সম্পাদকীয় ভূমিকা
বহুবিধ অনিশ্চয়তা, আতংক আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের। জিনিষপত্রের অবিরাম দাম বৃদ্ধির কারণে প্রকৃত আয় কমে গেছে, এর মধ্যে শুরু হয়েছে ডেঙ্গুর আক্রমণ। তার উপর নির্বাচন সামনে চরম অনিশ্চয়তা আর সহিংসতার উদ্বেগ। বিদ্যুৎ নিয়ে নানা গালগল্প সত্ত্বেও এখনও ঢাকার বাইরে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং চলছে। সরকারি দলিলেই এর পেছনের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে বলা হয়েছিল ‘লুটেরা মডেল’-এ চলছে এই খাত। পরে দলিল থেকে এই অংশ প্রত্যাহার করলেও এটাই সত্য।
গণতন্ত্র, উন্নয়ন নিয়ে সরকারের অবিরাম মিথ্যাচারের সাথে নির্বাচন সামনে দেশে আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক চাপে এখন যোগ হয়েছে নার্ভাসনেস। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপানের চরদখলের খেলা শুরু হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রান্তস্থ এই দেশে রাষ্ট্রক্ষমতা আর জনবিদ্বেষী ব্যবস্থার বিষাক্ত বৃত্ত চলছেই। সর্বজনের হাতে দেশ আনার শক্তির বিকাশ ছাড়া এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। গত পাঁচ দশকে ক্ষমতায় গিয়ে শাসক শ্রেণীর সব দল ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে, তাই তাদের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনেরও দৃষ্টান্ত তারা তৈরি করতে পারে নাই। প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী করতে, নির্বাচনে সকলের অংশগ্রহণ এবং সকল নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এইবার সহ হয়তো আরও কয়েকটি নির্বাচন অস্থায়ী, আস্থাভাজন এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে সক্ষম এরকম সরকারের অধীনেই করতে হবে। বর্তমান সরকার এই পথ তৈরি করতে যত বিলম্ব করবে তত দেশের নানামুখী বিপদ বাড়বে।
ডেঙ্গুতে যখন বিপর্যস্ত মানুষ, তখন নির্লিপ্ত সরকার। ঢাকার জুরাইনসহ বেশ কিছু অঞ্চলে এই রোগ ভয়ংকর আকার নিয়েছে। এগুলো আকস্মিক ঘটনা নয়, এর কারণ ও সমাধানের পথ বহু আগে থেকেই আলোচিত। কিন্তু রুটিন নড়াচড়া, বড় বড় প্রকল্পে অর্থ অপচয় আর বাগাড়ম্বরই এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আর দুই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান তৎপরতা। কিছুদিন আগে ঢাকা উত্তরের মেয়র মশা মারা দেখতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে বুঝলেন এতোদিন যেভাবে মশা মারা হচ্ছে তা ভুল ও ক্ষতিকর। তারপরও একই কাজ চলছে। দক্ষিণের মেয়র বাহাদুর শাহ পার্কসহ বিভিন্ন পার্ক ফুটপাত ইজারা দিতে আর গাছ কাটতেই বেশি ব্যস্ত দেখা যায়। ডেঙ্গু আতংকের মধ্যে দায়িত্বে চরম অবহেলা করে তিনি বিদেশ সফরে গেছেন। আর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর জমি নিয়ে জালিয়াতির খবর পত্রিকায় এসেছে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় কী কী করণীয় তা বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকেই বলছেন। ক্রমবর্ধমান ডেঙ্গু বিপদ মোকাবিলায় সরকারের (স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মাধমে) জরুরী করণীয় কাজগুলো হচ্ছে- (১) ঝুঁকিপূর্ণ বিপর্যস্ত সকল অঞ্চলের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যকর্মী দল নিয়োগ। (২) দ্রুত টেস্ট করার জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা। (৩) টেস্ট ও ডেঙ্গু চিকিৎসা বিনা মূল্যে করার জন্য সকল হাসপাতাল ও ক্লিনিককে নির্দেশ দেয়া। (৪) টিভি, রেডিও, মাইকিং, এসএমএস, অনলাইনে সতর্কতা এবং করণীয় বিষয়ক অবিরাম প্রচার। (৫) খোলা জায়গা, নির্মাণাধীন ভবন, অলিগলি ভাঙাচোরা রাস্তা ভবন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পরিত্যক্ত ক্ষেত্রে মশকনিধনে মেয়র ও কমিশনারদের নেতৃত্বে সিটি কর্পোরেশনের নিয়মিত অভিযান। (৬) সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, তথ্য সমন্বয় ও নির্দেশনা দেবার জন্য উচ্চ ক্ষমতা দিয়ে বিশেষজ্ঞসহ একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠন করা। অবিলম্বে এসব কাজ করতে সরকার যাতে বাধ্য হয় সেজন্য সকলেরই সক্রিয় সরব হওয়া দরকার।
এই সংখ্যায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট নিয়ে লেখায় তরুণ অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এর কার্যকরিতা বিশ্লেষণ করেছেন। বাংলাদেশে ইনফরমাল সেক্টর বা অনানুষ্ঠানিক/অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত নিয়ে গবেষণার পুরোধা ব্যক্তি তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই সংখ্যায় লিখেছেন। সর্বজনকথার গত ও বর্তমান সংখ্যায় অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিক নিয়ে লেখাগুলোও এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক। বিশ্বজুড়ে পুঁজির পুঞ্জিভবন ও বৈষম্য বিষয়ে টমাস পিকেটি ও আইএমএফ-এর বিতর্কের সারকথা তুলে ধরা হয়েছে এই সংখ্যায়।
‘তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ শীর্ষক নিবন্ধে প্রস্তাবিত তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পটির (তিস্তা প্রকল্প) সারবত্তা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই সংখ্যায় আরও থাকছে গ্রন্থ পর্যালোচনা ‘নদী খুন ও উন্নয়নের কমেডি’, চলচ্চিত্র পর্যালোচনা ‘সিনেমা সত্য। ঢাকার প্রামাণ্যচিত্রের হাসতর’। সেই সাথে ধারাবাহিক লেখা ‘মৌলবাদের সংঘাত: ক্রুসেড, জিহাদ এবং আধুনিকতা-৪’ এবং ‘২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৯’ । নতুন একটি ধারাবাহিক লেখায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে সাথে ইতিহাসের নানা নথি পর্যালোচনা করে এই দেশের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতির গতিমুখ তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে । প্রথম পর্বে ১৯৭২-৭৩ সালের কিছু দিক আনা হয়েছে।
১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে প্রথম ‘যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই নীতিমালা প্রণীত হবার পর তা নিয়ে অনেকেই কাজ করেছেন। এই দলিল অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করা হলো, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন নিজেদের নীতিমালা দাঁড় করাতে একে কাজে লাগাতে পারবেন।
আনু মুহাম্মদ
২৬শে জুলাই ২০২৩