সম্পাদকীয় ভূমিকা

অনলাইন করোনা বিশেষ সংখ্যা (মে-জুলাই ২০২০)

সম্পাদকীয় ভূমিকা

গত বছরের ডিসেম্বরে মানুষের অজানা করোনা ভাইরাস ‘কোভিড-১৯’ চীনে সংক্রমণ শুরু করে। তা বিশ্বব্যাপী ছড়াতে শুরু করে এই বছরের জানুয়ারি মাস থেকে, এই মাসেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভাইরাস সংক্রমণকে বৈশ্বিক মহামারি বা প্যানডেমিক হিসেবে ঘোষণা দেন। বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মার্চ মাসের ৮ তারিখ। ১৭ মার্চ থেকে ক্রমে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে আমরা সর্বজনকথার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি অনলাইনে। আর এই সংখ্যাও (মে-জুলাই) প্রকাশিত হচ্ছে অনলাইনে, আমাদের নতুন ওয়েবসাইটে। পরিস্থিতি অনুকূল হলে আবার আমরা মুদ্রণে যাবার চেষ্টা করবো। এই সংখ্যার মূল মনোযোগ ‘করোনা মহামারি’।

বস্তুত করোনা পূর্ব রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থানই নির্ধারণ করছে কোন দেশে মানুষ দুর্ভোগে পড়বে আর কোন দেশে মানুষ শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাবে। বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা, সর্বজনের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কখনোই ঠিকভাবে দাঁড়ায়নি, তার ওপর প্রথম থেকেই সরকারের ভূমিকা ছিল খুবই বিশৃঙ্খল, আত্মতুষ্টিতে অন্ধ। মহাসংকটে সরকারের ভূমিকা যথাযথভাবে পালনে সুনির্দিষ্ট করণীয় নির্দেশ করে সমাজের বিভিন্ন অংশের ব্যক্তিবর্গ কয়েক দফায় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। এর প্রথমটি ছিল প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি (২২ মার্চ, ২০২০), দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি ছিল যুক্ত বিবৃতি, দেয়া হয় যথাক্রমে ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল। এছাড়া করোনাকালে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় ১৩ এপ্রিল। ২২ এপ্রিল স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয় সুপারিশমালা প্রস্তুত করা হয় প্রধানত সর্বজনকথার উদ্যোগে এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও মনোযোগী ব্যক্তিদের সহযোগিতায়। নাগরিকদের এসব বক্তব্যের পূর্ণ বিবরণ আমরা এই সংখ্যায় প্রকাশ করছি। এছাড়া গার্মেন্ট মালিক, বিজিএমইএ এবং সরকারের ভূমিকা কীভাবে গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে নিষ্ঠুর তৎপরতা চালিয়েছে তার প্রামাণ্য চিত্র হিসেবে ‘মারণখেলার টাইমলাইন (২১ মার্চ-২৫ এপ্রিল ২০২০)’ এই সংখ্যায় যুক্ত করা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির সকল দিক এখন ব্যাপক বিপদ ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষ এখন কর্মহীন, ক্ষুধার্ত। পণ্য পরিবহনের সংকট কৃষি ও কৃষককে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পোশাক শিল্পের অনিশ্চয়তা এবং সরকারের প্রশ্রয়ে কারখানা মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা পোশাক শ্রমিকদের আর্থিক ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি দুইই বাড়িয়েছে, সেইসাথে সংক্রমণের ভয় বাড়িয়েছে। বেসরকারি খাতের পেশাজীবীরাও বড় অনিশ্চয়তায়। বিশাল জনগোষ্ঠির জন্য খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। এরমধ্যে সরকার কয়েক দফায় কয়েকটি প্রধানত ‘প্রণোদনা প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে। এই সংখ্যায় করোনা বিপদের উৎস, করোনা সংকটে অর্থনীতি, জনজীবনসহ বিভিন্ন খাতওয়ারী বিশ্লেষণ, সরকারি প্যাকেজ পর্যালোচনা এবং সুপারিশমালা নিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হলো। কৃষক, ভাসমান মানুষ, শ্রমিক ও প্রান্তিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে আরও কয়েকটি লেখায়।

বিশ্বের সবচাইতে পরাক্রমশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র করোনা ভাইরাসে সবচাইতে বিপর্যস্ত, আক্রান্ত সংখ্যা এবং মৃত্যু সংখ্যা দুটোতেই এই দেশ সবার শীর্ষে। এই দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা যে কতটা ভঙ্গুর তা এবারে আরও স্পষ্ট হয়েছে। আর কয়মাস পরেই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এর মধ্যে গুণগত পরিবর্তন যেমন সবার জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কর্পোরেট চক্র কীভাবে কাজ করছে তার বিশ্লেষণ করা হয়েছে একটি প্রবন্ধে।

আরেকটি প্রবন্ধে ভারতে নাগরিকত্ব আইন, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী প্রচারণা এবং করোনাকালীন পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভারতে প্রাণ প্রকৃতি ও মানুষ বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদী শাসনের নানা আয়োজন আমরা প্রত্যক্ষ করছি গত বেশ কিছুদিন থেকে। বৃহৎ পুঁজি-হিন্দুত্ববাদ-সাম্রাজ্যবাদের ঐক্যবন্ধন একদিকে মানুষে মানুষে হিংসা বিদ্বেষ অন্যদিকে নাগরিকদের চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে।

বিশ্ব এখন এক প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যাকে বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। করোনাকালে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এতে অধিকতর কর্তৃত্ববাদী শাসন, বেকারত্বসহ নানা উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। এই সংখ্যায় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বিভিন্ন দিক এবং করোনাসংকট কালে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের ধরন পর্যালোচনা করে দুটো প্রবন্ধ প্রকাশ করা হলো।

এছাড়া ধারাবাহিক লেখা ‘অ্যাঞ্জেলা ডেভিসের সাথে কথোপকথন-৩’, ‘নারী-পুরুষের মানস : পুরুষতান্ত্রিক ধারণা ও বৈষম্যের জৈবসামাজিক ভিত্তি-২’, এবং নিয়মিত বিভাগ ‘চলচ্চিত্র পর্যালোচনা’ ও ‘মতামত’ প্রকাশ করা হলো। স্মরণ বিভাগে এবারে থাকছে ফিডেল ক্যাস্ট্রো এবং সুরাইয়া ইয়াসমিন এর কথা। আরও থাকছে কয়েক মাসের খবর।

আমরা খেয়াল করলে দেখবো- করোনা ভাইরাস হঠাৎ করে আসেনি, এর ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে মুনাফা উন্মাদনাভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার আগ্রাসী তৎপরতায়। যে বিশ্বব্যবস্থা আর যে উন্নয়ন উন্মাদনা অস্থির করে রেখেছে বিশ্বকে তারই একটা বড় ধাক্কা এই মহামারি। এ পর্যন্ত দুই লক্ষাধিক মানুষ এই ভাইরাসে নিহত হয়েছেন। পুরো মানুষের দুনিয়া এখনও প্রায় থেমে আছে। এই থামাটা যেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। বিশ্বের সাগর মহাসাগর বায়ুমন্ডল নদী পাহাড় বাস্তুসংস্থান সব মুনাফার তান্ডবে এখন ক্ষতবিক্ষত। কিছু লোকের অতিভোগে, লোভে আর হিংস্রতায় বিশ্ব কাতর। সামরিকীকরণ আর প্লাস্টিকের জৌলুস মানুষকে ঢেকে দিচ্ছে। শ্বাস নেবার বাতাস আর পানের পানিও ঢেকে যাচ্ছে মারণাস্ত্র আর বিষে। মুনাফার পেছনে উন্মাদ হয়ে দুনিয়া যেভাবে ছুটছিল তাকে কেউ থামাতে পারেনি, এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাস থামিয়েছে। কঠিন নির্মম থামা। বিশ্ব যে অখণ্ড সেটাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে এই বিপদ ভাইরাস। কিন্তু উন্মাদ ছোটাতে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিপদে থাকে, থামাতেও তারাই বেশি দুর্যোগে। এই থামা যদি দুনিয়ার গতিমুখ পরিবর্তন করতে না পারে এরপর আরও বড় বিপদ থেকে মানুষের উদ্ধার নাই।

আনু মুহাম্মদ
২৯ এপ্রিল ২০২০

Social Share
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *