সমীক্ষা প্রতিবেদন: সিপিডি

সমীক্ষা প্রতিবেদন: সিপিডি

‘১২ মাসে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মূল্য বেড়েছে ২৫.৩৭ শতাংশ’

CPD’s Recommendations for the National Budget FY2023-24 এর Section 4: Price Of Essentials Beyond People’s Reach-এর সংক্ষিপ্ত অনুবাদ।

ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির চাপ বাড়ছিল। জ্বালানি খরচের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির পেছনে অভ্যন্তরীণ কিছু কারণও আংশিকভাবে দায়ী, যার মধ্যে রয়েছে কতিপয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী কর্তৃক বাজার কারসাজি এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শিথিলতা। বাংলাদেশে বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অন্যান্য উন্নয়নশীল বা শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় বেশি। জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে জীবিকার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, অন্তত ২৮টি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রী আমদানির ওপর উচ্চ কর ধার্য করা আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি সরকারের অভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ পদ্ধতির অন্তর্নিহিত দুর্বলতা প্রকাশ করেছে, যা মূলত পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। সম্ভবত বর্তমান হারে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকলে সরকার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর থেকে পরোক্ষ কর প্রত্যাহার করতে বাধ্য হতে পারে। এভাবে পরোক্ষ কর আহরণের ওপর নির্ভরশীল রাজস্বনীতি সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি করে এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মুখে সরকারকে রাজস্ব আহরণে ছাড় দিতে বাধ্য করে। এখন ভীষণ জরুরি হলো, প্রত্যক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো এবং পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, বিশেষ করে যেহেতু বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত।

দামের আন্তর্জাতিক তুলনা থেকে দেখা যায় যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম কমে না। উপরন্তু দেখা যায় যে কিছু প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকছে।

সংক্ষেপে আলোচনার জন্য আমরা এখানে চারটি খাদ্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক মূল্যের পার্থক্য তুলে ধরছি: চাল, সয়াবিন তেল, চিনি ও গরুর মাংস। এই চারটির মধ্যে চাল ও গরুর মাংস মূলত অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হয়, আর সয়াবিন তেল ও চিনি প্রধানত আমদানি করা হয়। তা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই যে, বাংলাদেশে এই চারটি সামগ্রীর দামই আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি। ইরি/বোরো, পাইজাম, নাজিরশাইল/মিনিকেট চালের দাম একই ধরনের থাই এবং ভিয়েতনামি চালের দামের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশি। দেখা গেছে যে, নভেম্বর ২০২২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমলেও একই সময়ে স্থানীয় বাজারে সয়াবিন তেলের দাম কমেনি। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিনির দাম বাংলাদেশে প্রতি কেজি ছিল ১২২ টাকা, কিন্তু মার্কিন বাজারে প্রতি কেজি মাত্র ৮০ টাকা, বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি ৪৪ টাকা এবং ইইউ বাজারে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা। এমনকি যদি আমরা পরিবহণ খরচ, আমদানি শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্য সম্পর্কিত খরচ বিবেচনা করি, দামের এই ধরনের উচ্চ পার্থক্য অদ্ভুত বলে মনে হয়। জুলাই ২০২২ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত গরুর মাংসের আন্তর্জাতিক মূল্য হ্রাস পেয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে গরুর মাংসের দাম একই সময়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম বিশ্ববাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দামের চেয়ে ২২৫ টাকা বেশি ছিল।

এই সংখ্যাগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে বিরাজমান মূল্যস্ফীতি আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতি না-ও হতে পারে, যেমনটি সাধারণত অনুমান করা হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বহুলাংশেই একটি অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয়। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে নিম্ন আয়ের এবং স্থায়ী আয়ের পরিবারগুলোকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে চারজনের একটি পরিবারের গড় মাসিক খাদ্য ব্যয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। মাছ-মাংস খাওয়া ছাড়াই চার ব্যক্তির একটি পরিবারের খাদ্য গ্রহণের গড় মাসিক খরচ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭১২ টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে হয়েছে ৭ হাজার ১৩১ টাকা। মাছ-মাংস খাওয়ার খরচসহ হিসাব করলে চারজনের একটি পরিবারের জন্য খাদ্য গ্রহণের গড় মাসিক খরচ ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ ১৫ হাজার ৭০৫ টাকা থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা হয়েছে।

একটি সাধারণ তুলনা থেকেই দেখা যায় যে, অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যসামগ্রীর মূল্যের শতকরা পরিবর্তন সরকারিভাবে প্রকাশিত খাদ্য মূল্যস্ফীতির হিসাবের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। সরকারি হিসাবে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১২ মাসের গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.০৮ শতাংশ, যেখানে একই সময়ে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর মূল্য বেড়েছে ২৫.৩৭ শতাংশ৷

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •