২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৮
পুঁজির দুর্বৃত্তায়ন, দুর্বৃত্তায়িত পুঁজি
মেহেদী হাসান
বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ উল্লেখযোগ্য আকার নিয়েছে। এই বিকাশধারায় একদিকে তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের ২২ পরিবারের চেয়েও সম্পদশালী বেশ কিছু গোষ্ঠী, অন্যদিকে বৈষম্য ও পরিবেশবিধ্বংসী তৎপরতাও অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ‘উন্নয়ন’ ধারার স্বরূপ বিশ্লেষণ, পুঁজির কেন্দ্রীভবনের ধরন, শ্রেণিবিন্যাস, এই ধারার পুঁজিবাদ বিকাশে রাষ্ট্রের ভূমিকা ইত্যাদি পরীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান প্রবন্ধ কয়েক কিস্তিতে এই অনুসন্ধান বিশ্লেষণ হাজির করছে। অষ্টম কিস্তিতে অনুৎপাদনশীল উপায়ে (আদিম সংবর্ধন প্রক্রিয়ায়) ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণে সরকার এবং রাষ্ট্রের ভূমিকার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে।
‘‘Capitalism is the elephant in the room which right-wing authoritarianism and fascism’s supporters either do not see and many of them do not want to see, because they believe in capitalism’s key principles and accept the ideological justifications of inequality.’’ – Simon Mohun[1]
যা সর্বজনের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ছিল না, কিন্তু…?
১৯৭৫ সালের পর থেকে একটি দীর্ঘ সময় (১৯৯০ সাল পর্যন্ত) বাংলাদেশ সরাসরি সামরিক শাসনের অধীন ছিল। সামরিক সরকারের শাসনামলে ব্যক্তিপুঁজির সংবর্ধন প্রক্রিয়ায় বিশেষ উল্লম্ফন ঘটে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে এই পুঁজি পুঞ্জীভূত, কেন্দ্রীভূত হয় মধ্যবিত্তের একটি অংশের হাতে, যারা সে সময় সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল। সামরিক শাসনক্ষমতা দখল করে এই পুঞ্জীভূত কেন্দ্রীভূত ব্যক্তিপুঁজির পক্ষের বৈধতা দান করে এবং সমাজে একটি শক্তিশালী জায়গা করে দেয়। যুদ্ধোত্তর পর্বের নির্মিত অসম্পূর্ণ (পুঁজি(গণ)তান্ত্রিক বিন্যাসের প্রেক্ষিতে) রাষ্ট্রকে ব্যক্তিপুঁজি সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে পুনর্বিন্যস্ত করে সরকার (প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য উপায়ে)। প্রথমাবস্থায় রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে শিল্পায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হলেও দর্শন-নীতি-পরিকল্পনার সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতার কারণে ভেতর থেকেই তা দুর্বল হতে থাকে। এরই ফাঁকফোকর দিয়ে দেশি-বিদেশি পুঁজি কেন্দ্রীভবন-পুঞ্জীভবনের শর্ত তৈরি হয়। সরকার রাষ্ট্রকে এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করার প্রয়াস পায়, যাতে দেশি পুঁজি আন্তর্জাতিক পুঁজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হতে পারে। বিপরীত দিক থেকে বললে, বাংলাদেশের ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের এমনসব শর্ত তৈরি করে, যাতে বিদেশি রাষ্ট্র, পুঁজি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌল উপাদান এবং উপরিকাঠামোর (রাজনীতি, সংস্কৃতি) ওপর আধিপত্য-কর্তৃত্ব করতে পারে। সর্বজনের দিক থেকে ‘মুক্ত, স্বাধীন এবং সার্বভৌমত্বের চেতনা’র বিপরীতে দেশি-বিদেশি পুঁজির মুক্ত, স্বাধীন এবং সার্বভৌম বিকাশের যাবতীয় পরিকল্পনা-প্রক্রিয়া তৈরি করে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকার। জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং তার পরবর্তী শাসনামলে এই ধারা অব্যাহত থাকে।
সমাজে লুম্পেন পুঁজির শক্তিশালী অবস্থান, সর্বজনের শোভন (decent) জীবন ও মর্যাদার অবদমন এবং পুঁজির প্রক্রিয়ার আদলে রাষ্ট্রের পুনর্বিন্যাস পরস্পর সম্পর্কিত বিষয়। কোন পরিপ্রেক্ষিতে এবং কী ধরনের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রের এই পুনর্বিন্যাস সম্ভবপর হয়েছিল, সে বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। দরকার পুঁজির ‘নয়া উদারনৈতিক’ দৃষ্টিভঙ্গির আদলে রাষ্ট্রকে সাজানোর (জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই প্রক্রিয়া দ্রুতগতিসম্পন্ন হয়) এবং বাংলাদেশে লুম্পেন পুঁজির আধিপত্যের পূর্বশর্ত বিচার করা। স্থানীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আন্তর্জাতিক পুঁজির যোগসাজশ-সম্পর্ক মূল্যায়ন করা। পরবর্তী অধ্যায়ে সেসব পর্যালোচনা করা হবে।
১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রদর্শনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে।[2] তবে এই পরিবর্তন প্রধানত পরিমাণগত। অর্থাৎ এই পরিবর্তনে পূর্বতন পুঁজির সংবর্ধন-সম্পর্কের ধারাবাহিকতাই বজায় রাখা হয়। রাষ্ট্রীয় পুঁজির স্থলে ব্যক্তিপুঁজির সম্প্রসারণের পথ পরিষ্কারের নানাবিধ আয়োজন করা হয়। নানা স্লোগানের আড়ালে একদলীয়/একনায়কতান্ত্রিক শাসনের আধিপত্য কায়েম হয়। এই পরিবর্তন সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন বলছেন,
‘সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ শাসনতন্ত্র থেকে বর্জিত হয়। এর আগেই অবশ্য ‘বাকশাল’ সৃষ্টির মাধ্যমে একদলীয় প্রশাসন কায়েম করে – যা ছিল মুখ্যত জুলিয়াস নায়েরের তানজানীয় সমাজতন্ত্রের অনুকরণ – শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সামাজিক অর্থনীতিকে সংহত করার যে প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন, তার ফলে সংবিধানাশ্রিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিলোপ হয়েছিল।’[3]
পরবর্তী সময়ে,
‘১৯৭৫ সালে সামরিক শাসনের সূচনা হওয়ার পর সামরিক শাসকরা রাষ্ট্রখাতের ভূমিকা কমিয়ে ব্যক্তিখাতে শিল্পায়নের নামে রাষ্ট্রযন্ত্র বা রাষ্ট্রক্ষমতার নৈকট্যধন্য কতিপয় ব্যক্তিকে – প্রায় হাজার পাঁচেক ব্যক্তিকে (কোটি টাকার মালিকমাত্রকেই ধরলে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় দশ থেকে বারো হাজার হবে) – রাষ্ট্রানুকূল্যে, রাষ্ট্রের অর্থে ব্যক্তিবিত্তের যে অমেয় ভান্ডার সৃষ্টির এবং নির্বিঘ্নে অবাধ লুণ্ঠন অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তার ফলে বাংলাদেশ উঞ্ছ-উন্নয়নের (Lumpen development) যে নিগড়ে আবদ্ধ হলো, তার থেকে কবে কোন বিপ্লবের মাধ্যমে তার মুক্তি ঘটবে তা বলা সুকঠিন।’[4]
একদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ভাঙন, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তিখাতের গড়নের বিস্তৃত আয়োজন সম্ভব হয়েছিল ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর ‘উদার’ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ইউএসএইডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রণীত নীতিমালার গভীর এবং জৈবিক সম্পর্ক রয়েছে এই দৃষ্টিভঙ্গির। এই প্রসঙ্গে আনু মুহাম্মদ বলছেন:
‘রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আয়তনের দিক থেকে এমন বৃহৎ ছিল যে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর গতিধারা বেসরকারি খাতসহ সমগ্র অর্থনীতির গতিধারা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ধারক ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং সেই সঙ্গে ব্যাংক, বীমাসহ অর্থকরী প্রতিষ্ঠান, পানি-বিদ্যুৎ-টেলিফোনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা যেভাবে দাঁড় করানো হয়, তাতে খুব দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানে একদিকে ক্ষমতার অপচয় হতে থাকে, অন্যদিকে সম্পদ পাচার ও লুণ্ঠনের নানা পথ তৈরি হয়। এর ফলাফল হলো: দ্রুত এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর দাঁড়িয়ে অর্থাৎ জনগণের সম্পদের ওপর দাঁড়িয়ে নতুন বিত্তবান শ্রেণি সংহত রূপ নিতে থাকে, যাদের অর্থসম্পদ উপার্জন আইনব্যবস্থায় বৈধ ছিল না।
কাজেই যাকে আমরা জানি রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের লোকসান হিসেবে, তা প্রকৃত বিচারে বলা চলে বরাবরই নতুন বিত্তবান শ্রেণি গঠনের রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি। মূলত রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন আত্মসাৎ করেই এই শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এই বিত্তবান শ্রেণি গড়ে ওঠার লক্ষণ সত্তরের দশকের প্রথমার্ধেই দেখা যায়, আশির দশকে এর বিকাশ হয় সবচেয়ে দ্রুত, যে দশকটি ছিল এ দেশে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সংস্কার কর্মসূচির সফল দশক। এই গড়ে ওঠা সংহত শ্রেণিই বাংলাদেশের পরিচালনার অভ্যন্তরীণ শক্তি।’[5]
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতারোহণের পর ব্যক্তিমালিকানানির্ভর অর্থনৈতিক ‘প্রবৃদ্ধি’র ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের বড় ‘কৃতিত্ব’ হলো, তিনি ব্যাপক আকারে রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ব্যক্তিখাতে হস্তান্তর করেন, তার বড় একটি অংশ তুলে দেওয়া হয় পূর্বেকার মালিকসহ নতুন ভুঁইফোঁড় মালিকদের হাতে। অবশ্য আওয়ামী লীগের আমলেই স্বল্প পরিসরে বিরাষ্ট্রীকরণের যাত্রা শুরু হয়। বেসরকারিকরণ এবং ব্যক্তি বিনিয়োগের সিলিং তুলে দেওয়ার মধ্যে একটি বিশেষ যোগ রয়েছে। আনু মুহাম্মদ তার ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ’ বইয়ে এই জৈবিক মৈত্রীবন্ধন সম্পর্কে বলেছেন,
‘জাতীয়করণ করবার সময় ব্যক্তি-উদ্যোক্তার সিলিং ছিল ২৫ লাখ, এরপর ১৯৭৫ সালের মধ্যে তা বেড়ে হয় ৩ কোটি এবং ’৭৫-এ রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগেই তা ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত উন্নীত করা হয়। এই বৃদ্ধিটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাৎপর্যপূর্ণ এই কারণে যে, যে সময় সিলিং বাড়ানো হচ্ছে, সেই সময়ে এই মাত্রায় বিনিয়োগের ব্যক্তিবর্গও ক্রমেই তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৭৫ সালের জুন মাসের মধ্যে ১২০টি জাতীয়করণকৃত প্রতিষ্ঠান বাঙালি মালিকদের হাতে ফেরত দেওয়া হয়েছিল। তবে এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, এসব সিলিংয়ের উচ্চমুখী যাত্রা কিংবা বিরাষ্ট্রীয়করণ বেসরকারি খাতে নতুন শিল্পায়নের আবহাওয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।’[6] ১৯৭৯ সাল নাগাদ শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিখাতে ফেরত দেওয়া হয়। মোট ৭৮৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিটের মধ্যে ১৫৯টি শিল্প-উদ্যোক্তার কাছে ফেরত দেওয়া হয় এবং ২০০টি প্রতিষ্ঠানকে নিলামের মাধ্যমে (সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট বিত্তবান) ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাদবাকি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন রাখা হয়।[7]
এ ছাড়া যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে নামে-বেনামে যারা প্রচুর সম্পদ জমা করে, তাদের সামনে অভূতপূর্ব সুযোগ উপস্থিত হয় যখন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতাবলে পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের নির্ধারিত ব্যক্তি বিনিয়োগের সীমা কার্যত তুলে দেন। আওয়ামী লীগের প্রথম সময়ে রাষ্ট্রীয় খাত নেতৃত্বাধীন অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়া হলেও তার ধারাবাহিকতা পরবর্তী সময়ে বজায় রাখা হয়নি। জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ব্যক্তিখাতনির্ভর (‘নয়া উদারনীতির’) অর্থনীতির ওপর জোর দেওয়া হয়।[8] ’৭৫ সালের পর থেকেই ব্যক্তি বিনিয়োগের পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৩-৭৪ সালে ব্যক্তিখাতে শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ যেখানে ছিল ৮.৭৪ কোটি টাকা, সেখানে ১৯৭৭-৭৮ সালে তার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২০.৯১ কোটি টাকায়।[9] ১৯৮২ সালের দিকে সরকার ভারত অথবা পাকিস্তানের চেয়ে অধিকতর ‘উদারনৈতিক’ শিল্পনীতি গ্রহণ করে।[10] বুর্জোয়া ধারার কর্তৃত্ববাদী সরকার যাবতীয় সংকটের মূলে হাত দেওয়ার বদলে উপরিকাঠামোর দৃশ্যমান সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হয়। এর ফলে মৌলিক সমস্যার যে কোনো সমাধান হয়নি সেটি তৎকালীন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে একটু খতিয়ে দেখলেই উপলব্ধি করা যায়।
১৯৭৪-৭৫ এবং ১৯৭৫-৭৬ সালের অর্থবছরের বার্ষিক বাজেট অনুযায়ী সরকারের ধারণা ছিল যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা থেকে বাড়তি উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন এবং মুনাফা উশুল করা যাবে। সরকারের এই আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্যে ছিল। সরকারের প্রথম শিল্পনীতিতে ধারণা করা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য যেসব করপোরেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাতে দক্ষ এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনাগত চাহিদা পূরণ হবে। এ ধরনের চাহিদা পূরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলো বাজার-কেন্দ্রিক দর্শন। বিদেশি পরামর্শক (Consultant) নিয়োগ দেওয়া হয় বিদ্যমান অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে ‘ব্যাবসাবান্ধব পদ্ধতি’ অনুযায়ী পরামর্শ প্রদানের জন্য। সরকারি সমর্থনে ব্যক্তিখাতের বিকাশের প্রয়োজনে সেই পরামর্শ মোতাবেক বিনিয়োগ নীতি গ্রহণ করা হয়।[11] সরকারের ভেতরে বেসরকারি এবং বিদেশি পুঁজি, রাষ্ট্র বিভিন্ন মাত্রায় সক্রিয় হতে থাকে। পুঁজির জাল বিস্তৃত হয়; বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রয়োজনীয় পথ করে নিতে থাকে নির্বাচিত, অনির্বাচিত, বেসামরিক, সামরিক সরকারের আমলে। বিভিন্ন সরকারের আমলে গৃহীত শিল্পনীতি তারই একধরনের প্রকাশ।
‘‘যে সময় সিলিং বাড়ানো হচ্ছে, সেই সময়ে এই মাত্রায় বিনিয়োগের ব্যক্তিবর্গও ক্রমেই তৈরি হয়েছে’’ – কী উপায়ে? বিনিয়োগ সম্পর্কিত কী ধরনের নীতি-পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল? অনুৎপাদনশীল পুঁজিপতিদের বিকাশে সরকারের ভূমিকা কী? সরকার মূলত কোন শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে? সরকারের সঙ্গে উৎপাদনশীল/অনুৎপাদনশীল পরগাছা ধরনের পুঁজির মালিক শ্রেণির জৈবিক বন্ধন/সম্পর্ক কী প্রকারের? পুঁজির সম্প্রসারণের সঙ্গে ধর্মের ব্যবহারের সম্পর্ক কী? পুঁজির একচেটিয়া প্রবৃদ্ধির ফলে সমাজে কী ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়? এসব প্রশ্নের অনুসন্ধান জরুরি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের আমলের বিভিন্ন সময়ের গৃহীত নীতি-পরিকল্পনা, উৎপাদনশীল পুঁজির ধরন এবং শ্রেণিগত বিন্যাস পূর্ববর্তী অধ্যায়ে অল্পবিস্তর পর্যালোচনা করা হয়েছে। উৎপাদনশীল উপায়ের (পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বর্ণিত) পাশাপাশি অনুৎপাদনশীল পুঁজির বিস্তারের প্রেক্ষিত অনুসন্ধান তাই প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য। নিম্নে উল্লিখিত ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণ তৎকালীন সময়ের রাষ্ট্র, সরকারের সঙ্গে পুঁজির মালিকদের শ্রেণিগত ঐক্য এবং পুঁজির অর্থনীতির (উৎপাদনী এবং অনুৎপাদনী অর্থাৎ পরগাছা ধরনের) বিশেষ পারস্পরিকতার সম্পর্ক অনুধাবনে তাৎপর্যপূর্ণ। আরও তাৎপর্যপূর্ণ এ কারণে যে, বর্তমান সময়ের মধ্যে সে ধরনের ঐক্যের পরম্পরাগত (ধারাবাহিক) বৈশিষ্ট্য সাধারণত দেখা যায় বলে এর অনুসন্ধান বিশেষভাবে প্রয়োজন।
সরকারের সঙ্গে উৎপাদনশীল/অনুৎপাদনশীল পরগাছা ধরনের পুঁজির মালিক শ্রেণির জৈবিক বন্ধন/সম্পর্ক কী প্রকারের? পুঁজির সম্প্রসারণের সঙ্গে ধর্মের ব্যবহারের সম্পর্ক কী? পুঁজির একচেটিয়া প্রবৃদ্ধির ফলে সমাজে কী ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়? এসব প্রশ্নের অনুসন্ধান জরুরি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে প্রথম সরকারের আমলের বিভিন্ন সময়ের গৃহীত নীতি-পরিকল্পনা, উৎপাদনশীল পুঁজির ধরন এবং শ্রেণিগত বিন্যাস পূর্ববর্তী অধ্যায়ে অল্পবিস্তর পর্যালোচনা করা হয়েছে।
অনুৎপাদনী (দখল, লুণ্ঠন, ডাকাতি, চুরি, উচ্ছেদ ইত্যাদি ধরনের) প্রক্রিয়ায় সম্প্রসারিত লুম্পেন পুঁজির সঙ্গে ধর্মের ব্যবহারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি সমকাল পত্রিকার একটি প্রবন্ধে বর্তমান শাসক শ্রেণির ঐতিহাসিক চরিত্র সম্পর্কে বলেছেন,
‘এই শাসক শ্রেণির চরিত্র সাম্প্রদায়িক না হলেও দেখা যায়, ১৯৭২ সাল থেকেই সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত লোকজন হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ করা হয়েছিল; স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার তা বাতিলের বদলে নতুন নামকরণ করে ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। এই আইনের স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল হিন্দুদের সম্পত্তি দখল। এই সম্পত্তি দখলের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক ছিল না। ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশে উর্দুভাষী মুসলমানদের সম্পত্তিও ব্যাপকভাবে দখল করে তাদের প্রায় সমগ্র অংশকে রাস্তায় বসানো হয়েছিল। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন অনেক লোকের সম্পত্তির ওপরও হামলা হচ্ছিল। হিন্দুদের সম্পত্তির ওপর যে হামলা শুরু হয়েছিল, তার চরিত্রও ছিল একই রকম। যারা হিন্দুদের ওপর এই হামলা করেছিল, তারা সাম্প্রদায়িক কারণে তা করছিল না। করছিল লুটপাটকারী, লুণ্ঠনজীবী হিসেবে।’[12]
আগেই বলা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ আমলে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যবস্থাপনা এবং ব্যক্তিখাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যাবসার জন্য লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেত দল ও পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসা ব্যক্তিরা। নতুন একটি বিত্তশালী গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। পরিবারতন্ত্রের বিকাশও হয় এই পরিপ্রেক্ষিতে। এই গোষ্ঠীটি সরকার এবং প্রকৃত ব্যাবসার মধ্যে মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করে; উঠতি ধনিক সম্প্রদায়ভুক্ত হয় দলীয় প্রভাব বিস্তার করে। কখনো কখনো সরকারি সংস্থাসমূহের জন্য ব্যয়কৃত অর্থের একটি বড় অংশ এই গোষ্ঠীটি আত্মসাৎ করেছে। রাষ্ট্রীয় পুঁজিতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং নতুন একটি বিত্তশালী গোষ্ঠী সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কয়েকটি উপায় নেয়া হয়েছিল।
প্রথমত: আওয়ামী লীগ সরকার তাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পরিত্যক্ত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রাথমিকভাগে ২২১টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন সৃষ্ট করপোরেশনের অধীন নিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে আরও ৩১১টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত করে বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা বোর্ডের অধীন আনা হয়। একটি আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনা পরিষদ গঠিত হতো প্রশাসক, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে। প্রশাসকদের নিয়োগ দেওয়া হতো রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর ভিত্তি করে। দক্ষ ব্যক্তি পাওয়া গেলেও সেটি বিবেচিত হতো না। প্রয়োজনীয় শিক্ষা কিংবা প্রশাসনিক দক্ষতা ইত্যাদির যোগ্যতা যাচাইয়ের ধার দিয়েও যেতেন না তারা। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা লোভ, অসততা এবং দুর্নীতিতে দুর্নিবার হয়ে উঠেছিল। একজন গবেষকের হিসাব থেকে জানা যায় যে, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের শতকরা প্রায় ১০ ভাগ স্থায়ী/অস্থায়ী (চলনযোগ্য) সম্পদ নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা হাতিয়ে নিয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে সরকার যখন নানাবিধ কারণ দেখিয়ে বিনিয়োগ করা বন্ধ করে দেয়, তখন কোনো কোনো প্রশাসক সেগুলো কিনে নেয়। নিজেদের সমবায়ের চেয়ারম্যান দেখিয়ে দিনের মধ্যেই সরকারি খাতায় নিবন্ধিত করে নেয়। একটি খসড়া হিসাবে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে যে পরিমাণ খুচরা যন্ত্রাংশ এবং কাঁচামাল এরা সরিয়ে নিয়েছে, তার দাম প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর ব্যবস্থাপকদের বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হওয়ার ফলে কোনো কোনো বাঙালি উদ্যোক্তাকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিমালিকদের একটা বৃহৎ সুযোগ তৈরি করে দেয় কোনো কোনো শিল্পকারখানা নিজের করে নেওয়ার জন্য।[13]
স্বাধীনতার পর ব্যবস্থাপকদের বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হওয়ার ফলে কোনো কোনো বাঙালি উদ্যোক্তাকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত ব্যক্তিমালিকদের একটা বৃহৎ সুযোগ তৈরি করে দেয় কোনো কোনো শিল্পকারখানা নিজের করে নেওয়ার জন্য।[13]
দ্বিতীয়ত: বৃহৎ আকারের শিল্প, ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে আনা হলেও শিল্পপণ্যের বণ্টন এবং বিপণনের ভার ছিল ব্যক্তিমালিকানার আওতায়। যুদ্ধের কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটায় যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে পণ্য ও সেবার বড় ঘাটতি তৈরি হয়। ঘাটতির কারণে জনগণের চরম দুঃসময়ে রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের বিপণন-বণ্টনের দায়িত্ব ব্যক্তিখাতে দেওয়ার কারণে পুঁজির পুঞ্জীভবনের বিশাল সুযোগ তৈরি হয়। ব্যক্তিপুঁজির আদি আহরণের একটি অন্যতম প্রধান উৎস ছিল এই ক্ষেত্রটি। আমদানি-রপ্তানিকারক, লাইসেন্স-পারমিটপ্রাপ্ত ডিলার, বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন দলের সহযোগিতায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বাজারের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। বণ্টন ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের আধিপত্য ছিল সর্বত্র। আমদানিকারকরা বৈদেশিক মুদ্রার সরকারি নির্ধারিত রেটে আমদানি করলেও স্থানীয় বাজারে পণ্য ছাড়ত তার চেয়ে চড়া দামে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় ট্রেডিং করপোরেশনের মাধ্যমে যে পণ্য আমদানি করা হতো, তার বিপণনের ভার ছিল প্রাইভেট ট্রেডারদের হাতে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য বণ্টন-বিপণনের ভার দেওয়া হতো প্রাইভেট ট্রেডারদের। প্রাইভেট ট্রেডারদের ওপর সরকারি নির্ভরতা এবং চাহিদার তুলনায় জোগানের অপ্রতুলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বণ্টন-বিপণন-বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর মুনাফা অর্জন করে।[14] শিল্প এবং বিপণন ক্ষেত্রগুলো সরকারি তত্ত্বাবধানে যেভাবে সাজানো হয়, তাতে জনগণের অভাবকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিপুঁজির মালিকরা অনুৎপাদনী উদ্বৃত্ত আয় পুঞ্জীভূত করার সহজ একটি সুযোগ পেয়ে যায়।
রাষ্ট্রীয় ট্রেডিং করপোরেশনের মাধ্যমে যে পণ্য আমদানি করা হতো, তার বিপণনের ভার ছিল প্রাইভেট ট্রেডারদের হাতে। পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় শিল্পকারখানা থেকে উৎপাদিত পণ্য বণ্টন-বিপণনের ভার দেওয়া হতো প্রাইভেট ট্রেডারদের।
একটি পরিসংখ্যানের সাহায্যে বিষয়টি তুলে ধরা যাক। ১৯৭২-৭৩ সালে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত তুলা টেক্সটাইল, সুতা এবং সিগারেট ক্রয়-বিক্রয় থেকে ব্যক্তিমালিকদের আয় হয় ৩০০ কোটি টাকা। এটি ছিল সে বছরের জিডিপির শতকরা প্রায় ৬ ভাগ। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকদের দেওয়া কর-বহির্ভূত ১৩০ কোটি টাকার যে হিসাব সে সময় কর কর্তৃপক্ষের কাছে জমা পড়ে, বাস্তবত কর-বহির্ভূত এবং অঘোষিত আয়ের পরিমাণ ছিল তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। তৎকালীন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (DCCI) সভাপতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী জানা যায় যে, ১৯৭৭ সালের শেষ নাগাদ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা দেশের খুব ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর কুক্ষিগত হয়, স্বাধীনতার পর থেকে যেখানে গড় জিডিপির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।[15] অনুৎপাদনশীল এই ব্যক্তিমালিকদের বেশিরভাগ পারমিট, লাইসেন্স, ডিলারশিপ এবং চোরাকারবারির মাধ্যমে যে অর্থ আত্মসাৎ করেছিল, সে অর্থ তারা দেশের কোনো উৎপাদনশীল শিল্পে বিনিয়োগ না করে বিদেশি ব্যাংক অথবা বিদেশি বাজারে বিনিয়োগ করেছে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কলামে এই পরিস্থিতির একটি বিবরণ ছাপা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘there is hardly any willingness for private investment in industry. Many of the moneyed class are transferring their capital abroad, keeping in foreign banks or investing in foreign markets.. .as if the country has reached a saturation point in respect of economic and industrial development’, The Daily Ittefaq, 2 November 1973.[16] অন্য আরেকটি অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনির্বাচিত সরকার শুরুর আগে স্বাধীনতার পরপর ‘রাজনৈতিক টাউট’রা অনুৎপাদনশীল প্রক্রিয়ায় (ইন্ডেন্টিং এবং দ্রুত কামানোর অন্যান্য বাণিজ্যিক উপায়ে) প্রায় ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়, যার বৃহৎ একটা অংশ খরচ করে ভোগবিলাসে।[17]
বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে চলে যাওয়ার কারণে এসব পরিচালনায় দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত কর্মীর অভাব দেখা দেয়। ফলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রশাসকদের নেতৃত্বে পরিত্যক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য বোর্ড গঠন করা হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলে যারা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তাদের বেশিরভাগের শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার কোনো পূর্বাভিজ্ঞতা ছিল না। প্রশাসকদের নিয়োগ দেওয়া হতো দলীয় স্বার্থ বিবেচনায়, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার পেশাগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা প্রকৌশলগত কোনো ধরনের শিক্ষার বিবেচনা ছিল না।[18] এসব প্রশাসকের তৎপরতার কয়েকটি দিক নিচে তুলে ধরা হলো।
সচরাচর যা কিছু আমরা দেখি(য়াছি), কিন্তু…?
মওলানা ভাসানীর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক হক কথা’তে এই প্রশাসকসহ তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল সে সময়কালে। যে কারণে ১৯৭২ সালেই পত্রিকাটির প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ ইরফানুল বারীকে গ্রেফতার করা হয়। কী ছাপা হতো ‘হক কথা’য়? তার কয়েকটি নমুনা দীর্ঘ উদ্ধৃতি আকারে এখানে উপস্থাপন করা হলো। পত্রিকাটি বলছে,
‘…বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে স্বজনপ্রীতি ইতিমধ্যেই জেঁকে বসেছে। পরাধীনতার নয় মাসে দালালীর অভিযোগ থাকলেও আওয়ামী আত্মীয়তার খোশ নসীবে শুধু ভবের তরীই পার হচ্ছেন না, অনেকে আখেরের কামাইও করে নিচ্ছেন। এমনি একটি নিয়োগ ঘটেছে মূলার এ্যান্ড পিপ-এ। যিনি এই কয়দিন আগেও ছিলেন জল্লাদ বাহিনীর দোস্ত তিনিই আজ হর্তাকর্তা। এই ব্যক্তিই বিগত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে কোম্পানির খুলনাস্থ অফিসের এক লাখ টাকার ঔষধ পঁচিশ হাজার টাকায় চুরি করে বিক্রি করে দেয়। আত্মীয়তার আবরণে সব সত্যই কি ঢাকা পড়ে যাবে?’[19] ‘আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো কোনো সদস্য ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষেত্রবিশেষে হুমকির আশ্রয় গ্রহণ করিতেছে বলিয়া জানা যাইতেছে। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অনেকেই পূর্বের ন্যায় কৃষকদের নিকট হইতে ঘুষ আদায় ও অযথা হয়রানি করিতেছে।’[20]
‘বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বাধীন ২৩টি চা বাগানের পরিচালনা কমিটির জনৈক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা মোট ৮টি বাগানের ম্যানেজার পদসহ বিভিন্ন বিভাগে নিজের অনুপযুক্ত আত্মীয়স্বজনকে নিয়োগ করে আমাদের চা শিল্পের সর্বনাশ সাধন করেছেন। নিকটস্থ একটি চা বাগানের মালিক হওয়া সত্ত্বেও উক্ত কর্মকর্তার নন ম্যাট্রিক এক শ্যালককে বিগত ১৭ই ফেব্রুয়ারি থেকে গাজীপুর চা বাগানের ম্যানেজার পদে নিযুক্ত করা হয়েছে।’[21] পশ্চিমবঙ্গীয় সীমান্ত দিয়ে রিলিফবাহী ভারতীয় ট্রাক, যেগুলো চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, সেসব ট্রাকের নম্বর তুলে ধরে পত্রিকাটি জানিয়েছিল, ‘কোচবিহার, মেঘালয়, আগরতলা, মুর্শিদাবাদ ও পশ্চিম দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে ট্রাকে করে রিলিফের মাল বাংলাদেশে পৌঁছে দেওয়ার নামে চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে।…যেহেতু এই লেনদেনের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী নেতাদেরও সম্পর্ক বিদ্যমান তাই কোনো প্রহরী কিংবা মহল এতে বাধাদান করার সাহস পাচ্ছে না।’[22]
বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কাদের হাতে ছিল–এ প্রসঙ্গে পত্রিকাটি আরও বলছে,
‘অবাঙ্গালী, আধাবাঙ্গালী অথবা সহযোগী বাঙ্গালী শ্রেণির পুঁজিকেই জাতীয়করণ করা হয়েছে। অপরদিকে এই সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে বাঙ্গালী মালিকদের স্বার্থকে সযত্নে সংরক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রণভার তাদেরই হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।’[23] “ওয়াপদা, হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স করপোরেশন প্রভৃতি সংস্থার স্ট্রং রুমের ফাইল ঘাঁটলে আজও যার অসাধুতার কেরামতি ধরা পড়বে, এক কোদাল মাটি না কাটিয়েও যিনি লক্ষ লক্ষ টাকার বিল অবলীলাক্রমে পাশ করিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে পারেন, শেষাঙ্কে যিনি ‘থ্রি নট থ্রি’ মঞ্চের অন্যতম দাগী নায়ক সেই মহাজনটি বাংলাদেশ সরকারের একটি জনকল্যাণমূলক দফতরের নায়েব সেজেছেন।’’[24] ‘একজন অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আওয়ামী লীগের স্বজনপ্রীতির বদৌলতে ৬টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিজ্ঞ লোক থাকা সত্ত্বেও মোটা অঙ্কের ঘুষ প্রদানের বদৌলতে একই ব্যক্তি এতগুলির অধিকর্তা হয়ে বসেছেন। আরও রহস্যজনক ব্যাপার এই যে, একটি বিদেশি কোম্পানির জনৈক বাঙ্গালী পার্টনারকে গত জুন মাসে পাকবাহিনী হত্যা করার পর তার বাড়ী-ঘর ও যাবতীয় জিনিষপত্র উক্ত চেয়ারম্যান স্বনামে-বেনামে দখল করেছেন।’[25]
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকর্তারা কী ধরনের কর্মে নিযুক্ত ছিলেন, সে প্রসঙ্গে পত্রিকাটি জানাচ্ছে,
‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আহমদ বাওয়ানী, শরমিন ও বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) এই তিনটি টেক্সটাইল মিলের যিনি প্রশাসক নিযুক্ত হয়েছেন তিনি একজন গণপরিষদ সদস্য। শ্রমিকদের স্বার্থ, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও সব খুচরা যন্ত্রপাতি, ব্যাংকের লেনদেন বা দেশ-বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাই আজীবন ফৌজদারী মামলায় পারদর্শী এই ভদ্রলোকটির নেই, তবু তিনি তিন তিনটে মিলের পরিচালক। মিল পরিচালনায় অযোগ্য হলেও, মিলের সম্পদ বিক্রয় এবং অন্যান্য অপকীর্তির ধারাবাহিকতায় তিনিও এমসিএ, আওয়ামী নেতৃবৃন্দ এবং তাদের আশীর্বাদপুষ্টদের চেয়ে পেছনে পড়ে নেই। প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে আজ পর্যন্ত তিনি যা করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তিটি হল আহমদ বাওয়ানী মিলের উৎপাদিত ৯০ লাখ টাকার গুদামজাত দ্রব্য আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে ৮০ লাখ টাকায় বিক্রয়। শরমিন ও বাংলাদেশ মিল দুটি মাত্র এক মাস চলার পরই কাঁচামাল ও অব্যবস্থার জন্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে আহমদ বাওয়ানী মিলসের আয়ুও ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু আওয়ামী গণপরিষদ সদস্য প্রশাসকটি এখনো নিজের এবং প্রিয়জনদের স্বার্থ গোছাতে ব্যস্ত। চট্টগ্রামের হাফিজ জুট মিলস ও টেক্সটাইল মিলসের আওয়ামী ভক্ত প্রশাসক ব্যাপক আলোড়ন তুলেছেন। মিল দুটির সচেতন শ্রমিক সমাজ এবং শুভাকাঙ্খীদের কয়েকটি প্রচারপত্র থেকে জানা গেছে, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার দিক থেকে অযোগ্য এবং দুর্নীতির দায়ে চট্টগ্রামের এ, কে, খান জুট ও মোমেনশাহীর আলহাজ্ব জুট মিলস থেকে এককালে বহিষ্কৃত এই প্রশাসকটি সম্পত্তি লুণ্ঠন, স্বজনপ্রীতি এবং ঘুষ-দুর্নীতির চরমে পৌঁছে গেছেন। তিনি মিলের অসংখ্য টন লোহা, তামা, সিমেন্ট ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কম দামে বিক্রয়লব্ধ অর্থে এ পর্যন্ত ২৫ হাজার ২৫৬ টাকার আসবাবপত্র নিজের বাড়ীতে উঠিয়েছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, ৩০ টাকা পাউন্ডের তামা তিনি মাত্র ৯০ পয়সা মূল্যে বিক্রয় করেছেন। এমনকি মিলের অফিসারস-মেসের নিজস্ব গাড়ীটিও তিনি নিজের দখলে নিয়েছেন। এই মিলটির শ্রমিক বা কর্মচারীদের কেউই আগে বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) পাটকল সমিতির নিয়মানুযায়ী বেতন ও অন্যান্য সুবিধে পেতে পারেননি। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সমিতির নিয়মানুযায়ী বেতন ও সুবিধেদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও দালাল প্রশাসকটির অহেতুক হস্তক্ষেপের ফলে তা মার্চ মাসেই বাতিল হয়ে যায়।’[26]
‘শেরপুরের জনৈক এমসিএ দু’জন অসাধু ব্যবসায়ীর প্রত্যেকের নিকট হতে এক হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করে প্রথমজনকে সিমেন্ট এবং অপরজনকে ৩০০০ বস্তা সারের পারমিটের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে তেলের ব্যবসায়ে নিযুক্ত মোঃ মুকছেদুর রহমান নামক ব্যবসায়ীর বৈধ লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও এই গণপ্রতিনিধি সাহেব ৭০০ টাকার বিনিময়ে নতুন করে অন্য একজনকে তেলের লাইসেন্স দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এই সিমেন্ট, সার এবং তেল কোনোটাই জনসাধারণ পায়নি।’[27] ‘.. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান আবদুর রাজ্জাকের (এম.সি.এ) বড় ভাই বুড়ীগঙ্গা নদী সংলগ্ন আজিজুর রহমান চৌধুরীর ডকইয়ার্ডে রক্ষিত বি.এন.ও-এর ৫০ গ্রেল তেলের ২৪ ড্রাম কেরোসিন তেল কালোবাজারিতে বিক্রীর সময় ভাসানী ন্যাপের জনৈক কর্মীর নেতৃত্বে জনতার নিকট হাতেনাতে ধরা পড়েন।’[28]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (শর্তাধীন) ‘সাহায্য’ ও স্বীকৃতি বিষয়ে পত্রিকাটি জানাচ্ছে,
‘শেখ সাহেব দু-একবার মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন ভূমিকার সমালোচনা করলেন বটে কিন্তু তাঁর মুক্তির প্রশ্নে মার্কিন উপদেশ এবং ভূমিকার জন্য স্বাভাবিক কারণেই তিনি কিছুটা দুর্বল ছিলেন। সুতরাং বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন সরকারের স্বীকৃতির ঢের আগেই সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে একটা গোপন সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক পিএল ৪৮০ তহবিল চালু করে দেওয়ার ব্যাপারেই তা প্রমাণ হয়ে যায়। অথচ এর মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ এই বহুল বিতর্কিত পিএল ৪৮০ তহবিলটি ফ্রিজ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মার্কিনদের কোনো সাহায্য বাংলাদেশের দরকার নেই – আমরা কিছুতেই সে সাহায্য গ্রহণ করবো না। শেখ মুজিবর রহমানের সিদ্ধান্ত সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। ম্যাকনামারাকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অভ্যর্থনা জ্ঞাপন, কিসিঞ্জারের গোপন সফর, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আমেরিকাকে ১০ দিন সময় দান, দশ দিন গত হওয়ার আগেই তাড়াহুড়া করে মার্কিন সরকারের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং বর্তমানে বাংলাদেশ-মার্কিন সাহায্য চুক্তি স্বাক্ষর সবগুলো ঘটনাই একসূত্রে গাঁথা।’[29]
প্রশাসক এবং ব্যবসায়ীদের সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরে ‘হক কথা’ বলছে,
‘টঙ্গীর এম.সি.এ সাহেবটি টাকা কামানোর ক্ষেত্রে অপূর্ব কৌশল জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন। এম.সি.এ সুলভ ক্ষমতার বলে তিনি কয়েকটি মিল-কর্তৃপক্ষকে সুতা বিক্রয় করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। কোনো ব্যবসায়ী সুতা কিনতে এলে তার দরবারেই হাজির হতে হয়। তিনি তখন ঐ ব্যবসায়ীটির কাছেই মিল রেটের অনেক বেশী দামে বিক্রয় করে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নেন। ওদিকে আবার নিজের ভাগ্নে ও ভগ্নিপতির নামে ইস্যুকৃত লাইসেন্সের সুতা থেকেও অর্থ কামাচ্ছেন। এখন তাহা এম.সি.এ সাহেবটির বাসায় রাজনৈতিক কর্মীর চেয়ে বেশী সমাগম হয় সুতার ব্যবসায়ীদের।’[30]
‘আদমজী গোষ্ঠীর চটকল, কাপড়ের কল, চিনি, চা, ইত্যাদি ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক হিসেবে যাকে নিয়োগ করা হয়েছে হানাদার আমলে তিনি ধানমণ্ডি শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তি ফৌজের জন্যে তিনি ছিলেন ত্রাস। আফসোস তিনিই আজ প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের ভাগ্য নিয়ন্তা।…খুলনার আমিন জুট মিলসের একজন উর্দ্ধতন অফিসার গত ২৩/৫/৭২ তারিখে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওয়েলসের খালিশপুর শাখা থেকে মিলের জন্য ১০০০ গ্যালন জেবি ওয়েল খরিদ করেন। এই তেল মিলের রেজিষ্টারে জমা না দেখিয়ে ড্রামে ভরে নৌকাযোগে কালোবাজারে বিক্রি করে ফেলেন। এই চোরাই কাজে সহযোগীকে যথোপযুক্ত অংশ না দেয়াতে গুমর ফাঁক হয়ে গেছে।[31]
‘আদমজী গোষ্ঠীর চটকল, কাপড়ের কল, চিনি, চা, ইত্যাদি ১৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রশাসক হিসেবে যাকে নিয়োগ করা হয়েছে হানাদার আমলে তিনি ধানমণ্ডি শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মুক্তি ফৌজের জন্যে তিনি ছিলেন ত্রাস। আফসোস তিনিই আজ প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিকের ভাগ্য নিয়ন্তা।
গাজী গোলাম মোস্তফার রেডক্রস এবং জাতিসংঘের ত্রাণসামগ্রী আত্মসাতের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাতি অর্জনের বিষয়টি কোনো কোনো লেখকের অনুসন্ধানে পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের আত্মীয়স্বজন সম্পর্কেও একই ধরনের অভিযোগের উল্লেখ আছে সেসব লেখায়। ভারতে পাট পাচারকারীদের সঙ্গে সম্পর্কসহ আদি উপায়ে সম্পত্তির উত্তরোত্তর বৃদ্ধির আয়োজনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং সহযোগীদের সম্পর্কে জানা যায় যে, তারা অবৈধ উপায়ে প্রচুর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। একজন বিদেশি সাংবাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে তালুকদার মনিরুজ্জামান সে সময়কার দুর্নীতি ব্যাপকতা সম্পর্কে একটি ধারণা দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ৩০ আগস্ট Far Eastern Economic Review-তে প্রকাশিত হয় একটি প্রতিবেদন, সেখানে বলা হয়: ‘Corruption is certainly not new, but for many in Dacca the relative scale and open character of the plunder holds few historical comparisons. One, perhaps, is China during 1930 and 1940.’[32]
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য দ্রুত বাড়তে থাকে। অনুপম সেন এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, এটি,
‘মূলত বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অকস্মাৎ মূল্যবৃদ্ধি থেকে উৎসারিত। তা ছাড়া আমদানি-রপ্তানি ব্যাবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা দেশত্যাগ করার ফলে ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে আমদানি ব্যবসায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। আমদানি প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার ফলে পূর্বে আমদানিকৃত ও মজুতকৃত পণ্যের মূল্য ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। উপরন্তু কতিপয় তথাকথিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’ আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগের সদস্য লাইসেন্স পারমিট ক্রয়-বিক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে বিপুল কালো বিত্তের মালিক হয় (এদের অধিকাংশই পরবর্তী কালে সরকারি দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠন অব্যাহত রেখেছে)। এদের এই কালো বিত্তের বোঝা, লাইসেন্স পারমিটের বারবার হাতবদলের ভার পণ্যমূল্যকে বহুগণ বৃদ্ধি করে নির্ধারিত আয়জীবীদের (fixed income earners) জীবনকে দুর্বিষহ করে।…অবশ্য যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির কারণে হঠাৎ ফুলেফেঁপে ওঠা দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী, আমলা, ব্যবস্থাপক, টাউট শ্রমিক রাজনৈতিক নেতা ছাড়া প্রায় সব শ্রেণিকেই কমবেশি কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে।’[33]
উৎপাদনের দায়-দায়িত্ব যদিও সরকারের হাতে থাকে, কিন্তু বিপণন এবং বণ্টনের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয় ব্যক্তিমালিকানাধীন লোভী এজেন্ট, অসৎ পাইকারি ও খুচরা প্রতিষ্ঠানের হাতে।[34] অর্থাৎ উৎপাদনের যাবতীয় খরচ বহন করতে হতো জনগণকে, কিন্তু বণ্টন ক্ষেত্রে লাভের বখরা যেত পরগাছা উদীয়মান ব্যক্তিপুঁজিপতিদের হাতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্কিত দলীয় নেতা-কর্মীরা রেশন দোকান থেকে শুরু করে বণ্টনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক বনে গিয়েছিল। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের মধ্যে বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের পরম আনন্দের বিষয় ছিল ‘পরিত্যক্ত’ সম্পত্তি দখল করে মালিক বনে যাওয়া।[35]
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ১৩৭.৩ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ এবং ‘অনুদান’ পাওয়া যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থার মাধ্যমে বহুপাক্ষিক ঋণ ও অনুদান আসে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং খাদ্যঋণ ১৭.৩ কোটি মার্কিন ডলার। একই সময়ে ‘বন্ধুপ্রতিম’ রাষ্ট্রগুলো থেকে ৮৫ কোটি মার্কিন ডলার ‘অনুদান’ ও ঋণ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ সংসদ সদস্য ত্রাণ কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য খুব ইচ্ছাপোষণ করত।[36] কারণ, ত্রাণের নগদ অর্থ এবং অন্যান্য পণ্য একদিকে যেমন নিজেদের স্ফীতির কাজে লাগানো যায়, অন্যদিকে এর একটি অংশ যার যার নির্বাচনি এলাকার নেতা-কর্মীদের ‘উপকারে’ ব্যয় করতে পারে। এর ফলে গ্রাম এবং শহরাঞ্চলে দলের শক্তি যেমন স্থিতি লাভ করে, তেমনি সংসদে নিজেদের আসন পোক্ত হয়।
১৯৭২ সালে বৈশ্বিক সংকটের ধাক্কা (মূল্যস্ফীতির প্রভাবজনিত) বাংলাদেশেও এসে লাগে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় দেশীয় অর্থনীতির লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া। এর ফলে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাগুলোর কথা বলা যায়। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলোতে প্রায় অদক্ষ ব্যবস্থাপকদের নিয়োগ দেওয়ার কারণে অধিকাংশ শিল্পের গড়ে মোট উৎপাদনী ক্ষমতার প্রায় ৯ শতাংশ হ্রাস পায়। এ ছাড়াও কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের হিসাব অনুযায়ী, পাট এবং চালের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৫ শতাংশ ভারতে চোরাচালান হতো। সেসময়ে উত্তরোত্তর টাকা ছাপানোর কারণে মুদ্রাস্ফীতির হার ৩০০ শতাংশেরও বেশি হয় এবং ক্রয়ক্ষমতার বিপরীতে জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। এ ছাড়া ’৭৪ সালের বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক। প্রায় ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য এবং এক থেকে দেড় কোটি ডলারের পাটসামগ্রী নষ্ট হয়। পাশাপাশি এ সময় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ দাম প্রায় ৭০০-৮০০ শতাংশে (১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায়) এসে দাঁড়ায়। পাশাপাশি ১৯৭৪ সালের আগস্ট-নভেম্বর পর্যন্ত নগদ ও অন্যান্য ‘সাহায্য’ ৪০ কোটি এবং ১৪.৫ কোটি মার্কিন ডলার আসে বৈদেশিক ঋণ।[37] যথারীতি এই ঋণ সাহায্য জনগণের দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই বাতাসে মিলিয়ে যেত। লু্ম্পেন পুঁজি সৃষ্টির শর্ত এবং আদিম সংবর্ধনের প্রক্রিয়ার সাথে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যুক্ত হয়ে মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তোলে। এ নিয়ে সে সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালিখি হয়। জাসদের দেওয়া পরিসংখ্যানের কথা উল্লেখ করে তালুকদার মনিরুজ্জামান জানাচ্ছেন যে, এ প্রক্রিয়ায় (বিপর্যস্ত অবস্থার সুযোগ নিয়ে) দেশের সম্পদের প্রায় ৮৫ শতাংশের মালিকানার দখল চলে যায় সমস্ত জনগণের শতকরা প্রায় ৮ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী দল (ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে আগস্ট ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত) আওয়ামী লীগের হাতে।[38]
সরকারি খাত সম্প্রসারণের উপজাত (by-product) হিসেবে একটি নতুন ‘ব্রিফকেস পুঁজিপতি’র সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়। এই নব্য পুঁজিপতিরা বিদেশি সাপ্লায়ার এবং সরকারি খাতের মধ্যকার সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করত এবং সরকারি পণ্যের ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করত।[39] নব্য এই ‘ব্রিফকেস পুঁজিপতি’দের পুঁজির উৎস ছিল মূলত দালালি (কমিশন)।
বহু বছর ধরেই পরিবহণ খাতের ‘সক্ষমতা’, ‘উন্নয়ন’ ইত্যাদির জন্য সরকারগুলো বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বিভিন্ন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান শতকোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে এই খাতে। তাদের শর্তানুযায়ী ঋণের অর্থের একটি বড় অংশ উক্ত খাত নিয়ে গবেষণা এবং পরিবহণ মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ প্রদান বাবদ নিজেরাই উশুল করে নিয়েছে। সাহায্য নামক ঋণের প্রবাহ বজায় রাখতে নতুন নতুন শর্ত যুক্ত করেছে। রেহমান সোবহান জানিয়েছেন, ‘এ ধরনের কর্মযজ্ঞ কোনো সুফল বয়ে আনেনি।’[40] জনগণের কাঁধে বৈদেশিক ঋণের বোঝাই কেবল বেড়েছে।
রাতারাতি ধনী হওয়ার জন্য পরিবহণ খাত ছিল একটি মৃগয়াক্ষেত্র। সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রায়ই এ খাতে বৈদেশিক ঋণপ্রবাহের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত। কারণ, সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে ঋণের অর্থ তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সাপ্লায়ারদের হাতে ঠিকা দেওয়া যেত। এতে লাভ হতো মূলত তিন পক্ষেরই–বিদেশি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান, কমিশনভোগী নেতা ও সাপ্লায়ারদের। কমিশন এজেন্টদের বিষয়ে রেহমান সোবহান তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে,
‘কমিশনে (পরিকল্পনা কমিশন) যোগ দেওয়ার প্রথম মাসেই এই গোষ্ঠীর (tribe) ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা হয়। আমি নুরুল ইসলামের কাছ থেকে একটি ফোন কল পাই এই মর্মে যে, জার্মানি থেকে ‘short take-off and landing (STOL)’ এয়ারক্র্যাফ্ট আমদানির জন্য পশ্চিম জার্মানি প্রদত্ত (ঋণ) ‘সাহায্যে’র সম্ভাব্য বরাদ্দ বিষয়ে আলোচনার জন্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন তওয়াবকে তিনি আমার কাছে পাঠাচ্ছেন। তওয়াব ছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর একজন নামকরা ব্যক্তি এবং সম্ভবত এয়ার মার্শাল খন্দকারের চেয়ে সিনিয়র। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে তিনি জার্মানির উদ্দেশে পাড়ি জমান। সে সময় তাজউদ্দীন ও খন্দকার তওয়াবকে বারবার বার্তা পাঠান দেশে ফিরে এসে যুদ্ধে যোগদানের জন্য, যাতে তার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখতে পারত। তওয়াব সে ডাকে সাড়া না দিয়ে জার্মানিতেই আসন গাড়লেন। সেই তিনিই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে পশ্চিম জার্মানির (এয়ারক্র্যাফ্ট) কোম্পানির কমিশন এজেন্ট হয়ে তার পূর্বখ্যাতিকে ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর সহায়তা চাইলেন। কোনো সুপারিশ ছাড়া বঙ্গবন্ধু তাকে পাঠিয়ে দিলেন নুরুলের কাছে; উক্ত বিষয়ে সম্পর্কিত থাকার কারণে নুরুল পাঠিয়ে দিল আমার কাছে। ১৯৭১ সালে তওয়াবের দেশের প্রতি কর্তব্যজ্ঞানহীন ভূমিকার স্মরণে থাকার কারণে তার দ্বারা প্রভাবিত হলাম না। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলাকালীন সিভিল এভিয়েশন সচিব, নুরুল কাদের খান আমাকে জানান যে, তওয়াব যে STOL-এর জন্য মার্কেটিং করছে সেটি আমাদের চাহিদার উপযুক্ত নয়। সে অনুযায়ী আমি তওয়াবকে পরামর্শ দিই। যারা তাকে হতাশ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে নালিশ করলেন। সংক্ষুব্ধচিত্তে তওয়াব জার্মানি ফেরত গেলেন এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর পুনরায় ফেরত এলেন। পরবর্তী সময়ে খন্দকার মোশতাক তাকে (এয়ার মার্শাল) খন্দকারের স্থলে নিয়োগ দিলেন।’[41]
এ ছাড়া সরকারি গৃহায়ন, গণপূর্ত এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি প্রক্রিয়া ছিল ধনী হওয়ার একটি সহজ উপায়। উদাহরণ হিসেবে আবাসন খাতের কথা উল্লেখ করা যায়। এ খাতে আধিপত্য করত গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির জন্য এই বিভাগ আগে থেকেই বেশ নামকরা ছিল। ধানমন্ডি ও গুলশানের একটি বড় অংশ এই বিভাগের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে গড়া। নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছিল মূলত প্রাইভেট ঠিকাদারদের মাধ্যমেই। এই ঠিকাদাররা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে তাদের কাজ বাগিয়ে নিত। দলীয় প্রভাবশালী ঠিকাদারদের বিভিন্ন ধরনের আবদার যেমন: নির্ধারিত বাজেটের চেয়ে অতিরিক্ত পরিমাণে নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি, ধীরগতি এবং ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণ ইত্যাদি পাস হয়ে যেত কর্মকর্তাদের কল্যাণে। আমলা-বিভাগীয় কর্মকর্তাদের ইহজাগতিক স্ফীতি এবং ঠিকাদার সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধি হাত ধরাধরি করে চলতে থাকে। বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণির গঠনে আদিম সঞ্চয়নের রূপকার ঠিকাদাররা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিল্প-উদ্যোক্তা শ্রেণির অগ্রগামী যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে জহরুল ইসলাম C&B-এর কর্মচারী থেকে ঠিকাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন এবং পরবর্তী সময়ে শিল্পের বিভিন্ন সেক্টরে শিল্পপতি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন।[42] পরিকল্পনা কমিশনের কোনো কোনো সদস্যের এ ধরনের পুঁজির মালিকদের সম্পদ আহরণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার নানা ধরনের পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত হালে পানি পায়নি।
তৎকালীন সরকারের দুজন মন্ত্রীর শিল্পকারখানা অনুসন্ধানের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বদরুদ্দীন উমরের একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় ‘হলিডে’ পত্রিকায়। বদরুদ্দীন উমরের ভাষ্য অনুযায়ী,
‘মন্ত্রীদ্বয়ের ‘নাটকীয়’ ভুয়া শিল্পকারখানা এবং ডিলারশিপ উদ্ঘাটনের মাধ্যমে জনগণের সামনে এই চিত্র হাজির করতে চান যে, তারা আসলে সব ধরনের চোরের বিরুদ্ধে লেগেছেন। হাল-জমানার হারুন আল রশীদ, বাণিজ্যমন্ত্রী, তার পরিদর্শনকালে আবিষ্কার করেন যে, ৭৮ জন সিমেন্ট, টেক্সটাইল এবং এ ধরনের অন্যান্য পণ্যের ডিলারের নিজেদের কোনো স্থাপনা নেই। কিংবা, ভিন্নভাবে বললে, তারা পুরোপুরিই ভুয়া। শিল্পমন্ত্রী একটি জনসভায় বক্তৃতায় বলেন, বিভিন্ন আকারের ১ হাজার ২৭৭টি শিল্পের কোনো সত্যিকারের ভিত্তি নেই, অথচ তা সত্ত্বেও তারা এসব ব্যক্তিকে লাইসেন্স এবং অন্যান্য পারমিট দিয়েছেন।’[43] উমর আরও বলেছেন, ‘শুধু তা-ই নয়, মন্ত্রীদ্বয় যে সংখ্যার কথা উল্লেখ করেছেন, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভুয়া ডিলার ও শিল্পপতিদের সংখ্যা এবং এরা যে কোনো-না-কোনোভাবে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে সম্পর্কিত, তা-ও জনগণ জানে।’[44]
পরগাছা ধরনের মুনাফালোভী এই রাজনৈতিক ক্ষমতাবান টাউট এবং ফড়িয়া গোষ্ঠী লাইসেন্স, পারমিট সরকারের যোগসাজশে হাতিয়ে নিয়ে পরবর্তী সময়ে তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে রাতারাতি বিত্তশালীতে রূপান্তরিত হয়েছে।
সামগ্রিক অর্থনীতিতে লুণ্ঠনের প্রভাব পড়ে সমাজে ব্যাপক আকারে। ১৯৭৪-এর বন্যার সময় সেপ্টেম্বর নাগাদ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেক বাইরে চলে যায়। অনাহারী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তার শেষ পরিণতি হিসেবে লাশের সংখ্যা বাড়ে। যদিও সরকারের কাছে অস্বাভাবিক মৃত্যু একটি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি কিছু নয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের ২২ নভেম্বর তারিখ পর্যন্ত অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৫০০ জনে। বেসরকারি হিসাবে অক্টোবর নাগাদ মৃতের সংখ্যা ছিল ১০০,০০০।[45]
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি (১৭৫৭-১৯৪৭) ‘উন্মুক্ত বাজার’ নীতির আওতায় তার শিল্প বিকাশের স্বার্থে যাবতীয় নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধান এবং প্রশাসনিক পরিকল্পনা গ্রহণ-বাস্তবায়ন করে। পাকিস্তান সরকার (১৯৪৭-৭১) তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এ সময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তার উদ্দেশ্য ছিল মূলত প্রাইভেট খাতকে পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী করা। যার কারণে, পরবর্তী সময়ে প্রাইভেট খাতের শিল্প-বাণিজ্যকেই অর্থনীতির ক্ষেত্রে আধিপত্য করতে দেখা যায়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে (১৯৭১ এবং তার পরবর্তী) আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর রাষ্ট্রীয়করণের বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে ‘সমাজতন্ত্র’ মুখী মনে হলেও এর পরিচালন পদ্ধতি, প্রক্রিয়া, পরিকল্পনা এবং শাসক দলের সঙ্গে পুঁজির মালিক শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ককে অনুসন্ধান করলে বিপরীতমুখী চিত্রটি প্রধান হয়ে ধরা পড়ে।
উল্লিখিত ঘটনাবলি যুদ্ধোত্তর কালের সার্বিক পরিস্থিতির সামান্য একটি অংশ মাত্র। শত হাজার ঘটনার মধ্যে উল্লিখিত সামান্য কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত অনুসন্ধানে ধারণা করা যায়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়াটি কোন পথে এগোচ্ছিল। অর্থনীতির গতি-প্রকৃতির দিক কীভাবে নির্ধারিত হয়েছিল–এসব ঘটনা তার সাক্ষী। ব্যক্তিমালিকানাধীন দেশি-বিদেশি অনুৎপাদনশীল পুঁজির বিকাশ এবং রাষ্ট্রের অগণতান্ত্রিক চরিত্র পারস্পরিক সম্পর্কিত। এবং লুম্পেন পুঁজির সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গতিমুখ নির্ধারণে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে – সেই প্রক্রিয়াটি উপলব্ধি করার জন্য উল্লিখিত উদাহরণগুলো তাৎপর্যপূর্ণ। শাসক শ্রেণির ‘উন্নয়ন’ এবং ক্রমবৃদ্ধিমূলক (Growth) দৃষ্টিভঙ্গি (প্রবৃদ্ধি হিসেবে যাকে চিত্রায়িত করা হয়, তা মূলত প্রযুক্তিগত কারণে উত্তরোত্তর জ্যামিতিক হারে ক্রমবৃদ্ধি) এবং লুণ্ঠনজীবী শ্রেণির ক্রমসম্প্রসারণ পরস্পর সম্পর্কিত বিষয় এটি সামগ্রিক অর্থনীতির প্রাপ্ত ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়। ফলাফলগুলোও বেশ পরিষ্কার। সরকারি সুবিধার বেশিরভাগ অংশ জোটে ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাতে এবং অন্যদিকে সর্বজন বঞ্চিত হয় মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে। ‘নিজের শ্রমশক্তি দ্বারা উৎপন্ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অধিকাংশ মানুষ।’[46]
আগের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৭
পরের পর্ব: ২২ পরিবারের অতীত ও বর্তমান-৯
মেহেদী হাসান: লেখক, গবেষক। ই-মেইল: mehedihassan1@gmail.com
তথ্যসূত্র:
[1] Greg Albo, Leo Panitch & Colin Leys edited, New Polarizations Old Contradictions, The Crisis of Centrism, The Merlin Press, Monthly Review Press, Fernwood Publishing, 2021, London, p.-66-67.
[2] লুণ্ঠন পুঁজির দৌরাত্ম্য, আয় বণ্টনে অসাম্য, সামাজিক অস্থিতিশীলতা, জনজীবনে দুর্ভোগ (প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পুঁজিসৃষ্ট চরম শোষণ), শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী রাজনৈতিক ধারার অনুপস্থিতি, বুর্জোয়া রাজনৈতিক সংকট সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের শর্ত পূরণ করে। যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলোতে সরকারের অদূরদর্শী নীতি-পরিকল্পনার কারণে লুণ্ঠন পুঁজির দৌরাত্ম্য অভূতপূর্ব মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক মানদণ্ডের সীমাবদ্ধতা এবং সর্বজনের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক শক্তির অভাব এবং দুর্বলতার সুযোগে শূন্যস্থান পূরণ করে লুণ্ঠন পুঁজি। ফলে সমাজের সর্বস্তরে নৈরাজ্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা এবং সংকটের সুযোগে ‘স্থিতিশীলতা’ প্রতিষ্ঠার স্লোগান সামনে রেখে নেপথ্যে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। তার ফলে লুণ্ঠন পুঁজি সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসুবিধা হয়নি, বরং ক্রমবৃদ্ধি ঘটেছে। বরং তার বিপরীতে, ব্যক্তি পুঁজির সিলিং বৃদ্ধির ফলে আগে পুঞ্জীভূত লুণ্ঠিত পুঁজি রাষ্ট্রীয় বৈধতা লাভ করে। এ ধরনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার কারণ সম্পর্কে সাইমন মহুন (Simon Mohun) বলেন, ‘(সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক) মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিলে যদি (প্রগতিশীল) বাম ধারা খুব দুর্বল থাকে এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া না করতে পারে, তখন (বুর্জোয়াদের) উগ্র ডানপন্থি অংশ অপরাপর মতাদর্শ খারিজের রাজনীতি নিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে।’ তার ভাষ্যটি ছিল এরকম: ‘When radical change is necessary, but the left is too weak to enact the change, it is the far right with its politics of exclusion that fills the void.’ , Ibid, p.-61। বাংলাদেশে কার্যত তা-ই ঘটে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে সংবিধানাশ্রিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতির আপাতত পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়।
[3] অনুপম সেন বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ; সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ, ২য় সংস্করণ, ঢাকা: অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৭১।
[4] — পূর্বোক্ত—
[5] আনু মুহাম্মদ, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিমুখ, বাঙ্গালা গবেষণা, প্রথম প্রকাশ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫, পৃষ্ঠা-১৯।
[6] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-২০।
[7] Mohammad Dulal Miah, Yasushi Suzuki: Power, Property Rights, and Economic Development; The Case of Bangladesh, Palgrave Macmillan, Singapore, 2018, p.-93.
[8] — Ibid— p.-92.
[9] — Ibid—
[10] Syed Serajul Islam, Bangladesh in 1986: Entering a New Phase, Asian Survey, Vol. 27, No. 2, A Survey of Asia in 1986: Part II (Feb., 1987), pp. 163-172, University of California Press Stable URL: http://www.jstor.org/stable/2644611.
[11] Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries in Bangladesh; Political and Administrative Perspectives, For the degree of PhD, University of Tasmania, December, 1980, p.-232-233.
[12]বদরুদ্দীন উমর: https://samakal.com/editorial-subeditorial/article/2210137685/সাম্প্রদায়িকতার-ঐতিহাসিক-বিবর্তন সাম্প্রদায়িকতার ঐতিহাসিক বিবর্তন, ২২ অক্টোবর ২০২২ ।
[13]Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries in Bangladesh; Political and Administrative Perspectives, For the degree of PhD, University of Tasmania, December, 1980, p.-138-140.
[14] — Ibid— p.-141.
[15] — Ibid— p.-142-143.
[16] — Ibid— p.-145.
[17] — Ibid—
[18] — Ibid— p.-108.
[19]আবু সালেক কর্তৃক সংগৃহীত ও সম্পাদিত, মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক হক–কথা সমগ্র, ঘাস ফুল নদী, তৃতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি, ২০০৬, ঢাকা, পৃষ্ঠা-১৫।
[20] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-১৯।
[21] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-৯৫।
[22] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-৯৭।
[23] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-১০৭।
[24] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-১১৫।
[25] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-১৯৯।
[26] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-২০১।
[27] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-২৫৯।
[28] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-২৬১।
[29] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-২৬৯।
[30] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-৩০৫, ৩০৬।
[31] — পূর্বোক্ত— পৃষ্ঠা-৩০৬।
[32]Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath, University Press Limited, Dhaka, Second edition, 1988, p.-160, 192.
[33]অনুপম সেন, বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও সমাজ; সামাজিক অর্থনীতির স্বরূপ, ২য় সংস্করণ, ঢাকা: অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-৭২।
[34]Muhammad Fazlul Hassan Yusuf, Nationalisation of Industries in Bangladesh; Political and Administrative Perspectives, For the degree of PhD, University of Tasmania, December, 1980, p.-114.
[35]— Ibid— p.-115.
[36]Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath, University Press Limited, Dhaka, Second edition, 1988, p.-161, 192.
[37]— Ibid— p.-162.
[38]— Ibid— p.-167.
[39]Rehman Sobhan, Untranquil Recollections; Nation Building in Post-Liberation Bangladesh, Sage, Select Publications, 2021, p.-114.
[40]— Ibid— p.-159-160.
[41]— Ibid—
[42]— Ibid— p.-161.
[43]Badruddin Umar, Politics and society in East Pakistan and Bangladesh, Mowla Bros. 1974, p.-292.
[44] — Ibid—
[45]Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh Revolution and Its Aftermath, University Press Limited, Dhaka, Second edition, 1988, p.-162.
[46] এ প্রসঙ্গে তালুকদার মনিরুজ্জামানের ব্যাখ্যা হলো: ‘The creation of a parasitic affluent class, divorced from production and squandering easy money spicuous consumption, only aggravated the economic problems while the political damage to the regime was irreparable. With the people’s swollen aspirations and the very unfavourable resource/population ratio, government patronage satisfied onty a few but alienated many.’ — Ibid— p.-160.