বাংলাদেশে অনলাইন খ্যাপের অর্থনীতি: ডেলিভারি শ্রমিকের জীবন

বাংলাদেশে অনলাইন খ্যাপের অর্থনীতি: ডেলিভারি শ্রমিকের জীবন

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ

বেতন বৃদ্ধি সহ চার দফা দাবি বাস্তবায়নে ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় ফুডপান্ডার রাইডারদের প্রতিবাদ, ছবি: মাহমুদ হোসাইন অপু / ঢাকা ট্রিবিউন

বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতি বা অনলাইনের খ্যাপ মারার অর্থনীতির আকার হুহু করে বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতির এই উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এই অর্থনীতির চেহারাটি কেমন এবং সেটা শ্রমিকের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে, সেটা নিয়েই এই প্রবন্ধ। এটি মূলত বাংলাদেশের অনলাইন ফুড ডেলিভারি খাতের শ্রমিকদের ওপর চালানো একটি অনুসন্ধানে যা উঠে এসেছে সেটার ভিত্তিতে লেখা। গবেষণাটি কেসস্টাডি নির্ভর। এর পাশাপাশি অন্যান্য দেশের প্রকাশিত কিছু গবেষণাও পর্যালোচনা করা হয়েছে। মাঠকর্ম থেকে প্রাপ্ত ফলাফল তুলে ধরার জন্য এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতির চেহারা কেমন এবং তার উত্থান কীভাবে হলো, সেটা নিয়ে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে আলাপ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

‘খ্যাপ মারা’ কথাটার সঙ্গে আমরা, বিশেষত যারা বয়সে তরুণ প্রজন্মের, তারা খুবই পরিচিত। খ্যাপ হলো সেই জিনিস বা সেই কাজ, যেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন, কেউ অনুবাদের খ্যাপ মারে, কেউ ট্রান্সক্রিপশনের খ্যাপ মারে, কেউ টিউশনির খ্যাপ মারে তো কেউ কোরবানি ঈদের সময় কসাইয়ের খ্যাপ মারে। খ্যাপ হলো হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া কাজ, যেটা পার্টটাইম করা যায়, আবার বেশি কাজ পেলে সারা দিন ধরেও করা যায়। ভ্যানচালকরা কোনো মালামাল ডেলিভারির কাজ পেলে সেটাকে খ্যাপ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি সারা দিনে কয়টা খ্যাপ পাবেন সেটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কতক্ষণ কাজ করলে কত টাকা পাবেন, সেটারও নিশ্চয়তা নেই। রিকশাচালকও প্রতিদিন হিসাব করেন তিনি সকাল থেকে কয়টা খ্যাপ মেরে কত টাকা পেলেন।

এই খ্যাপ একটা ‘অমার্জিত’ বাংলা শব্দ। ঠিক ইংরেজি গিগ শব্দটার মতোই। গিগ শব্দটাও একটা ‘অমার্জিত’ শব্দ হিসেবেই পরিচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে এই গিগ কথাটার প্রচলন করেন জ্যাজ শিল্পীরা। জ্যাজ শিল্পীরা তখন নিজেদের জীবিকার তাগিদে যা পেতেন তাই করতেন। কেউ যদি তাদের কোথাও গানবাজনা করার জন্য বায়না করত, তাহলে তারা সেটাকে বলতেন যে একটা গিগ পেয়েছেন, মানে একটা জায়গায় কোনো একটা নির্দিষ্ট দিনের জন্য তাকে বায়না করা হয়েছে। এখন এই গিগ বা খ্যাপ একটা রেস্তোরাঁতেও হতে পারে, কিংবা হতে পারে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে। এমনকি এসব গিগ বা খ্যাপের ক্ষেত্রে সবসময় যে টাকার বিনিময়ে মূল্য পরিশোধ করা হতো এমনও ছিল না বিষয়টা। এমনও হতে পারত যে এই শিল্পীর গানের বিনিময়ে সম্মানী দেওয়া হয়েছে বারে গিয়ে ভরপুর মদ খাওয়া, কিংবা কোনো হোটেলে ডিনার কিংবা এমন কোনো কিছু। সোজা বাংলায় পুরোপুরি অপ্রথাগত, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কিংবা নামমাত্র টাকায় নানাবিধ বিচিত্রসব কাজ করার নামই ছিল গিগ করা বা বাংলায় যাকে আমরা বলি খ্যাপ মারা।

এই খ্যাপ একটা ‘অমার্জিত’ বাংলা শব্দ। ঠিক ইংরেজি গিগ শব্দটার মতোই। গিগ শব্দটাও একটা ‘অমার্জিত’ শব্দ হিসেবেই পরিচিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। গত শতাব্দীর শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে এই গিগ কথাটার প্রচলন করেন জ্যাজ শিল্পীরা। জ্যাজ শিল্পীরা তখন নিজেদের জীবিকার তাগিদে যা পেতেন তাই করতেন। কেউ যদি তাদের কোথাও গানবাজনা করার জন্য বায়না করত, তাহলে তারা সেটাকে বলতেন যে একটা গিগ পেয়েছেন

পরবর্তীতে এই শতাব্দীতে, যখন চারিদিকে অনলাইনের জয়জয়কার, সে সময় অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে নানা ধরনের খ্যাপ মারার কাজ শুরু হয়। যদিও বিভিন্ন পেশায় ফ্রিল্যান্সিং করা বহু আগে থেকেই ছিল। কিন্তু অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং শুরু হওয়ার পর থেকে পরবর্তী সময়ে সেই অনলাইন খ্যাপ মারার খাত এতই বড় হয়ে ওঠে যে এই খাতটিকেই আলাদা করে এখন গিগ ইকোনমি বলা হয়। গিগ ইকোনমি শব্দবন্ধটি ২০০৯ সালে প্রথম ব্যবহার করেন নিউইয়র্কারের সাবেক সম্পাদক এবং ডেইলি বিস্টের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক টিনা ব্রাউন। ততদিনে অনলাইনের ফ্রিল্যান্সিং জগতে প্রকট হয়ে ওঠা চরম অপ্রথাগত, অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং মালিকের দায়দায়িত্ব এড়িয়ে কাজ আদায় করে নেওয়ার যে নিদারুণ প্রথা গড়ে ওঠে, সেটিকে ধারণ করতেই যেন অনেকটা শ্লেষের সঙ্গেই তিনি অর্থনীতির ওই নতুন ধারাকে নামকরণ করেন গিগ ইকোনমি হিসেবে। জ্যাজ শিল্পীদের ব্যবহার করা ওই ‘অমার্জিত’ ইংরেজি গিগ শব্দটাকে ধার করেই তিনি এই নামকরণ করেন। এ কারণেই গিগ ইকোনমির যথাযথ বাংলা অনুবাদ কোনো তথাকথিত ‘মার্জিত’ বাংলা শব্দ দিয়ে করাটা মুশকিল। গিগ ইকোনমির বাংলা ভাবানুবাদ তাই খ্যাপ মারা অর্থনীতি বা খ্যাপের অর্থনীতি হতে পারে।

অনলাইন খ্যাপ মারার খাত এতই বড় হয়ে ওঠে যে এই খাতটিকেই আলাদা করে এখন গিগ ইকোনমি বলা হয়। গিগ ইকোনমি শব্দবন্ধটি ২০০৯ সালে প্রথম ব্যবহার করেন নিউইয়র্কারের সাবেক সম্পাদক এবং ডেইলি বিস্টের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক টিনা ব্রাউন।

পৃথিবীর এই গিগ অর্থনীতি বা অনলাইনের খ্যাপ মারা অর্থনীতির বয়স সাকুল্যে বড়জোর ২০ বছরের মতো। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সময়ে সময়ে তার ভোল পালটায়। কখনো সে পরিস্থিতির প্রয়োজনে নমনীয় সাজে, আবার কখনো হয়ে ওঠে ভীষণ আগ্রাসী। খ্যাপ মারা অর্থনীতি পুঁজিবাদের সেই ভীষণ আগ্রাসী রূপেরই সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা তার নিজের রাজনৈতিক প্রয়োজনে পরিস্থিতির চাপে কখনো ‘উদার’ সাজে, বাজারের ওপর সীমিত মাত্রায় হলেও কিছু রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, আইনকানুনের মাধ্যমে লোক দেখানোর মতো করে হলেও শ্রমশোষণের ওপর কিছুটা রাশ টেনে ধরে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মানুষের কর্মসংস্থান, সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করে। কিন্তু যখনই পুঁজিবাদী অর্থনীতি নিজের ভেতরকার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে, যে সংকট পুঁজিবাদের মজ্জাগত, তখনই সেটি তার সেই আপাত মোলায়েম চেহারাটিকে মুহূর্তের মধ্যেই ছুঁড়ে ফেলে দস্যুবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। তবে এই দস্যুবৃত্তি করা হয় আগের থেকে আরও সূক্ষ্মভাবে, আরও গভীরভাবে এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তি দিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার মাধ্যমে। প্রযুক্তির সেই চোখধাঁধানো কারবার দেখে মানুষের চোখে শুরুতে তখন আর শ্রমশোষণ কিংবা মজুরি চুরি ধরা পড়ে না। মানুষ হাঁ করে বিমোহিত হতে হতে ভাবে দুনিয়া কত এগিয়ে গেছে! একটা মোবাইল দিয়েই কি না করা যাচ্ছে! ঘরে বসে খাবার অর্ডার করা যাচ্ছে, মার্কেটিং করা যাচ্ছে, মোবাইল দিয়েই কাজ খুঁজে নেওয়া যাচ্ছে, পেমেন্টও মোবাইলে চলে আসছে!

প্রযুক্তির সেই চোখধাঁধানো কারবার দেখে মানুষের চোখে শুরুতে তখন আর শ্রমশোষণ কিংবা মজুরি চুরি ধরা পড়ে না। মানুষ হাঁ করে বিমোহিত হতে হতে ভাবে দুনিয়া কত এগিয়ে গেছে! একটা মোবাইল দিয়েই কি না করা যাচ্ছে!

সবকিছু আমাদের হাতের মুঠোয়! প্রযুক্তির এসব চোখ ধাঁধানোর মধ্যে মানুষ তাই শুরুতেই চট করে এটা আর দেখতে পায় না যে, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা এখন তার সহজাত আগ্রাসী ভূমিকায় গিয়ে এবার তার নিজেরই বানানো বহু বছরের স্বীকৃত শ্রমের নিয়মকানুনগুলোকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারা অর্থনীতির উত্থানের মধ্য দিয়ে, শ্রমিকদের বৈশ্বিক মজুদ বাহিনীটিকে ঠেলে দিচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের থেকে আরও বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে, আরও কঠোর শ্রমশোষণের মধ্যে, কিন্তু কোনো রকম দায় না নিয়েই। সারা পৃথিবীতে গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারা অর্থনীতির নামে এটাই করা হচ্ছে।

খ্যাপ মারা অর্থনীতি কীরকম?

সোজা বাংলায় বলতে গেলে অনলাইন খ্যাপ মারা অর্থনীতি বা গিগ অর্থনীতির মূল ধারণাটি হলো, কোম্পানি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম মারফত যে সেবাটি বিক্রি করবে সেই সেবা বা পণ্য যারা উৎপাদন করছে সেসব শ্রমিককে কোম্পানি তার শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না। কোম্পানি তাদের নিজের পার্টনার হিসেবে দেখাবে। কোম্পানি বলবে যে তারা স্বাধীন পার্টনার। তাদের মন চাইলে তারা কাজ করে, মন না চাইলে করে না। তারা বাজারদর থেকে অনেক কম মজুরি পাবে। তাদের ঘামে-শ্রমে কোম্পানির মুনাফা হবে সারাক্ষণ, কিন্তু তারপরও প্রচলিত কাজের থেকে অনেক কম ওই আয়টিও নিয়মিত করতে পারার কোনো নিশ্চয়তা কোম্পানি তাদের দেবে না, তারা কতদিন কত ঘণ্টা কাজ করতে পারবে সেটারও কোনো নিশ্চয়তা কোম্পানি দেবে না। তাদের কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেবে না। তাদের কোনো ধরনের দায়-দায়িত্বও নেবে না। কোম্পানির বিক্রি করা পণ্য বা সেবাটি উৎপাদন করার জন্য যেসব পুঁজি দরকার হবে, সেটারও কোনো দায়ভার কোম্পানির থাকবে না। সেই পুঁজিটি হতে হবে শ্রমিকের পকেট থেকে (যেমন, গিগ অর্থনীতির কোম্পানি উবার পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি হলেও তার নিজের মালিকানাধীন কোনো ট্যাক্সি নেই!)। কোম্পানির বিক্রি করা সেবাটি কাস্টমারের কাছে পৌঁছে দিতে শ্রমিকের দৈনিক যা যা খরচ হয়, সেটাও কোম্পানি বহন করবে না। কোম্পানি তাদের নিজের তৈরি করা নিয়মে কাজ করতে বাধ্য করবে। পরোক্ষভাবে বাধ্য করবে বেশি বেশি কাজ করার জন্য, নয়তো সে পরবর্তীতে কাজ পাবে না। কোম্পানির তৈরি করা নিয়মের অন্যথা হলে কারখানা মালিকের মতোই কোম্পানি তাকে জরিমানা করতে পারবে, ছাঁটাই করতে পারবে। কিন্তু কোম্পানির বিক্রি করা সেবাটি উৎপাদন করতে গিয়ে কেউ যদি দুর্ঘটনাতেও পড়ে, মারাও যায়, তাহলেও কোম্পানির তাতে কোনো দায় নেই। কারণ, তারা তো কোম্পানির ‘শ্রমিক’ নয়। তাদের কোম্পানি ‘স্বাধীন পার্টনারের মর্যাদা’ দিয়ে রেখেছে।

কোম্পানি বলবে যে তারা স্বাধীন পার্টনার। তাদের মন চাইলে তারা কাজ করে, মন না চাইলে করে না। তারা বাজারদর থেকে অনেক কম মজুরি পাবে। তাদের ঘামে-শ্রমে কোম্পানির মুনাফা হবে সারাক্ষণ, কিন্তু তারপরও প্রচলিত কাজের থেকে অনেক কম ওই আয়টিও নিয়মিত করতে পারার কোনো নিশ্চয়তা কোম্পানি তাদের দেবে না, তারা কতদিন কত ঘণ্টা কাজ করতে পারবে সেটারও কোনো নিশ্চয়তা কোম্পানি দেবে না। তাদের কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দেবে না। তাদের কোনো ধরনের দায়-দায়িত্বও নেবে না।

শুনতে খুব অবাক লাগলেও এটাই হলো বিশ্বজুড়ে গিগ অর্থনীতি বা অনলাইন খ্যাপ মারা অর্থনীতির চেহারা। যার মূল কথাটাই হলো, প্রচলিত শ্রম আইনগুলোকে সরাসরি পাশ কাটিয়ে শ্রমিক নিয়োগ করা এবং তাদের শোষণ করা প্রচলিত যেকোনো কাজের থেকে অনেক অনেক বেশি হারে। এই খ্যাপ মারা অর্থনীতির কোম্পানির মালিক তার পুঁজি বিনিয়োগ করে শুধু অ্যালগরিদম, মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট আর প্ল্যাটফর্ম বানাতে এবং সেগুলোকে চালানোর জন্য আইটি ও ম্যানেজারিয়াল টিমের জন্য অফিস বানাতে। কোম্পানির পক্ষে সারা দুনিয়ায় ব্যাবসা করা সম্ভব হবে কোনো ধনী দেশের ছোট এক শহরে বসেই। তার জন্য কোনো কারখানা বানানোর প্রয়োজন নেই, কোনো উৎপাদনের যন্ত্রপাতি কেনার প্রয়োজন নেই, এমনকি পণ্য রাখার জন্য কোনো গোডাউনেরও দরকার নেই। সেই প্ল্যাটফর্মে ক্রেতাও থাকবে আবার কোম্পানির ওই প্ল্যাটফর্মে নথিভুক্ত শ্রমিকরাও থাকবে। ক্রেতা যখন যা চাইবে অনলাইনে, প্ল্যাটফর্মের নথিভুক্ত শ্রমিকরা তখনই সেটা উৎপাদন করে কিংবা জোগাড় করে সেটা ক্রেতার কাছে পৌঁছাবে। আর প্রতিটি ডেলিভারির জন্য কোম্পানি পাবে কমিশন। কোম্পানি আবার এর জন্য একটা কম সময়ের ডেডলাইন নির্ধারণ করে দেবে ক্রেতাকে খুশি করার জন্য, যাতে প্ল্যাটফর্মে আরও বেশি বেশি করে ক্রেতা আসে এবং তাদের কাছে সেবা বা পণ্য বিক্রি করে কোম্পানির লাভ হয়। তার মানে হলো, প্রচলিত ধরনের কোনো প্রকার প্রয়োজনীয় পুঁজিই কোম্পানি বিনিয়োগ করবে না, কোনো ধরনের ঝুঁকিই সে নেবে না, কিন্তু লাভ করবে সেই প্রচলিত ধারার থেকে বেশি হারে। যার ফলাফল হবে শ্রমিকের ওপর সার্বক্ষণিক একটা চাপ এবং কোম্পানির সার্বক্ষণিক লাভ। খেয়াল করলে বোঝা যায় যে, এই কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন সেবা বা পণ্যের দালালদের আচরণগত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দুই পক্ষই দালাল। পার্থক্য শুধু বোলচালের, প্রযুক্তির আর আর্থিক অবস্থার।

প্রচলিত ধরনের কোনো প্রকার প্রয়োজনীয় পুঁজিই কোম্পানি বিনিয়োগ করবে না, কোনো ধরনের ঝুঁকিই সে নেবে না, কিন্তু লাভ করবে সেই প্রচলিত ধারার থেকে বেশি হারে। যার ফলাফল হবে শ্রমিকের ওপর সার্বক্ষণিক একটা চাপ এবং কোম্পানির সার্বক্ষণিক লাভ।

বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারা অর্থনীতির আকার বর্তমানে হুহু করে বাড়ছে। শুরুটা অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং বা ঘরে বসে কাজ দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে খ্যাপ মারা অর্থনীতির কোম্পানিগুলো একের পর এক বিভিন্ন খাতে বাজার দখল করছে। পরিবহন, খাবার ডেলিভারি, কুরিয়ার সার্ভিস থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজ, শিক্ষকতা, মেডিকেল সেবাসহ একের পর এক খাতে বাজার তৈরি করে নিচ্ছে অনলাইন খ্যাপ মারা কোম্পানিগুলো। আমাদের দেশে এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত হলো উবার এবং ফুডপান্ডা, দেশি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে পাঠাও। বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির আকার কত দ্রুত বাড়ছে, সেটা বোঝার জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। ২০১৮ থেকে ২০২১ এই মাত্র পাঁচ বছরেই বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির আকার দ্বিগুণ হয়েছে! বছরে ১৭ শতাংশ করে তার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বর্তমানে ২০২৩ সালের শেষে বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির আকার ৪৫৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, এটি বাংলাদেশের বর্তমান প্রাক্কলিত জিডিপির প্রায় সমান। গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারার এই অর্থনীতি যে দ্রুতই আরও বড় হতে থাকবে সেটাও প্রায় নিশ্চিত।

২০১৮ থেকে ২০২১ এই মাত্র পাঁচ বছরেই বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির আকার দ্বিগুণ হয়েছে! বছরে ১৭ শতাংশ করে তার প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বর্তমানে ২০২৩ সালের শেষে বৈশ্বিক গিগ অর্থনীতির আকার ৪৫৫.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

খ্যাপ মারা অর্থনীতির উত্থান কীভাবে হলো?

এখন কথা হলো, এই গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারা অর্থনীতির কি হঠাৎ করেই উত্থান হলো? আরও প্রশ্ন ওঠে যে, এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে এ রকম একটি চরম শ্রমশোষণকারী অর্থনীতির উত্থান ঘটা কীভাবে সম্ভব হলো, যেটি কিনা গত শতাব্দীতে পুঁজিবাদের স্বীকৃত শ্রমদানের সব নিয়মকানুনকে এভাবে উড়িয়ে দিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের তাকাতে হবে গত শতাব্দীর শেষের দিককার পুঁজিবাদের ইতিহাসের দিকে। গত শতাব্দীর শেষের দিক থেকে আজ পর্যন্ত পুঁজিবাদের ইতিহাস হলো মূলত অর্থনৈতিক সংকটের ইতিহাস।

২য় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পখাত সারা দুনিয়ার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করার মতো অবস্থায় চলে এলো, তখন তাদের রমরমা পরিস্থিতি তৈরি হয়। তারা তখন হেনরি ফোর্ডের দেখানো পথে তাদের অর্থনীতিকে সাজায় গণ উৎপাদন, গণভোগ, গণমিডিয়া তৈরির আলোকে। সে জন্য ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে বিশাল বিশাল কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। দরকার হয় স্থায়ী পুঁজি (ফিক্সড ক্যাপিটাল) বাড়ানোর। উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদে কর্মসংস্থান বাড়ে, শ্রমিকের মজুরি বাড়ে, তার কাজের কিছু নিশ্চয়তা তৈরি হয়। শ্রমের প্রক্রিয়াটিকে সাজানো হয় টেইলরিস্ট নীতিতে, যার মানে হলো প্রতিটি কাজকে ছোট ছোট কাজে এমনভাবে ভাগ করে ফেলা, যাতে সেগুলো করতে দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না এবং সবশেষে সেই ছোট ছোট ভাগে করা কাজগুলোকে সবচেয়ে দক্ষতার সাথে আবার জোড়া লাগিয়ে ফেলা। এই বাস্তবতায় শিল্পকারখানায় একসাথে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক জড়ো হতে থাকায় শ্রমিকের দরকষাকষির ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায় সেই সময়টা জুড়ে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আন্দোলন ও জনমতের চাপে কল্যাণ রাষ্ট্রের কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয় সার্বিক  প্রক্রিয়াটিকে নিরাপদ রাখতে। এখন আমরা একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাজ বলতে যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা বুঝি যে একটা কাজের নিশ্চয়তা থাকবে, একটা নির্ধারিত মজুরি থাকবে, বিভিন্ন ভাতা থাকবে, পেনশন থাকবে সেগুলো মূলত ৩০ দশকে থেকে সেই সময়ের ধারণা। ওই সময়টা আসলে পুঁজিবাদের একটা সোনালী সময় বলা হয়। কারণ, মুনাফা ও মজুরি দুটোই তখন বাড়ছিল।

যাই হোক, রমরমা অবস্থাটা ওরকম থাকল না। ৭০ এর দশকেই পুঁজিবাদ আবারও গভীর সংকটে পতিত হয়। এবার দেখা দিল একই সঙ্গে মুনাফা কমা, প্রবৃদ্ধির হার ধীর হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব বাড়া এবং ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো কমে যেতে লাগল। সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য উদ্বৃত্ত পুঁজি নিত্যনতুন খাত খোঁজা শুরু করল।  সেবা খাতগুলোর অধিকতর বাজারীকরণ তখন থেকেই শুরু। এদিকে সংকটে পড়া পুঁজির তাগিদে দুনিয়াজুড়ে এক সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন বিস্তৃত হলো। রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বকে অস্বীকার করা, শ্রমিকের জীবনকে হুমকির মধ্যে ফেলা, শ্রমিককে আরও নাজুক করে তোলা নব উদারবাদ গেড়ে বসল দুনিয়া জুড়ে। ৯০ এর দশকে ইন্টারনেট ও কম্পিউটার প্রযুক্তি বাণিজ্য জগতে সুলভ হয়। শুরু হলো ইন্টারনেট খাতের বাণিজ্যিকীকরণ। উদ্বৃত্ত পুঁজি ওই ইন্টারনেট খাতে লগ্নি করেই থেমে থাকেনি। সেটি সেখানে শুরু করল ফাটকা কারবার। ফলাফল হলো ইন্টারনেট খাতের ফুলেফেঁপে ওঠা। যেটাকে পরে নাম দেওয়া হলো ডটকম বাবল বা তথ্য প্রযুক্তির বুদ্বুদ। এই ডটকম বাবলই আজকের অনলাইন খ্যাপ মারা অর্থনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভিত তৈরি করে। এরপর ২০০০ সালের দিকে ডটকম বাবলেও ধ্বস নামল। সেই অর্থনৈতিক সংকট ঠেকাতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার ফলাফল হিসেবে মর্টগেজ খাতে সুদের হার কমে গেলে লগ্নি পুঁজি তখন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবারও ফাটকা কারবার শুরু করে। এবারের ফলাফল হিসেবে আসে ২০০৭-৮ আরও ভয়াবহ বৈশ্বিক আর্থিক সংকট, যাকে গ্রেট ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস বা মহা আর্থিক সংকট নাম দেওয়া হয়েছে।

এই প্রতিটি সংকটেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শ্রমিকের ওপর অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে লাগামছাড়া আক্রমণ বাড়িয়েছে। শ্রমিকের কাজ হয়ে গেল ছুটা, অস্থায়ী, তার কাজের নিরাপত্তাগুলো চলে গেল। স্থায়ী কাজের জায়গায় তার জন্য পুঁজি হাজির করল ছোট ছোট ছুটা কাজ। একই সঙ্গে চলল ছাঁটাই এবং আরও কম টাকায় একই কাজ করানোর জন্য আউটসোর্সিং। একটা বিশাল জনসংখ্যার জন্য পুঁজি হাজির করল জীবিকার জন্য একাধিক কাজ বা তারও বেশি কাজ করার বাধ্যবাধকতা। আমরা যদি ১৯৯১ থেকে ২০২১ সাল এই সময়টার দিকে তাকাই, তাহলে দেখব বৈশ্বিকভাবেই বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে, বেকারত্বের হারের ট্রেন্ড তা-ই বলে। সুতরাং এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন সামনে বেকার ও অর্ধবেকার শ্রমিকের বিশ্বজোড়া এক মহাসাগর, এমন একটা পরিস্থিতিতে যখন কোনোভাবেই প্রবৃদ্ধির হারকে ওঠানো যাচ্ছে না, শিল্পখাতের মুনাফার হার কমে যাওয়াকে স্থায়ীভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না, তখন পুঁজি যদি এমন কোনো খাত দেখে যেখানে বিনিয়োগ করলে তাকে কোনো ধরনের দায়-দায়িত্ব নিতে হচ্ছে না শ্রমিকের, উল্টো তাকে স্বাধীন পার্টনার ঘোষণা করে বাস্তবে দাসের মতো করে খাটিয়ে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মুনাফা করার সুযোগ আছে, তাহলে পুঁজি সেই সুযোগ হাতছাড়া করবে কেন? পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই ঐতিহাসিক বাস্তবতা থেকেই উত্থান হয়েছে আজকের দিনের গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারার অর্থনীতির। সাম্প্রতিক কোভিড মহামারীকালেই এই খ্যাপ মারার অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠেছে।

খ্যাপ মারা অর্থনীতির এই উত্থানের পেছনে আরও কতগুলো পূর্বশর্ত কাজ করেছে। প্রথমত, অনলাইন প্ল্যাটফর্মের অবকাঠামোর পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আগেকার প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন ছিল যে যারা কাজ খুঁজছে তারা তাদের জীবনবৃত্তান্ত সেখানে পোস্ট করবে আর নিয়োগকর্তা সেটা দেখে তার প্রয়োজনমতো তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে- ব্যাপারটা এখন আর এমন নয়। এখনকার গিগ অর্থনীতির বা খ্যাপ মারা অর্থনীতির প্ল্যাটফর্মগুলোকে শুধু একটি অনলাইন বাজার বললে ভুল হবে। এগুলো হলো এমন একটা বাজার, যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই খ্যাপ মারা কোম্পানিগুলোর নির্ধারিত মূল্যে ও নিয়মকানুন মেনে বেচাকেনা করবে। অর্থাৎ, বাজার যে বসালো তার একটি সর্বময় ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছে এখানে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং নজরদারি করার প্রযুক্তির বিকাশ এমন একটা পর্যায় পর্যন্ত হতে হয়েছে যাতে করে যেকোনো সম্পাদিত কাজকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মাপা যায়, দূর থেকে নিয়ন্ত্রণও করা যায়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এই কাজকে মাপা ও দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা করা ছাড়া গিগ অর্থনীতি আগাতে পারবে না। কারণ, তার পক্ষে সশরীরে শ্রমিকের পেছনে গিয়ে গিয়ে, তদারকি করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। তৃতীয়ত, দুনিয়াজুড়ে অদৃষ্টপূর্ব গণযোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ এবং সেই যোগাযোগের জন্য সস্তা প্রযুক্তির বিকাশ হওয়া। এখনকার যে স্মার্টফোনগুলো মাত্র ৬০০০ টাকায় পাওয়া যায়, সেদিকে খেয়াল করলেই এই দিকটি ধরতে পারা যাবে। গণযোগাযোগের এই সস্তা প্রযুক্তি ছাড়া কোনো উন্নত দেশের গিগ কোম্পানির পক্ষে কখনোই সম্ভব হতো না বাংলাদেশ কিংবা কেনিয়ার নিম্নবিত্ত বেকার যুবকদের দিয়ে অনলাইনের মাধ্যমে এই মাত্রায় কাজ করানো। চতুর্থত, ভোক্তার প্রেফারেন্স বা পছন্দের পরিবর্তন ঘটানো। এই কাজটি করা হয়েছে খুব চাতুর্যের সঙ্গে। এতে ব্যবহার করা হয়েছে মিডিয়াকেও। বাংলাদেশেই মোবাইল ফোনের ফিচার ও বিভিন্ন অনলাইন প্রযুক্তি নিয়ে যে মুখ হাঁ করা বিমোহিত উন্মাদনা গত এক দশকের কিছু বেশি সময় ধরে তৈরি করা হয়েছে, সেদিকে তাকালে আমরা এই দিকটি সম্পর্কে খুব ভালো করেই টের পাব। একই সঙ্গে ভোক্তাকে আগের চেয়েও বেশি হারে প্রলুব্ধ করা হয়েছে কনজিউমারিজম বা ভোগবাদে। ফলে ভোক্তা এখন দুনিয়ার সবকিছুই ‘ঘরে বসে পেতে চায়’। পঞ্চমত, একটা দেশের বিদ্যমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে ন্যূনতম মাত্রায় ডিজিটাল সাক্ষরতার বিকাশ ঘটা। ষষ্ঠত, খুবই গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। সেটি হলো শ্রমিকের নিজে থেকেই স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাওয়া। এটা মূলত শ্রমিকের একধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণের ইচ্ছা বা তার কর্তাসত্তার বহিঃপ্রকাশ। যদিও এই স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাওয়ার পেছনে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে প্রচলিত প্রথাগত কাজের যে কর্মপরিবেশ, তাকে যেভাবে অনর্থক সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর রাখা হয়, তাকে যেভাবে মূল কাজের পাশাপাশি অজস্র অপ্রয়োজনীয় কাজ দিয়েও ব্যতিব্যস্ত করে রাখা হয়, সেটারই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রয়েছে। নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেবার এ ধরনের কাজগুলোকে নাম দিয়েছিলেন ‘বুলশিট জব’, যার ভদ্র বাংলা হতে পারে- ‘ছাতামাথা কাজ’। পূর্বে বর্ণিত পুঁজিবাদী অর্থনীতির ওই ঐতিহাসিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ওপরের এই পূর্বশর্তগুলোর উপস্থিতির ফলেই আজকের গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারার অর্থনীতির উত্থান ঘটেছে।

বাংলাদেশে ফুড ডেলিভারি শ্রমিকের জীবন অনুসন্ধান

বাংলাদেশে এখন গিগ অর্থনীতির নানা কোম্পানি কাজ করছে। এগুলোর মধ্যে কিছু আছে দেশী, বাকিগুলো বিদেশী। গিগ অর্থনীতি বা খ্যাপ মারার অর্থনীতির যেসব কোম্পানি বাংলাদেশের ভেতরে অপারেশন পরিচালনা করছে, সেগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে পরিচিত হলো উবার, পাঠাও, ফুডপান্ডা। এ ছাড়াও বাংলাদেশের তরুণরা বহু বছর থেকেই বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে কাজ করছেন ঘরে বসেই। বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির চেহারা বোঝার চেষ্টা থেকে আমি একটি ছোট্ট অনুসন্ধান চালাই। অনুসন্ধানটি মূলত কেসস্টাডি নির্ভর। এই লেখাটি মূলত সেই গবেষণায় যা যা উঠে এসেছে সেটা নিয়ে। বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির শ্রমিকের জীবন বোঝার জন্য খাত হিসেবে ফুড ডেলিভারি খাতটিকে বেছে নেওয়া হয় সাম্প্রতিক কালে এই খাতের দৃশ্যমান বাড়বাড়ন্ত দেখে।

গবেষণা পদ্ধতি:

গবেষণায় বিভিন্ন প্রকাশনা বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি কেসস্টাডি করা হয়েছে। কেসস্টাডির জন্য নমুনা বাছার পদ্ধতিটি দৈবচয়ন ছিল না। কারণ, দৈবচয়ন করার জন্য বিভিন্ন এলাকার ফুড ডেলিভারি শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রয়োজন হতো। সেটা একমাত্র কোম্পানিগুলো ছাড়া আর কারো কাছেই নেই। এই বাস্তবতায় তাই দৈবচয়ন পদ্ধতি ব্যবহার করার কোনো সুযোগ ছিল না। এখানে নমুনা বাছাই করার জন্য যে পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে সেটি মূলত পারপাসিভ স্যাম্পলিং। গবেষণার অঞ্চল হিসেবে ঢাকা শহরের একটা গুরুত্বপূর্ণ জমজমাট রেস্টুরেন্ট হাব খিলগাঁওয়ের তালতলার শহীদ বাকী সড়ককে বেছে নেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর ওই রাস্তার দুই পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চক্কর দিতে দিতে যখনই সামনে কোনো ফুড ডেলিভারি রাইডার পড়েছে, তখনই তার সঙ্গে কথা বলেছি, যদি তার তখন কথা বলার মতো অবস্থা থাকত। কখনো কখনো তার ফোন নম্বর রেখে দিয়ে পরদিন যখন তিনি কাজ ছাড়া ছিলেন তখন তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। ১৫ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই ১৫ জনের মধ্যে ১২ জন ছিলেন ফুডপান্ডার সাইকেল রাইডার আর পাঠাও ফুডসের সাইকেল রাইডার ছিলেন ৩ জন। এদের মধ্যে দুজন আবার ছিল শিশুশ্রমিক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক রাইডার।

ফুডপান্ডা তাদের ওয়েবসাইটে রাইডারের কাছে কীভাবে নিজেদের উপস্থাপন করে

রাইডারদের জন্য ফুডপান্ডার বাংলাদেশের যে ওয়েবসাইট সেখানে রাইডারের নিয়মকানুন বিষয়ে কিছুই নেই। যদি আগে নিয়মকানুন জেনে কেউ রাইডার হতে চায়, তাহলে এই ওয়েবসাইট দেখে তার পক্ষে কিছুই বোঝা সম্ভব নয় যে তাকে আসলে কীভাবে কাজ করতে হবে।

ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেল, রাইডার এখানে কতটা স্বাধীন সেটা বোঝানোর জন্য সেখানে লেখা আছে: ‘আপনি নিজেই বেছে নিতে পারবেন আপনার পছন্দ অনুযায়ী কাজের সময়’। সেখানে বাড়তি সুবিধা হিসেবে রাইডার কী কী পাবেন সেই ঘরে লেখা আছে: পারফরম্যান্স বোনাস, বন্ধুকে রেফার করলে বোনাস, নতুন জয়েন করলে বোনাস, ইদ/রোজায় অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ এবং ইন্স্যুরেন্স। এ ছাড়াও বিভিন্ন রকম সামাজিক আয়োজন (পিকনিক, স্পোর্টস ডে, প্রতিযোগিতা)। সেখানে আবেদন করার যোগ্যতা হিসেবে যেসব জিনিস রাইডারের থাকতে হবে বলে তারা রাইডারকে বলছে সেগুলো হলো: ‘১. অ্যান্ড্রয়েড ফোন (৪.২ বা আরও নতুন) অথবা আইফোন (4S বা আরও নতুন), ২. সাইকেল, স্কুটার অথবা মোটরবাইক অথবা ওয়াকার রাইড, ৩. জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ৪. বয়স হতে হবে ১৮+। এরপর সেই ওয়েবসাইটে ফুডপান্ডাকে দেওয়া দুজন স্বাস্থ্যবান রাইডারের প্রশংসাপত্র দেওয়া হয়েছে। প্রথমজন বলছেন, ‘আমি চার বছর ধরে ফুডপান্ডায় কাজ করছি এবং আমি এখানে কাজ করা উপভোগ করি। এবং এটি শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য নয়, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি অনেক সহজে কাজ করতে পারি।’ এবং দ্বিতীয়জন বলছেন, ‘ফুডপান্ডায় রাইডার হিসেবে কাজ করা আমার জীবনে একটি বড় সুযোগ। এখানে কাজ করার সুবাদে প্রতিদিন আমি নতুন নতুন বন্ধু পাই এবং নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই।’ এই দুজনের প্রশংসাপত্রের পরই ফুডপান্ডা তাদের রাইডার ওয়েবসাইটের নিচে তিনজন হাস্যোজ্জ্বল সুখী স্বাস্থ্যবান রাইডারের ছবি দিয়ে রেখেছে।

আবেদন করার যোগ্যতা হিসেবে যেসব জিনিস রাইডারের থাকতে হবে বলে তারা রাইডারকে বলছে সেগুলো হলো: ‘১. অ্যান্ড্রয়েড ফোন (৪.২ বা আরও নতুন) অথবা আইফোন (4S বা আরও নতুন), ২. সাইকেল, স্কুটার অথবা মোটরবাইক অথবা ওয়াকার রাইড, ৩. জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ৪. বয়স হতে হবে ১৮+। এরপর সেই ওয়েবসাইটে ফুডপান্ডাকে দেওয়া দুজন স্বাস্থ্যবান রাইডারের প্রশংসাপত্র দেওয়া হয়েছে।

খেয়াল করে দেখুন যে এখানে একজন রাইডারের জন্য যে জিনিসটি জানা সবচেয়ে জরুরি ছিল সেই নিয়মকানুন সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেই, অস্বচ্ছতার চূড়ান্ত চর্চা করে, তাকে এখানে রাইডার হিসেবে নিবন্ধিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। পরবর্তীতে ফুডপান্ডার রাইডারদের সঙ্গে এই গবেষণা চলাকালীন কথা বলে তাদের সেইসব নিয়মকানুন সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়। সেই নিয়মকানুনগুলো একই সঙ্গে অস্বচ্ছতা, নির্লজ্জতা ও বর্বরতার একটা মিশেল।

রাইডারদের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশে ফুডপান্ডার যেসব নিয়মকানুন ও চর্চাগুলো সম্পর্কে জানা যায়

কোনো এলাকায় রাইডার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার পর ফুডপান্ডা তাদের একটা ট্রেনিং দেয়। সেই ট্রেনিংয়ে বিস্তারিত রাইডারকে বোঝানো হয় যে কীভাবে কাজটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো লিখিত নিয়মকানুন থাকার কথা রাইডাররা জানেন না বলে জানিয়েছেন।

রাইডার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার পর প্রথমে রাইডার একটা ব্যাচ নম্বর পায়। ফুডপান্ডার ব্যাচ হলো ১ থেকে ৬ পর্যন্ত। যে নতুন রাইডার তার জন্য ব্যাচ থাকে ৬। তারপর ধীরে ধীরে তার পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে তার ব্যাচ উপরের দিকে উঠতে থাকে। প্রতি অর্ডার ডেলিভারির জন্য রাইডার একটা কমিশন পায়, সেটাই তার অর্ডার প্রতি আয়। ৬ নম্বর ব্যাচের ক্ষেত্রে অর্ডার প্রতি ২৫ থেকে ২৮ টাকা এবং ১ নম্বর ব্যাচের ক্ষেত্রে অর্ডারপ্রতি ৩৫-৪৫ টাকা পাওয়া যায়। বাকিরা এর মাঝামাঝি কোনো একটা অঙ্কের টাকা পাবেন।

অর্ডারপ্রতি রাইডারের টাকার পরিমাণ নির্ভর করে দূরত্বের ওপর। দূরত্ব আসা-যাওয়া মিলে সর্বোচ্চ ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। তবে কীভাবে অর্ডার প্রতি রাইডারের আয় হিসাব করা হচ্ছে, সেটা রাইডাররা বিস্তারিত জানেন না। তাদের সেটা বুঝিয়ে বলা হয়নি পরিষ্কারভাবে। তাদের শুধু এটা বলা হয়েছে যে এই বিষয়টা ‘অ্যাপ’ হিসাব করে নেয়। সেই হিসাবের প্রক্রিয়া কতটুকু সঠিক সেটা নিয়ে রাইডারদের কোনো কিছু জানার কোনো অবকাশ নেই। তারা শুধু জানেন যে দূরত্ব কম হলে টাকা কম আর দূরত্ব বেশি হলে টাকা বেশি। এখন ঠিক কত কিলোমিটারের জন্য কত টাকা এটার কোনো পরিষ্কার হিসাব তাদের ফুডপান্ডা জানায়নি।

কীভাবে অর্ডার প্রতি রাইডারের আয় হিসাব করা হচ্ছে, সেটা রাইডাররা বিস্তারিত জানেন না। তাদের সেটা বুঝিয়ে বলা হয়নি পরিষ্কারভাবে। তাদের শুধু এটা বলা হয়েছে যে এই বিষয়টা ‘অ্যাপ’ হিসাব করে নেয়। সেই হিসাবের প্রক্রিয়া কতটুকু সঠিক সেটা নিয়ে রাইডারদের কোনো কিছু জানার কোনো অবকাশ নেই।

অন্যদিকে কোনো একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের অর্ডার ডেলিভারির জন্য কেউ যদি ৩০ টাকা পান, তাহলে সেই অর্ডার ছোট হোক কি বড় তিনি ওই ৩০ টাকাই পাবেন। অর্থাৎ, অর্ডারটা যদি ২০০ টাকার একটা ছোট খাবার প্যাকেট হয় তাহলেও ৩০ টাকা পাবেন, আবার অর্ডারটা যদি ৫০০০ টাকার ব্যাগভর্তি করা ওজনদার অনেক খাবারের প্যাকেট হয় তাহলেও তিনি ওই ৩০ টাকাই পাবেন। অথচ একই দূরত্বের এই দুই প্রকার অর্ডার ডেলিভারি দিতে তার দুই রকমের শরীর ক্ষয় হবে। কম ওজনে কম, বেশি ওজনে বেশি শরীর ক্ষয়।

রাইডারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ যদি ব্যাচ ৬ থেকে ব্যাচ ১-এ উঠতে চায়, তাহলে তাকে প্রতিদিন অন্তত ৯-১০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। কোনো অর্ডারই যাতে মিস না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হয়। প্রতিটি অর্ডারই নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি করাটা নিশ্চিত করতে হয়, কাস্টমারের কাছ থেকে কোনো প্রকার কমপ্লেইন না আসাটা নিশ্চিত করতে হয়। তার নির্ধারিত শিফটের বাইরেও সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট সময় কাজ করতে হয় এবং ফুডপান্ডা নির্ধারিত স্পেশাল আওয়ারগুলোতে কাজ করতে হয়। অথচ উপরে আমরা দেখেছি যে ফুডপান্ডা তাদের ওয়েবসাইটে লিখে রেখেছে যে রাইডারের নিজের ইচ্ছামতো কাজের সময় বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা আছে। হ্যাঁ, স্বাধীনতা আছে, তবে সেই স্বাধীনতার প্রয়োগ করতে গেলে রাইডারের অর্ডার প্রতি আয় তলানিতে থাকবে।

রাইডারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কেউ যদি ব্যাচ ৬ থেকে ব্যাচ ১-এ উঠতে চায়, তাহলে তাকে প্রতিদিন অন্তত ৯-১০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়। কোনো অর্ডারই যাতে মিস না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হয়। প্রতিটি অর্ডারই নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি করাটা নিশ্চিত করতে হয়, কাস্টমারের কাছ থেকে কোনো প্রকার কমপ্লেইন না আসাটা নিশ্চিত করতে হয়।

ফুডপান্ডা তাদের ওয়েবসাইটে যেভাবে রাইডারের জন্য লিখেছে যে আপনিই আপনার কাজের সময় নির্ধারণ করুন, সেটাও আসলে আক্ষরিকভাবে পালন করা যায় না। কারণ, রাইডার নিজের সুবিধামতো দিনের ঠিক কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত  কাজ করবে সেটা নির্ধারণ করতে পারে না। তাকে আসলে ফুডপান্ডার নির্ধারিত সারা দিনের বিভিন্ন শিফটের মধ্য থেকে নিজে কোন কোন শিফটে কাজ করবেন সেটা বেছে নিতে হয়। ব্যাপারটা উন্মুক্ত উত্তরের মতো নয়, ব্যাপারটা বহুনির্বাচনি প্রশ্নের উত্তরের মতো। মানে আপনাকে কোম্পানি নির্ধারিত অপশনগুলোর মধ্য থেকেই বাছতে হবে। নিজে কোনো স্বাধীন অপশন তৈরি করতে পারবেন না। আর ফুডপান্ডার ওয়েবসাইটে এটাকেই বলা হচ্ছে ‘নিজের সুবিধামতো সময় নির্ধারণ’।

শুধু তা-ই নয়, অর্ডার রিসিভ করার ক্ষেত্রেও রাইডারের স্বাধীনতা কেবল হ্যাঁ অথবা না বলার। তিনি একটা এলাকায় যখন থাকেন তখন সেই সময়ে কোন কোন অর্ডার সামনে আছে সেগুলোর সবগুলো তার মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে আসে না। অ্যাপ থেকে তাকে একবারে কেবল একজন কাস্টমারের অর্ডারই পাঠানো হয়। তার শুধু সেটা গ্রহণ অথবা গ্রহণ না করার স্বাধীনতা আছে।

একটা অর্ডার রিসিভ করার জন্য অ্যাপ থেকে রাইডারকে সময় দেওয়া হয় মাত্র ৪৫ সেকেন্ড। ৪৫ সেকেন্ডের মধ্যেই চিন্তা করা শেষ করে রাইডার যদি সেই অর্ডার রিসিভ না করে, তাহলে সেই অর্ডার আরেকজন রাইডারের কাছে চলে যাবে। কোনো রাইডার যদি কোনো কারণে সারা দিনে অন্তত ৩টি অর্ডার রিসিভ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে পরবর্তী কয়েক দিনের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হয় অ্যাপ থেকে। এর মানে হলো, পরবর্তী কয়েকদিন তিনি আর কাজ করতে পারবেন না। আয়ও হবে না। এখন কোনো কারণে রাইডার যদি সাইকেল চালানো অবস্থায় থাকার কারণে অর্ডারের নোটিফিকেশন মিস করেন, কিংবা কোনো কারণে যদি তার মোবাইল ফোনটি হ্যাং করে, তাহলে সেটা ফুডপান্ডার বিবেচনার বিষয় নয়। যা কিছুই হোক, অর্ডার মিস করলে রাইডারের জরিমানা হবেই।

কোনো রাইডার যদি কোনো কারণে সারা দিনে অন্তত ৩টি অর্ডার রিসিভ করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তাকে পরবর্তী কয়েক দিনের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হয় অ্যাপ থেকে। এর মানে হলো, পরবর্তী কয়েকদিন তিনি আর কাজ করতে পারবেন না। আয়ও হবে না।

৪৫ সেকেন্ডের মধ্যে কাস্টমারের অর্ডার রিসিভ করার পর রাইডারকে অ্যাপ দেখে খুঁজে বের করতে হয় যে কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্ট থেকে অর্ডারটি পিকআপ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে রাইডারের যেমন অর্ডারের নোটিফিকেশন আসে, তেমনি হোটেল বা রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছেও একই রকম অর্ডার নোটিফিকেশন আসে। তিনি তখন ওই খাবার কতক্ষণের মধ্যে তৈরি হবে তার একটা সময় দেন। রাইডারকে কাস্টমারের অর্ডার রিসিভ করার পর তখন ওই হোটেল বা রেস্তোরাঁর নিচে গিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয়। খাবারটি প্রস্তুত হয়ে গেলে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ অ্যাপের মাধ্যমে রাইডারকে মেসেজ পাঠায় খাবারটি পিক আপ করার জন্য।

রাইডার খাবারটি পিক আপ করার পর তাকে একটা ছবি তুলে সেটা ফুডপান্ডা অ্যাপের মাধ্যমে ফুডপান্ডার কাছে পাঠাতে হয়। ফুডপান্ডা তাকে একটা ডেলিভারি টাইম দেয়। এরপর সে কাস্টমারের লোকেশনে যাত্রা শুরু করে এবং ফুডপান্ডার নির্ধারিত ডেলিভারি টাইমেই অর্ডারটি ডেলিভারি দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। যে কারণেই হোক, রাস্তা কাটা থাকুক কি ম্যাপে লোকেশন ভুল থাকুক, অর্ডার ডেলিভারি দিতে দেরি হলে সেটা রাইডারের জন্য খারাপ পারফরম্যান্স হিসেবে বিবেচনা করে ফুডপান্ডা অ্যাপ।

রাস্তা কাটা থাকুক কি ম্যাপে লোকেশন ভুল থাকুক, অর্ডার ডেলিভারি দিতে দেরি হলে সেটা রাইডারের জন্য খারাপ পারফরম্যান্স হিসেবে বিবেচনা করে ফুডপান্ডা অ্যাপ।

কাস্টমারের কাছে অর্ডার ডেলিভারি দেওয়ার পর সেখানেও আগে একটা ছবি তুলে সেটা ফুডপান্ডাকে পাঠাতে হয় অ্যাপের মাধ্যমে। যদি কাস্টমার নগদ টাকায় মূল্য পরিশোধ করেন, তাহলে কাস্টমারের কাছ থেকে অর্ডারের দামটা সংগ্রহ করে রাইডার। কাস্টমার অনলাইনে টাকা পরিশোধ করলে রাইডার শুধু ছবি তুলেই অ্যাপে ড্রপ অফ বাটনে চাপ দিয়ে চলে আসেন।

এখন কাস্টমারের দেওয়া নগদ অর্থ রাইডারের কাছে যে জমা হতে থাকে সেটার একটা সীমা আছে। রাইডারের কাছে কাস্টমারের দেওয়া নগদ অর্থ ২০০০ টাকা পর্যন্ত জমে গেলেই অ্যাপ থেকে রাইডারের কাছে নির্দেশ আসে ৪০ মিনিটের মধ্যে সেই টাকা ফুডপান্ডার কাছে পাঠানোর জন্য। ফুডপান্ডার কাছে টাকা পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত হয় সাধারণ বিকাশ করার দোকানগুলোই। তবে টাকাটা বিকাশে পাঠানো হয় না। ফুডপান্ডার বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করেই সেই টাকা রাইডারের কাছ থেকে নিয়ে ফুডপান্ডার অ্যাকাউন্টে জমা করেন দোকানদার। আবার সব বিকাশের দোকানে ফুডপান্ডার কাছে টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা থাকে না। প্রতি এলাকায় এ রকম অল্প কিছু নির্ধারিত দোকান আছে যেখান থেকে এই টাকা পাঠানো যায়। এখন রাইডার যদি কোনো কারণে ওই ৪০ মিনিটের মধ্যে ফুডপান্ডাকে টাকা পাঠাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে সাসপেন্ড করে রাখা হয়। মানে তিনি আর তখন কোনো অর্ডার পাবেন না। পরবর্তীতে যখনই তিনি ফুডপান্ডাকে টাকাটা পাঠাতে পারেন, একমাত্র তখনই সাসপেনশন তুলে নেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো কারণে দেখা যায় যে এলাকার ওই নির্ধারিত দোকানটি বন্ধ বা অন্য কোনো সমস্যা হয়েছে যার কারণে টাকা পাঠানো যাচ্ছে না, তাহলে সব দায়-দায়িত্ব রাইডারের। ফুডপান্ডা শুধু তাকে সাসপেন্ড করে রাখবে।

ফুডপান্ডা নিজের আয় বুঝে পেতে রাইডারকে মাত্র ৪০ মিনিট সময় দিলেও রাইডারের আয় বুঝে পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় এক সপ্তাহ! অর্ডার প্রতি রাইডার যে টাকাটা আয় করলেন সেটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে পান না। এক সপ্তাহ ধরে অর্ডার ডেলিভারি দিয়ে রাইডার যে আয় করেন, এক সপ্তাহ পর অ্যাপের মাধ্যমে সেই টাকাটা তার অনলাইন ওয়ালেটে জমা করে ফুডপান্ডা।

ফুডপান্ডা নিজের আয় বুঝে পেতে রাইডারকে মাত্র ৪০ মিনিট সময় দিলেও রাইডারের আয় বুঝে পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় এক সপ্তাহ! অর্ডার প্রতি রাইডার যে টাকাটা আয় করলেন সেটা তিনি সঙ্গে সঙ্গে পান না। এক সপ্তাহ ধরে অর্ডার ডেলিভারি দিয়ে রাইডার যে আয় করেন, এক সপ্তাহ পর অ্যাপের মাধ্যমে সেই টাকাটা তার অনলাইন ওয়ালেটে জমা করে ফুডপান্ডা। এখন এক সপ্তাহ পর যেদিন রাইডারের ওয়ালেটে তার গত সপ্তাহের আয় ঢোকে, সেটা যে তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো সঙ্গে সঙ্গেই নগদ টাকা হিসেবে তুলে ফেলতে পারবেন ঘটনাটা এমন নয় কিন্তু। তাকে সেই টাকাটা ওঠাতে হয় পরবর্তী সপ্তাহে কাজ করে। অর্থাৎ, পরবর্তী সপ্তাহে তিনি যখন অর্ডার ডেলিভারি দেবেন তখন কাস্টমার যে নগদ টাকা দেবেন সেই টাকা থেকে তার আগের সপ্তাহের আয় তিনি কেটে রেখে বাকি টাকাটা ফুডপান্ডায় জমা করবেন। এখন এই যে তার আগের সপ্তাহের আয়ের টাকা ভাঙাতে তাকে আবার পরবর্তী সপ্তাহে নতুন করে কাজ করতে হলো, সেই কাজ বাবদ তার যে নতুন আয় হলো, সেটা আবার তিনি ভাঙাতে পারবেন এর পরের সপ্তাহে আবার নতুন করে কাজ করে। এভাবে সারাক্ষণই তার আয় আটকে রেখে তাকে শিকলে আটকে রাখার একটা সুচতুর ধান্দা করেছে ফুডপান্ডা। ধরা যাক, কোনো ১ নম্বর ব্যাচের রাইডার প্রতিদিন গড়ে ৯-১০ ঘণ্টা খেটে এক সপ্তাহে ৩৫০০ টাকা আয় করলেন। এর মানে হলো, পরবর্তী সপ্তাহে প্রথম অর্ডারটাতেই যদি ৩৫০০ টাকার খাবার থাকে এবং সেটা নগদে পরিশোধ করে কাস্টমার, তাহলে পরবর্তী সপ্তাহে তিনি প্রথম অর্ডার ডেলিভারি করেই তার আগের সপ্তাহের আয় উঠিয়ে ফেলতে পারবেন। তবে বাস্তবে এমন হয় খুব কম। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের বেশিরভাগেরই সারা দিনের অর্ডারের গড় মূল্যমান ছিল অর্ডারপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকার মতো। তার মানে হলো, উক্ত ১ নম্বর ব্যাচের রাইডারকে তার আগের সপ্তাহের টাকা তোলার জন্য অন্তত ৭-৮টা অর্ডার ডেলিভারি করতে হবে পরবর্তী সপ্তাহে যেখানে কাস্টমার নগদ টাকা দেবেন। এখন এই ৭-৮ অর্ডারে যদি তার গড়ে ৩৫ টাকা করে জমা হয়, তাহলে এই আগের সপ্তাহের আয় ভাঙানোর জন্য নতুন করে ২৪৫-২৮০ টাকা আবার ফুডপান্ডার কাছে আটকে গেল।

আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের বেশিরভাগেরই সারা দিনের অর্ডারের গড় মূল্যমান ছিল অর্ডারপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকার মতো। তার মানে হলো, উক্ত ১ নম্বর ব্যাচের রাইডারকে তার আগের সপ্তাহের টাকা তোলার জন্য অন্তত ৭-৮টা অর্ডার ডেলিভারি করতে হবে পরবর্তী সপ্তাহে যেখানে কাস্টমার নগদ টাকা দেবেন।

কাস্টমার অনেক সময় অর্ডার দেওয়ার পর অর্ডার ক্যানসেল করেন। যদি রাইডার অর্ডার হোটেল থেকে পিক আপ করার পর তিনি অর্ডারটি ক্যানসেল করেন কোনো কারণে, তাহলে ওই কাস্টমার অর্ডার ক্যানসেল করার পরও রাইডারকে প্রথমে আগে ওই কাস্টমারের লোকেশনে যেতে হয়। এরপর সেই লোকেশন থেকে অ্যাপে মেসেজ পাঠাতে হয় যে অর্ডারটি ক্যানসেল করেছেন কাস্টমার, যাতে জিপিএসে ট্র্যাক করা যায়। তারপর সেই ক্যানসেল হওয়ার খাবারটি নিয়ে সাইকেল চালিয়ে সেই খাবার জমা দিয়ে যেতে হয় ফুডপান্ডার লোকাল অফিসে। আমি যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা মুগদা, মান্ডা থেকে খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা অঞ্চলের রাইডার। তাদের জন্য ফুডপান্ডার লোকাল অফিস হলো মালিবাগ কমিউনিটি সেন্টারের পাশে। এবং বাতিল হওয়া অর্ডারের জন্য কোনো ডেলিভারি ফি- কেউ বলেছেন একেবারেই পাননি, আবার কেউ বলেছেন যে ডেলিভারি ফির ১০-২০% পেয়েছেন। অর্থাৎ, অর্ডার ক্যানসেল হলে বলতে গেলে প্রায় পুরোটাই তাকে দিয়ে অযথা বেগার খাটিয়ে নেয় ফুডপান্ডা!

নিজের টাকায় কেনা সাইকেল আর মোবাইল ফোন তো থাকতে হয়ই নিবন্ধন করার জন্য, নিবন্ধনের পর কাজ শুরু করার জন্য ফুডপান্ডার লোগো বসানো ব্যাগ আর টি-শার্টটিও ফুডপান্ডার কাছ থেকে রাইডারকে কিনে নিতে হয়। ব্যাগের দাম ২২০০ টাকা। আর টি-শার্টগুলো ৩০০ টাকা করে প্রতিটি। ব্যাগ যদি ছিঁড়ে যায় কিংবা নষ্ট হয়, তাহলে সেটা আবার রাইডারকে কিনে নিতে হবে ফুডপান্ডার কাছ থেকেই। তারা রাইডারকে সেটা রিপ্লেস করে দেবে না বিনা মূল্যে।

ফুডপান্ডার লোগো বসানো ব্যাগ আর টি-শার্টটিও ফুডপান্ডার কাছ থেকে রাইডারকে কিনে নিতে হয়। ব্যাগের দাম ২২০০ টাকা। আর টি-শার্টগুলো ৩০০ টাকা করে প্রতিটি। ব্যাগ যদি ছিঁড়ে যায় কিংবা নষ্ট হয়, তাহলে সেটা আবার রাইডারকে কিনে নিতে হবে ফুডপান্ডার কাছ থেকেই।

রাইডিংয়ের সময় ব্যাগ থাকা এবং টি-শার্ট পরা দুটোই বাধ্যতামূলক। কোনো রাইডার যদি টি-শার্ট ছাড়া ডিউটির সময় রাস্তায় থাকে এবং তাকে ফুডপান্ডার কোনো সুপারভাইজার দেখে ফেলে, তাহলে গোপনে তার ছবি তুলে রাখা হয় এবং সেটা লোকাল অফিসে জমা দেওয়া হয়। তখন ছবির সঙ্গে রাইডারের নাম-ঠিকানা মিলিয়ে তাকে জরিমানা হিসেবে কয়েক দিনের জন্য সাসপেন্ড করে রাখা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কোনো রাইডার হয়তো টাকার অভাবে মাত্র ১টাই টি-শার্ট কিনেছে এবং তার সেই টি-শার্টটি ময়লা হয়ে যাওয়ায় ধুয়ে শুকাতে দিয়ে এসেছে বাসায়, ফলে সে তখন টি-শার্ট ছাড়া ডিউটিতে গেলে যদি সুপারভাইজারের সামনে পড়ে, তাহলে জরিমানা গুনতে হয় তাকে। এবং এ ধরনের বহু ঘটনা রাইডারদের সঙ্গে হয়েছে।

ফুডপান্ডায় কাজ করতে হলে রাইডারকে প্রতিটি অর্ডার ডেলিভারির জন্যই কাস্টমারের সঙ্গে ফোন দিয়ে কথা বলতে হয়। সেই ফোনের বিল এবং অ্যাপ চালানোর জন্য যে ইন্টারনেট ব্যবহার হয় সেই মোবাইল ডাটার বিল ফুডপান্ডা বহন করে না। সেটা রাইডারকেই বহন করতে হয়। অন্যদিকে নিয়মিত সাইকেল চালানোর জন্য সাইকেলের পেছনে মাসে যে মেরামত বা সার্ভিসিং খরচ আছে, সেটাও রাইডারকেই বহন করতে হয়।

ফুডপান্ডা তাদের ওয়েবসাইটে বড় করে ইন্স্যুরেন্স সুবিধার কথা লিখে রাখলেও বাস্তবে রাইডাররা জানিয়েছেন যে তারা কখনোই এমন কিছু শোনেননি। শুধু তা-ই নয়, সাইকেল চালাতে গিয়ে ছিনতাইয়ের কবলে পড়া, সাইকেল চুরি হওয়া এবং নিয়মিত দুর্ঘটনায় পড়ার কথাও রাইডাররা জানিয়েছেন। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই সব দায়-দায়িত্ব রাইডারকে বহন করতে হয়। ফুডপান্ডা এখানে কোনো দায়-দায়িত্ব নেয় না।

ফুডপান্ডা তাদের ওয়েবসাইটে যদিও লিখেছে যে ১৮ বছরের নিচে তারা কাউকে নেয় না, বাস্তবে শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক রাইডার কাজ করে ফুডপান্ডায়। আমি আমার গবেষণা চলাকালেই মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে দুজন পেয়েছি শিশু রাইডার। 

রাইডারদের সঙ্গে কথা বলে পাঠাওয়ের যেসব নিয়মকানুন সম্পর্কে জানা যায়

রাইডারদের জন্য পাঠাওয়ের নিয়ম আর ফুডপান্ডার নিয়ম প্রায় একই। তবে কয়েকটি জায়গায় পার্থক্য আছে। পাঠাও রাইডারদের কোনো ব্যাচ নেই। রাইডাররা ডেলিভার প্রতি ৬০ টাকা করে পান সব মিলিয়ে। এদিকে পাঠাওয়ের ক্ষেত্রে রাইডারকে নিজেদের টাকা দিয়ে কাস্টমারের অর্ডার করা খাবার হোটেল থেকে কিনে নিতে হয়। ফলে তাদের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের আয় এক সপ্তাহের জন্য আটকে থাকে না ফুডপান্ডার মতো। তারা নিজেরা নগদ টাকা দিয়ে খাবার কিনে কাস্টমারের কাছে তার ডেলিভারি ফি, পাঠাওয়ের কমিশনসহ নগদ টাকা বুঝে নেন। পাঠাওয়ের কমিশনটা তারা পরে পাঠাওকে পাঠিয়ে দেন। অর্থাৎ, তাদের প্রতিদিনের আয় তারা প্রতিদিনই বুঝে পান। তবে এ ক্ষেত্রে যেটা লক্ষণীয় তা হলো, রাইডারকে অন্তত ৩-৫ হাজার টাকা ক্যাশ হাতে নিয়ে প্রতিদিন বের হতে হয়। পাঠাও রাইডারদের ক্ষেত্রে খাবার পিকআপ করার পর অর্ডার ক্যানসেল হলে নিয়ম হচ্ছে সেই অর্ডারটা আবার তারা হোটেলে ফিরিয়ে দিয়ে যান। এবং সেটার জন্য কোনো ধরনের ডেলিভারি চার্জ তারা পান না। শিশু রাইডার নেওয়া হবে না এমন কোনো কথা পাঠাওয়ের ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পাঠাওয়ের ক্ষেত্রে রাইডারকে নিজেদের টাকা দিয়ে কাস্টমারের অর্ডার করা খাবার হোটেল থেকে কিনে নিতে হয়। ফলে তাদের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের আয় এক সপ্তাহের জন্য আটকে থাকে না ফুডপান্ডার মতো।

অনলাইন ফুড ডেলিভারি শ্রমিকের আয় এবং সেই আয় করতে গিয়ে তার প্রতিদিনের লুকানো ব্যয়

যে ১৫ জন রাইডারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে তাদের মধ্যে দুজনের বয়স ছিল ১৬-১৭ বছর (এরা ফুডপান্ডার রাইডার), ১০ জনের বয়স ছিল ১৮ থেকে ২৭ বছরের মধ্যে। আর তিনজনের বয়স ছিল ৪০ থেকে ৪২ বছরের মধ্যে। এই রাইডারদের মধ্যে তিনজন পাঠাওয়ের রাইডার আর বাকিরা ফুডপান্ডার। ফুডপান্ডার ওই ১২ জন রাইডারের মধ্যে ১ নম্বর ব্যাচের রাইডার ছিলেন ৪ জন, ২ নম্বর ব্যাচের রাইডার ছিলেন ২ জন। ৩ নম্বর ব্যাচের রাইডার ছিলেন চারজন এবং ৪ ও ৬ নম্বর ব্যাচের রাইডার ছিলেন ১ জন করে। এই রাইডারদের মধ্যে ৫ জনের মাসিক গড়পড়তা আয় ৬০০০ থেকে ৯০০০-এর মধ্যে। আরও ৫ জনের মাসিক আয় ১১ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে। আর বাকিদের মাসিক আয় এর উপরে। তবে এদের মধ্যে একজন কেবল বলেছেন যে মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় করেন। বাকিদের মাসিক আয় এর নিচে।

রাইডারদের মধ্যে ৫ জনের মাসিক গড়পড়তা আয় ৬০০০ থেকে ৯০০০-এর মধ্যে। আরও ৫ জনের মাসিক আয় ১১ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে। আর বাকিদের মাসিক আয় এর উপরে। তবে এদের মধ্যে একজন কেবল বলেছেন যে মাসে অন্তত ২০ হাজার টাকা আয় করেন।

এই রাইডারদের মধ্যে ২ জন ছিলেন যারা সপ্তাহে নিয়মিতভাবে ১ দিন করে ছুটি নেন। বাকিরা মাসে ৩০ দিনই কাজ করেন। তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় অন্যান্য প্রশ্নের পাশাপাশি সবাইকেই কতগুলো সাধারণ প্রশ্ন করা হয়েছিল: দিনে কয় ঘণ্টা কাজ করেন, মাসে কয়দিন কাজ করেন, দৈনিক আয়, মাসিক আয় কত, মাসিক মোবাইল ও ইন্টারনেট বিল কত, মাসিক সাইকেল মেরামতের পেছনে খরচ কত। এগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেই তাদের বলা হয়েছিল একটা গড়পড়তা হিসাব দিতে। কারণ, একদম হুবহু তারা নিজেদের আয়-ব্যয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব রাখেন না। তবে তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই তারা উত্তর দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, প্রত্যেক রাইডারের সঙ্গেই আলাদা আলাদা করে কথা বলা হয়েছে। তাদের দেওয়া এই সাধারণ তথ্যগুলো থেকে তাদের প্রতিদিনকার আয় এবং শুধু ওই আয়টুকু করার জন্য প্রতিদিন তাকে কী কী ব্যয় করতে হয় সেটার একটা চিত্র পাওয়া যায়। সারণি-১ সেই চিত্রটাই উপস্থাপন করছে। লক্ষ রাখতে হবে যে, এখানে যে ব্যয়টা দেখানো হচ্ছে সেটা কিন্তু তার মাসিক থাকা-খাওয়া-চলার খরচ নয়।

প্রত্যেক রাইডার দিনে গড়ে কত ঘণ্টা কাজ করেন সেটার ভিত্তিতে তার ওই কাজ করতে গিয়ে দৈনিক কত ক্যালরি খরচ হয়, সেটাও এখানে বের করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের ক্যালরি খরচের হিসাব দেখানো হয়েছে।

প্রত্যেক রাইডার দিনে গড়ে কত ঘণ্টা কাজ করেন সেটার ভিত্তিতে তার ওই কাজ করতে গিয়ে দৈনিক কত ক্যালরি খরচ হয়, সেটাও এখানে বের করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের ক্যালরি খরচের হিসাব দেখানো হয়েছে। প্রথম হিসাবটি করা হয়েছে ব্রিটিশ স্পোর্টস সায়েন্স ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞ জেন ওয়েকের করা একটা ক্যালরি হিসাবকে ধরে। তিনি ২০১৯ সালে ব্রিটেনের অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানি ডেলিভারুর সাইকেল রাইডারদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে হিসাব করে দেখিয়েছিলেন যে, ৭০ কেজি ওজনের একজন ফুড ডেলিভারি সাইকেল রাইডারকে প্রতি ঘণ্টায় ১০৮০ ক্যালরি খরচ করতে হয়। যেটি অন্যান্য পেশার থেকে অনেক বেশি। এমনকি তিনি তার সঙ্গে অগ্নিনির্বাপণ কর্মীদের প্রতি ঘণ্টায় ক্যালরি পোড়ার হিসাবের তুলনাও করেছিলেন। দেখা গেছে, একই ওজনের অগ্নিনির্বাপণকারী কর্মীদের ঘণ্টায় ৮৪৫ ক্যালরি খরচ করতে হয়। এ বিষয়ে ২০১৯ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। জেন ওয়েকের সেই ৭০ কেজির ব্যক্তির ক্যালরি খরচকে এখানে ৬০ কেজি ব্যক্তির জন্য কনভার্ট করে হিসাব করা হয়েছে। তাতে সেটি হয় ঘণ্টায় ৯২৬ ক্যালরি। উল্লেখ্য, রাইডারদের ক্যালরি খরচের হিসাব করার সময় জেন ওয়েক শুধু তাদের সাইকেল চালানোকেই হিসাবে ধরেননি, তিনি হিসাবে ধরেছেন একজন রাইডারকে ফুড ডেলিভারি দিতে গিয়ে যা যা করতে হয় তার প্রতিটি শারীরিক কর্মকাণ্ডই। ফলে ২য় কলামের শ্রমঘণ্টার সঙ্গে ৯২৬ কে গুণ দিয়ে রাইডারের দৈনিক ক্যালরি খরচ বের করা হয়েছে। এটিকে নিচের সারণিতে ক্যালরি খরচের অরক্ষণশীল হিসাব বলে অভিহিত করা হয়েছে। (সারণির কলাম ৩)

ক্যালরি খরচের দ্বিতীয় আনুমানিক হিসাবটি করা হয়েছে রক্ষণশীলভাবে। এ ক্ষেত্রে রাইডারদের সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কতগুলো বিষয়কে গড়পড়তা হিসাবে ধরা হয়েছে। রাইডারদের কথার ভিত্তিতে ধরে নেওয়া হয়েছে, তারা এক ঘণ্টার মধ্যে গড়ে ১-২টা অর্ডার পান। তার মানে ১ ঘণ্টার মধ্যে ওই ১-২টা অর্ডার ডেলিভারি দেওয়ার জন্য সাইকেল দিয়ে আসা-যাওয়া করতে তার অন্তত ৩০ মিনিট ব্যয় হয় (এ জন্য খরচ হয় ৩০০ ক্যালরি)। খাবার ডেলিভারি বাবদ এক ঘণ্টার মধ্যে গড়ে অন্তত পাঁচ মিনিট তাকে ব্যয় করতে হয় সিঁড়ি ভাঙতে (এ জন্য খরচ হয় ৪৬ ক্যালরি)। খাবারের অর্ডারটি পিকআপ করার জন্য এক ঘণ্টার মধ্যে ২০ মিনিট তিনি বিভিন্ন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন (এ জন্য খরচ হয় ৩২ ক্যালরি)। এবং পাঁচ মিনিট তিনি ফুটপাতে বসে থাকেন (এ জন্য খরচ হয় প্রায় ১৮ ক্যালরি)। সবকয়টি ক্যালরি যোগ করলে দেখা যাচ্ছে, প্রতি ঘণ্টায় একজন ফুড ডেলিভারি সাইকেল রাইডার ৩৯৬ ক্যালরি খরচ করেছেন।  এই ২য় হিসাবের ভিত্তিতে দৈনিক যে ক্যালরি খরচ বের করা হয়েছে সেটিকে নিচের সারণিতে ক্যালরি খরচের রক্ষণশীল হিসাব বলা হয়েছে। (সারণির কলাম ৪)

খরচ হওয়া ক্যালরির বাজারমূল্য নির্ধারণ করার জন্য প্রথমে মোটামুটি ২০০০ ক্যালরির জোগান দিতে পারে এমন একটা সাদামাটা খাদ্যঝুড়িকে ঠিক করা হয়েছে। এই খাদ্যঝুড়িতে রয়েছে দুই প্লেট ভাত, ১০০ গ্রাম মাছের তরকারি, দুই কাপ মসুর ডাল, একটা ডিম পোচ, দুই কাপ সবজি ভাজি এবং একটা কলা। এ ক্ষেত্রে ক্যালরির দামটি সস্তা রাখার জন্য ইচ্ছা করেই কোনো মাংস বা দামী খাবার যেগুলোতে উচ্চ ক্যালরি রয়েছে সেটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যাই হোক, সেই ২০০০ ক্যালরির খাদ্যঝুড়িটির ন্যূনতম বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে সংগত কারণে ওই পরিমাণ খাবার বাসায় রান্না করতে গেলে কত খরচ হতো সেটাকে বিবেচনা করা হয়নি। কারণ, বাসায় ওই খাদ্যঝুড়ি রান্না করতে হলে হয়তো সেটা ২০০ টাকার কমেও আয়োজন করা সম্ভব হতো, কিন্তু সেখানে নতুন করে আরেকবার শ্রম, সময়, জ্বালানি ও ক্যালরি খরচ হতো। ফলে আমরা রাইডারের খরচ হওয়া ক্যালরির প্রকৃত মূল্যটি পেতাম না। এ কারণেই ওই খাদ্যঝুড়ির বাজার মূল্য ধরা হয়েছে। একটা সস্তা হোটেলে এক বেলা ভাত, সাধারণ কোনো মাছ, ডাল, ডিম, সবজি ও দোকান থেকে কলা কিনে খেতে খুব কম দাম হলেও বর্তমানে ২০০ টাকা খরচ পড়ে (আসলে দাম আরও বেশি হবে, এটা রক্ষণশীল হিসাবে ধরা)। ফলে সেই খাদ্যঝুড়ির ন্যূনতম বাজারমূল্য ধরা হয়েছে ২০০ টাকা। এখন রাইডারের দৈনিক ক্যালরি খরচের বাজারমূল্য নির্ধারণ করার জন্য প্রথমে তার দৈনিক ক্যালরি খরচকে ২০০০ দিয়ে ভাগ করে ভাগফলটিকে ওই খাদ্যঝুড়ির বাজারমূল্য অর্থাৎ ২০০ দিয়ে গুণ করা হয়েছে (সারণিতে কলাম ৬ ও ৭)।

খরচ হওয়া ক্যালরির বাজারমূল্য নির্ধারণ করার জন্য প্রথমে মোটামুটি ২০০০ ক্যালরির জোগান দিতে পারে এমন একটা সাদামাটা খাদ্যঝুড়িকে ঠিক করা হয়েছে। এই খাদ্যঝুড়িতে রয়েছে দুই প্লেট ভাত, ১০০ গ্রাম মাছের তরকারি, দুই কাপ মসুর ডাল, একটা ডিম পোচ, দুই কাপ সবজি ভাজি এবং একটা কলা। এ ক্ষেত্রে ক্যালরির দামটি সস্তা রাখার জন্য ইচ্ছা করেই কোনো মাংস বা দামী খাবার যেগুলোতে উচ্চ ক্যালরি রয়েছে সেটাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

ফুড ডেলিভারি করার জন্য প্রতিদিনের যে মোবাইল খরচ, ইন্টারনেটের বিল এবং প্রতিদিন সাইকেল মেরামতের পেছনে যে খরচ হয়েছে সেটি বের করা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে তাদের যে মাসিক খরচ সেখান থেকে। এ ছাড়াও রাইডারকে কাজে থাকাবস্থায় প্রতিদিন কিছু টুকিটাকি চা-নাশতা-সিগারেটের পেছনে খরচ করতেই হয়, যেটা কাজে না থাকলে এভাবে লাগত না, সেই খরচটাকেও একটা গড়পড়তা হিসাবে ধরা হয়েছে।

এভাবে হিসাব করার পর, সারণি ১ থেকে দেখা যাচ্ছে একজন অনলাইন ফুড ডেলিভারি রাইডারের দৈনিক আয় থেকে যদি আমরা তার প্রতিদিনের ক্ষয় হওয়া ক্যালরির বাজারমূল্য, সেই কাজ করতে গিয়ে দৈনিক খরচ হওয়া মোবাইল বিল, ইন্টারনেট বিল, সাইকেল মেরামতের খরচ এবং প্রতিদিনকার কাজে থাকার কারণে টুকিটাকি চা-নাশতার খরচ বাদ দিই তাহলে দেখা যাচ্ছে:

১। ক্যালরি খরচের অরক্ষণশীল হিসাব ধরলে প্রতিটি রাইডারেরই কোনো নিট আয় তো হচ্ছেই না, উল্টো বিপুল পরিমাণে লোকসান হচ্ছে (কলাম ১১)। এই লোকসান হচ্ছে মূলত শরীর ক্ষয়ের আলোকে। অর্থাৎ, রাইডার দৈনিক যত টাকা আয় করছে গিগ অর্থনীতির অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানির কাছ থেকে, সেই টাকা দিয়ে তার নিজের ও পরিবারের সারা দিনের খরচ চালাতে পারা তো দূরের কথা, শুধু ওই কাজ বাবদ তার যে শরীরের ক্ষয় হচ্ছে সেটাও ওই টাকা দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

২। ক্যালরি খরচের রক্ষণশীল হিসাব ধরলে অবশ্য রাইডারদের কিছু নিট আয় থাকছে। তবে সেটা শ্রমঘণ্টার আলোকে অবিশ্বাস্য রকমের কম (কলাম ১২)। এর মানে হচ্ছে রাইডার যত টাকা আয় করছে প্রতিদিন, সেই টাকা দিয়ে যদি সে ওই কাজ করা বাবদ তার নিজের দৈনিক যতটুকু শরীরের ক্ষয় হয় সেটা মেটাতে চায় (রক্ষণশীল ক্যালরির হিসাবে), তাহলে তার দৈনিক অন্যান্য খরচ ও তার পরিবারের খরচ চালানোর জন্য বলতে গেলে কোনো টাকাই আর তার কাছে থাকছে না।

এই যে রাইডারের শরীর ক্ষয়ের মূল্যটাই না ওঠা কিংবা ওঠার পর বলতে গেলে আর কোনো টাকা না থাকা, এই যে রাইডার বা শ্রমিকের শরীরটাকে সরাসরি চুরি করা, এটাই হচ্ছে খ্যাপ মারা অর্থনীতি বা গিগ অর্থনীতির এসব ‘স্মার্ট’, ‘নতুন দিনের সূচনাকারী’ অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানির মুনাফার আসল ভিত্তি। যদিও তারা ঘোষণা দিয়ে বেড়ায় যে তারা মুনাফা করে মূলত তাদের অ্যাপ ব্যবহার করে রেস্তোরাঁয় যে খাবারের অর্ডার যায় সেটা থেকে কমিশন আর প্ল্যাটফর্ম চার্জ কেটে রাখার মাধ্যমে। (চলবে…)

মাহতাব উদ্দীন আহমেদ: লেখক, গবেষক | ই-মেইল: mahtabjuniv@gmail.com

তথ্যসূত্র:

১. Sameer Hasija, V. “Paddy” Padmanabhan, and Prashant Rampal : ‘Will the Pandemic Push Knowledge Work into the Gig Economy?’ Harverd Business Review, 1 June , 2020.

২. Tina Brown: ‘The Gig Economy’, Daily Beast, 12 Jan 2009.

৩. Emma Charlton: ‘What is the gig economy and what’s the deal for gig workers?’ World Economic Forum Website, 26 May 2021.

৪. Nick Srnicek: Platform Capitalism, Polity Press, 2007

৫. https://data.worldbank.org/indicator/SL.UEM.TOTL.ZS

৬. Jamie Woodcock and Mark Graham: The Gig Economy A Critical Introduction , Polity Press, 2020.

৭. ‘Bicycle Courier Is The Job That Burns Most Fat, Finds Fitness Guru’, Forbes, 14 January 2019.

৮. ক্যালরির হিসাবগুলো নেওয়া হয়েছে https://www.omnicalculator.com/sports/calories-burned ওয়েবসাইট থেকে

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •