সর্বজনীন শিক্ষা: নীতি ও সংস্কারের গতিমুখ

সর্বজনীন শিক্ষা: নীতি ও সংস্কারের গতিমুখ

কাবেরী গায়েন

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা এক কঠিন সংকটে। সংখ্যাবৃদ্ধির উচ্ছ্বাসের নীচে চাপা পড়ে আছে এর ভয়াবহ অবনতির দশা। শিক্ষানীতি একটি দেশের শিক্ষাদর্শনের আইনি ও প্রায়োগিক কাঠামো। বাংলাদেশের শিক্ষাদর্শন ঔপনিবেশিক অতীতের সাথে সাম্প্রদায়িক ও বাণিজ্যিক কাঠামোতে বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এক অস্বস্তিকর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছে। ‘সর্বজনীন’, ‘গণমুখী’ এবং ‘বিজ্ঞানভিত্তিক’ শিক্ষানীতির দাবি বহুদিনের হলেও বাস্তব চিত্র ক্রমেই আরও দূরে সরে যাচ্ছে। এই বিষয় একবাক্যে বলা  সহজ, কিন্তু বিষয়টি অনুধাবন করা এবং সে লক্ষ্যে কাজ করা এক দীর্ঘ বিপ্লবের সমান নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগ ও প্রতিজ্ঞা দাবি করে। এই লেখায় ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে প্রণীত শিক্ষানীতি পর্যালোচনা করে বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে এবং একইসঙ্গে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় নিয়েও আলোচনা উত্থাপন করা হয়েছে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষানীতি

ইংরেজ দখল নেওয়ার পর, মূলত তাদেরই প্রয়োজনে, এদেশে পাশ্চাত্য ধারায় আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষার প্রচলন শুরু হয়। পাশ্চাত্য মিশনারি, বণিকশ্রেণি এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের হাতেই এই শিক্ষার সূচনা। এ শিক্ষাদানের পেছনে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের মূল অভিপ্রায় ছিল এদেশ থেকে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের কাজটি নির্বিঘ্ন করার জন্য এদেশে একদল সমর্থক এবং লাঠিয়াল বাহিনী তৈরি করা। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত শিক্ষানীতিতে কখনো জোর দেওয়া হয়েছে প্রাচ্যবিদ্যা বা ধর্মীয় শিক্ষাদানের প্রতি (কলিকাতা মাদ্রাসা এবং বেনারস হিন্দু কলেজ দিয়ে যার শুরু), কখনো-বা জোর দেওয়া হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ পাশ্চাত্য শিক্ষাদানের দিকে (ইংরেজি স্কুল, কলেজ স্থাপন ও কলিকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মধ্য দিয়ে)। প্রতিষ্ঠান যা-ই হোক, তাদের প্রণীত শিক্ষানীতির লক্ষ্য একটাই ছিল: এদেশের মানুষের ওপর শোষণ ও আধিপত্য নিরঙ্কুশ করার জন্য দক্ষতাসম্পন্ন জনবল তৈরি করা। এই উদ্দেশ্যে ১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশমালা, ১৮৩৫ সালের মেকলের শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদন, ১৮৩৮ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষা বিষয়ক জরিপ, ১৮৫৭ সালের চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালে উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ এবং শেষে ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বর্তমান রূপটি প্রদান করা হয়।

১৭৯২ সালের চার্লস গ্র্যান্টের শিক্ষাবিষয়ক সুপারিশমালা, ১৮৩৫ সালের মেকলের শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদন, ১৮৩৮ সালের উইলিয়াম অ্যাডামসের শিক্ষা বিষয়ক জরিপ, ১৮৫৭ সালের চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচ, ১৮৮২ সালে উইলিয়াম হান্টারের নেতৃত্বে প্রথম ভারতীয় শিক্ষা কমিশন নিয়োগ এবং শেষে ১৯০৪ সালে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার বর্তমান রূপটি প্রদান করা হয়।

উল্লেখ করা যেতে পারে, চার্লস উডের শিক্ষাবিষয়ক ডেসপ্যাচে কলিকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজে ডাইরেক্টরেট অব পাবলিক ইন্সট্রাকশনস বা ডিপিআই স্থাপন ও এই তিন শহরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও কেবল সরকারি বিদ্যালয়ের স্থলে গ্র্যান্টস ইন এইড দিয়ে বেসরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করার সুপারিশ করা হয়। আর হান্টারের নেতৃত্বে গঠিত ভারতীয় শিক্ষা কমিশন উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিবর্তে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছিল। নীতি হিসেবে সর্বজনীন শিক্ষাদান ব্রিটিশ সরকার কখনো গ্রহণ করেনি, তবে উচ্চশিক্ষার প্রসারে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে উচ্চশিক্ষা সংকোচন ও প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের কথা বলা হয়েছিল, যদিও ভারতীয় এলিটরা এ কথায় গুরুত্ব দেয়নি। (চট্টোপাধ্যায়, ১৯৮৭; খান, ১৯৮৮/১৯৯০) শিক্ষা ভারতবর্ষে প্রাচীন কালের মতো, ইংরেজ আমলেও মুষ্টিমেয়র উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার উপলক্ষ্যই থেকে যায়। সর্বজনীন গণমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষার বিস্তার তাদের লক্ষ্য ছিল না। কোনো ঔপনিবেশিক শক্তিরই সেই দায় থাকে না।

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর, নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রেও শিক্ষা ইংরেজ আমলের মতোই সুবিধাভোগী শ্রেণির প্রায় একচেটিয়া দখলে থাকে, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে পড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। পশ্চিম পাকিস্তানে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর পূর্ব পাকিস্তানে পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা কমতে থাকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সেই সংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে। গুণগত দিক থেকেও পশ্চিম পাকিস্তানে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয় পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন চেষ্টা, আরবি-উর্দু শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ইসলামিকরণ করা–এসব কাজে বাঙালিদের ব্যস্ত রেখে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ সাধনে ব্রতী হয়। শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের পাশাপাশি শ্রেণিবিভক্তির কাজটিও অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক করা হয়।

পাকিস্তানের প্রথম শিক্ষা সম্মেলনে (১৯৪৭) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় দ্রুত একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করতে হবে। ১৯৪৬ সালে, ভারত বিভক্তি নিয়ে যখন দরকষাকষি চলছিল, তখনই মার্কিন সামাজ্যবাদ পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার প্রয়াস নেয় এবং পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর একদম চেপে বসে। পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি নয়া উপনিবেশে পরিণত হয়। ব্রিটিশ সামাজ্যবাদের পরিবর্তে মার্কিন সামাজ্যবাদে অন্তর্ভুক্তির পর স্বাক্ষরিত হয়েছিল সিয়েটো ও সেন্টোর মতো সামরিক চুক্তি। ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য প্রয়োজন একটি অনুগত ও দক্ষ প্রশাসন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আমলে এই শক্তির জোগান পাওয়া যেত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস বা আইসিএস নামের আমলাতন্ত্রে। এই আইসিএস ক্যাডার ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিভূ। আইসিএস ক্যাডারদের কাছে ব্রিটিশ সবকিছুই ছিল শ্রেষ্ঠ। একইভাবে, পাকিস্তানে গড়ে তোলা হলো সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান বা সিএসপি, যারা মার্কিনিদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে শিখল। মার্কিন স্বার্থরক্ষায় অগ্রাধিকার দিতে শিখল। তাই ব্রিটিশ আমলের মতো পাকিস্তান আমলেও শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য হয়ে উঠল দেশের মেধাকে বিদেশি সেবায় নিয়োজিত রাখা এবং দেশের মধ্যেই নয়া উপনিবেশ গড়ে তোলা।

১৯৫১ সালে পাকিস্তানের দ্বিতীয় শিক্ষা সম্মেলনেও পূর্বেকার শিক্ষানীতি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী শিক্ষার্থীদের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য হয়ে উঠল সিএসপি হওয়া, যদিও সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের প্রবেশগম্যতা ছিল খুবই সীমিত। ১৯৫২ সালে মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে যে শিক্ষা পুনর্গঠন কমিটি গঠিত হয়, সেখানে বেশ কিছু ভালো সুপারিশ থাকলেও পাকিস্তানের ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষার তাগিদ থেকে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণের ওপর জোরারোপ করা হয়। পাকিস্তান আমলে আরও তিনটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল: ১৯৫৯ সালের শরীফ কমিশন, ১৯৬৬ সালের হামদুর রহমান কমিশন এবং ১৯৬৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন নূর খান কমিশন। প্রতিটি শিক্ষানীতির মূল লক্ষ্য একই: মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যে শিক্ষার সকল সুযোগ নানা কৌশলে সীমাবদ্ধ রাখা। পূর্বপাকিস্তানের লড়াকু ছাত্রসমাজের প্রতিরোধে এসব নীতির প্রকাশ্য বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও অনেক সুপারিশই কার্যকর করা হয় নীরবে। স্কুলে অবৈজ্ঞানিক পন্থায় ধর্মশিক্ষা, প্রথম শ্রেণি থেকে আরবি ভাষা শিক্ষা এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি সাহিত্যের পরিবর্তে ফাংশনাল ইংলিশ নামে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিক্ষা কোর্স চালু করা হয়। পাশাপাশি চালু করা হয় ব্যয়বহুল মডেল স্কুল, ক্যাডেট কলেজ ও মাদ্রাসা। এসব প্রতিষ্ঠানে মূল ধারার স্কুলের তুলনায় ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে চারশ গুণ বেশি ব্যয় করা হতে থাকে। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি ও জিইয়ে রাখার প্রকল্প হিসেবেই এসব শিক্ষা সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়। একই উদ্দেশ্যে বেসরকারি কলেজগুলোতে শুধু পাসকোর্স রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। এবং শিক্ষাকে শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করার দৃষ্টিতে দেখার পরামর্শ দেওয়া হয়। ফলে গোটা পাকিস্তান আমল জুড়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং শিক্ষাসংকোচন নীতির বীজ বপন করে চারাগাছ তৈরির কাজ সম্পন্ন হতে দেখি, যার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ এড়াতে পারেনি বলেই প্রতীয়মান হয় বাংলাদেশে প্রণীত শিক্ষানীতিগুলোর সমূহ পাঠ থেকে। (ইসলাম, ১৯৮৮/১৯৯০; খান, ১৯৮৮/১৯৯০)

পাকিস্তান আমলে আরও তিনটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল: ১৯৫৯ সালের শরীফ কমিশন, ১৯৬৬ সালের হামদুর রহমান কমিশন এবং ১৯৬৯ সালের অন্তর্বর্তীকালীন নূর খান কমিশন।

বাংলাদেশের শিক্ষানীতি: ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক বাণিজ্যিক শিক্ষার সম্প্রসারণ

কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন

বাংলাদেশে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় ১৯৭২ সালে, ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট’ নামে প্রকাশিত এই কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এবং সংবিধানের চার মূল নীতির মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষানীতির লক্ষ্য থাকবে: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, দেশাত্মবোধ ও আলোকিত নাগরিকত্ব, মানবতাবাদ এবং বিশ্বনাগরিকত্ব, নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসেবে শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষা, কায়িক শ্রমের প্রতি যথাযথ মর্যাদা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং নেতৃত্বের দক্ষতা, মৌলিক গবেষণা ও সামাজিক অগ্রগতিএবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য শিক্ষা। ((বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৭৪: ৪)

এসব লক্ষ্য পূরণের জন্য তারা সুপারিশ করেছিলেন:

১) চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রতিফলন অবশ্যই সকল স্তরের শিক্ষায় থাকতে হবে।

২) বাংলাকে সকল স্তরে শিক্ষার মাধ্যম করতে হবে।

৩) প্রাথমিক শিক্ষাকে অবশ্যই অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে হবে। ১৯৮০ সালের মধ্যে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং ১৯৮৩ সালের মধ্যে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৪) বিজ্ঞান ও কৃষিবিজ্ঞান শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে ক্রমান্বয়ে তার গুরুত্ব বাড়াতে হবে।

৫) টেকনিক্যাল ও প্রাযুক্তিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের নবম শ্রেণি থেকে কারিগরি শিক্ষা শুরু করা হবে। কারিগরি ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটসমূহের মধ্যে এবং এদের সঙ্গে কাজে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।

৬) সকল পর্যায়ে কর্মমুখী সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে।

৭) ১৯৮০ সালের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করতে হবে এবং এ কাজটি দেশের সকল শিক্ষিত মানুষের সহযোগিতায় করা হবে।

৮) বিদ্যমান পরীক্ষা মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন করতে হবে।

৯) সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যকার পার্থক্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে দূর করতে হবে। ১০ বছরের একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এব্যাপারে।

১০) শিক্ষায়তনিক প্রশাসন শনাক্ত করতে হবে।

১১) কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী যেন অর্থের অভাবে বা সুযোগ-সুবিধার অভাবে ঝরে না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

১২) তরুণদের সবচেয়ে যোগ্য জাতীয় চাকরিতে ঢোকার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

১৩) শিক্ষাবিষয়ক চাকরিকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে, যেন সবচেয়ে যোগ্য শিক্ষার্থীরা সেখানে যোগ দিতে চায়।

১৪) শিক্ষাকে দেখতে হবে মানবসম্পদে বিনিয়োগ হিসেবে, কোনো সমাজসেবামূলক কাজ হিসেবে নয়। শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় বর্তমানের ৭ শতাংশ থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ করতে হবে। শিক্ষাখাতে ব্যয় অবিলম্বে জিএনপির ৫ শতাংশ করতে হবে এবং অতি দ্রুত সেটি ৭ শতাংশ করতে হবে।

কমিশন শিক্ষাখাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের কথাও বিবেচনা করেছে। এগারো বছর স্কুল শেষে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্সের বিধান রেখে নতুন শিক্ষা কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করার সুপারিশ করেছে। পরীক্ষামূলকভাবে এই পদ্ধতি সফল হলে কমিশন পাঁচ বছর পর ১০ বছরের স্কুলশিক্ষাশেষে চার বছরের ডিগ্রি শিক্ষার সুপারিশের আগাম ইচ্ছা ব্যক্ত করে রিপোর্ট শেষ করেছে।

শিক্ষা দর্শনের যে সাতটি ধারাকে (ঈঁৎৎবহ বঃ ধষ, ২০০৩) শিক্ষাব্যবস্থায় মানধারা হিসেবে মান্য করা হয়, এই রিপোর্টে তার অনেকগুলোই একসঙ্গে ব্যবহারের প্রচেষ্টা রয়েছে। পাকিস্তান আমলের শিক্ষানীতিসমূহের তুলনায় এই শিক্ষানীতির দর্শন অনেকটাই অগ্রগামী। এখানে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার মতো আধেয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার সকল পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রথমে ভারত এবং পরে পাকিস্তানের শিক্ষানীতি দ্বারা প্রভাবিত থাকার কারণে প্রাথমিক থেকেই ধর্মশিক্ষা বহাল রাখার পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড যথারীতি চালু রাখা হয়েছে। প্রত্যেক শ্রেণিতে ধর্মীয় শিক্ষার কতটি ক্লাস পরিচালিত হবে, সেটিও বলে দেওয়া হয়েছে। যেমন: প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রতি সপ্তাহে ক্লাস হবে ২টি, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে হবে ৩টি, পঞ্চম শ্রেণিতে ৩টি, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ২টি এবং সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে ২টি। (বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট, ১৯৭৪: ২৪)।

এখানে ধর্মীয় শিক্ষার পরিবর্তে নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের বিধান ছিল। সপ্তাহভিত্তিক এই ক্লাস বণ্টন ধর্মীয়/নৈতিক শিক্ষার জন্য একই মাত্রায় প্রযোজ্য ধরা হয়েছিল। যদিও স্কুলে নৈতিক শিক্ষা নয়, ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের বিধানই বলবৎ থেকেছে। শিক্ষায় সবার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও শিক্ষায় সবার প্রবেশগম্যতা আইন দ্বারা নির্ধারণের কথা বলা হয়নি। বাতিল করা হয়নি ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি রয়েছে অর্থায়নের প্রসঙ্গে। শিক্ষার কোনো পর্যায়েই সম্পূর্ণ অবৈতনিক করার কথা বলা হয়নি। ইংরেজি মাধ্যম এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাঠামো বহাল রেখেই সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা শুনতে ভালো হলেও আসলে এটি বাগাড়ম্বরমাত্র। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসা সমাজকাঠামো একই রেখে, সেই সমাজের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখেই এই প্রস্তাবগুলো করা হয়েছিল। তবে শিক্ষায় অর্থায়নের জন্য যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর অনুগামী না হলেও শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশের সঙ্গে, কল্যাণ অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে খানিকটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই শিক্ষানীতি প্রয়োগ করলে শিক্ষাব্যবস্থায় কতটা গুণগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারত সেটা বোঝা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ, এই নীতিটি বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

শিক্ষানীতিসমূহ (১৯৭৭-২০০৩)

সামরিক সরকার প্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে তখনকার শিক্ষামন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদের নেতৃত্বে ‘অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি’ নামের শিক্ষা কমিশন নিয়োগ দেন। মূলত কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ রিভিউ করার জন্যই এই কমিশন গঠিত হয়েছিল। এই কমিশন একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করেছিল। কিন্তু এই শিক্ষানীতির সুপারিশ সম্পর্কে কেউই ঠিক অবগত নন। কারণ, এই নীতি প্রণয়নের কিছু দিনের মধ্যেই তিনি বরখাস্ত হন। এরপর সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে, ১৯৮৩ সালে, ড. আবদুল মজিদ খান ‘শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি ভূমিকায় ‘বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষাকে উৎপাদন পদ্ধতি ও বাস্তব পেশাসমূহের সঙ্গে বিচ্ছিন্নভাবে সংযুক্ত করা হয়েছে’ বলে দাবি করলেও আসলে এই রিপোর্টে প্রাথমিক স্তরে আরবি ও ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা, মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যায় আরও দু-বছর বাড়ানো, স্নাতক ক্লাসের পূর্বে প্রাক-স্নাতক পর্ব যুক্ত করা, উচ্চশিক্ষার জন্য মেধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষার্থী বাছাই করা, মাদ্রাসা শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার ঘটানো ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়। অর্থাৎ, বাণিজ্যিকীকরণের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার ঘটানোর সুপারিশ করা হয়। শিক্ষার্থী সমাজের প্রতিরোধের মুখে এই রিপোর্ট বাস্তবায়ন থেকে তখনকার মতো সরকার পিছু হটলেও এই রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়িত হয় পরে।

১৯৮৭ সালে মফিজ উদ্দিন খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। কমিশন বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ানোর জন্য ল্যাবরেটরি নির্মাণ, উন্নতমানের বিজ্ঞান বইয়ের জোগান বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলে মাদ্রাসা শিক্ষার এমন বিস্তার চেয়েছেন যে এসব পদক্ষেপ মাদ্রাসাকে স্কুলে নয়, স্কুলকে মাদ্রাসায় পরিণত করতে সক্ষম। এই নীতিও বাস্তবায়িত হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালে গঠন করে শামসুল হক শিক্ষা কমিটি। এই কমিটি রিপোর্ট পেশ করে ২০০০ সালে। স্কুল ম্যানেজমেন্ট কমিটির সক্রিয়তা বৃদ্ধি, ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা, প্রাথমিক শিক্ষায় এক ধারার সিলেবাস প্রণয়ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩৫ করা, বিভিন্ন পর্যায়ের জন্য শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বাড়ানো–এসব বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এই শিক্ষানীতিতে বিজ্ঞান গবেষণার জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় সম্পদ ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। গবেষণার ফল সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিষয়ভিত্তিক গবেষণা জার্নাল প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষা ধারায় অনুসৃত শিক্ষার্থী মূল্যায়ন প্রক্রিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা ধারায়ও অনুসরণ করার সুপারিশ করা হয়েছিল। এই নীতিও বাস্তবায়িত হয়নি। ২০০৩ সালে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে যে কমিশন গঠিত হয়, সেই কমিশন মানসম্মত শিক্ষার জন্য নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর সুপারিশ করেছিল। এই কমিশনও আলোর মুখ দেখেনি। তবে প্রায় প্রতিটি শিক্ষানীতিতেই ক্রমাগত বাণিজ্যিক এবং সাম্প্রদায়িক উপাদান যুক্ত হয়েছে। ২০১০ সালে কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ছিল প্রথম শিক্ষানীতি, যেটি আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে। তাই এই নীতির ঘোষিত দর্শন বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। 

শিক্ষানীতি ২০১০

কবির চৌধুরী শিক্ষানীতি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট এবং শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত, যেখানে একাধিক পরিবর্তন আনা হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষার ওপর জোরারোপ, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিক ও যুগোপযোগীকরণ, যা মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূল ধারার চাকরির জগতে প্রবেশগম্যতা দিয়েছে, ধর্মীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষায় স্থানীয় মসজিদের আওতাধীন করা এবং অর্থায়নের ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে জোরারোপ করা এবং উচ্চশিক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষক নিয়োগের মতো সুপারিশ থাকায় এই নীতিকে ‘না গণতান্ত্রিক না অসাম্প্রদায়িক’ মর্মে সমালোচনা উঠেছে খসড়া নীতি প্রণয়নের পর থেকেই। তবে অতীতের সব শিক্ষানীতি থেকে এই শিক্ষানীতিকে অধিকতর বাস্তবসম্মত বলেও মতামত দিয়েছেন কেউ কেউ।

বাস্তবতা হলো, ২০১০ সালের শিক্ষানীতি সঙ্গে নিয়েই বাংলাদেশে গত ১২ বছরে শিক্ষাখাতের সমস্যা প্রকটতর হয়েছে। এই নীতি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অবশ্য ঘোষিত নীতির অনেক সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত না হওয়াকে দায়ী করেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে এক বছরের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করার কথা ছিল, তা এখনো চালু করা হয়নি বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এনজিও বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে চালানো হয়, যা হয় খুব ব্যয়বহুল নয়তো নিচুমানের সেবা প্রদানকারী। শিশুদের মানসিক-শারীরিক বিকাশের জন্য জুতসই নয়। গত ১০-১২ বছরে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষক এবং শ্রেণিকক্ষের জন্য পৃথক পদ তৈরি করা ছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোতে অভিন্ন মান বজায় রাখা বা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু রাখার জন্য মন্ত্রণালয় কোনো নির্দিষ্ট আদেশ প্রচার করতে পারেনি। অবকাঠামোর অভাবে সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা স্থগিত হয়েছে। আবার পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি শেষ করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) চালু হওয়ায় প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়েছে। প্রথম থেকেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করে আসছেন যে, এগারো বা বারো বছর বয়সে পাবলিক পরীক্ষায় বসলে শিশুদের ওপর ক্ষতিকর মানসিক চাপ তৈরি হতে পারে এবং তা তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতে পারে।

সর্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা স্থগিত হয়েছে। আবার পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি শেষ করে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা (জেএসসি) চালু হওয়ায় প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়েছে।

এসব পাবলিক পরীক্ষা চালু হওয়ার পর অনেক শঙ্কাই সত্যি হলো। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরকে যে কোনো উপায়ে সব বিষয়ে এ+ পাওয়ার প্রতিযোগিতার মধ্যে নিয়ে আসা হলো। পরীক্ষায় নকল করা নতুন উচ্চতা পেয়েছে, বইয়ের বাজার বেআইনি গাইড বইয়ে সয়লাব হয়ে গেছে। পরীক্ষার কয়েকদিন আগে কিংবা আগের রাতে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। এমনকি শিক্ষার্থীরা সন্তোষজনক ফল নিয়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারায় আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে অনেক।

এসব পাবলিক পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্ন প্রবর্তনও আশানুরূপ ফল বয়ে আনতে পারেনি। সৃজনশীল প্রশ্ন হলো এমন প্রশ্নপত্র, যা শিক্ষার্থীদের স্মরণ করার, উপলব্ধি করার এবং শেখানো পাঠকে তার বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এটি এমনভাবে প্রণয়ন করা হবে যাতে শিক্ষার্থীরা বাক্যগুলো মুখস্থ না করে ধারণাটির উপলব্ধি থেকে উত্তর লিখতে পারে। তবে প্রকল্পটি প্রায় নিষ্ফল হয়ে পড়েছে। কারণ, বাজারে অসংখ্য অবৈধ গাইডবই এবং কোচিং সেন্টার রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের সব ধরনের সৃজনশীল প্রশ্ন সরবরাহ করে। শিক্ষার্থীরা উত্তর মুখস্থ করার জন্য কোচিং সেন্টারগুলো থেকে দেওয়া এই গাইডবই এবং নোটগুলো কিনতে ছুটে আসে। কারণ, তাদের পরীক্ষায় একই ধরনের প্রশ্ন পাওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এই গাইডবই প্রকাশক এবং কোচিং সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান সত্ত্বেও, এখনও তারা এ+ পাওয়ার ‘সহজ’ উপায় শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করতে পারে।

কওমি মাদ্রাসার জন্য পৃথক কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতিও এখনো প্রতিশ্রুতি রয়ে গেছে। সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ওপর সরকারের সরাসরি কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বর্তমান শিক্ষানীতির সঙ্গে তাদের পাঠ্যক্রম এবং শিক্ষণ-শেখানো প্রক্রিয়ার কোনো যোগসূত্র নেই এবং এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাস করা অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে তাদের স্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি মূলধারার মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে আসা শিক্ষার্থীরাও চরম অবহেলার শিকার হয়েছে।

শিক্ষানীতিতে সকল স্তরের শিক্ষার মান উন্নয়ন, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার অগ্রাধিকার ছিল। নীতিমালায় শিক্ষকদের মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে প্রতিশ্রুতি ও কৌশলের বিপরীতে সরকারের নজিরবিহীন সিদ্ধান্তে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন-মর্যাদা নিম্নমুখী করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষকদের বিক্ষোভ কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং এখনো সমস্যার সমাধান হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় তলানিতে ঠেকেছে। চোখের সামনে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে।

নীতিমালার বিভিন্ন ধাপ বাস্তবায়নের সময় যে অপ্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া গেছে, তা সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রস্তুতির অভাবের ফলাফল হিসেবে দেখেছেন বিশেষজ্ঞরা। যে কারণই চিহ্নিত করা হোক, গোটা শিক্ষাব্যবস্থা যে এখন মারাত্মক সংকটে নিমজ্জিত, সেই বাস্তবতা ঢেকে রাখতে পারছে না সাক্ষরতা বৃদ্ধি, লিঙ্গসমতা নিশ্চিত করার কিছু পদক্ষেপ এবং দেশের সব জায়গায় পাঠ্যপুস্তক সময়মতো বিতরণ জাতীয় কিছু সাফল্য। তৈরি হচ্ছে মুখস্থবিদ্যায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত একটি একমাত্রিক সমাজের নাগরিক, যারা কেবল নিজের এ+ নিয়ে সন্তুষ্ট। এই সংকট কেবল প্রয়োগের সংকট নয়, এ সংকট প্রচলিত শিক্ষাদর্শনেরই সংকট। বোঝাই যাচ্ছে, লক্ষ্য হিসেবে সুনাগরিক বানানোর কথা থাকলেই কেউ সুনাগরিক হয়ে ওঠে না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে নিউক্লিয়াস পরিবারে একটি-দুটি সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকরা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে সাহস পান না। শিক্ষক হারাতে চান না টিউশনের সুযোগ। তিনি শ্রেণিকক্ষে পড়ান না বা এক ঘণ্টার ক্লাসে ১০০জন শিক্ষার্থীকে পড়ানো সম্ভব নয়। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার ফলের ওপর স্কুলের টিকে থাকা নির্ভর করে। শিক্ষকরা খারাপ ফলের চাপ নিতে পারবেন না। সরকার কম পাসের ঝুঁকি নেবেই না, তাই সবাইকে পাস করিয়ে দেওয়াই একমাত্র সমাধান হয়ে উঠেছে। শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই একটা অনৈতিক চক্রে ঢুকে গেছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকের এই নকলকেন্দ্রিক মুখস্থবিদ্যার যে উৎসব, তার অন্তর্নিহিত কারণ প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদী সমাজকাঠামো। যোগ্যতমের ঊর্ধ্বতনের টিকে থাকার দর্শনেই বিকৃত হয়ে গেছে শিক্ষাব্যবস্থা।

এসব বিষয়ে কারণ নির্ধারণের আগেই, জাতীয় পর্যায়ে অলোচনা শুরু করার আগেই, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির জন্য নতুন পাঠ্যক্রম অনুমোদনের ঘোষণা দেওয়া হয়ে গেছে, যেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কেবল আটটি বই পড়তে হবে। শিক্ষার্থীরা হয়ে গেছে একের পর এক শিক্ষা কমিশনের বিজ্ঞ কমিশন সদস্যদের ইচ্ছাপূরণের গিনিপিগ।

এসব বিষয়ে কারণ নির্ধারণের আগেই, জাতীয় পর্যায়ে অলোচনা শুরু করার আগেই, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শ্রেণির জন্য নতুন পাঠ্যক্রম অনুমোদনের ঘোষণা দেওয়া হয়ে গেছে, যেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা নেই এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কেবল আটটি বই পড়তে হবে। শিক্ষার্থীরা হয়ে গেছে একের পর এক শিক্ষা কমিশনের বিজ্ঞ কমিশন সদস্যদের ইচ্ছাপূরণের গিনিপিগ। এক শিক্ষানীতি চালু হওয়ার আগেই ভিন্ন শিক্ষানীতি শুরু হয়। ঔপনিবেশিক অতীত, সাম্প্রদায়িক বাণিজ্যিক বর্তমান নিয়ে চালিত শিক্ষানীতি নিয়ে ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কী আশা করা যায়! (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

(লেখাটি ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি আন্দোলন-এর সেমিনারে পঠিত। ঈষৎ পরিবর্তিত।)

ডক্টর কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ইমেইল: kaberi.gayen@du.ac.bd

তথ্যসূত্র:

দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় (১৯৮৭)। ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে। অনুষ্টুপ প্রকাশন: কোলকাতা।

আবদুল মতিন খান (১৯৮৮/১৯৯০)। ‘এযাবৎকালের শিক্ষানীতি ও বিকল্প কাঠামো’ (আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত, বাংলাদেশের শিক্ষা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)। বাঙলাদেশ লেখক শিবির: ঢাকা।

শহীদুল ইসলাম (১৯৮৮/১৯৯০)। ‘বাংলাদেশের আধুনিক শিক্ষা: ঐতিহাসিক পটভূমি’ (আনু মুহাম্মদ সম্পাদিত, বাংলাদেশের শিক্ষা: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)। বাঙলাদেশ লেখক শিবির: ঢাকা।

কাবেরী গায়েন (২০১৪)। ‘শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় আচ্ছাদন কেন?’, মতামত, প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুযারি২০১৪।

কাবেরী গায়েন (২০২৩)। ‘বাংলাদেশের শিক্ষাদর্শন: ঔপনিবেশিক অতীত, সাম্প্রদায়িক বাণিজ্যিক বর্তমান এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।’ সাপ্তাহিক একতা, ২৬ জুলাই২০২৩।

কাবেরী গায়েন (২০২৩)। ‘দেশের পড়াশোনা কীভাবে বিসিএসমুখী হলো’। আজকের পত্রিকা, ২৬ জুলাই২০২৩।

দ্য ডেইলি স্টার (২০২৩)। ‘জনশুমারিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের প্রকৃত সংখ্যা আসেনি।’ ২৩ সেপ্টেম্বর২০২৩।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

Bangladesh Education Committee Report 1974. Ministry of Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh.

Curren, R., Robertson, E. and Paul Hager, P. (2003). The Analytical Movement,

in Curren 2003: 176– 191. doi:10.1002/9780470996454.ch13

National Education Policy 2010. Ministry of Education, Government of the People’s Republic of Bangladesh.

Rikowski, G. (2004). Marx and Education. Policy Future in Education, 2(November 3&4).

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •