অনানুষ্ঠানিক খাত: দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অসমতা
এটিএম নুরুল আমিন
জীবন-জীবিকার নিরুপদ্রব নিরাপত্তাই সব ভালোর উৎস ও ভিত্তি’
–প্রাবন্ধিক আহমেদ শরীফ (শরিফ, ২০১১, পৃ. ৮১)
বাংলাদেশে ইনফরমাল সেক্টর বা অনানুষ্ঠানিক/অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আয়তন ক্রমেই বাড়ছে। এই খাতের গুরুত্বের তুলনায় এ নিয়ে গবেষণা কম। এই খাতে শ্রমবাজারের সবচাইতে বেশি সংখ্যক মানুষ যুক্ত, কিন্তু তাদের কাজ আয়সহ সব ক্ষেত্রেই রয়েছে অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা। সরকারি নীতিতেও এই বিশাল জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিয়ে কার্যকর টেকসই কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। বাংলাদেশে এ বিষয়ে গবেষণার পুরোধা ব্যক্তি তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই লেখা তৈরি করেছেন।সর্বজনকথার গত ও বর্তমান সংখ্যায় অনলাইন ডেলিভারি শ্রমিক নিয়ে লেখাগুলোও এই বিষয়ে প্রাসঙ্গিক।
১. চাকরি, কাজ বা সেবা দিয়ে আয়
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামব্যবস্থা ভেঙে পড়া, শিল্পবিপ্লব ও নগরভিত্তিক শিল্পায়ন ও বিনিময় বা বাণিজ্যিক অর্থনীতির প্রসারের ফলে জীবন-জীবিকার জন্য ‘চাকরি’ (জব বা এমপ্লয়মেন্ট) কতটা জরুরি হয়ে উঠেছে, তা বোঝানোর জন্য জন মেনার্ড কেইনস (১৮৮৩-১৯৪৬) ও অস্কার ল্যাঞ্জ-এর (১৯০৪-১৯৬৫) বক্তব্য স্মর্তব্য। কেইনসের মতে, লোক নিয়োগের কোনো প্রয়োজন না থাকলেও চাকরি দেওয়ার জন্য গাছের সবুজ পাতাকে প্রথমে কালো রং এবং পরে তা পরিষ্কার করার জন্য হলেও চাকরিপ্রার্থীদের নিয়োগ দাও। তিনি স্বল্পমেয়াদের সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন ‘ইন দ্য লং রান উই আর অল ডেড’ বা দীর্ঘমেয়াদে আমরা সবাই মৃত। অস্কার ল্যাঞ্জ উন্নয়ন/অনুন্নয়নের মাত্রাকে সংজ্ঞায়িতই করেছেন কোনো দেশের ‘মোট নিয়োগযোগ্য জনসংখ্যার’ তুলনায় ‘কতজন নিযুক্ত’ সেই অনুপাতের ভিত্তিতে (Lange, Oscar, 1967)। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা অনুন্নয়নকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেন – যেমন: সাংস্কৃতিক কারণ বা কুসংস্কার, পরাধীনতা বা পরনির্ভরশীলতা। এই ধরনের সংজ্ঞায়নে শ্রমশক্তির নিয়োগের অপরিহার্যতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয় মনে করেই ল্যাঞ্জ শ্রমশক্তির বেকারত্বকেই অনুন্নয়নের নির্ধারক মনে করেন।
শিল্পে উন্নত দেশেও বেকারত্ব কী পরিস্থিতি তৈরি করে তা ১৯২৯-৩০ সালের মহামন্দার সময় দেখা গেছে। ওই সময়ে যা ঘটেছিল তার পটভূমিতেই কেইনস-এর মূল অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও সরকারের নীতি গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ল্যাঞ্জের ব্যতিক্রমধর্মী অনুন্নয়ন তত্ত্বের গুরুত্ব বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও স্বল্প কৃষি-ভূমির দেশের জন্য কতটা অর্থবহ, তা এই দেশের শ্রমবাজার ও জীবন-জীবিকার জন্য মানুষ কি দুঃসহ বেদনা নিয়ে দেশে-বিদেশে কাজ করে তা দেখলে না বোঝার কথা নয়। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসা বা শীতের রাতে একজন রিকশাচালকের উন্মুক্ত স্থানে তার রিকশার নিচেই ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য বা নির্মাণ সাইটে কাজ করার সময় দুর্ঘটনার দৃশ্য–এই সবই জীবন-জীবিকা ও তার ‘নিরুপদ্রব-নিরাপত্তার’ অভাবকে দৃশ্যমান করে। মাহমুদ শফিক তাঁর ঢাকা নগরের বিপন্ন পরিবেশ গ্রন্থের ‘অবধারিত মৃত্যু’ অধ্যায়ে লিখেছেন, বকুল (তালাকপ্রাপ্ত একজন নারী যার রিকশাচালক স্বামী তাকে তালাক দিয়ে চলে গেছেন) বলেন:
‘আমার স্বামীর ছিল দানবের মতো দেহ। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। এখন বুঝতে পারি, রিকশা চালানো কত কষ্টের কাজ। কাজের শেষে দেহটা বিছানার সঙ্গে লেগে যেত। তার পাশে যে একজন মেয়েমানুষ শুয়ে আছে, সে তা মোটেও ভাবত না’ (শফিক, ২০০১, পৃ. ৭৭)।
বিদেশে কাজ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসা বা শীতের রাতে একজন রিকশাচালকের উন্মুক্ত স্থানে তার রিকশার নিচেই ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য বা নির্মাণ সাইটে কাজ করার সময় দুর্ঘটনার দৃশ্য–এই সবই জীবন-জীবিকা ও তার ‘নিরুপদ্রব-নিরাপত্তার’ অভাবকে দৃশ্যমান করে।
এই যে হাজার হাজার শ্রমজীবী আরব দেশে গিয়ে ডলার পাঠায়, তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনকে আমি জানি দেশে গাড়িচালক হিসেবে। গাড়িচালকের বেতন দিয়ে ঢাকায় পরিবার নিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। আরব মরুভূমির চাকরি পেলে নিজ দেশের অবস্থা থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে–এই আশায় তারা অপেক্ষা করে। কেউ কেউ পেয়েও যায়। আমার জানা তিনজনের ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগ এসেও যায়। বিবাহিতজন স্ত্রী ও সন্তানকে রেখে চলে যায়। দুই বছরের আগে আসা হয় না। অবিবাহিত দুজন দুই বছর পর এসে বিয়ে করে। এক মাস থেকে দেড়-দুই মাস থেকে চলে যায়। ফিরে যাওয়ার এক বছরের কম সময়ের মধ্যে সন্তানের জন্ম হয়। সন্তান দেখে না পিতাকে, পিতা দেখে না সন্তানকে। স্ত্রী পায় না স্বামীর সান্নিধ্য। তাতে কী? দেশের ডলার অর্জন তো বাড়ে, যা না হলে দেশের প্রয়োজনীয় আমদানিতে ও সম্পদ পাচারে প্রতিকূলতা সৃষ্টি হয়।
শুধু বাংলাদেশ কেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও চাকরি না থাকা বা হারানো একজন মানুষ ও তার পরিবারের জন্য কী দুরবস্থা সৃষ্টি করে, তা ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে, ‘যখন চাকরি চলে যায়’ (হোয়েন ওয়ার্ক ডিসএপিয়ার্স), লেখক উইলিয়াম জুলিয়াস উইলসনের (Wilson,1996) বর্ণনায় ফুটে উঠেছে। ইউটিলিটি বিল পরিশোধ না করতে পারা, অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া না দিতে পারা, যাতায়াত খরচের জন্য ক্যাশ না থাকা ইত্যাদি একেবারেই ন্যূনতম ব্যয় নির্বাহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নিজ গবেষণার পরিপ্রেক্ষিতে উইলসন মনে করেন, দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচির থেকে গুরুত্বপূর্ণ বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নীতি প্রণয়ন।
বাংলাদেশের মতো দেশে দরিদ্রদের মধ্যে পূর্ণ বেকারত্ব থাকতে পারে না। কেননা, একদিন কাজ করে আয় না করতে পারলে না খেয়ে থাকতে হতে পারে। অনানুষ্ঠানিক খাতে অনেক কাজের সৃষ্টি হয় এই বাস্তবতায়। এসব বিষয়ে যাওয়ার আগে কাজ সৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা বা অগ্রাধিকারের আরও দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। বেকারত্ব রোধ করতে ২০০৮-২০০৯ সালের মন্দা-উদ্ভূত বিপর্যয়ের সময়ে প্রেসিডেন্ট ওবামা বেসরকারি খাতের বড় বড় আর্থিক করপোরেশনকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে টিকিয়ে রাখেন। তারও আগে বিল ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ‘ইট ইজ ইকোনমি, স্টুপিড’ নির্বাচনী স্লোগান গ্রহণ করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার দুই টার্মের প্রেসিডেন্সিতে নিয়োগযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য নানা ধরনের দক্ষতা আপগ্রেডিং প্রোগ্রাম করেন। এর ফলে কর রাজস্বও বৃদ্ধি পায়, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য হাতে নেওয়া প্রোগ্রামগুলোর ব্যয় উঠিয়ে আনতে ও বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনতে সহায়তা করে।
বাংলাদেশের মতো দেশে কাজের সুযোগ আরও কত বেশি সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন, তা অস্কার ল্যাঞ্জ-এর দিকনির্দেশনা থেকে উপলব্ধি করা যায়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না এই যে চাকরি, নিযুক্তি বা কর্মসংস্থান তা কোনো কুলি-মজুর, টোকাই, রিকশাচালক বা নির্মাণ সাইটে জোগালির কাজ বা পরিবহণে বা মোটর সার্ভিস শপে অল্প বয়সী ছেলেদের (শিশুশ্রমিকও হতে পারে) হেলপার বা শিক্ষানবিশের কাজ বা চাকরি হলে চলে না। কাজ করে আয় হতে হবে এমন যা দিয়ে মৌলিক চাহিদা মেটানো যায়। নগরায়ন, শিল্পায়ন ও আধুনিকীকরণের যুগের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যে কর্মসংস্থান বা ‘এমপ্লয়মেন্ট’ তা হলো এমন কাজ, যা জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় আয়ের নিশ্চয়তা দেয় ও তার সাথে থাকে সামাজিক নিরাপত্তা, যা নিশ্চিত করে কোনো কারণে কাজ হারালে তার থেকে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা। যখন এ ধরনের কাজ বা চাকরি পাওয়া যায় না, তখন নিজেদের প্রয়োজনে ও উদ্ভাবনী শক্তির ফলে শ্রমশক্তির অনেকে নিজেরাই আয়ের জন্য কাজ সৃষ্টি করে নেয় ঠিকই, কিন্তু তা দেয় না নগর-মহানগরে থাকা-খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আয় যার ফলে স্থান নিতে হয় বস্তিতে।
আন্তর্জাতিকভাবে এসব কাজের প্রতি প্রথম দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ১৯৭২ সালে যখন আইএলও-ইউএনডিপির কেনিয়া-এমপ্লয়মেন্ট মিশন তাদের রিপোর্টে (ILO, 1972) বিশদভাবে তুলে ধরে আনুষ্ঠানিক (ফরমাল) খাতের বাইরে হাজার হাজার মানুষ নাইরোবির রাস্তাঘাটে ও বস্তি বসতিতে নানা ধরনের জিনিসপত্রের বেচাকেনা, মেরামতের কাজসহ বিভিন্ন সেবামূলক কাজে নিয়োজিত। উন্নয়ন, নগরায়ন, শিল্পায়নের উচ্চাশা সংশ্লিষ্ট ভালো বেতন, সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তাসহ যে কর্মসংস্থান তার চিন্তা যেন উবে গেল। ইউরেকা হয়ে গেল এসব স্বল্প আয়ের ও অনিশ্চিত কাজকর্ম। নাম দেওয়া হলো অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) খাত (ILO, 1972, পৃ. ৬)। ধনী দেশগুলোতেও দীর্ঘস্থায়ী, ভালো বেতন ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ কাজের সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট বা স্নাতকধারী তরুণেরা, বিশেষ করে অভিবাসীরা, তাদের যোগ্যতা বা শিক্ষা অনুসারে কাজ না পেয়ে বাধ্য হচ্ছে নানা ধরনের স্বল্পস্থায়ী, স্বল্প বেতনের ও নিরাপত্তাহীন কাজ করতে।
অনিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি ও ‘ফ্লেক্সিবল এন্টারপ্রাইজ’ পদ্ধতি উৎসাহিত করার অনিবার্য পরিণতিতে তৈরি হওয়া এ ধরনের কাজকে অনিশ্চিত বা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গাই স্ট্যান্ডিং তার ২০১৬ সালে প্রকাশিত দ্য প্রিকেরিয়াট বইতে (Standing, 2016)। এখানে উল্লেখ্য যে, ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে শিল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় তাতে অংশগ্রহণকারীদের অনেকে শিক্ষাজীবন শেষ করে কোনো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছিলেন না। ষাটের দশকে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদে শক্তিশালী হয়ে ওঠে তাদের সাথে মিল দেখা যায় গাই স্টান্ডিং যাদের সাম্প্রতিক সময়ে প্রিকেরিয়াট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তাদের। আর এর সাথে কিছুটা হলেও সাদৃশ্য দেখা যায় সাম্প্রতিক কালের ‘আমরা ৯৯%’ গ্রুপের ওয়ালস্ট্রিটের দিকে মার্চে।
ষাটের দশকে কর্মসংস্থানের অভাব শিক্ষিত যুবশক্তিকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ নতুন করে কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তা বৃদ্ধির উপায় সন্ধানে কাজ করা শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে আইএলও বিশ্ব কর্মসংস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই সময়ে একটির পর আর একটি উন্নয়ন কৌশল যেমন: কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য ‘উপযুক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবন’ গ্রহণ করা হয়। ‘মৌলিক চাহিদা’ মেটানোর জন্য কৌশল গ্রহণও কর্মসংস্থান ও তার উপায়ের সাথে যুক্ত বা সংশ্লিষ্ট। ধারণা করা হয়েছিল উৎপাদনে বা সেবা প্রদানে শ্রম নিবিড় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হলে শ্রম নিয়োগ বৃদ্ধি ও আয় বৃদ্ধি পাবে, যা ‘মৌলিক চাহিদা’ পূরণে সহায়ক হবে।\
ষাটের দশকে কর্মসংস্থানের অভাব শিক্ষিত যুবশক্তিকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ নতুন করে কর্মসংস্থানের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তা বৃদ্ধির উপায় সন্ধানে কাজ করা শুরু করে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে আইএলও বিশ্ব কর্মসংস্থান কর্মসূচি গ্রহণ করে।
এই আলোকে উল্লিখিত আইএলও-ইউএনডিপির উদ্যোগে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির উপায় সন্ধানে দেশে দেশে মিশন পাঠানো হয়। কিন্তু এসব উদ্যোগ থেকে আসা ‘অনানুষ্ঠানিক খাত’ যে কর্মসংস্থান ও মৌলিক চাহিদা মেটানোর একটি সমাধান হতে পারে তা অনেকেই গ্রহণ করতে পারেনি। কেননা এই খাতে নিয়োজিত শ্রমজীবী মানুষের কাজ থেকে স্বল্প ব্যয়ে নগরায়ন, নির্মাণ, পরিবহণ ও বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সেবা পাওয়ার সুবিধা হয় ঠিকই, কিন্তু এই সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে শ্রমজীবী মানুষের অর্জন অতি সামান্য। এই কাজে নিয়োজিত মানুষগুলোর অর্জিত আয় তাদের নিজ নিজ জীবনে সুখ-সাচ্ছন্দ্য-সুস্বাস্থ্য নিয়ে আসে না। এমনকি কোনো কোনো কাজে আয় আসে সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল কমানোর মাধ্যমে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ, আয় ও বাসস্থান হয় এমন কাজে যার বদৌলতে জলাঞ্জলি দিতে হয় সন্তান-সন্তদিদের ভবিষ্যৎ। কেননা, এসব কাজে নিয়োজিত মানুষেরা তাদের অর্জিত আয় দিয়ে না পারে এদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে, না পারে সুস্বাস্থ্যের জন্য যা দরকার তার ব্যবস্থা করতে। ইউনিসেফের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহর-নগরের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুবিধা বেশি ঠিকই, কিন্তু এই তুলনা গ্রাম ও (শহর-নগরের) বস্তি বসতির সাথে করে দেখা গেছে এখানকার অবস্থা গ্রামের থেকে খারাপ (UNICEF, 2010, p. 13)। সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনা গৃহকর্মীর মেয়ে গৃহকর্মী হওয়া, রিকশাচালকের ছেলে রিকশাচালক হওয়া। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। ভয়ের ব্যাপার হলো, অনানুষ্ঠানিক খাতের কোনো কোনো পেশা পুরনো জাত (কাস্ট) ভিত্তিক প্রথার (অর্থাৎ জাত অনুসারে পেশা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আসা) মতো না হয়ে ওঠে। এই প্রসঙ্গে অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে যেসব বিতর্ক রয়েছে দু-একটি উদাহরণ সংক্ষেপে দেওয়া হলো।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ, আয় ও বাসস্থান হয় এমন কাজে যার বদৌলতে জলাঞ্জলি দিতে হয় সন্তান-সন্তদিদের ভবিষ্যৎ। কেননা, এসব কাজে নিয়োজিত মানুষেরা তাদের অর্জিত আয় দিয়ে না পারে এদের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে, না পারে সুস্বাস্থ্যের জন্য যা দরকার তার ব্যবস্থা করতে। ইউনিসেফের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহর-নগরের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুবিধা বেশি ঠিকই, কিন্তু এই তুলনা গ্রাম ও (শহর-নগরের) বস্তি বসতির সাথে করে দেখা গেছে এখানকার অবস্থা গ্রামের থেকে খারাপ।
২. অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে বিতর্ক
অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে বিতর্ককে দুটি প্রধান ভাগে – আশাবাদী ও হতাশাবাদী – দেখা যেতে পারে (Amin, 1982)। কী যুক্তিতে একজন আশাবাদী ও কী যুক্তিতে একজন হতাশাবাদী তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাচ্ছে। আশাবাদীরা যুক্তি দেখান অনানুষ্ঠানিক খাতে স্বল্প বিনিয়োগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। পক্ষান্তরে হতাশাবাদীদের অভিমত, অনানুষ্ঠানিক খাত শ্রমিক শোষণের সুযোগ করে দেয়। তাদের যুক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতের আবির্ভাবে ও টিকিয়ে রাখাতে দুই ভাবে শ্রমিক শোষণ হয়।
প্রথমত, এই খাত থাকার ফলে আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রম মজুরি কম হয়। কেননা, অনানুষ্ঠানিক খাতের সেবা পাওয়ার ফলে আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যয় কিছুটা হলেও কম হয়। এই সুবিধার বদৌলতে আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রম নিয়োগকারীরা নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি বা বেতন কম দেয়। এই যুক্তির মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাত ‘শ্রমিক শোষণকে’ সহজতর করে মনে করেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। দ্বিতীয়ত, অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সরবরাহ অনেক বেশি ও ইলাস্টিক হওয়ায় সরবরাহ-চাহিদা ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারের নিয়মে এই খাতের শ্রম মজুরি কম হয়। আর যারা স্বনিয়োজিত হয়ে বিভিন্ন বেচাকেনা বা সেবা প্রদানের কাজ করে তাদের সংখ্যা প্রয়োজনের থেকে অনেক অনেক বেশি হওয়ায় তাদের আয় বা লাভ নিখুঁত প্রতিযোগিতামূলক বাজার বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হয়। যার অর্থ হলো, খুবই কম আয় বা লাভ।
কিন্তু এর বিপরীতে আশাবাদীরা মনে করেন, কাজ পাওয়া বা করার সুযোগের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমশক্তি নিজেদের দারিদ্র্য মোচনের সুযোগ পায়। এমনকি স্বনিয়োজিতদের মধ্য থেকে সফল স্বদেশীয় ও স্থানীয় উদ্যোক্তার আবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখেন আশাবাদীরা। তাঁরা আরও মনে করেন, আনুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তারা লভ্যাংশ বিদেশে পাচার করতে পারেন, যা অনানুষ্ঠানিক খাতের উদ্যোক্তারা পারেন না।
এসব বিষয়ে গবেষণা থেকে যা জানা যায় তা হলো, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমশক্তির অধিকাংশ তাদের আয়ের বা মজুরির মাধ্যমে কোনোক্রমে বেঁচে থাকার সুযোগ পান ঠিকই, কিন্তু তা দারিদ্র্য মোচনে, বিশেষ করে মৌলিক চাহিদা পূরণে তাদের সমর্থ করে তোলে না। খুব অল্প সংখ্যক উদ্যোক্তাই সফল হন ছোট উদ্যোক্তা থেকে নিজেদের ব্যবসা বা সেবা প্রদানকে বড় ও লাভবান করতে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনানুষ্ঠানিক খাতের অন্তর্বর্তীকালীন ভূমিকা বনাম এর থেকে বের হয়ে আসার জটিলতা নিয়েও বিতর্ক আছে (Amin, 1987)। ধারণা করা হয় যে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রার সাথে অনানুষ্ঠানিক খাতের আকারের সম্পর্ক বিপরীত অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়ন বৃদ্ধির সাথে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্স্থান কমে আসবে (Amin, 2010, p. 21)। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিশাল শ্রম যোগানের দেশসমূহে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সত্ত্বেও অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের বিশাল নির্ভরতা কমে আসার কোনো লক্ষণ এখনো নেই। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা বেশি হওয়ায় থাইল্যান্ডে অনানুষ্ঠানিক খাতের আকার ছোট হয়ে আসে। কিন্তু একমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য এটা হয়েছে তা মনে করার কারণ নেই। থাইল্যান্ডে কৃষিজমির প্রাচুর্য ও গ্রামভিত্তিক কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে অগ্রাধিকার বা গুরুত্ব দেওয়ার ফলে শহর-নগরভিত্তিক অনানুষ্ঠানিক খাতনির্ভর কর্মসংস্থানের সংখ্যা কমে আসা কিছুটা হলেও সহজ হয়েছে। কিন্তু উন্নয়নে পিছিয়ে পড়া প্রতিবেশী দেশগুলো (কম্বোডিয়া, লাওস ও মিয়ানমার) থেকে আসা দরিদ্র মানুষের আগমনে অনানুষ্ঠানিক খাতের কমে আসার ধারা কিছুটা হলেও ব্যাহত হচ্ছে। এর থেকে বোঝা যায় যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে অনানুষ্ঠানিক খাতের আকার কমে আসার সম্পর্ক সরল নয়, জটিলতা আছে। বহু শিল্পে উন্নত দেশে অনানুষ্ঠানিক খাত উঠে গেছে বা সংকুচিত হয়ে ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু দরিদ্র, বেকার ও অভিবাসী বা অবৈধ অভিবাসীদের বেঁচে থাকার আয়ের প্রয়োজনে অনানুষ্ঠানিক খাতের মতো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশের মতো বিশাল শ্রম যোগানের দেশসমূহে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সত্ত্বেও অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের বিশাল নির্ভরতা কমে আসার কোনো লক্ষণ এখনো নেই। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দ্রুত ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা বেশি হওয়ায় থাইল্যান্ডে অনানুষ্ঠানিক খাতের আকার ছোট হয়ে আসে। কিন্তু একমাত্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য এটা হয়েছে তা মনে করার কারণ নেই।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নব্য-উদারনীতির ধারাবাহিকতায় ‘ফ্লেক্সিবল এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘ফ্লেক্সিবল শ্রমবাজার’ (Eyck, 2003) পন্থা অনুসরণ করায় অনানুষ্ঠানিক খাত বৃদ্ধিতে আরেক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে–ছোট আনুষ্ঠানিক খাতকেও অনানুষ্ঠানিকীকরণ। এই ধারায় আনুষ্ঠানিক খাতের শিল্প-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় সব স্তরের নিয়োগকে করে চলেছে অনানুষ্ঠানিক খাত ধরনের। যেমন: চাকুরিকে সহজেই ছাঁটাইযোগ্য ও পেনশন-চিকিৎসার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার বিধান না রাখা বা বাতিল করা। এর বিপরীতে আশাবাদীরা মনে করেন, এ ধরনের প্রক্রিয়া কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সহায়ক হয়; আনুষ্ঠানিক খাত অনানুষ্ঠানিক খাতে সাবকন্ট্রাকটিং দেয়, যার ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতের চাহিদা বৃদ্ধি পায় ও তারা নিজেদের আনুষ্ঠানিক খাতের কাজের উপযুক্ত করার প্রয়াস নেয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নব্য-উদারনীতির ধারাবাহিকতায় ‘ফ্লেক্সিবল এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘ফ্লেক্সিবল শ্রমবাজার’ (Eyck, 2003) পন্থা অনুসরণ করায় অনানুষ্ঠানিক খাত বৃদ্ধিতে আরেক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে–ছোট আনুষ্ঠানিক খাতকেও অনানুষ্ঠানিকীকরণ। এই ধারায় আনুষ্ঠানিক খাতের শিল্প-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগকারীরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রায় সব স্তরের নিয়োগকে করে চলেছে অনানুষ্ঠানিক খাত ধরনের। যেমন: চাকুরিকে সহজেই ছাঁটাইযোগ্য ও পেনশন-চিকিৎসার মতো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার বিধান না রাখা বা বাতিল করা।
অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্রুত প্রবৃদ্ধির সাথে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের সম্পর্কের উদাহরণ দিয়ে আশাবাদীরা দেখান যে মন্দার সময় আনুষ্ঠানিক খাত থেকে ছাঁটাই হওয়া মানুষগুলো অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায় আর দ্রুত প্রবৃদ্ধির সময় আনুষ্ঠানিক খাতের সেবার চাহিদা বাড়ে। কর্মসংস্থানের জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরতাও কমে আসে, যার ফলে এই খাতে কর্মরতদের আয় বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে হতাশাবাদীরা এই যুক্তি প্রত্যাখ্যান করে দেখান যে, শিক্ষিত ও দক্ষ চাকরিজীবীদের পক্ষে হঠাৎ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজে নিজেকে উপযোগী করে নেওয়া সম্ভব হয় না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দার সময় কর্মসংস্থানের জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রান্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাড়ে বা একই কাজ করার জন্য বেশি মানুষ জড়িত বা নিযুক্ত হয় যার ফলে গড় আয় হ্রাস পায়।
৩. অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানের অনানুষ্ঠানিক খাতের আগেও অনানুষ্ঠানিক খাত ছিল বলা যায়। উদাহরণ হিসেবে প্রসান্ত রায়ের হারিয়ে যাওয়া জীবিকা বইটিতে লিপিবদ্ধ জীবিকার উদাহরণ দেওয়া যায়। তিনি পশ্চিম বাংলার কিন্নর রায়ের লুপ্ত জীবিকা বইয়ের আলোকে বাংলাদেশের ত্রিশটি হারিয়ে যাওয়া জীবিকা নিয়ে তার বইটি লেখেন। সেদিনের ‘টাইপরাইটার’ যে আর নেই তা কিছুটা বয়সী মানুষদের অবাকই করবে। ‘পুরোনো কাপড়ের বদলে বাসনকোসন’-এর কথাও (Mridha, 2023, p.10।)
যেসব কাজকে আজ আমরা অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজ হিসেবে জানি, তা প্রথমে এই নামে চিহ্নিত হয় আইএলও-ইউএনডিপির কেনিয়া রিপোর্টে, যার কথা ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা যায়, ‘অনানুষ্ঠানিক আয়ের সুযোগ’ (ইনফরমাল ইনকাম অপরচুনিটিজ) নামটি প্রথম ব্যবহার করেন কেইথ হার্ট তার ঘানার/আক্রার একটি গবেষণায় (Hart, 1971)। আইএলও চিহ্নিত অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের কাজের উদাহরণ হিসেবে রয়েছে দোকানভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসা; রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে হরেক রকমের জিনিস বিক্রি; দর্জি ও সেলাইয়ের কাজ; জুতা সেলাই ও কালি করা; বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ; গাড়ি ও টেম্পো/লেগুনার মতো যানবাহনের এবং ম্যানুয়ালি চালিত বা ননমোটরাইজড যানের (যেমন: ঠেলাগাড়ি) চালক; কাঠমিস্ত্রি; ও নির্মাণশিল্পে বিভিন্ন দক্ষতা স্তরের শ্রমিক (জোগালি থেকে রাজমিস্ত্রি); ও স্যানিটারি মিস্ত্রি, প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ান (ILO, 1972, p. 5)।
আইএলও চিহ্নিত অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের কাজের উদাহরণ হিসেবে রয়েছে দোকানভিত্তিক ক্ষুদ্র ব্যবসা; রাস্তায় দাঁড়িয়ে বা বসে হরেক রকমের জিনিস বিক্রি; দর্জি ও সেলাইয়ের কাজ; জুতা সেলাই ও কালি করা; বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কশপ; গাড়ি ও টেম্পো/লেগুনার মতো যানবাহনের এবং ম্যানুয়ালি চালিত বা ননমোটরাইজড যানের (যেমন: ঠেলাগাড়ি) চালক; কাঠমিস্ত্রি; ও নির্মাণশিল্পে বিভিন্ন দক্ষতা স্তরের শ্রমিক (জোগালি থেকে রাজমিস্ত্রি); ও স্যানিটারি মিস্ত্রি, প্লাম্বার ও ইলেকট্রিশিয়ান।
বিপ্লব দাশগুপ্ত তাঁর ১৯৭৩ সালের প্রকাশনায় কলকাতার অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজের শ্রেণীবিন্যাসে যে প্রধান তিন ধরনের কাজের উদাহরণ দেন তা হলো: এক. ‘অদক্ষ’ ম্যানুয়াল শ্রমিক যার মধ্যে রয়েছে বাবুর্চি ও গৃহকর্মী, দারোয়ান ও পিয়ন, ঝাড়ুদার ও মেথর, রিকশাচালক ও ঠেলাগাড়ি, কুলি, ধোপা-নাপিত ও মুচি, মালী ও বর্জ্য কাগজ সংগ্রাহক, বিড়ি প্রস্তুতকারী; দুই. দক্ষ ম্যানুয়াল কর্মী যার মধ্যে রয়েছে বিল্ডার, প্লাম্বার, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি; টার্নারস, গ্রাইন্ডারস, ড্রিলারস, মুল্ডারস, স্মেল্টারস, স্মিথস; গাড়িচালক, কুমার, জুয়েলার্স, ঘড়ি মেরামত, বই বাঁধাই, রেডিও মেকানিক ও ইলেকট্রিশিয়ান, দর্জি ও কারখানা শ্রমিক; তিন. হস্তশিল্পী যার মধ্যে রয়েছে খাদ্য, পানীয়, তামাক; টেক্সটাইল তৈরির পেশা; পোশাক তৈরি এবং বস্ত্রবয়ন; চামড়াজাত পণ্য; কাঠ-বেত-বাঁশ সংক্রান্ত পেশা; মুদ্রণ ও বাইন্ডিং সংক্রান্ত পেশা; মেটাল বা লোহা সংক্রান্ত পেশা; জাহাজ ও নৌকা তৈরি ইত্যাদি (Dasgupta, 1973, p. 67)।
আব্দুল্লাহ ফারুক ও মোহাম্মাদ আলির ১৯৭৪ সালে পরিচালিত বাংলাদেশের কঠোর পরিশ্রমী দরিদ্রদের (‘হার্ড ওয়ার্কিং পুওর’) একটি জরিপে যেসব কাজ প্রাধান্য পায় তার মধ্যে শহর-নগরভিত্তিক কাজগুলোর উদাহরণে আসে ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহণ, কারুশিল্প, গৃহকাজে মজুরি উপার্জনকারী; ও (অনিয়মিত বা অস্থায়ী) নগর শ্রমিক (Faruk and Ali, 1977, p.87)।
বর্তমান লেখকের ১৯৭৮-৭৯ সালের ঢাকার জরিপে সাতটি এলাকা (Amin, 1982, p.66-70) থেকে অবস্থান-নির্দিষ্ট (লোকেশন-স্পেসিফিক) যে ৪ হাজার ৪০০ অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজের তালিকা করা হয় তার মধ্যে পাওয়া যায় ২১৩ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড (Amin, 1982, p.390) যেমন: রাস্তায় দাঁড়িয়ে, বসে নানা ধরনের জিনিসপত্র বিক্রয় (সদরঘাট, গুলিস্তান, ফার্মগেট, ইন্দিরা রোডে সদরঘাট হকার মার্কেট বিভিন্ন ধরনের মেরামতের ও সেলাইয়ের কাজ, বিভিন্ন ধরনের মেটাল ওয়ার্কশপ (নানা ধরনের হ্যান্ডকার্ট ও ঠেলাগাড়ি, ইত্যাদি)। আরও নেওয়া হয়েছিল রিকশা, টেম্পো ও ঠেলাগাড়ির মতো পরিবহণ যান; ও নির্মাণ সাইট থেকে মাটি কাটা, ইটভাঙা ও জোগালির কাজ। এসব কাজের পূর্বসূরির উদাহরণ হতে পারে কামার-কুমার-মুচি-মাঝি-জেলে-মেথর-কুলি-মজুর-কৃষক-শ্রমিক যাদের কথা উঠে আসত মওলানা ভাসানীর মজলুমদের মুক্তির ডাকে।
বর্তমান লেখকের ১৯৭৮-৭৯ সালের ঢাকার জরিপে সাতটি এলাকা থেকে অবস্থান-নির্দিষ্ট (লোকেশন-স্পেসিফিক) যে ৪ হাজার ৪০০ অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজের তালিকা করা হয় তার মধ্যে পাওয়া যায় ২১৩ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
কামাল সিদ্দিকী, রওশান কাদির, সিতারা আলমগীর ও সায়েদুল হক তাদের ১৯৯০ সালে প্রকাশিত সোশ্যাল ফরমেশন ইন ঢাকা সিটি’ গ্রন্থে ঢাকার অনানুষ্ঠানিক খাতের যে পাঁচটি দরিদ্র গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেন সেগুলো হলো: ভাসমান (স্কোয়াটার), মহিলা প্রধান ভাসমান পরিবার, টোকাই, গৃহকর্মী ও রিকশাচালক। এসব পরিবারের প্রধানদের ‘স্বনিযুক্ত’ পেশার মধ্যে রয়েছে রিকশা চালনা, ক্ষুদ্র বিক্রেতা, ঠেলাগাড়ি টানা, পুরনো কাগজ সংগ্রহ, কবিরাজ। এ ছাড়া মজুরিতে কর্মসংস্থানের মধ্যে ছিল- দিনমজুর, বেসরকারি ও আধা সরকারি অফিসের কর্মচারী, গাড়িচালক, শিল্পশ্রমিক ও হোটেল বয়। এ ছাড়া বেকারের মধ্যে রয়েছে ভিক্ষুক ও বৃদ্ধ। অনানুষ্ঠানিক খাতে নারীদের কাজ নিয়ে খালেদা সালাহউদ্দিন ও ইশরাত শামিমের ১৯৯২ সালের বই থেকে দেখা যায়, নারীদের মজুরিতে কাজের মধ্যে অন্যতম গৃহকর্ম, মসলা পিষণ, ঝাড়ু দেওয়া, ইটভাঙা, পানি আনা, ক্যান্টিনে কাজ, কারখানার নিম্নস্তরের কাজ, সেলাই করা।
কামাল সিদ্দিকী, তার সাথে ছয়জন সহলেখক নিয়ে আরও বড় ধরনের কাজের ভিত্তিতে ২০১০ সালে ঢাকার সোশ্যাল ফরমেশন, ১৯৮৫-২০০৫ বইয়ে ‘অনানুষ্ঠানিক খাতের দরিদ্র’ অধ্যায়ে যে পাঁচটি কাজের চিত্র তুলে ধরেন তা হলো: রিকশাচালক, টোকাই, হকারস, গৃহকর্মী ও নারীদের মধ্যে যারা দর্জি, গৃহকর্মী, ভিক্ষা, কবিরাজি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ইটভাঙা ও আনুষ্ঠানিক খাতের কায়িক শ্রমের কাজ (Siddiqui, et al., 2010, pp. 211-227)। ‘অনানুষ্ঠানিক খাতের দরিদ্র’ পেশা বা কাজের বিপরীতে তুলনার জন্য ‘আনুষ্ঠানিক খাতের দরিদ্রদের’ পেশা হিসেবে নির্বাচন করা হয় নারী তৈরি পোশাক শ্রমিক, হাসপাতাল শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, বিক্রয়কর্মী, নিরাপত্তারক্ষী, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, পুলিশ কনস্টেবল এবং জওয়ান (Siddiqui, et, al., 2010, pp.236-273)। এখানে উল্লেখ্য, কামাল সিদ্দিকী, তার সাথে তিনজন সহলেখক নিয়ে এই কাজের বিশ বছর আগে একই ধরনের একটি গবেষণা সম্পন্ন করেন, যা ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় (Siddiqui, et, al., 1990)। এই দুটি বড় মাপের কাজের উদ্দেশ্য ছিল সময়ের ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের সাথে সামাজিক বা শ্রেণী গঠনের প্রকৃতির ধরন বিশ্লেষণ করা।
বর্তমান লেখকের (অন্যদের সাথে) ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে আইএলও-র জন্য করা তিনটি জরিপভিত্তিক গবেষণা (Amin and Shultana, 2013; Amin, et al. 2013; Amin, et al. 2015) থেকে দেখা যায় যে, সাম্প্রতিক কালে হকার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও রিকশার সাথে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে পরিবহণ, নির্মাণ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও মোটর বা গাড়ি ওয়ার্কশপে কর্মরতদের শ্রমজীবীর সংখ্যা যাদের প্রায় সবাই অনানুষ্ঠানিকভাবে নিয়োজিত। বিড়ি উৎপাদন ও জাহাজ ভাঙা কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিয়োগের অনানুষ্ঠানিকতার সাথে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনকি তৈরি পোশাক শিল্পেও ৬৮ শতাংশ শ্রমিকের নিয়োগের ধরন ও শর্তাবলি এবং কাজের পরিবেশও অনানুষ্ঠানিক খাতের ধরনের বলে অন্য একটি গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়। নির্মাণ খাতের কাজটি থেকে দুটি তথ্য এই খাতের শ্রমিকের অরক্ষিত অবস্থা জানতে সহায়ক হবে। নারী জোগালিদের মজুরি সম্বন্ধের প্রশ্নের উত্তর ছিল: ‘হাজিরা’ ১২৫ থেকে ১৫০ টাকা (Amin, et al. 2013, p.iv)।
হকার এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও রিকশার সাথে তাল মিলিয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে পরিবহণ, নির্মাণ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও মোটর বা গাড়ি ওয়ার্কশপে কর্মরতদের শ্রমজীবীর সংখ্যা যাদের প্রায় সবাই অনানুষ্ঠানিকভাবে নিয়োজিত। বিড়ি উৎপাদন ও জাহাজ ভাঙা কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের নিয়োগের অনানুষ্ঠানিকতার সাথে রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। এমনকি তৈরি পোশাক শিল্পেও ৬৮ শতাংশ শ্রমিকের নিয়োগের ধরন ও শর্তাবলি এবং কাজের পরিবেশও অনানুষ্ঠানিক খাতের ধরনের বলে অন্য একটি গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়।
ওরা মজুরি শব্দটার সাথে হয় পরিচিত নয় বা জানলেও যা প্রচলিত তা-ই বলে থাকেন। মজুরিকে হাজিরা হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে যা সুস্পষ্ট হয় তা হলো, হাজির হলেই কেবল মজুরি পাওয়া যায়। এই অবস্থাটা যদিও নারী জোগালিদের কিন্তু প্রায় সব ধরনের নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য যা প্রযোজ্য তা হলো তাদের অরক্ষিত অবস্থার মূলে রয়েছে এদের নিয়োগ ব্যবস্থা! সাবকন্ট্রাক্টিং-এর চেইনে (Amin, et al. 2013, 29) আটকে পড়া এই শ্রমিকদের একেবারে সন্নিকটে (অনেকের ক্ষেত্রে যে তাদের নিয়ে আসে) রয়েছে সর্দার, এর পরে আছে ফোরম্যান যেহেতু কাজ পর্যবেক্ষণ করে (ওভারসিয়ার), এই চেইনে পরবর্তী বড় ভূমিকা হলো সাবকন্ট্রাকটর বা উপঠিকাদারের ও ঠিকাদারের; আর ঠিকাদারদের যারা কাজ দেন তারা হলেন কন্ট্রাক্টিং পার্টি যারা হতে পারেন সরকারি কাজের ক্ষেত্রে তার বিভিন্ন বিভাগ যথা: গণপূর্ত, গৃহায়ন ও রাস্তা এবং মহাসড়ক। বেসরকারি খাতে ঠিকাদার নিয়োগে রয়েছে বিল্ডারস ও ডেভেলপারস বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো। এর থেকে ধারণা করা যায়, একজন নির্মাণ শ্রমিকের নিয়োগকর্তা কতটা পরোক্ষ ও অস্পষ্ট। এর ফলে একজন শ্রমিক তার মজুরি সংক্রান্ত বিষয়ে সমস্যা হলে বা দুর্ঘটনায় পড়লে কার কাছে যাবেন তা সুনির্দিষ্ট থাকে না।
ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে অর্থনৈতিক বিবর্তনে ও উন্নয়নের সাথে যেসব কাজ বর্তমানে প্রধান হয়ে উঠেছে তার মধ্যে রাস্তায় বসে/দাঁড়িয়ে বেচাকেনা, ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের (বাস, ট্রাক, গাড়ি, সিএনজি, ‘লেগুনা’ ও এ ধরনের যানের নতুন নতুন সংস্করণ) চালক ও কন্ডাকটর/হেলপার; নির্মাণ শ্রমিক (মাটি কাটা এবং উত্তোলন, ইটভাঙা – ইটভাঙার কাজ যা অনেকটাই এখন মেশিন দিয়ে বা যান্ত্রিকভাবে হয়), জোগালির কাজ যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীরা করে, রাজমিস্ত্রি ও রাজমিস্ত্রি হেলপার, গৃহকর্মী, টোকাই, আবর্জনা/বর্জ্য সংগ্রাহক। এত বিভিন্ন ধরনের জীবিকাকে কী নামে চিহ্নিত করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনার অন্ত নেই। এর ফলশ্রুতিতে ‘অনানুষ্ঠানিক খাতে’ নামকরণের বিকল্প যেসব নাম ব্যবহার বা প্রস্তাব করা হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম খুদে ব্যবসা-সেবা, অনানুষ্ঠানিক কাজ করে আয়, গণনায় না আসা অন্তর্বর্তী বা মধ্যবর্তী, অসংগঠিত, পরিবার-শ্রমভিত্তিক, অনিয়মিত, ক্ষুদ্র পণ্য উৎপাদন, নগর অর্থনীতির নিম্ন সার্কিট, সাময়িক ঠিকা শ্রমিক, অপরিকল্পিত কার্যক্রম, ‘পশ্চিমা’ বা উন্নত দেশে নাই এ রকম জীবিকা। এই লেখক এ রকম ২০টি নাম তার ২০১০ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে তালিকাভুক্ত করেছেন (Amin, 2019, p. 12)। এসব বিকল্প নামের প্রতিটি থেকেই এই খাতের বৈচিত্র্য ও উপাদান সম্বন্ধে একটা ধারণা হয় ও আনুষ্ঠানিক খাত সম্বন্ধে জানাটা গভীর হয়।
শিল্পে উন্নত দেশে যেসব কাজ বা চাকরি সাম্প্রতিক কালে ‘প্রিকেরিয়াট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ও যার মূল বৈশিষ্ট্য ‘অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতা’ – সে ধরনের কাজ বা চাকরি বাংলাদেশের মতো দেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। এসব কাজের আকর্ষণীয় ও অত্যাধুনিক নাম এগুলোর অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতার বাস্তবতাকে আড়াল করে। উদাহরণ হিসেবে আধুনিক ট্রাভেল ব্লগারস, ফুড ব্লগারস, উবার, পাঠাও (ডেলিভারি সার্ভিস কর্মী), ফ্রিল্যান্সার, অনলাইন ব্যবসার বিক্রেতা ইত্যাদি। এ ধরনের কাজকে ‘আধুনিক’ অনানুষ্ঠানিক খাতের উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। এসব উদাহরণ থেকে ও গত পঞ্চাশ বছরের বিভিন্ন দেশের, বিশেষ করে আইএলও পরিচালিত, গবেষণাসমূহ থেকে ধারণা করা যায় যে, অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের বিশালতা, নতুন চাকরির স্বল্পতা ও চাকরির অনিরাপত্তা এবং অস্থায়িত্ব এখন জীবন-জীবিকার বড় বাস্তবতা। কিছু কিছু পুরনো জীবিকা ও পেশা ধীরে ধীরে কমছেই না শুধু, একবারে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বা যাবে। কিছু কিছু আবার যুগ যুগ ধরে টিকে আছে যেমন: জুতা সেলাই বা কালির কাজ।
যেসব কাজ বা চাকরি সাম্প্রতিক কালে ‘প্রিকেরিয়াট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ও যার মূল বৈশিষ্ট্য ‘অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতা’ – সে ধরনের কাজ বা চাকরি বাংলাদেশের মতো দেশে ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। এসব কাজের আকর্ষণীয় ও অত্যাধুনিক নাম এগুলোর অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতার বাস্তবতাকে আড়াল করে। উদাহরণ হিসেবে আধুনিক ট্রাভেল ব্লগারস, ফুড ব্লগারস, উবার, পাঠাও (ডেলিভারি সার্ভিস কর্মী), ফ্রিল্যান্সার, অনলাইন ব্যবসার বিক্রেতা ইত্যাদি।
নতুন রূপে আসা এমন জীবিকা যার মূল বৈশিষ্ট্য অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতার, উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আজকের ‘পাঠাও’ যেন চলে সুকান্তের ‘রানারের’ থেকেও অধিক অনিরাপত্তা নিয়ে। এর সাথে আছে স্থায়িত্বহীনতা– কতদিন কী আয় নিয়ে থাকবে এই ডেলিভারি কাজ। টাইপিস্টের পরিবর্তে এসেছে বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের কাজ, কিন্তু অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতা পিছু ছাড়েনি এসব আধুনিক অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজেও; বরং মাত্রা বেড়েছে এই অর্থে যে পুরনো কাজগুলোতে অনিরাপত্তা ও স্থায়িত্বহীনতা এতটা প্রকট ছিল না। অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির অবারিত দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে ‘ফ্লেক্সিবল এন্টারপ্রাইজ ও ফ্লেক্সিবল শ্রম বাজারের’ নামে। এর সাথে নতুন বাস্তবতা শ্রমজীবী বা কর্মজীবী মানুষের নিজস্ব সংগঠনের অনুপস্থিতি। ‘উন্নয়ন অংশীদার’দের চাপে কোথাও কোথাও ট্রেড ইউনিয়নের অনুমতি দেওয়া হলেও তা বেশ সীমিত আকারের, তার থেকেও খারাপ দিক ট্রেড ইউনিয়ন যখন মালিকপক্ষই তৈরি বা পরিচালিত করে। অথচ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণী সৃষ্টি হওয়ার সময় থেকে সাধারণ জ্ঞান এই যে ‘ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া শ্রমিক শ্রেণীর কিছুই পাওয়ার নেই (‘ওয়ার্কার্স হ্যাভ নাথিং উইদাউট এ ট্রেড ইউনিয়ন’)।
অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে মুনাফা বৃদ্ধির অবারিত দ্বার খুলে দেওয়া হয়েছে ‘ফ্লেক্সিবল এন্টারপ্রাইজ ও ফ্লেক্সিবল শ্রম বাজারের’ নামে। এর সাথে নতুন বাস্তবতা শ্রমজীবী বা কর্মজীবী মানুষের নিজস্ব সংগঠনের অনুপস্থিতি।
৪. অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশালতা
গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শ্রমশক্তির পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষকে কাজ ও আয়ের জন্য খুঁজে নিতে বা সৃষ্টি করতে হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতের অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন, বিপজ্জনক কাজকর্ম বা ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য। এই বিশালতার মূল কারণ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেকার থাকা সম্ভব নয়। ধারণা করা হয়, একজন দরিদ্র মানুষ তিন দিনের বেশি বেকার থাকতে পারে না। তাই কাজ না পেলে তাদের কাজ সৃষ্টি করতে হয়। এর থেকেই দেখা যায় কুলি, টোকাই, হকার বা রিকশা ও টেম্পোচালকদের মতো কাজ বা পেশা। ধোলাইখালের মেটাল ওয়ার্কশপে বা গাড়ি মেরামতের ওয়ার্কশপে কিশোরদের অ্যাপ্রেনটিস বা শিক্ষানবিশের যে দীর্ঘ সময়ের কাজ তা-ও করতে হয় পিতা-মাতার দারিদ্র্যের জন্যই। জাহাজভাঙা শিল্পের বিপজ্জনক পরিবেশের কাজও দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কারণেই। অনেক পুরনো বিপজ্জনক বিড়িশিল্পে শিশু/কিশোর শ্রমিক নিয়োগ চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নগরায়নের সাথে অবকাঠামো ও ইমারত নির্মাণে, পরিবহণে সেবা প্রদানে, হোটেল-রেস্টুরেন্ট খাওয়া প্রস্তুতে ও পরিবেশনে, ও নানারকম ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজন হয় অনেক শ্রমিক ও বিভিন্ন ধরনের কর্মচারী। এসব কাজে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সব নিয়োগই অস্থায়ী বা অনানুষ্ঠানিক খাত পর্যায়ের। এডিবি-বিবিএসের ২০১২ সালে প্রকাশিত অনানুষ্ঠানিক খাত ও অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পরিবহণ খাতের ৩.৯৪ মিলিয়ন কর্মরত শ্রমশক্তির ৩.৬৭ মিলিয়নের (৯৩.২৩ শতাংশ) কাজ বা নিয়োগই অনানুষ্ঠানিক ধরনের। একই অবস্থা নির্মাণ খাতে ২.৬১ মিলিয়নের মধ্যে ২.৪৪ মিলিয়নের (৯৩.৬ শতাংশ) কাজই অনানুষ্ঠানিক ধরনের। হোটেল-রেস্টুরেন্টে শ্রমিক-কর্মচারীরও ৯০ শতাংশের নিয়োগও একই ধরনের (ADB-BBS, 2012, p.16)। যদিও এরকম উপখাত বা সাবসেক্টর অনুযায়ী পরিসংখ্যান পরবর্তী শ্রমশক্তি জরিপে (এলএফএস) নেই, অনানুষ্ঠানিক খাতের সামগ্রিক চিত্র এখনো বিশাল।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে শ্রমশক্তির পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষকে কাজ ও আয়ের জন্য খুঁজে নিতে বা সৃষ্টি করতে হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতের অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন, বিপজ্জনক কাজকর্ম বা ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য। এই বিশালতার মূল কারণ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, শ্রমশক্তি জরিপ (এলএফএস)-এ প্রাপ্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে ২০১০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কার্যরত শ্রমশক্তির যে তথ্য দিয়ে আসছে তা থেকে দেখা যায়, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৫-৮৭ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। শ্রমশক্তি জরিপ, ২০১৬-১৭, অনুসারে দেশের মোট কর্মরত শ্রমশক্তির ৬০.৮ মিলিয়নের মধ্যে ৫১.৭ মিলিয়নই কর্মরত অনানুষ্ঠানিক খাতে (৮৫.১ শতাংশ)। এই বিশালতার ধারণা পেতে দেখা প্রয়োজন কর্মরত শ্রমশক্তির মোট সংখ্যা। শ্রমশক্তির এই জরিপ অনুসারে ৬ কোটি ৮ লাখ (৬০.৮ মিলিয়ন) কর্মরত জনসংখ্যার ৫ কোটি ১৭ লাখ (৫১.৭ মিলিয়ন) ব্যক্তিই কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে (BBS, 2018b, p.124)। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ সাল প্রকাশনার পাঁচ বছর পর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ (প্রভিশনাল) সম্প্রতি প্রকাশিত (মার্চ ২০২৩) হয়েছে (BBS, 2023)। কিন্তু এই রিপোর্টে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমশক্তির কোনো উল্লেখ নেই।
পরিবহণ খাতের ৩.৯৪ মিলিয়ন কর্মরত শ্রমশক্তির ৩.৬৭ মিলিয়নের (৯৩.২৩ শতাংশ) কাজ বা নিয়োগই অনানুষ্ঠানিক ধরনের। একই অবস্থা নির্মাণ খাতে ২.৬১ মিলিয়নের মধ্যে ২.৪৪ মিলিয়নের (৯৩.৬ শতাংশ) কাজই অনানুষ্ঠানিক ধরনের। হোটেল-রেস্টুরেন্টে শ্রমিক-কর্মচারীরও ৯০ শতাংশের নিয়োগও একই ধরনের।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, এই পরিসংখ্যান জাতীয় পর্যায়ের অনানুষ্ঠানিক খাতের হওয়ায় গ্রামভিত্তিক কৃষি খাতের শ্রমশক্তিকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাত সম্পর্কীয় উদ্বেগ প্রথম থেকে সীমাবদ্ধ হয়ে এসেছে অ-কৃষি বা নগর-শহরকেন্দ্রিক অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে। এর কারণ গ্রামীণ কৃষি খাতে আধুনিক নগরভিত্তিক শিল্প বা ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো আনুষ্ঠানিক খাত নেই বলে শহর-নগরের বাইরে অর্থাৎ গ্রামীণ কৃষি খাতের জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের বিষয় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নগরায়নের মধ্য দিয়ে শহর-নগরের সাথে গ্রামের পার্থক্য হ্রাস পাচ্ছে বিধায় অনানুষ্ঠানিক খাতের বিষয়টি ধীরে ধীরে শুধু শহর-নগরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা অনেকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেন না। বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে শহর-নগর ও গ্রাম নির্বিশেষে অনানুষ্ঠানিক খাতের পরিসংখ্যানের সাথে কেবল শহর-নগরকেন্দ্রিক (আরবান) অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের পরিসংখ্যানও দেওয়া হয়ে আসছে।
শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৬-১৭) অনুসারে ‘আরবান’ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের আকারও বিশাল, যা মোট কর্মরত শহুরে (আরবান) শ্রমশক্তির ৭৭.৩ শতাংশ (BBS, 2018a, p.62) যার অর্থ গ্রামভিত্তিক কৃষি-অকৃষি খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তি বাদ দিয়ে কেবল নগর অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের মোট সংখ্যা ১৩.১ মিলিয়ন। পক্ষান্তরে আনুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত সংখ্যা মাত্র ৩.৮ মিলিয়ন। গ্রামভিত্তিক কৃষি-অকৃষি খাতে আনুষ্ঠানিক খাতের শ্রমশক্তি খুবই কম। প্রায় ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে মাত্র ৩.৮ মিলিয়নের আনুষ্ঠানিক খাত নিয়ে আমাদের যত অর্থনৈতিক দৌড়-ছুট ও নীতিনির্ধারণ। এখানে আরও উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ জরিপ ২০০৩ ও ২০১৩ থেকে দেখা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্রামেও ক্ষুদ্র ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে (BBS, 2015; BBS, 2007)। মোবাইল ফোনের জন্য নানা ধরনের সেবার চাহিদাজনিত পেশা এই বৃদ্ধির একটি কারণ।
জীবন-জীবিকার জন্য অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীলতা, বিশেষ করে আয়ের অনিশ্চয়তা ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। করোনার বিপর্যয়ের সময় সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজ ও সেবার চাহিদাও হ্রাস পায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গ্রামে ফিরে গিয়ে কৃষিকাজে যোগ দেওয়ার চেষ্টা হয় (Nayam, 2021)। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুরবস্থা, টাকার মূল্যহ্রাস ও ব্যাংকিং সেক্টর সংক্রান্ত, আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বড় বড় প্রকল্পের ব্যয়ের ঋণের অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় দেওয়ার সময় শুরু হলে। এ রকম অবস্থায়ই ১৯৮৭ সাল থেকে চলে আসা থাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রায় দশ বছরের বুম বাস্ট হয়েছিল ১৯৯৬-৯৭ সালে। জর্জ সরোসরা ঠিকই হিসাব রাখতেন ঋণের পরিমাণের, যা পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে অর্থনৈতিক মন্দার সাথে আসে থাইল্যান্ডের মুদ্রা বাথের পতন। বুমের শুরুতে যে ডলার কেনা যেত পঁচিশ বাথে, তা হয়ে গেল ৫৫ বাথে এক ডলার। এই বিষয় উল্লেখের কারণ, এক সময়ের ভলভো ও মার্সিডিজ-বেঞ্জ মালিকদের অনানুষ্ঠানিক খাতে স্যান্ডউইচ বিক্রি করতে দেখা গিয়েছিল ওই সময়। অর্থনৈতিক মন্দা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সাথে অনানুষ্ঠানিক খাতের সম্পর্ক নিয়ে এই ধরনই দেখা যায় ইন্দোনেশিয়ার একটি গবেষণায় (Amin and Sudarsono, 1993)।
আশা করা হয়েছিল, করোনা ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমশক্তির পরিবর্তন সম্বন্ধে একটি ভালো ধারণা, শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রকাশনার, পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ (প্রভিশনাল), সম্প্রতি প্রকাশিত (মার্চ ২০২৩), থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই রিপোর্টে (BBS, 2023) অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমশক্তির কোনো উল্লেখই নেই।
অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশালতার কারণ বিশ্লেষণে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব যতটা দেখা যায় ততটা দেখা যায় না আয়ের ও সম্পদের অসমতার বিষয়। কিন্তু অসমতা যে একটি মৌলিক কারণ তা ধারণা ও ব্যাখ্যা করা যায় এই বিষয়ে একটি ছোট ঘটনার মাধ্যমে। আমি একবার এক তরুণ শিক্ষিত ছেলেকে চাকরির জন্য আমার এক ডাক্তার মামার নিকট নিয়ে যাই। তিনি আমাকে ও ওই ছেলেটিকে বলে উঠলেন: ‘ঢাকা শহরে টাকা উড়ে, যে যেখান দিয়ে পারে ধরে!’ এই যে অসংখ্য মানুষ ঢাকার মতো মহানগরে এসে কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা দেখছে এখানে নাগরিকদের হাতে টাকা আছে। রিকশা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে বিশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ টাকা দিতে একজন নাগরিকের পক্ষে–সে ছাত্র-ছাত্রী হোক বা অফিস কর্মচারী হোক–খুব অসুবিধা হয় না। কিন্তু একজন রিকশাচালকের জন্য এ রকম একটি ট্রিপ দিয়ে যে নগদ রোজগার তা কিছুটা স্বস্তি আনে। এই যে ঘরে ঘরে গৃহকর্মী ও অনেক নাগরিকের গাড়ির চালকের কাজ ও আয় তা-ও তো নগরবাসীর মধ্যে ভালো ও নিয়মিত আয়ের নাগরিক আছে বলেই তো। এর পরে আছে সম্পদশালী ও উপার্জনকারীদের বিভিন্ন সেবা ও কাজের জন্য ব্যয়ের সক্ষমতা। এ ধরনের হাজারো উদাহরণ পাওয়া যাবে, যা ইঙ্গিত করে প্রাচুর্য আছে বলেই তা থেকে কিছু পাওয়ার জন্য সেবা প্রদানে উদগ্রীব মানুষের ভিড়। এসব বিবেচনায় একজন গবেষকের (হ্যানরি রেম্পেল) অভিমত, অনানুষ্ঠানিক খাতের মাধ্যমে শহরে-নগরে পুঞ্জীভূত আয় ও সম্পদের বিতরণ হয় (Rempel,1974; and Rempel and Lobdell, 1977)। বলা বাহুল্য, এই অভিমত অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে আশাবাদের কথা। কিন্তু এই আশাবাদের ভিত্তি তো অসমতা। ওই যে প্রিকেরিয়াটদের উদ্ভব তার কারণও আয় ও সম্পদের পুঞ্জীভবন। ল্যাটিন আমেরিকায় ‘মারজিনালস’ বা বেআইনি ‘ওকুপায়ারস’-বাস্তবতাও (Soto, 1989) শহরে-নগরে পুঞ্জীভূত আয় ও সম্পদের কারণেই।
আশা করা হয়েছিল, করোনা ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমশক্তির পরিবর্তন সম্বন্ধে একটি ভালো ধারণা, শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ প্রকাশনার, পাঁচ বছর পরে প্রকাশিত ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ (প্রভিশনাল), সম্প্রতি প্রকাশিত (মার্চ ২০২৩), থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই রিপোর্টে (BBS, 2023) অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমশক্তির কোনো উল্লেখই নেই।
৫. অনানুষ্ঠানিক খাতের জীবন-জীবিকার সমস্যা ও কিছু করণীয় বিষয়
‘হকার নিয়ে ইঁদুর-বেড়াল খেলা’ ধরনের পত্রিকার শিরোনামে খবরের সারাংশ হলো পুলিশ বা মোবাইল কোর্ট আসছে শুনেই রাস্তায় বসে দোকানদারি করা হকারদের পাততাড়ি গুটিয়ে সরে পড়া আর এই উপদ্রব শেষ হলেই আবার ফিরে আসা, যা চলে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। এটা ঘটে চলেছে এলাকার মাস্তানদের ও পুলিশকে নিয়মিত একটা চাঁদা দেওয়ার পরও। রাষ্ট্রের বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের চলতি ধারায় বেকারত্ব নিরোধ হয় না বলেই জীবন-জীবিকার জন্য শ্রমশক্তির বিশাল অংশ গ্রামে ও নগরে, বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো মহানগরে, নিজেদের উদ্ভাবনী দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আয়ের একটা উপায় বের করে। কিন্তু এ ধরনের কাজের আয় দিয়ে যে বাঁচা তা যে আয়ুষ্কালই কমিয়ে দেয় তা-ই নয়, তা নিজ সন্তানদের জন্য আনে অন্ধকার ভবিষ্যৎ।
এসব কারণেই অনানুষ্ঠানিক খাত যেনতেন প্রকারে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য ঢাকার উপায় হয়ে আছে মাত্র। এই কাজ বা তার থেকে আয় অনেকের জন্যই যার যার নিজের জীবনের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে পরিণতি নিয়ে আসে তা বইপুস্তক ও গবেষণা প্রকাশের রিপোর্টে থাকলেও, ও পথে চলা মানুষের দৃষ্টিতে পড়লেও, এর পরিবর্তনের জন্য যা করা দরকার ও যারা করতে পারেন তাদের এগিয়ে আসার খবর বিরল। বেকারত্ব ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষগুলোর জন্য যা যা করা সম্ভব তা করা মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির বিবেচনায় জরুরি।
প্রথমেই বেকারত্বের বিষয়। শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের, মধ্যে বেকারত্ব দেখে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারছে না। এ ধরনের অভিমত শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনকে খাটো করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফা অর্জনে সহায়তা বা পারদর্শী হওয়াই শিক্ষার মৌলিক বা একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষার মূল বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও কাজ হলো মানবিক গুণে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রকৌশলে, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-পরিবেশ-বিশ্বায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানভান্ডারে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এই পরিচিতি সাধারণ জ্ঞানের মতো যা আজকের দুনিয়ার সব নাগরিকের জন্য প্রয়োজন।
বেকারত্ব দেখে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজের জন্য যথোপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারছে না। এ ধরনের অভিমত শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য বা প্রয়োজনকে খাটো করে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফা অর্জনে সহায়তা বা পারদর্শী হওয়াই শিক্ষার মৌলিক বা একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় মানের শিক্ষার মূল বা প্রাথমিক উদ্দেশ্য ও কাজ হলো মানবিক গুণে, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রকৌশলে, সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-পরিবেশ-বিশ্বায়ন সম্পর্কিত জ্ঞানভান্ডারে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
শিক্ষার পরবর্তী ধাপ হলো পেশাগত শিক্ষা, যার জন্য রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, ব্যবসা ব্যবস্থাপনা শিক্ষা ও তার সাথে সম্পর্কিত পেশাদারি অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যবস্থা। শিক্ষকতার জন্য রয়েছে টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত যে ভাঙাগড়া বা পরিবর্তন হয় তার সাথে তাল মিলিয়ে দেশ-বিদেশে উৎপাদন-ক্রয়-বিক্রয়-আমদানি-রপ্তানি ও এসব করার জন্য যে নতুন নতুন কারিগরি কৌশল ব্যবহার করতে হয় তার সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষাকে সামঞ্জস্য বা বিন্যস্ত করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজও নয়, সম্ভবও নয়, বোধহয় কাম্যও নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা শেষে নিয়োজিত কর্মচারী বা জনশক্তিকে নিজ নিজ কর্মস্থলে পরিবর্তিত অবস্থার সাথে নতুনভাবে প্রস্তুত করার জন্য কর্মকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণই সর্বোৎকৃষ্ট, যথোপযুক্ত ও কার্যকর পন্থা। এই ব্যবস্থা যে প্রচলিত নেই তা-ও নয়। প্রয়োজন এই কাজে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ ও প্রশিক্ষণের প্রোগ্রাম ও প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি।
শিক্ষিত ও মোটামুটি সচ্ছল বেকারদের থেকে দরিদ্রদের বেকারত্ব গুণগতভাবে ও পরিমাণগতভাবে ভিন্ন। ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে একজন দরিদ্রের পক্ষে তিন দিনের বেশি বেকার থাকা সম্ভব নয়। তাই আয়ের জন্য তাদের কোনো-না-কোনো কাজ বের বা সৃষ্টি করতে হয়। আরও বড় বাস্তবতা, এই অবস্থাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বিশাল সংখ্যক মানুষের জন্য এবং তা হয়ে উঠেছে দীর্ঘস্থায়ী। এই পরিপ্রেক্ষিতেই হয়তো আইএলও অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণের (ফরমালাইজেশন) পরামর্শ দিয়ে থাকে (Amin and Shultana 2013); (Amin, et al. 2013)। কিন্তু বাস্তবতা যেখানে আনুষ্ঠানিক খাতের উৎপাদন বা ব্যবসা-বাণিজ্যের অনানুষ্ঠানিকীকরণ (আউটওয়ার্ক বা সাবকনট্রাকটিং-এর মতো পদ্ধতির মাধ্যমে) চলছে সেখানে অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণ খুব একটা বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নয়।
কাজেই প্রথমে যা করা দরকার তা হলো, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য আনুষ্ঠানিক খাতের যথাযথ ভূমিকা নিশ্চিত করা। এর জন্য যা যা করা দরকার তার কিছু উদাহরণ: এক. আনুষ্ঠানিক খাতের (সরকারি ও বেসরকারি উভয়ের ক্ষেত্রে) নিয়োগ বা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান ও তা বাস্তবায়ন করার জন্য যা যা করা দরকার তা করা; দুই. আনুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগে ও নিয়োজিত শ্রমশক্তির বেনিফিট প্যাকেজ শ্রম আইনের বেনিফিট নিয়মাধীন হওয়া নিশ্চিত করা; তিন. আউটওয়ার্ক বা সাবকনট্রাকটিং পদ্ধতি অবলম্বন করে আনুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগ এবং উৎপাদন ব্যবস্থা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি অনুশীলন করাকে বন্ধ বা নিরুৎসাহিত করা; তিন. আনুষ্ঠানিক খাতের নিয়োগে কর্মচারী ও শ্রমিক বিভাজনের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাত প্রসারের প্রবণতাকে নিরুৎসাহিত করা।
যেহেতু ইতোমধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভর করে শ্রমশক্তির একটি বিশাল অংশ জীবিকা নির্বাহ করছে, অতএব যেকাজগুলো জরুরী ভিত্তিতে করা দরকার তা হলো: এক. অনানুষ্ঠানিক খাতের সব কাজকর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির জন্য আইডি কার্ড প্রদান; দুই. অনানুষ্ঠানিক খাতের কাজকর্মে নিয়োজিত শ্রমশক্তির সামাজিক নিরাপত্তার জন্য, দুর্ঘটনা-স্বাস্থ্য-সন্তানদের শিক্ষার জন্য তহবিল সৃষ্টি। এখানে উল্লেখ্য যে, থাইল্যান্ডে আনুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিকদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতকে সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখা যায়। এর কারণ হতে পারে তারা জানেন যে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রম-সেবা-ব্যবসা-বাণিজ্য থাকার ফলে তা তাদের কাজকর্মে, ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারে নানারকম সুবিধা যা ব্যয় হ্রাস এবং মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
প্রস্তাবিত পদক্ষেপের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতকে আনুষ্ঠানিকীকরণের আইএলও-র পরামর্শ কার্যকর করার পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হতে পারে ও যার ফলে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক খাতের দ্বৈততা বা ব্যবধান কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। সবচেয়ে জরুরি কাজ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির বাসস্থান ও নাগরিক সেবা। এই বিষয়ে করণীয় কাজগুলো হলো: এক. অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নাগরিকদের বর্তমান বাসস্থানসমূহে পানি, টয়লেট, ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ও বর্জ্য সংগ্রহ সেবা নিশ্চিতকরণ। উল্লেখ্য যে, বিনা বা স্বল্পমূল্যে দরিদ্রদের সেবা প্রদান করতে গেলে তারা কার্যত সেবা পায় না বা বেআইনি পন্থায় বেশি দামে কিনতে বাধ্য হয়। যা করা দরকার তা হলো আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা। আয় বাড়লে এই মৌলিক প্রয়োজনগুলোর জন্য ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। দুই. বস্তির বাসস্থানের পরিবর্তে কর্মস্থলের সন্নিকটে ভাড়া বাসা নির্মাণের ব্যবস্থা গ্রহণ। তিন. কর্মস্থলের আশপাশে নারী ও পুরুষদের জন্য পানি ও টয়লেট সুবিধার ব্যবস্থা। আট-দশ (কারো কারো জন্য বারো) ঘণ্টা বাসস্থানের বাইরে কাজ করা এই মানুষগুলোর পানি ও টয়লেটের প্রয়োজন কীভাবে মেটানো হয়, তা নগর কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখে না বলেই মনে হয়। চার. এই খাতের কর্মজীবীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে দারিদ্র্য ও অনানুষ্ঠানিক খাতের পেশা হস্তান্তর (রিকশাচালকের ছেলে রিকশাচালক, মুচির ছেলে মুচি, গৃহকর্মীর মেয়ে গৃহকর্মী, বর্জ সংগ্রাহকের ছেলে বর্জ্য সংগ্রাহক) প্রক্রিয়া বন্ধ করা জরুরি। পাঁচ. এই খাতের যে কোনো কাজে পনেরো বছরের কম বয়সী ছেলেদের শিক্ষা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে শিশুশ্রম বন্ধ করা জরুরি।
কর্মস্থলের আশপাশে নারী ও পুরুষদের জন্য পানি ও টয়লেট সুবিধার ব্যবস্থা। আট-দশ (কারো কারো জন্য বারো) ঘণ্টা বাসস্থানের বাইরে কাজ করা এই মানুষগুলোর পানি ও টয়লেটের প্রয়োজন কীভাবে মেটানো হয়, তা নগর কর্তৃপক্ষ দেখেও দেখে না বলেই মনে হয়।
বিস্ময়ের ব্যাপার, বেসরকারি এতিমখানা বা মাদ্রাসাগুলো ছোট ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব নিতে পারে, কিন্তু পারে না সরকার বা নগর কর্তৃপক্ষ। এই কাজগুলো কার্যকর করা সম্ভব স্থানীয়ভাবে। অতএব ওয়ার্ড কমিশনারদের এ ধরনের দায়িত্ব দিতে ও নিতে হবে। খুঁটিয়ে দেখলে উপলব্ধি করার কথা যে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবস্থাপনা ওয়ার্ড পর্যায়ে হওয়া প্রয়োজন এবং এটা করতে হলে ওয়ার্ডকে নগর পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও অর্থায়নে সরাসরি যুক্ত হতে ও করতে হবে। আর একটি কাজ সব কাজের অনেকটা পূর্বশর্ত যা হলো অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা জীবিকানির্বাহী শ্রমজীবীদের নিজেদের সংগঠিত করা। বিভিন্ন কাজ বা পেশা অনুসারে এই সংগঠন হতে পারে। প্রথম কাজ এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরি করা। এই কাজে আইএলও-র দায়িত্ব রয়েছে। এলাকাভিত্তিক তালিকা করার জন্য স্কুল-কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের সহায়তা দিতে পারে আইএলও। যুক্ত করতে হবে নগর কর্তৃপক্ষ, ওয়ার্ড কমিশনার ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের অভিজ্ঞতা।
অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত নারী শ্রমজীবীদের প্রধান পেশাগুলোর কিছু তথ্য ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। পেশার ওই নামগুলো থেকেই ধারণা করা যায় এই খাতেও নারীরা নিম্নস্তরের কাজগুলোতে কর্মরত। এই বাস্তবতা যে কত ব্যাপক তা এই লেখকের (সহলেখকের সাথে) ২০১৩ সালের একটি কাজে পরিলক্ষিত হয় (Amin and Sultana 2013, p.8)। শ্রমশক্তির নয়টি সূচক বা মানদণ্ড দিয়ে তুলনায় প্রতিটিতে নারীদের অবস্থান পুরুষদের থেকে প্রতিকূলে। এই সূচকগুলো হলো: বেকারত্ব, আংশিক বেকারত্ব, শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ, নগর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ, দারিদ্র্য, অবৈতনিক পারিবারিক শ্রম, আনুষ্ঠানিক সেক্টরের চাকরি, সেবাশ্রম। নারীর কাজ এবং তা যদি হয় শিশুসন্তান নিয়ে ফুটপাতে বা নির্মাণ সাইটে কাজ, তবে তা শিশুর ও মায়ের স্বাস্থ্য বা সুস্থতার জন্য কী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে তা দেখে বা জেনেও আমরা বিচলিত হই না। সম্প্রতি শীতের এক সন্ধ্যায় দেখা ফুটপাতের দৃশ্য: ফুটপাতে এক শিশু একটি প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে খাবার খুঁজছে; ওই শিশুর মায়ের কোলে আরেকটি শিশু আর পাশেই একজন পুরুষ মানুষ–নিশ্চয়ই পিতা। তাদের রাতের থাকার স্থান কোথায়, তা কে জানতে চায়? অনানুষ্ঠানিক খাতে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের এই ধরনের বাস্তবতা সামনে এলে কোনো সমাধানের চিন্তা উবে যায়! তবুও ধারণা করি উপরে শিশুশ্রম নিয়ে যে দিকনির্দেশনা করা হয়েছে, সে রকম কিছু করা প্রয়োজন। বড় প্রশ্ন কে করবে? এই লেখায় কিছু ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
নারীর কাজ এবং তা যদি হয় শিশুসন্তান নিয়ে ফুটপাতে বা নির্মাণ সাইটে কাজ, তবে তা শিশুর ও মায়ের স্বাস্থ্য বা সুস্থতার জন্য কী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে তা দেখে বা জেনেও আমরা বিচলিত হই না। সম্প্রতি শীতের এক সন্ধ্যায় দেখা ফুটপাতের দৃশ্য: ফুটপাতে এক শিশু একটি প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে খাবার খুঁজছে; ওই শিশুর মায়ের কোলে আরেকটি শিশু আর পাশেই একজন পুরুষ মানুষ–নিশ্চয়ই পিতা। তাদের রাতের থাকার স্থান কোথায়, তা কে জানতে চায়?
আজকের ইন্দোনেশিয়ান প্রেসিডেন্ট জোকো ওয়িডোডো প্রথমে ছিলেন একটি ছোট শহরের মেয়র। তার অন্যান্য কাজের মধ্যে সবচেয়ে বড় হয়ে দৃশ্যমান হলো অনানুষ্ঠানিক খাত নিয়ে কাজ। অনেকেই সাধুবাদ দিলেন। কিন্তু অনেকে মনে করলেন ছোট শহর! করুক না জাকার্তায়। হলেন জাকার্তার মেয়র/গভর্নর। জাকার্তায়ও সফল। নগর পিতার সফলতার পটভূমিতে এলেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ইন্দোনেশিয়ানরা তাদের ভোটের অধিকারকে কাজে লাগিয়ে পুরস্কৃত করলেন জোকো ওয়িডোডো-কে।
আমাদের দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সরকারি সহায়তা আনুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই-যে কয়েক কোটি মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে ক্ষুদ্র ব্যবসা, মেরামত, নির্মাণ, পরিবহণ ও বিভিন্ন ধরনের জিনিস তৈরিতে (মেটাল প্রডাক্ট, আসবাব) উদ্যোক্তা, শ্রমিক ও শিক্ষানবিশ (অ্যাপ্রেনটিস) হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে, তা সম্পূর্ণভাবে সরকারি সহায়তার বাইরে। এই নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। সহায়তা প্রয়োজন পুঁজি বিকাশে, দক্ষতা বৃদ্ধিতে, মার্কেটিংয়ে ও বাসস্থানের জন্য। এর কোনোটিই বিনা মূল্যে দেওয়ার বিষয় নয়। যা দরকার তা হলো একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা।
এটিএম নুরুল আমিন: ইমেরিটাস প্রফেসর, এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এআইটি), ব্যাংকক। প্রাক্তন শিক্ষক- নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। ইমেইল: aminatmn@gmail.com
তথ্যসূত্র
ADB-BBS (2012), The Informal Sector and Informal Employment in Bangladesh, ADB Country Report, Dhaka, Asian Development of Bank.
Amin, ATMN (1982), An Analysis of Labour Force and Industrial Organization of the Informal Sector in Dhaka, PhD thesis, Department of Economics, University of Manitoba.
Amin, ATMN (1987), “The Role of the Informal Sector in Economic Development: Some Evidence from Bangladesh”, International Labour Review, Vol.126, No 5, pp.611-623.
Amin, ATMN (2010), The Informal Sector in Asia: Public Policy in Asia: Public Policy and Actions toward Decent Work, Saarbrucken, Germany, VDM Verlag.
Amin, ATMN and Sudarsono (1993), The Urban Informal Sector in Indonesia: Through the Economic Recession and Recovery, a study prepared for ILO, World Employment Program, New Delhi, Asian Regional Team for Employment Promotion.
Amin, ATMN and Shultana, Shamima (2013), The Informal Economy of Bangladesh: An Exploratory Study to Find Way towards Formalization (as part of Way Out of Informality: Facilitating Formalization of Informal Economy in South Asia), ILO, Dhaka.
Amin, ATMN; Bhuiyan, MSR; Faruq, Omar; and Shultana, Shamima (2013), Informal Employment Practices in Bangladesh’s Construction Sector and Opportunities for Formalization , ILO, Dhaka.
Amin, ATMN; Hossen, A; Islam, M; Chowdhury, Arthee; Chakma, Prima; Alam, MT (2015), Working Conditions of Indigenous and Tribal Workers in Bangladesh Urban Economy: A Focus on Garments and Beauty Parlour: A Working Paper prepared for ILO, Dhaka.
BBS (2015), Economic Census 2013, Dhaka, Bangladesh Bureau of Statistics.
BBS (2007), Economic Census 2001 & 2003, Dhaka, Bangladesh Bureau of Statistics.
BBS (2018a), Labour Force Survey, Bangladesh 2016-17, Dhaka, Bangladesh Bureau of Statistics.
BBS (2018b), Labour Statistics in Bangladesh – An Empirical Analysis, Dhaka, Bangladesh Bureau of Statistics.
BBS (2023), Quarterly Labour Force Survey 2022 Bangladesh Provisional Report, Dhaka, Bangladesh Bureau of Statistics.
Dasgupta, Biplab (1973), “The Informal Sector and Marginal Groups”, Bulletin, Institute of Development Studies, Vol 5, no. 2/3, October, pp. 2-30.
Eyck, Van (2003), Flexibilizing Employment: An Overview, Geneva, ILO.
Hart, K. (1971), “Informal Income Opportunities and Urban Employment in Ghana”, Journal of Modern African Studies, Vol 11, No.1, pp. 61-89.
ILO (1972), Employment Incomes, and Equality: A Strategy for Increasing Productive Employment in Kenya, Geneva, International Labour Office.
Lange, Oscar (1967), Essays in Economic Planning, Calcutta, Statistical Publication Society.
Leys, Colin (1973), “Interpreting African Underdevelopment: Reflection on the ILO Report on Employment, Incomes, and Equality in Kenya”, African Affairs, vol, 72, pp. 419-429.
Mridha, Prasant (2023), হারিয়ে যাওয়া জীবিকা, ঢাকা, কথাপ্রকাশ
Nayam, Kushnuma Tun (2021), “Coping Mechanism of Informal Trading Enterprises in Adverse Situation: A case study of street vendors in Narayanganj City, Bangladesh ”, M.Sc. thesis, Department of Economics and Social Sciences, Brac University
Rempel, H. (1974), The Informal Sector, mimeo, Institute for Development Studies, University of Nairobi.
Rempel, H. and Lobdell, R. (1978), “The Role of Urban to Rural Remittances in Rural Development”, Journal of Development Studies Vol.14, pp. 324-341.
Shafiq, Mahmud (2001), ঢাকা নগরের বিপন্ন পরিবেশ, ঢাকা, এইচ ডেভেলপমেন্ট পাবলিশিং হাউস (AHDPH).
Sharif, Ahmed (2011), সময়-সমাজ-মানুষ, ঢাকা, বিদ্যাপ্রকাশ
Siddiqui, KAhmed; Qadir, Syeda, Rowshan; Alamgir, Sitara; Huq, S. (1990), Social Formation in Dhaka City: A Study in Third World Urban Sociology, Dhaka, UPL.
Siddiqui, K., Ahmed; Siddique, K.; Huq, S.; Hossain, A.; Nazimud-Doula, S.; and Rezawana, Nahid (2010), Social Formation in Dhaka, 1985-2005: A Longitudinal Study of Society in a Third World Megacity, Dhaka, England, Ashgate.
Soto, Hernando de (1989). The Other Path: The Invisible Revolution in the Third World, New York, Harper & Row,
Standing, Guy (2016), The Precariat, London, Bloomsbury Academic.
UNICEF (2010), Understanding Urban Inequalities in Bangladesh (a study based on the results of the 2009 multiple indicator cluster survey) : A Prerequisite for Achieving Vision 2021, Dhaka, UNICEF.
Wilson, William Julius (1996), When Work Disappears: The World of the New Urban Poor, New York, Alfred A Knopf.