশেষ ধরনের জলের দ্বারা কতকগুলি বিশেষ বিশেষ লতাগুল্ম ও বৃক্ষরাজি জন্ম নেয়। এটা সুন্দরবনের এক বিরল বিশেষত্ব যা পৃথিবীর আর কোথাও দৃষ্টিগোচর হয় না।
সুন্দরবন সত্যিই অতি সুন্দর। কিন্তু এই বনে ফলজ বৃক্ষ নেই বললেই চলে। যা দুএকটি দেখা যায় তার ফল মানবকুলের অভক্ষ্য, তা কেবল পাখ-পাখালি এবং বানরের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত। এ বনে স্নিগ্ধছায়া বহুবিস্তৃত বট-অশ্বত্থ নাই। সুন্দরবনের সকল গাছপালাই দীর্ঘকায়। কারণ এত ঘন, নিবিড় বন বিধায় সূর্য কিরণ প্রত্যাশী সবাইকে মাথা উঁচু করে উপরের দিকে উঠতে হয়। তাই তাকে লম্বা হতে হয়। এই বনে কোন ফুলগাছ হয় না। যা সামান্য আছে তার ফুল সুগন্ধী হলেও মানুষের প্রয়োজনে লাগে না। কারণ এই বন এতোটাই শ্বাপদসংকুল, এতটাই কর্দমাক্ত, এতটাই কন্টকাকীর্ণ, এতটাই বিপদজনক যে সেই সবকিছুর কাছে মানুষ পৌঁছাতে পারে না। তারপরও সুন্দরবন বড়ই সুন্দর। এর বন্য প্রকৃতির বন্য শোভা, এর নদ-নদীগুলোর কুলুকুলু জলধ্বনি, এর পাখিদের কলকাকলি, চঞ্চলা হরিণীর অবাধ বিচরণ, সর্বোপরি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডোরাকাটা রূপ সত্যি সুন্দরবনকে সৌন্দর্যে গৌরবান্বিত করেছে।
সুন্দরবনের প্রাচীনত্ব নিরুপণ এখনো যথাযথভাবে সম্ভব হয়নি। তবে বঙ্গ সমতটের সর্বত্রই যে একদা সুন্দরবন ছিল তা নানা কারণে অনুমান করা যায়। গঙ্গা মোহনা ক্রমাগত ভূ-গঠন করে করে দক্ষিণে সরে গেছে। সাথে সাথে সুন্দরবনও দক্ষিণে সরেছে এবং উত্তরাঞ্চল চাষাবাদী এলাকায় পরিণত হয়েছে। দেখা গেছে খুলনা শহরের নিকটে পুকুর খনন করে যে সব সিন্দুর গাছের গুঁড়ি পাওয়া গেছে ঠিক সেই ধরনের সিন্দুর গুঁড়ি পাওয়া গেছে কলকাতার সন্নিকটে শিয়ালদহ স্টেশনের নিকট পুকুর খনন করে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, এই সমতটের সর্বত্রই সম্ভবত সুন্দরবন ছিল। সুসাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশি তাঁর ‘কেরি সাহেবের মুন্সি’ উপন্যাসে কলকাতার অতি সন্নিকটে গভীর বনের বর্ণনা দিয়েছেন। অনুমান হয় যে ওটাও তখন সুন্দরবনেরই অংশীভূত ছিল।
খুলনা শহরের নিকটে পুকুর খনন করে যে সব সিন্দুর গাছের গুঁড়ি পাওয়া গেছে ঠিক সেই ধরনের সিন্দুর গুঁড়ি পাওয়া গেছে কলকাতার সন্নিকটে শিয়ালদহ স্টেশনের নিকট পুকুর খনন করে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে, এই সমতটের সর্বত্রই সম্ভবত সুন্দরবন ছিল। সুসাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশি তাঁর ‘কেরি সাহেবের মুন্সি’ উপন্যাসে কলকাতার অতি সন্নিকটে গভীর বনের বর্ণনা দিয়েছেন। অনুমান হয় যে ওটাও তখন সুন্দরবনেরই অংশীভূত ছিল।
১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির এক অধিবেশনে রেনী পুত্র (H.J. Rany’’র মধ্য পুত্র) সুন্দরবন ও প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে এক প্রবন্ধ পাঠ করেন। সভাপতি সবার মতামত জানতে চাইলে জনৈক মি: রেভারেন্ড লং (Rev. J. Long) বলেছিলেন যে, ১৮৪৮ সলে প্যারিস শহরে রাজকীয় অনুসন্ধান পরিষদের এক প্রধান পণ্ডিত তাঁকে ভারতবর্ষের একটি মানচিত্র দেখিয়েছিলেন। ওটি জনৈক পর্তুগীজ পর্যটকের আঁকা ছিল এবং তা প্রায় তখন থেকে ২০০ বছর আগের আঁকা। অর্থাৎ ওটি ছিল মোঘল রাজত্বের মধ্যযুগের। ঐ মানচিত্রে সুন্দরবনকে উর্বর দেশ দেখানো হয়েছে এবং সেখানে ৫টি নগরের উল্লেখ রয়েছে। ডি. ব্যারোস প্রণীত মানচিত্রেও এরূপ দেখানো হয়েছে এবং ভ্যাসডেন ব্রুকও তা সমর্থন করেছেন। এসব মানচিত্র থেকে জানা যায় যে, সুন্দরবনের সমুদ্র উপকূলে প্যাকাকুলি, কুইপিটাভাজ, নলদী, ডাপারা এবং টিপরিয়া নামে পাঁচটি বাণিজ্য বন্দর ছিল। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ঐকালে সুন্দরবন সংলগ্ন অনেক বন্দর ছিল কিন্তু পর্তুগীজদের সাথে যোগাযোগ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল ঐ পাঁচটি নগরীর।
ডি. ব্যারোস প্রণীত মানচিত্রেও এরূপ দেখানো হয়েছে এবং ভ্যাসডেন ব্রুকও তা সমর্থন করেছেন। এসব মানচিত্র থেকে জানা যায় যে, সুন্দরবনের সমুদ্র উপকূলে প্যাকাকুলি, কুইপিটাভাজ, নলদী, ডাপারা এবং টিপরিয়া নামে পাঁচটি বাণিজ্য বন্দর ছিল। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ঐকালে সুন্দরবন সংলগ্ন অনেক বন্দর ছিল কিন্তু পর্তুগীজদের সাথে যোগাযোগ এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল ঐ পাঁচটি নগরীর।
প্রাচীন কালে সুন্দরবন সংলগ্ন বন্দরগুলি ছিল বড়ই মনোরম। অসংখ্য নদীর মোহনা, সাগরকুলে বিস্তীর্ণ বালুকাবেলা, তদুপরি গভীর অরণ্য সবকিছু মিলিয়ে এই স্থানগুলো ছিল অতীব মনোরম। এখানে অবস্থান করলে মনে হবে একদিকে রাঢ়ভূমি ও কলিঙ্গ আর অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও আরাকান ভূমি সবাইকে আকর্ষণ করছে এই সুন্দরবন সংলগ্ন বাণিজ্য নগরীগুলো। আর ওই সকল জনপদের প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সম্ভার আমদানী-রফতানীর মাধ্যমে ওখানকার মানুষের অভাব মোচন করত। বিশেষতঃ যখন পশুর ও বলেশ্বরে পার্বত্য স্রোতের প্রাবল্য দেখা দিত তখন এসকল স্থানের গুরুত্ব আরও বেড়ে যেত। ইতিহাসখ্যাত চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য তরীগুলোও এসব এলাকায় গমনাগমন করত বলে অনুমান হয়।
তিন
সুন্দরবনের নদ-নদী
বৃহত্তর খুলনা জেলার প্রায় সবকটি নদী এঁকে-বেকে, ঘুরে-ফিরে শেষ পর্যন্ত সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। খুলনা জেলার নদ-নদীগুলোর বিবরণ এখানে প্রয়োজনীয়। খুলনার অসংখ্য নদী-নালা, অগণিত খাল-বিল জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে-বিছিয়ে আছে এ জেলার স্থলভাগ জুড়ে। বিদগ্ধ লেখকেরা একে মানবদেহের অন্তর্বাহী ধমনী ও শিরার সাথে তুলনা করেছেন। খুলনা জেলার এককালীন সেটেলমেন্ট অফিসার মি: এল. আর ফোকাস (FAWCUS) এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন নিম্নলিখিতভাবে:
‘It’s river system is to Khulna what veins and arteries are to the body; it carries the imports and exports essential to the economic life the district and disseminates the progress which builds up its moral welfare; the lines of ancient prosperity and culture run across the map of Khulna where its most ancient river ran.’
এই জেলার বহু নদী আগের মতো তীব্রগতি স্রোতস্বিনী বা সুগভীর নাই বটে তবে এখনো বর্ষাকালে যে কটি নদী আছে তার সবকটিই প্রবল স্রোত বহন করে সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করে। আমরা আগেই বলেছি যে এই জেলার প্রায় সকল নদ-নদীই সুন্দরবনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। যে যাই হোক, এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক আলোচনা এই যে, এখানকার কৃষি সমাজ, নগরসভ্যতা, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি প্রভৃতি গঠনে সর্বোপরি সুন্দরবনের সজীবতা, স্থায়ীত্ব এবং বিকাশের প্রয়োজনে নদ-নদীগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালির ইতিহাস: আদিপর্ব গ্রন্থে নদ-নদীর গুরুত্ব প্রসঙ্গে এভাবে উল্লেখ করেছেন,
‘বাঙালার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাঙালার ছোট-বড় অসংখ্য নদনদী। এই নদনদীগুলিই বাঙালার প্রাণ; ইহারাই বাঙালাকে গড়িয়াছে, বাঙালার আকৃতি প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে। এই নদনদীগুলিই আশীর্বাদ; এবং প্রকৃতির তাড়নায়, মানুষের অবহেলায় কখনও কখনও যেটি হয় বাঙালার অভিশাপও। এসব নদনদী উচ্চতর ভূমি হইতে প্রচুর পলি বহন করিয়া আনিয়া বঙ্গের বদ্বীপের নিম্নভূমিগুলিকে গড়িয়াছে, এখনও সমানে গড়িতেছে; সেহেতু বদ্বীপ বঙ্গের ভূমি কোমল, নরম ও কমনীয়; এবং পশ্চিম, উত্তর এবং পূর্ববঙ্গের কিয়দংশ ছাড়া বঙ্গের প্রায় সবটাই ভূতত্ত্বের দিক হইতে নবসৃষ্টভূমি। এই কোমল, নরম ও নমনীয় ভূমি লইয়া বাঙলার নদনদীগুলি ঐতিহাসিককালে কত খেলাই না খেলিয়াছে; উদ্দাম প্রাণলীলায় কতবার যে পুরাতন খাত ছাড়িয়া নূতন খাতে, নূতন খাত ছাড়িয়া আবার নূতনতর খাতে বর্ষা ও বন্যার বিপুল জলধারাকে দুরন্ত অশ্বের মতো মত্ত ঐরাবতের মতো ছড়াইয়া লইয়া গিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। সহসা এই খাদ পরিবর্তনে কত সুরম্য নগর, কত বাজার-বন্দর, কত বৃক্ষশ্যামল গ্রাম, শস্যশ্যামল প্রান্তর, কত মঠ ও মন্দির, মানুষের কত কীর্তি ধ্বংশ করিয়াছে, আবার নতুন করিয়া সৃষ্টি করিয়াছে, কত দেশখন্ডের চেহারা ও সুখ সমৃদ্ধি একেবারে বদলাইয়া দিয়াছে তাহার হিসাবও ইতিহাস সর্বত্র রাখিতে পারে নাই। অনেক নতুন পথ মরিয়া গিয়াছে, প্রশস্ত খরতোয়া নদী সংকীর্ণ ক্ষীণস্রোতা হইয়া পড়িয়াছে; অনেক নদী নতুন খাতে নতুনতর আকৃতি-প্রকৃতি লইয়া প্রবাহিত হইতেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে পুরাতন নামও হারাইয়া গিয়াছে, নদীও হারাইয়া গিয়াছে; নতুন নদীর নতুন নামের সৃষ্টি হইয়াছে! এসব নদনদীর ইতিহাসই বাঙালার ইতিহাস। ইহাদেরই তীরে তীরে মানুষ-সৃষ্ট সভ্যতার জয়যাত্রা; মানুষের বসতি, কৃষি পত্তন, গ্রাম, বন্দর, বাজার, নগর, বন্দর, সম্পদ, সমৃদ্ধি, শিল্প-সাহিত্য, ধর্মকর্ম সবকিছুরই বিকাশ। বাঙলার শস্যসম্পদ একান্তই এই নদীগুলির দান।’
আমরা তাই বলি, সুন্দরবনের জন্ম, বিকাশ ও বৃদ্ধির পিছনে বৃহত্তর খুলনা জেলার নদীগুলির অনবদ্য অবদান রয়েছে। খুলনার হাজারো জনপদ বিধৌত সুমিষ্ট জলরাশি বয়ে এনে সেগুলো সুন্দরবনের জীবন-রস সরবরাহ করেছে। এই জেলাতে রয়েছে সুবিশাল বিল — দিগন্তবিস্তৃত; যার এপার থেকে ওপার দেখা যেত না। যেমন বিল ডাকাতিয়া, বিল পাঙ্গালিয়া, বিল পাবলা, বিল বয়রা, নালুয়ার বিল, ধতুখালির বিল, গাওলার বিল, কেন্দুয়ার বিল, পদ্মবিলার বিল, কোলার বিল প্রভৃতি। এইসব বিলে বর্ষায় জল জমে উৎকৃষ্ট কৃষি ফলায়। ওইসব বিলের কোটি কোটি গ্যালন জলরাশি বহন করে নিয়ে আসে নদীগুলি আর সমুদ্রের লোনা জলের সাথে সংমিশ্রিত হয়ে এক বিরল রসায়নের জন্ম হয়। সেই রসায়ন প্রক্রিয়ায় সুন্দরবনের উদ্ভিদ ও বৃক্ষরাজি জন্ম নেয়। বেঁচে থাকে, বেড়ে ওঠে এ বনের জীবজন্তু, পশুপাখী, কীটপতঙ্গ, মৎস্যকুল এবং অসংখ্য জলজ ও স্থলজ প্রাণীকুল।
ছোট বড় সব মিলিয়ে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে মোট ৪৫০টি নদনদী প্রবাহিত হয়েছে। এর সবকটিই স্থলভাগ থেকে মিষ্টি জলের প্রবাহ বহন করে নিয়ে সমুদ্রে ঢেলে দেয়। এখানে আমরা অল্প কটি প্রধান প্রধান নদনদীর নাম উল্লেখ করলাম: তালেশ্বর, বলেশ্বর, শিবসা, পানাগুছি, কালিগঙ্গা, বড়শিয়া, মুড়িখালি, চিত্রা, রূপসা, ভদ্রা, হরিণঘাটা, কুমার নদী, কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, ঘসিয়াখালি, পশুর, আড়-পাঙ্গাশিয়া, ভাঙ্গরা, কুঙ্গা, মালঞ্চ, সাতক্ষীরা নদী, সুতোরখালি নদী, রায়মঙ্গল, মারজাতী, হরিণডাঙ্গা, মহাগঙ্গা, হরিপুর, সোনাই, বুধহাটির গাঙ্গ, টাকি, বাদুরগাছা, গুচিয়াখালী, কয়রা নদী, কালিন্দী, পায়রা, কচা, মৈয়ার গাং, কাজিবাছা, কাকশিয়ালি, নারায়ণখালি, কদমতলি, বাংরা, শীলা, কলাগাছিয়া, বাঁশতলি, শালঙ্খী, শাকবাড়িয়া, আলকী, মানিকদিয়া, চন্দেশ্বর, পানকুশি, মাঞ্জাল, ঠান্ডাই, পানখালী, শোলমারী, হাসকুড়া, নাইমখালি, শাতাল, ভৈরব, ভোলা প্রভৃতি।
এখানে আমরা অল্প কটি প্রধান প্রধান নদনদীর নাম উল্লেখ করলাম: তালেশ্বর, বলেশ্বর, শিবসা, পানাগুছি, কালিগঙ্গা, বড়শিয়া, মুড়িখালি, চিত্রা, রূপসা, ভদ্রা, হরিণঘাটা, কুমার নদী, কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, ঘসিয়াখালি, পশুর, আড়-পাঙ্গাশিয়া, ভাঙ্গরা, কুঙ্গা, মালঞ্চ, সাতক্ষীরা নদী, সুতোরখালি নদী, রায়মঙ্গল, মারজাতী, হরিণডাঙ্গা, মহাগঙ্গা, হরিপুর, সোনাই, বুধহাটির গাঙ্গ, টাকি, বাদুরগাছা, গুচিয়াখালী, কয়রা নদী, কালিন্দী, পায়রা, কচা, মৈয়ার গাং, কাজিবাছা, কাকশিয়ালি, নারায়ণখালি, কদমতলি, বাংরা, শীলা, কলাগাছিয়া, বাঁশতলি, শালঙ্খী, শাকবাড়িয়া, আলকী, মানিকদিয়া, চন্দেশ্বর, পানকুশি, মাঞ্জাল, ঠান্ডাই, পানখালী, শোলমারী, হাসকুড়া, নাইমখালি, শাতাল, ভৈরব, ভোলা প্রভৃতি।
এখানে আমরা মাত্র ৫টি নদীর গতিপথের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি।
১) বলেশ্বর নদী: বলেশ্বর সুন্দরবনের সব থেকে অধিক প্রশস্ত নদী। কোথাও কোথাও এর কুল দেখা যায় না। বাগেরহাটের পূর্ব প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই নদী। পিরোজপুর শহরকে বামে রেখে দক্ষিণগামী হয়েছে। অতঃপর দীর্ঘ ১৪৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুন্দরবনের আরেক নদী হরিণঘাটার সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর গতি পথে অনেক গ্রাম, নগর ও বন্দর গড়ে উঠেছে। শরণখোলা নগরীর প্রাণকেন্দ্র এই বলেশ্বর। এখানকার জেলে ও নিকেরীরা এই বলেশ্বরে মাছ ধরে জীবিকার্জন করে। প্রচুর পরিমাণে নানাবিধ মাছ পাওয়া যায় এই নদীতে। বর্ষা মৌসুমে এই নদীতে অসংখ্য ইলিশ ধরা পড়ে। বলেশ্বরের মাছ অতি সুস্বাদু। কিন্তু বলেশ্বর অত্যন্ত ভয়ংকর নদী।
২) শিবসা: সুন্দরবনের বৃহৎ এবং তীব্র খরস্রোতা নদীগুলির মধ্যে শিবসা অন্যতম। শিবসা খুলনা জেলার অতি ভয়ংকর নদীগুলির মধ্যে অন্যতম। সাথে সাথে এটি অতি প্রাণবন্তও বটে। এই নদীটি প্রাচীন কালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুন্দরবনের প্রাচীন সভ্যতার কেন্দ্র শেখেরটেক এবং কালিবাড়ি নামে দুটি বন্দর এই নদী তীরেই অবস্থিত ছিল। শিবসার উৎপত্তি কপোতাক্ষ থেকে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্মস্থান পাইকগাছা উপজেলার রাড়লী নামক গ্রামের কাছে। কপোতাক্ষ থেকে বেরিয়ে শিবসা দক্ষিণমুখী যাত্রা করে। অতঃপর শিবসা বহু ছোট ছোট নদী হরিয়া, খাংরাইল নরা, হাবড়খালি, বাদুরগাছা, ঢাকি, ডেলুটি, মিনাজ, কয়রা প্রভৃতির জলধারা আত্মস্থ করে প্রলয়ংকরী হয়ে ওঠে। একদা গড়াইখালির ত্রিমোহনায় শিবসার রুদ্ররূপ দেখলে সাধারণের হৃদকম্প উপস্থিত হতো। নলিয়ার ফরেস্ট অফিসের দক্ষিণে ভদ্রার আর একটি শাখা যেখানে শিবসার সাথে মিলেছে সেখান থেকেই সুন্দরবনের শুরু। পশ্চিমে এর অন্য একটি শাখা দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এর নাম আধোশিবস। পরে কদ্ধো নদীর সাথে মিলিত হয়ে সমুদ্রে বিলীন হয়েছে। সুন্দরবনের ভিতরে শিবসার বহু শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে রয়েছে।
৩) পশর বা পশুর: সুন্দরবনের আরো একটি প্রলয়ংকরী নদী হল পশর। সমুদ্রগামীতার কারণে এ নদীও দক্ষিণমুখী। বহু ছোট নদীর জলরাশিকে পশর নিজের বুকে ঠাঁই দিয়েছে। এদের মধ্যে কাজীবাছা, বৈঠাঘাটা, শোলমারির গাঙ, ঝপঝপিয়া, চুনকুড়ি, ভদ্রা ও শিপশা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কাজীবাছা যেখানে পশরের সাথে মিলিত হয়েছে সেখান থেকে পশর বিস্তৃত হতে হতে চালনার কাছে বাজুয়া ডাংমারী ফরেস্ট অফিস বরাবরে, সুন্দরবনের বিখ্যাত মজ্জতের সাথে মিলিত হয়। এই সঙ্গমস্থল হতে নদী বৃহদাকার রূপ ধারণ করে পূর্বোক্ত নদীগুলোর সাথে মিলিত স্রোতোধারা বুকে নিয়ে দুবলার চরের (দ্বীপ) কাছে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। পথিমধ্যে ত্রিকোণ দ্বীপের উত্তর-পশ্চিম হতে নাম পরিবর্তন হয়ে কদ্ধো বা মায়জাট্টা (মজুত) নাম ধারণ করে। বনাঞ্চলের এই অংশটাকে সাধারণ মানুষ নীলমকল বলে। মায়জাট্টার মোহনা ১০০ শত বছর পূর্বে প্রায় ১৩ কিলোমিটার প্রশস্ত ছিল। মায়জাট্টার মুখে বঙ্গোপসাগরের বিখ্যাত “ফিসারম্যানস আইল্যান্ড” এবং এর পূবদিকে “টাইগার পয়েন্ট” অবস্থিত।
৪) কপোতাক্ষ: মালদহের মধ্য দিয়ে এসে শ্রতিকীর্তি মহানদ যেখানে পদ্মায় মিলিত হয়েছে ঠিক বিপরীত পারে মনে হয় যেন সেই নদই ভৈরব নাম ধরে জন্ম নিল। অনেকদূর এসে পদ্মার আর এক শাখা জলঙ্গীর সাথে মিশে গেল। ওই যুক্ত প্রবাহ থেকে মুক্ত হয়ে ভৈরব জয়রামপুর এসে পদ্মার অন্য একটি শাখা মাথাভাঙ্গার সাথে মিলিত হল। আবার মাথাভাঙ্গা থেকে মুক্ত হল এবং যশোর জেলায় প্রবেশ করল। ভৈরব কোটচাঁদপুর পর্যন্ত পূর্বগামী ছিল কিন্তু প্রায় ১২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে দক্ষিণ মুখী কপোতাক্ষর জন্ম দিয়ে ভৈরব নিজে ওই পূব দিকেই এগিয়ে চলল। আমাদের আলোচ্য কপোতাক্ষ তার চলার পথে ‘হরিহর’ ও ‘ভদ্র’ দুটি শাখানদীর জন্ম দেয়। এর একটি পূর্ব এবং অন্যটি দক্ষিণগামী ছিল। যশোরে জন্ম নিয়ে কপোতাক্ষ খুলনা জেলায় প্রবেশ করল বর্তমান সাতক্ষীরার কলারোয়ার সন্নিকটে। অতঃপর কপোতাক্ষ পাটকেলঘাটা, তালা, কপিলমুনি প্রভৃতি জনপদ অতিক্রম করে বাড়ুলি এসে শিবসায় মিশে যায়। শিবসা আরো বহু নদীর জলস্রোতের সাথে কপোতাক্ষর জলরাশিও বহন করে সমুদ্রে বিসর্জন দেয়।
কপোতাক্ষ বর্তমানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপরিণামদর্শী ধনী মানুষদের লোভের কারণে কপোতাক্ষর ছোট ছোট শাখা নদীগুলি এবং বহু খাল অন্যায়ভাবে দখল নিয়ে স্বাভাবিক প্রবাহে বাধার সৃষ্টি করেছে। তাই এর নাব্যতা এখন নাই বললেই চলে। সরকারী চেষ্টায় নাব্যতা ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিন্তু তা খুব কার্যকরী হচ্ছে না বলা চলে। তাই কপোতাক্ষ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার জন্ম দিয়েছে।
৫) ইছামতি-কালিন্দি-রায়মঙ্গল: আদি নাম ইছামতি। এই ইছামতিকে নিয়ে অনেক সাহিত্য রচিত হয়েছে বাংলা ভাষায়। এটি একটি সুন্দর নদী। এর দুই পাড়ের দৃশ্যাবলী অতীব মনোরম। ইছামতি নামে পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে নানা স্থানে একাধিক নদী রয়েছে। আমাদের আলোচ্য ইছামতি সুন্দরবন সংলগ্ন ইছামতি। যুক্তত্রিবেণী হতে কলদীপ্ত গঙ্গা বাংলায় প্রবেশ করে ভাগিরথী নাম নিল। ভাগিরথী সপ্তগ্রাম পর্যন্ত আসার পর সেখান থেকে সরস্বতী নামে ডাইনে এবং যমুনা বামে বিযুক্ত হয়। যমুনা ক্রমান্বয়ে চৌবেড়িয়া, জলেশ্বর, ইছাপুর ও গোবরডাঙ্গা ঘুরে অবশেষে চারঘাটার কাছে টিপির মোহনায় ইছামতির সাথে মিলিত হয়েছে। এতক্ষণে ইছামতি সোজা দক্ষিণগামী হল। টাকি, শ্রীপুর, বসিরহাট, দেবহট্ট, বসন্তমুর, কালিগঞ্জ হয়ে প্রাচীন যশোর নগরীতে (প্রতাপাদিত্যের সময়কালে) পৌঁছায়। ঐ স্থানে ডানদিকে যমুনা নাম ধরে একটি শাখা দক্ষিণে গিয়ে সাগরে পড়ে। আর ইছামতি কিছুটা পূর্বমুখী হয়ে কদমতলা, মালঞ্চ প্রভৃতি নাম ধারণ করেছে। অন্যদিকে কালিন্দি সাতক্ষীরার পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ভারত বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারণ করেছে। ইতিপূর্বে ইছামতি এবং কালিন্দি মিলিত হয়েছে যশোরের পশ্চিম প্রান্তে সাতক্ষীরার সন্নিকটে। দু দেশের সীমান্ত বরাবর প্রবাহিত হয়ে ইছামতি কালিন্দি সুন্দরবনের অন্যতম ভয়ংকর জলস্রোত রায়মঙ্গলের সাথে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে আত্মবিলীন করেছে।
গঙ্গোপদ্বীপের নদ-নদীর কাজ ছিল দুটি। একটি হল জনপদের জল নিঃসরণ করা। আর দ্বিতীয়টি হল ভূভাগের উচ্চতা এবং উর্বরতা বৃদ্ধি করা। অনেক নদী তার তীরবর্তী স্থলভাগের উচ্চতা বৃদ্ধি করতে করতে নিজের গতিপথকেই হারিয়ে ফেলেছিল। আবার তীরবর্তী মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপে নদী গতিহারা হয়েছে। ঘটনা যাই হোক না কেন, বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার এই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার নদীগুলি যা দীর্ঘকাল ধরে তার ভূমি গঠন ও জল নিষ্কাশন কাজে ব্যাপৃত ছিল, বিগত পঞ্চাশ বছরে তার উল্লেখযোগ্য এবং গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের কারণে এই এলাকার মানুষের জীবন যাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। কৃষিকাজ, উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াতেও তা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। সর্বোপরি এই এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্যে বিশেষ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। সেই কারণে সুন্দরবনের বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ মায় জলজপ্রাণী ও মৎস্যকুল পর্যন্ত অস্তিত্বের হুমকিতে পড়েছে।
অপরিণামদর্শী অনুৎপাদক শ্রেণীর হাতে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতা থাকার ফলে তারা তাদের ব্যক্তি-গোষ্ঠী-শ্রেণী স্বার্থে অধিকাংশ শাখানদী, খাল এবং জলাভূমিগুলো অন্যায় ও অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। তারা এর যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। জলপ্রবাহের স্বাভাবিক গতিকে বাধা দিচ্ছে নদীর-খালের-শাখানদীগুলোর বুকে বাঁধ দিয়ে মাছ-চিংড়ি-কাঁকড়া প্রভৃতি চাষের প্রয়োজনে। ফলে অতি বৃহৎ বিল ও জলাভূমিতে পতিত বৃষ্টির মিষ্টি জলপ্রবাহ বাধা পাচ্ছে। কোথাও কোথাও লবণ জল তুলে বাগদা চিংড়ির চাষ করা হচ্ছে। ফলে ওই চাষের জমি আর চাষোপযোগী থাকছে না। একদিকে জমি তার উর্বরা শক্তি হারাচ্ছে আর অন্যদিকে হাজার বছরের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এ এলাকার ফসল, নারিকেল, সুপারীসহ অত্যন্ত অর্থকরী ফসলগুলি আর উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
আরো একটু পিছনের দিকে যদি তাকানো যায় তবে দেখা যাবে, পাকিস্তান সরকারের প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান কানাডা কলম্বো প্ল্যান অনুযায়ী এই সুন্দরবন সংলগ্ন সকল ছোটবড় নদীগুলোর পাড় বরাবর চওড়া এবং উঁচু বাঁধ দিয়ে নদীর স্বাভাবিক জলপ্রবাহ এবং স্রোতধারা বাধাগ্রস্ত করেছিলেন। তার ফলে স্বাভাবিক ভূমি গঠনের যে প্রক্রিয়া ছিল — জোয়ারের সময় নদীর পলিবাহিত জলরাশি তীরবর্তী ভূমিকে প্লাবিত করে পলিমাটি ফেলে তাকে উর্বর করে তুলত। সেই প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হওয়াতে জমির উর্বরতা হারিয়েছে। পরন্তু বাহিত সেই পলিমাটি নদী তার নিজ গর্ভে ধারণ করে শুকিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। সুন্দরবন সংলগ্ন বহু নদী-শাখানদী আজ বিলুপ্ত হয়েছে এই প্রক্রিয়ায়। সেই সব নদীর কোন চিহ্ন আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এর ফলে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে যার কোন সমাধান একেবারে কঠিন হয়ে পড়েছে।
এদিকে গোদের উপর বিষফোঁড়া সৃষ্টি করেছে ভারত। গঙ্গার উজানে ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে মিষ্টি জলের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে অন্যায়ভাবে। ফলে জোয়ারের সময় সমুদ্রের নোনা জল উপরের দিকে উঠে আসছে। দীর্ঘ নদীপথগুলি লবণাক্ত জলে পরিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ওই জল কৃষি কাজের অনুপযোগী হওয়ায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে যথেষ্ট মিষ্টি জলের অভাব, স্থানীয় বিল-জলাশয়গুলো থেকে আগে যে বিপুল পরিমাণে জল পাওয়া যেত উপরে উল্লেখিত কারণে তা বিঘ্নিত হওয়ায় এবং সর্বোপরি লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ার স্বাভাবিক ফল হয়েছে এই যে, নদ-নদীগুলি, সমুদ্র হতে অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী নদীগুলি ক্রমাগত ভরাট হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে; সংকীর্ণ হচ্ছে, ক্ষীণকায়া হচ্ছে। ফলে সুন্দরবনসহ সমগ্র এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় প্রাণী ও উদ্ভিদকুল তথা জীববৈচিত্র্য নষ্ট হওয়াসহ সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশের জন্য তা প্রবল হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে যশোর-খুলনার ইতিহাস (সতীশচন্দ্র মিত্র) থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি,
‘গৌরী-মধুমতি, নবগঙ্গা-চিত্রা এবং ইছামতি-কালিন্দী গঙ্গার পার্বত্য স্রোত বহন করিতেছে। এই তিনটি মাত্র নদী স্রোত মিষ্টি জল আনিয়া দেশের শোভা-সমৃদ্ধি ও উর্বরতা বৃদ্ধি করিতেছে এবং ইহারাই চিরানুগত প্রথায় গঙ্গার ভূমিগঠন কার্যের সহায়তা করিতেছে। কোন প্রকারে ইহার গতিরূদ্ধ হইলে, দেশের যে কি গতি হইবে, তাহা নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।’
সতীশ বাবুর এই ভবিষ্যৎবাণী আমরা আজ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি।
চার
সুন্দরবনের উদ্ভিদসম্পদ
বহু বৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনের উদ্ভিদজগৎ আরো বিচিত্র। বিচিত্রতার কারণ হল ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্বই বৈচিত্র্যে ভরা। এই বন প্রতিদিন সমুদ্রের লবণ জলে ভেসে যায়। আবার ভাটার টানে শুকিয়ে যায়। এর বাতাসে লবণ, জলে লবণ, মাটিতে লবণ, সর্বত্রই লবণ। এই লবণাক্ততা সহ্য করে জলের মধ্যে জন্ম নিয়ে এবং বেড়ে উঠে টিকে থাকতে হয় এর সকল উদ্ভিদকুলকে। এসব কিছু সহ্য করে, পাতলা পলির কাদার উপরে অতি শক্ত কাঠের সুন্দরী, পশুরী, গরাণ প্রভৃতি জন্মে থাকে। এখানে সুখী প্রাণী হরিণ কাদা জলে পালে পালে বসবাস করে। এই জলসিক্ত সোনাদেশ বাঘ এবং গন্ডারের মতো ভীষণ জন্তুর আবাসস্থল। এখানে মাছ গাছে ওঠে, ভয়ংকর কুমির ডাঙ্গায় এসে শিকার ধরে, বাঘ গাছের ডালে বিশ্রাম করে, সাঁতরিয়ে নদী পার হয়। বিচিত্র, বহু বিচিত্র এই সুন্দরবন।
সুন্দরবন নিবিড় জঙ্গলাকীর্ণ। কিন্তু এখানে সবরকমের গাছপালা জন্মাতে পারে না। এখানকার উদ্ভিদজগতের রয়েছে মৌলিক বিশেষত্ব। যেসব বৃক্ষরাজি লবণ সইতে পারে, জলীয়বাষ্প সম্বলিত হাওয়া যাদের তৃপ্তি মেটায়, প্রবল বাতাস বা ঝড়ে যারা আত্মরক্ষা করতে পারে এবং প্রতিদিন তলদেশ জলপ্লাবিত হলেও যারা মরে না সেই সব উদ্ভিদ, বৃক্ষলতা এই সুন্দরবনে জন্ম নিতে পারে, বেড়ে উঠতে পারে এবং টিকে থাকতে পারে। এখানে গাছ মানেই প্রতিদিন জোয়ারের জলে গোড়ার মাটি ধুয়ে গোড়া আলগা হয়, প্রবল বাতাসে সর্বদাই আন্দোলিত হয়, নদীর স্রোতে পাড় ভেঙ্গে গাছপালা উপড়ে পড়ে; তাই এসব গাছপালার শিকড় হয় অত্যন্ত শক্ত, আর বহু শিকড় চারদিকে ছড়িয়ে যায়। শিকড়গুলো পাশের গাছের শিকড়ের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ থাকে। সকলে মাটির নিচে শিকড় দিয়ে পরষ্পরকে রক্ষা করার জন্য জড়াজড়ি করে অবস্থান করে। এখানকার গাছগুলোর শিকড় যেমন বেশি, তার বায়ু গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অধিক। এই কারণে শিকড়গুলো নিচ থেকে উপরের দিকে উঠে আসে অসংখ্য সূঁচালো শূল বা শূলোয়। সুন্দরবন শূলে ভরা। এখানকার প্রায় সকল গাছেরই শূল হয়। কারো দীর্ঘ, কারো খাট, কারো মোটা কারো সরু। তবে সুন্দরী গাছের শূলগুলি আকারে বড় এবং সংখ্যায় অধিক।
সুন্দরবনের প্রায় সকল গাছই অধিক লম্বা। অতি ঘন বন হওয়ার কারণে সূর্যের ছোঁয়া পাওয়ার জন্য তারা প্রতিযোগিতায় নামে একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য। তাছাড়া বীজ থেকে উৎপন্ন গাছ দীর্ঘ হয়ে থাকে। এখানে আমরা সুন্দরবনের অসংখ্য গাছপালার মধ্যে অল্প কয়েকটির নাম, বিশেষত্ব এবং প্রয়োজনীয়তার বিষয় নিয়ে আলাপ করব।
সুন্দরী বা সুন্দর গাছ: অতি দীর্ঘকায় এই সুন্দরী গাছের পাতাগুলো ছোট। উপরে মসৃণ নিচে ধূসর। এর হলুদ রংয়ের ফুলগুলিও ছোট। অত্যন্ত লম্বা হয় এবং মোটাও বেশ। চিকন সুন্দরী গাছ অনেকটা বাঁশ গাছের মতো লম্বা এবং মসৃণ। গাছের দেহের উপরের ছাল ফেলে দিলে লাল রং দেখা যায়। ভিতরের কাঠ গাঢ় লাল বর্ণের এবং অত্যন্ত মজবুত। এই কাঠ অনেক মূল্যবান। দক্ষিণবঙ্গ নদীপ্রধান এলাকা। সুন্দরবন নদীতে পরিপূর্ণ। তাই সমুদয় অঞ্চলে নৌযান জলযান ছিল একমাত্র বাহন। এখন সেই অবস্থা না থাকলেও নৌযান এখনো অনেক প্রয়োজনে লাগে। সুন্দরবনের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নৌযান ছাড়া আজও অচল। সেক্ষেত্রে নৌকা নির্মাণ ও মেরামতের জন্য সুন্দরী কাঠ প্রধান ও সহজলভ্য উপাদান। তবে বর্তমান সময়ে সুন্দরী কাঠ আর আগের মতো পাওয়া যায় না। দুই প্রধান কারণে সুন্দরবনের প্রধান কাঠ সুন্দরী গাছ আর যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথম এবং প্রধান কারণ হল: যমুনা, ইছামতি, কপোতাক্ষ, ভৈরব প্রভৃতি স্রোতস্বিনী যে পরিমাণে পাহাড় ধোয়া পলিমাটি বয়ে আনতো তা প্রায় পৌনে একশত বছর আর আনতে পারছে না। কারণ গঙ্গার সাথে এই সব নদীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পলিমিশ্রিত মিষ্টিজল সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সাথে মিশে গিয়ে ব্রাকিশ ওয়াটার তৈরি করত, যা সুন্দরীকাঠ উৎপাদনের সহায়ক ছিল। এখন তা না থাকায় সুন্দরীর উৎপাদন কমে গেছে মারাত্মকভাবে। দ্বিতীয়ত, অবৈধভাবে ধনিক শ্রেণী সুন্দরী কাঠ কেটে সাবাড় করে দিয়েছে। অবিবেচক, মুনাফালোভী কাঠ চোরেরা নির্বিচারে সুন্দরী কাঠ কেটে ফেলেছে। সুন্দরী কাঠ কাটার নিয়ম আছে; তা হল প্রতি ৫টি গাছের মধ্যে ১টি গাছ কাটা যাবে। এইসব নিয়মকানুনের ধার না ধেরে তারা সুন্দরী কাঠের বিলুপ্তির কারণ ঘটিয়েছে।
পশুর: সুন্দরী কাঠের পরে পশুরই হল সুন্দরবনের দ্বিতীয় প্রধান কাঠ। ঘরের খুঁটি এবং অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরিতে এই কাঠ সুন্দরী অপেক্ষাও গুরুত্বপূর্ণ। পশুর গাছও অনেক বড় হয়। পাতাগুলি প্রশস্ত, অনেকটা কাঁঠাল পাতার মতো। এর খুঁটি অত্যন্ত শক্ত হয়। গৃহ সরঞ্জাম ছাড়াও নিত্য প্রয়োজনীয় আরও নানান কাজে পশুর কাঠ প্রয়োজন হয়।
বাইন: কাঠের স্থায়িত্ব, শক্তি এবং আকারে এই বাইন কাঠ সুন্দরবনের তৃতীয় শ্রেষ্ঠতম উৎপাদন। এই গাছগুলো অনেক বড় হয় এবং দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে। এর গুড়িগুলোর আকার অতীব বিশাল। পুরাতন বাইন গাছে ভালো তক্তা প্রস্তুত হয় এবং তা দিয়ে ঘরের বেড়াসহ অনেক আসবাবপত্র প্রস্তুত করা যায়।
ধোন্দল বা গামুর: গামুর গাছ অনেকটা পশুর গাছের মতোই, এই গাছে মিষ্টি কুমড়ার মতো বড় বড় ফল উৎপন্ন হয়। পাকলে তার মধ্য থেকে তালের আঁটির মতো বীজ বেরিয়ে আসে। ওই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গাছ জন্মে। গামুর বা ধোন্দল গাছের তক্তা দিয়েও নানান আসবাবপত্র সহ গৃহসজ্জা তৈরি করা যায়। গামুর কাঠও অত্যন্ত শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী।
কেওড়া: সুন্দরবনে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। প্রায় অধিকাংশ নদীর কুলে এবং চরজমিতে কেওড়া গাছ উৎপন্ন হতে দেখা যায়। কেওড়া গাছ সব থেকে বড় হয়। এগুলি সব থেকে সুন্দরও বটে। কথিত আছে সুন্দরবনে এর থেকে অধিক বড় গাছ আর নাই। চরের পাড়ে বা নদীর পাড়ে এক স্থানে লাইন দিয়ে বহু গাছ ঝাঁকড়া মাথায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে এক অপূর্ব দৃশ্য বটে! কেওড়াপাতা চিকন ও সরু। অনেকটা কটা বা জিওল পাতার মতো। এই পাতা ও এর ফল বানর ও হরিণের প্রিয় খাদ্য। কেওড়া গাছের ডালে ডালে বানরের দল আর তার তলায় হরিণের পাল। বানরেরা কেওড়া পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তলায় ফেলে আর হরিণেরা তা খুঁটে খুঁটে খায়। প্রকৃতির এক এক মধুর দৃশ্য; এবং এই দুটি বন্য জন্তুর মধ্যে এ এক অপূর্ব বন্ধুত্ব। যুগ যুগ ধরে বানরেরা পাতা ফেলে আর হরিণেরা আহার করে। কেওড়ার ফল টক স্বাদযুক্ত। এর ফল বানর হরিণেরও প্রিয় খাদ্য। বনবাসী মানুষেরা কেওড়া ফলের টক রান্না করে খায়। কেওড়া তলায় অজস্র হরিণ থাকে বলে ওখানেই শিকারীরা হরিণ শিকার করে থাকে। সংলগ্ন গ্রামবাসীরাও কেওড়ার ফলের চাটনি খায়। এর স্বাদ নিয়ে শ্লোক আছে, “যে খেয়েছে কেওড়ার ঝোল/ সে ছেড়েছে যুবতী নারীর কোল।”
গরান: গরান গাছ চিকন, খাটো— অনেকটা কচা গাছের মতো হয়ে থাকে। এর পাতা গোলাকার হলুদ রংয়ের পুরু হয়ে থাকে। উচ্চতায় ১০/১২ ফুটের অধিক হয় না। এক এক ঝাড়ে অনেকগুলো গাছ একসাথে জন্মে থাকে। অত্যন্ত লবণযুক্ত স্থানে গরান কাঠ ভাল জন্মে। এ গাছ অত্যন্ত শক্ত। ঘরের খুঁটি, লগি, বেড়া দেয়ার কচা প্রভৃতি কাজে এ গাছ ব্যবহৃত হয়। বনবিভাগের সকল স্টেশন, ফাঁড়ি প্রভৃতি অফিসে নিরাপত্তা বেড়া এই গরান কাঠ দিয়েই দেয়া হয়। নৌকার লগির জন্য এই গাছ বেশ উৎকৃষ্ট। এক সময় এই কাঠ দিয়ে হুকোর নচে এবং ছাতির বাঁট প্রভৃতি প্রস্তুত হত। সর্বোপরি জ্বালানী কাঠ হিসেবে এই গাছ সর্বোত্তম।
গেঁয়ো: গেঁয়ো গাছ সোজা এবং লম্বা হয়ে উঠে। এ গাছ অনেক লম্বা হয়। এর গায় সাদা, আঠালো, বিষাক্ত রস নির্গত হয়। এর কাঠ খুব পাতলা জ্বালানী হিসেবে একটা উত্তম কাঠ। বড় গেঁয়ো গাছের গুঁড়ি দিয়ে ঢোল, তবলা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের খোল তৈরি হয়।
গর্জন: সুন্দরবনের সর্বত্র গর্জন কাঠ পাওয়া যায়। নদী-খাল কুলে এই গাছ প্রায়শই দেখা যায়। বটগাছের মতো দেহের চারদিক দিয়ে শিকড় মাটিতে বসিয়ে দেয় নিজেকে সোজা রাখার জন্য। এই গাছে ছোট ছোট ফুল হয় এবং সেই ফুল থেকে ছোট ছোট সজনার ডাটার মতো ডাটা ঝুলে ঝুলে থাকে। গর্জনের পাতা রাবার পাতার মতো পুরু। গর্জন কাঠ থেকে এক প্রকার তেল প্রস্তুত হয় যা বহু কাজে লাগে। গর্জন তেল প্রতিমা, মূর্তি প্রভৃতির রং উজ্জ্বল করতে ব্যবহৃত হয়। সর্বোপরি এই তেল কুষ্ঠরোগের মহৌষধ হিসেবে প্রসিদ্ধ।
হেঁতাল: ছোট বাঁশের মতো দেখতে কিন্তু আকৃতি যেন ঠিক খেজুর গাছ। এক জায়গায় অনেকগুলো একত্রে ঝাড় বেঁধে জন্ম নেয়। এর দৈর্ঘ্য ১৫ ফুটের বেশি হয় না। ঘরের চালের রুয়ো এবং লাঠি তৈরিতে এই কাঠ ব্যবহৃত হয়। হেঁতালের লড়ি ও ছড়ির বিবরণ দক্ষিণবঙ্গের ধর্মীয় সাহিত্য যেমন, ‘মনসার ভাসানে’ উল্লেখ আছে। হেঁতাল বন বাঘের আশ্রয়স্থল। হেঁতাল বনের ভিতরটা পরিচ্ছন্ন এবং উপরে ছাউনি দেয়ার মতো ঝোপ আকারে অবস্থিত। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর লুকিয়ে থাকার মতো স্থান হেঁতাল বন ছাড়াও আর যা যা আছে তার মধ্যে বলা, বলাসুন্দরী এবং হেদোবন উল্লেখযোগ্য। বলা গাছের গোলপাতা, হলুদ রংয়ের ফুল নিয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে ঝোপ তৈরি করে। নদী ও খালের তীর নিয়ে বহুদূর পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন অথচ লুকাবার উত্তম স্থান তৈরি করে এই বলাবন। বাঘসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণী জলপান ও শিকার ধরার প্রকৃষ্ট জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে এই বলা বন বা বলার ঝোপ। হেদো গাছ অনেকটা খড়বনের মতই অনেকটা স্থান জুড়ে জন্মে। এসব ছাড়াও শিঙ্গড় বা শিঙ্গুর, গড়ে বা গড়িয়া, ওড়া, কাকড়া, খলসি ভাঁড়ার, করঞ্জ এবং হিদ্ধে প্রভৃতি গাছ সুন্দরবনে জন্মে। হিদ্ধের কাঠ ওজনে হালকা। তাই এই কাঠ দিয়ে একসময় পালকী প্রস্তুত হত। লোনা জলে ওড়া গাছ অধিক জন্মে। অজস্র ওড়ার পাতা পচে নানাপ্রকার জলজ কীটসহ নোনা চিংড়ি, হরিণা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি প্রভৃতি জন্ম নেয়। একমাত্র গলদা ছাড়া আর প্রায় সকল প্রকার সুস্বাদু চিংড়ি মাছ লবণ জলে জন্মে থাকে। এসব ছাড়া হরগোজা, ওড়াধান, কাশবন, তুলাটপরী, ঝাউ ও বনলেবু প্রভৃতি গাছ দেখা যায়। সুন্দরবনে অশ্বত্থ গাছ নতুনরূপে জন্মে থাকে। হলুদ গাছ সটি হয়ে গেছে, নানাপ্রকার লেবু বন্য রূপ নিয়েছে। শুধুমাত্র গাবগাছ সুন্দরবনে অবিকল একইরকম রয়েছে।
হেঁতাল বনের ভিতরটা পরিচ্ছন্ন এবং উপরে ছাউনি দেয়ার মতো ঝোপ আকারে অবস্থিত। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ অন্যান্য হিংস্র প্রাণীর লুকিয়ে থাকার মতো স্থান হেঁতাল বন ছাড়াও আর যা যা আছে তার মধ্যে বলা, বলাসুন্দরী এবং হেদোবন উল্লেখযোগ্য। বলা গাছের গোলপাতা, হলুদ রংয়ের ফুল নিয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে ঝোপ তৈরি করে।
গোলপাতার গাছ-গোল গাছ: না এর পাতা গোল, না এর গাছ অথচ এর নাম হয়েছে গোল গাছ বা গোলপাতার গাছ। গোল গাছের পাতা পুরোপুরি নারকেলের পাতার মতো। তবে গাছ সেরকম না। গোল গাছের কাণ্ড মোটেই লম্বা হয় না। মাটির সাথে মিশে থেকে অবিরত পাতা ছাড়ে। লম্বা লম্বা নারকেল পাতার মতো বড় বড় পাতায় ভরে যায় এলাকা। এক জায়গায় বহু গাছ থাকে। যেখানে এই গাছ হয় সেখানে বহু বিস্তৃত এলাকা নিয়ে গোলগাছে ভরে যায়। গোলবনও বাঘের লুকাবার আদর্শ স্থান। গোলপাতা অনেক শক্ত এবং শুকালে তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এই পাতা দরিদ্রদের এবং মধ্যবিত্ত মানুষের ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হত, এখন তা কমে গেছে। এককালে যশোরের দক্ষিণাংশ সমগ্র খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাট ও পিরোজপুর এলাকায় সাধারণ মানুষের ঘর ছাওয়ার প্রধান উপাদান ছিল এই গোলপাতা। প্রতিদিন শত শত নৌকা বোঝাই করে গোলপাতা নিয়ে আসত বাওয়ালীরা। সরকার সুন্দরবনের গোলপাতা থেকে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব লাভ করত। গোলগাছে তালের মতো কাঁধিভরে ফল হয়। তালের শাসের মতো খাওয়াও যায়, তবে অতটা সুস্বাদু নয়। তবে গোলফল পাকলে তা অভক্ষ্য হয়।
এছাড়া সুন্দরবনে লতা ও বেত উৎপন্ন হয়। লতা চিকন ও মোটা উভয়ই হয়ে থাকে। চিকন লতা দিয়ে মাছ ধরায় বাঁশের চারো, পোলো, দুয়োড়, ঘুনী, বচনে প্রভৃতি তৈরি হয়। আর বেত মানুষের নানাবিধ সাংসারিক ক্রিয়াকর্মে প্রয়োজন হয়। ধামা, কুলো, খুঁচি, পয়ে প্রভৃতি প্রস্তুত হয় বেত দিয়ে। বেতের সোফাসেট অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এবং দীর্ঘস্থায়ী। (চলবে)
রণজিৎ চট্টোপাধ্যায়: লেখক, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। অবস্থান-বাগেরহাট।