বিশ্বায়নের ফাঁদ থেকে মুক্তির পথ
আলমগীর খান
বর্তমানে আমরা যে বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে বাস করছি তাকে বলা হয় বিশ্বায়ন, তবে তা প্রকৃতপক্ষে সবার বিশ্বায়ন নয়। সঠিকভাবে বললে এটা হলো একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিশ্বায়ন বা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন। এটাই ‘সকলের আরাধ্য’ এবং এটাই ‘মানব সমাজের শেষ গন্তব্য’ সেভাবেই প্রচার করা হয় এবং এর সাফল্যের গুণগান করা হয়। আসলে বাঁচতে হলে এই জাল থেকে বের হতে হবে মানুষকে, তার পথ সন্ধানেই এই লেখা।
হ্যাঁ, বিশ্বায়ন একটি ফাঁদ। কিছুটা আরামদায়ক ও আকর্ষণীয়ও বটে। আর ফাঁদ বলে তো মনেই হয় না, যখন কিনা চরম প্রতিক্রিয়াশীল ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার অনুসারীরাও এর বিরোধিতা করেছে ও করছে, তখন এর অর্থ নিয়ে খানিকটা ধাঁধা লাগাই স্বাভাবিক। যে বিশ্বায়ন ‘১০০ কোটির বেশি মানুষকে চরম দারিদ্র্যসীমার উপরে তুলে এনেছে’ বলে দাবি করা হয় তাকে কিছুটা সমীহ না করলেও চলে না।১ এই ‘অভূতপূর্ব কৃতিত্বে’র পরও এটি একটি ফাঁদ মাত্র। আর এই ফাঁদটি এখন ভেঙে পড়ছে ভেতরের কলকবজায় নয়াউদারনৈতিক মরিচা ধরে। উদারনৈতিক তেল মেখে মেখে অনেক দিন ধরে চালানো হলেও এখন এর মরণদশা। ফাঁদ তো ফাঁদই, যতই সুন্দর হোক-না কেন।
আর মানুষ তো ফাঁদে জীবন কাটাতে চায় না, সে মুক্তি চায় আর ঘর চায়—সাম্যতা ও সহমর্মিতার ঘর। মার্টিন লুথার কিংয়ের দেখানো স্বপ্নের ঘর—ওয়ার্ল্ড হাউজ বা বিশ্বগৃহ যেখানে সব ধর্মের, বর্ণের, চিন্তার, আদর্শের ও স্বাতন্ত্র্যের মানুষকে একটা বিরাট বিশ্বগৃহে এক পরিবারের মতো বসবাস শিখতে হবে।২ মানুষের যাত্রা সেই দিকে।
গ্রিসের সাবেক অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস এই ফাঁদ থেকে মুক্তির একটি পথ বাতলেছিলেন ট্রাম্প-পূর্ব যুগের একটি লেখায়:
“এই রাজনৈতিক ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকতাবাদ, যা উদ্ভূত হয়েছে পৃথিবী জুড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনর্জাগরণে আগ্রহী বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঐক্যবোধ থেকে। যদি এটি শুনতে ইউটোপিয়ানও মনে হয়, জোর দিয়ে বলতে চাই যে, এর কাঁচামাল এখন হাতের কাছেই আছে।”৩
“এই রাজনৈতিক ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে প্রগতিশীল আন্তর্জাতিকতাবাদ, যা উদ্ভূত হয়েছে পৃথিবী জুড়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনর্জাগরণে আগ্রহী বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঐক্যবোধ থেকে। যদি এটি শুনতে ইউটোপিয়ানও মনে হয়, জোর দিয়ে বলতে চাই যে, এর কাঁচামাল এখন হাতের কাছেই আছে।”
আন্তর্জাতিকতাবাদের এই প্রচেষ্টা অবশ্য আগেও হয়েছে। সম্প্রতি ভারাওফ্যাকিস প্রশ্ন করেছেন,
“শেষবার আমরা হারলাম কেন? ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে কেন চরমভাবে হেরে গেলাম? কেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন আক্রান্ত হলো নয়াসাম্রাজ্যবাদের চরম রূপ আর্থিক পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন দ্বারা? …সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে: কারণ পুঁজিবাদীরা প্রমাণ করল বাস্তবে তারা আমাদের চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিকতাবাদী। কারণ, তারা বৈশ্বিক শ্রেণিসংগ্রাম আরও ভালো বুঝেছে আর তাই জিতে গেছে।”৪
ভারাওফ্যাকিস নিজের প্রশ্নের নিজেই উত্তর দিয়েছেন নয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার জন্য হাভানা কংগ্রেসে ‘Because we must!’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদানকালে। তার প্রশ্ন ও উত্তরসমূহ দুই-ই আছে এ বক্তৃতায়, যা এখনকার গভীর রাজনৈতিক সত্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। তার আগে আমরা একটু পেছন ফিরে দেখব বিশ্বমঞ্চে আন্তর্জাতিকতবাদ ও বিশ্বায়নের উৎপত্তি ও ভূমিকা।
৭০ হাজার বছর আগে আফ্রিকায় আধুনিক মানুষের উৎপত্তির পর থেকেই তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে ও এখন পুরো বিশ্বকে প্রায় হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে, এমনকি পরিকল্পনা করছে মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহে ছড়িয়ে পড়ার।৫ এই চোখধাঁধানো বিপুল অগ্রগতির পরও মানুষ আজও বিভক্ত—দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে ও আরও কত রকমে। এসব নানাবিধ পরিচয় নিয়ে আবার আমাদের বিদ্বেষ, সংঘর্ষ, হানাহানি ও খুনোখুনি লেগেই আছে। সব মানুষ তাদের প্রায় একই আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন, স্বার্থ ও মন নিয়েও এখনো হতে পারেনি এক মানুষ।
তবে বৃহত্তর পরিসরে প্রয়োগযোগ্য নিয়ম-কানুন, আইন ও বিধিনিষেধ তৈরি করে মানুষকে এক পতাকাতলে আনার চেষ্টা চলছে মানুষের অতীত ইতিহাস থেকেই। বিজয়ী সম্রাট, ধর্ম, আদর্শ ইত্যাদি জন্ম নিয়েছে ও ধ্বংস হয়েছে যুগে যুগে এই লক্ষ্য নিয়ে। বিশ্বকে একটি ঘর ও মানুষকে একটি পরিবারে পরিণত করাই যেন মানুষের ইতিহাসের নিয়তি। এই নিয়তির টানে দেয়াল ধসে পড়েছে, সীমান্ত পদদলিত হয়েছে, ধর্মালয় পুড়ে ধর্মালয় গড়ে উঠেছে, পৃথিবীর এক প্রান্তের পণ্য পৌঁছে গেছে অন্য প্রান্তে। ধ্বংস ও সৃষ্টির এই লীলায় মানুষ সুখ ও দুঃখের ভেলায় দুলেছে ইতিহাসের কাল জুড়ে।
ইতিহাসের এই চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সাম্প্রতিককালে সচেতনভাবে তৈরি মানুষের সবচেয়ে বড় উদ্যোগটি ছিল—কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। এ বিপ্লবী আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শ্রমিক-শ্রেণির নেতৃত্বে দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটিয়ে এক বিশ্বসাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা। মানুষে মানুষে স্বার্থভিত্তিক দ্বন্দ্বের বিলোপ ঘটিয়ে এক ভ্রাতৃত্বমূলক বিশ্বমানবসমাজ গঠনের জন্য এই আন্দোলন ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সচেতন উদ্যোগ। লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনকে উৎসর্গ করে স্বেচ্ছায় যুক্ত হয়েছিল মার্ক্স-এঙ্গেলসের এই আদর্শিক স্বপ্নপূরণে।
কিন্তু অল্পদিনেই কমিউনিস্ট আন্দোলনকে হটিয়ে দেয় পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ঝড়। বিশ্বায়নের ধারাটা যদিও নতুন নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি জোয়ারে পরিণত হয়। নয়াসাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ হলো এর উর্বর জমিন। পশ্চিমা উদারনীতিবাদও এর সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে। বিশ্বব্যাংক,আইএমএফ, ডব্লিউটিও ইত্যাদি এর পেছনে শক্তির জোগান দিয়েছে যার প্রবল ধাক্কায় এখন বিশ্বায়নই রাস্তাচ্যুত হওয়ার উপক্রম। বার্লিন দেয়াল ভাঙার পর শুরু হয়েছিল এর পাগলা গতি।
বিশ্বায়ন সবচেয়ে বড় হোঁচট খেয়েছে বিশ্ববাণিজ্যে আচমকা চীনের প্রবেশের পর থেকে। ইউরোপ-আমেরিকার ধনী দেশগুলোর ঘুম হারাম হয়ে গেছে সেই থেকে। ২০০১ সালে চীনকে ডব্লিউটিও-র সদস্য বানিয়ে প্রচলিত বিশ্ববাণিজ্যব্যবস্থা একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ধাক্কা খেল। পশ্চিমাদের মনের মতো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চীনের এই পুঁজিবাদী গর্জনে খোদ যুক্তরাষ্ট্রই আতঙ্কিত। মুক্তবাণিজ্য, বেসরকারিকরণ, কাঠামোগত সমন্বয় ইত্যাদির ফেরিওয়ালা নয়াউদারনীতিবাদ পরিচালিত বিশ্বায়ন নিজের কাটা গর্তে নিজেই পড়ল।
শুরু থেকেই বিশ্বায়ন বাম ও ডান উভয়পক্ষ থেকেই ভিন্ন ভিন্ন সমালোচনার শিকার হয়েছে, যদিও এর কোনো আদর্শিক সংজ্ঞা নেই। এ হচ্ছে বিশ্বপুঁজিবাদের একটি ধারা, যা কোনো পণ্যের উৎপাদনকে শ্রমবিভাজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক করে তোলে। এর ফলে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের শ্রমজীবী মানুষের শ্রমকে অতি সস্তায় কেনা সম্ভব হয়। পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রি বিশ্বব্যাপী করা হলেও শ্রমিককে কিন্তু স্থানীয় করে রাখা হয়। অর্থাৎ, পণ্যের জন্য যত সীমান্ত উবে যেতে থাকে, শ্রমের জন্য তত সীমান্ত খাড়া হতে থাকে। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি বিশেষত মোবাইল ফোন, অন্তর্জাল, যাতায়াতের বিশেষ করে আকাশপথের উন্নতি শ্রমিককেও সীমান্তের বাধা অতিক্রম করতে অনেকখানি সহায়তা করে।
সস্তা চীনা পণ্যের মতো এই শ্রমিক অভিবাসনও বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলেছে ধনী দেশের মানুষকে, বা তাদেরকে সুবিধাবাদী রাজনীতিকরা খেপিয়ে তুলছে নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকবার ও সহজে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। অথচ তারাই কিন্তু বিশ্বায়নের হোতা, আবার এ থেকে ফায়দাও লুটেছে বেশি। এখন তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ থেকে যাওয়া সস্তা পণ্য ও সস্তা শ্রম তাদেরকে করে তুলছে জাতীয়তাবাদী, ট্রাইবাল, গোষ্ঠিবাদী ও বিশ্বায়নবিরোধি। চলছে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর খেলা, জাতি ও ধর্মবিদ্বেষ চাঙা করা ও যুদ্ধাস্ত্রের ঝনঝনানি।
উদারনীতিবাদী ও নয়াউদারনীতিবাদী উভয়ই এখন কাছা দিয়ে নেমেছে এই বিশ্বায়নের রাশ টেনে ধরার জন্য। সংকীর্ণ জাতি-ধর্ম-বর্ণবিদ্বেষী রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে উচ্চে তুলে ধরা হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের একাংশকেও ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষের মাদকতা ছড়িয়ে। প্রয়োজনে উসকে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধোন্মাদনাকেও। এভাবে মানবজাতির একটি সম্ভাব্য উন্নত সুন্দর ভবিষ্যৎকে করে তোলা হচ্ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন।
উদারনীতিবাদী ও নয়াউদারনীতিবাদী উভয়ই এখন কাছা দিয়ে নেমেছে এই বিশ্বায়নের রাশ টেনে ধরার জন্য। সংকীর্ণ জাতি-ধর্ম-বর্ণবিদ্বেষী রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে উচ্চে তুলে ধরা হচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের একাংশকেও ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিদ্বেষের মাদকতা ছড়িয়ে। প্রয়োজনে উসকে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধোন্মাদনাকেও।
একটি নয়া আন্তর্জাতিকতাবাদই কেবল পারে এ ফাঁদ থেকে মানুষকে বের করে আনতে। যার শুরু যুক্তরাষ্ট্রে বার্নি স্যান্ডার্সের, যুক্তরাজ্যে জেরেমি করবিনের ও ইউরোপে DiEM২৫ (ডেমোক্রেসি ইন মুভমেন্ট, ভারাওফ্যাকিস যার একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য) আন্দোলনের মাধ্যমে।৬
এই নয়া আন্তর্জাতিকতাবাদই কেবল পারে সাম্যতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বিজয়ের মাধ্যমে মানুষকে বিশ্বায়নের ফাঁদ থেকে মুক্ত করে একটি সুখী ও সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে।
আলমগীর খান: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি| ইমেইল:alamgirhkhan@gmail.com
তথ্যসূত্র
১. Johan Norberg, Globalization’s Greatest Triumph: The Death of Extreme Poverty, The Hill (অনলাইন), ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮
২. মার্টিন লুথার কিং, Where Do We Go From Here: Chaos or Community?, Beacon Press, যুক্তরাষ্ট্র, ২০১০
৩. ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, ‘Building a Progressive International’, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ৩১ জুলাই ২০১৬
৪. ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, ‘Because we must!’, প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল ওয়েবসাইট, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩
৫. ইউভাল নোয়া হারারি, Sapiens: A Brief History of Humankind, Harper, নিউইয়র্ক, ২০১৫
৬. ইয়ানিস ভারাওফ্যাকিস, Building a Progressive International, পূর্বোক্ত